সন্তোষ গুপ্ত : সৎ সাংবাদিকতার অনন্য পথিকৃৎ by আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
সন্তোষ গুপ্ত-সৎ সাংবাদিকতায় সমর্পিত এক ব্যক্তি-নামের আড়ালে বাংলাদেশে সাংবাদিকতাক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তাই তাঁর কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন পড়ে না। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে প্রয়াত সন্তোষ গুপ্তের অসাধারণ ও অনবদ্য অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে অনাদিকাল।
সন্তোষদাকে কাছ থেকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, বহু সভা-সমাবেশে একসঙ্গে বসার সুযোগ হয়েছিল আমার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বহু পরীক্ষা কমিটিতে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। এভাবেই এই অসাধারণ মানুষটির একান্ত জীবনের কিছু অন্তরঙ্গ পরিচয় আমরা পেয়েছি। সত্যের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল তাঁর পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের কর্মকাণ্ড। সাংবাদিকতা পেশায় সততার সর্বতোমুখী স্বাক্ষর সন্তোষ গুপ্ত স্বয়ং। মা-বাবার একমাত্র সন্তান সন্তোষ গুপ্ত ১৯২৫ সালের ৯ জানুয়ারি ঝালকাঠিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭৯ বছর সাত মাস বয়সে ২০০৪ সালের ৬ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। প্রবীণ সাংবাদিক ওবায়েদ উল হকের ভাষায়, 'তাঁর মৃত্যু নেই। তাঁকে বরণ করে মৃত্যুও ধন্য।' সন্তোষ গুপ্তের জীবনাচরণ সৎ মানুষের পরম প্রত্যয়ের প্রতিচ্ছবি। সারল্যের আভিজাত্য প্রকাশ পেত তাঁর কথায়, তাঁর লেখায়, তাঁর চলাফেরায়, তাঁর আচার-আচরণে, তাঁর রুচিবোধে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আতিকুজ্জামান খানের উদ্ধৃতি দিয়ে সন্তোষদা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'একজন ডাক্তার ভুল করলে একজন রোগী মারা যায়। এতে একটি পরিবারের লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শোকাহত হয়। কিন্তু একজন সাংবাদিক যদি ভুল করে (তা স্বেচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক), তাহলে তা একটি জাতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে।' একই সাক্ষাৎকারে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, "'আধুনিকতা' আমরা যেটাকে বলি, সেটার সঙ্গে আমরা মিলিয়ে ফেলি 'সমকালীনতা'কে। আধুনিকতা হলো মানুষকে, মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করা, সম্প্রসারিত করা। সমকালীনতা হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে উন্নতি হয়েছে, তা থেকে আমরা যে সুবিধা পেয়েছি, সেই সুবিধাগুলো গ্রহণ করা। সুবিধা গ্রহণ করেও মানুষকে 'মানুষ' হিসেবে প্রকাশ করতে হবে সাহিত্যে, তার গল্পে, তার সাংবাদিকতায়, তার লেখায়। সেই জিনিসটা যদি না আসে, সেটাকে আধুনিকতা বলি না। কিন্তু আমরা এ দুটোকে মাঝে মাঝে গুলিয়ে ফেলি। কারণ একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তিও তার ঘরে রেডিও-টেলিভিশন রাখেন, আধুনিক ব্যক্তিও রাখেন। কাজেই রেডিও-টেলিভিশন বা আধুনিক প্রযুক্তির অন্যান্য যে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে চলেছি, সেগুলো কিন্তু সমকালীনতা; আধুনিকতা নয়। এটা পার্থক্য করা দরকার। এ বিষয়টি অবশ্য আমরা অনেক সময় পার্থক্য করতে ভুলে যাই-তাড়াহুড়ার মধ্যেই হোক আর খেয়াল না করার জন্যই হোক।"
বহু আলোচনা সভায় তাঁকে দেখেছি, কথা বলতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন, মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করতে ভালোবাসতেন। সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত উপস্থিত থেকে সবার বক্তব্য শুনতেন। নিজে বক্তব্য দিয়ে কখনো সভাস্থল ত্যাগ করতেন না। স্বভাবসুলভ নিচু গলায় তিনি কথা বলতেন এবং সভাগুলোতে সর্বদাই নতুন আঙ্গিকে নবতর বিশ্লেষণে বক্তব্য উপস্থাপন করতেন, যা শ্রোতা-দর্শকের অন্তরের অন্তস্তলে পৌঁছে যেত। তিনি বলতেন, আলোচনা সভায় মানুষ আসে নতুন কিছু শুনতে। তিনি এ ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকতেন। পাঠক-শ্রোতার চাহিদার প্রতি তীক্ষ্ন দৃষ্টি তাঁর সার্বিক সততার এক অনন্য নজির। সন্তোষ গুপ্তের কলামগুলো পাঠ করলে বোঝা যায় সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও ইতিহাস কত নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। মনে হয়, সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও ইতিহাস যেন একই বিষয়। সাংবাদিকতাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে 'Literature in hurry' বা 'History on the wing' যে কারণে বলা হয়, তার টেঙ্ট বই উদাহরণ পাওয়া যাবে সন্তোষ গুপ্ত রচিত প্রবন্ধ ও কলামে।
দেশের সমসাময়িক ঘটনাবলিসংক্রান্ত তাঁর কলামগুলো পড়ার সময় প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক জেমস রেস্টনের একটি উক্তি প্রায়ই আমার মনে পড়ে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে রেস্টন বলেছিলেন, 'If it is far away it is news, but if it is close at home, it is sociology।' সন্তোষ গুপ্তের কলামে আমরা বারবার সমাজকেই পেয়েছি, সমাজমুক্তির প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের সূত্র পেয়েছি। তাঁর কলামে বিশদভাবে সমাজচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। সন্তোষ গুপ্ত বিশ্বাস করতেন, The truth shall make us free। সমসাময়িক তথ্যের নির্ভুল উপস্থাপনা, ইতিহাসের নিরিখে তাঁর নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং নীতি-নৈতিকতার কষ্টিপাথরে তাঁর নিখুঁত যাচাই-বাছাই যেভাবে অনিরুদ্ধ করে গেছেন জীবনভর, তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক পরম সম্পদ। কলাম লেখায় বিবর্তন এনে তিনি বাংলাদেশের পাঠকসমাজের কাছে কলামকে জনপ্রিয় আইটেমে রূপান্তর করেছেন। তাঁর multi-topical column পড়ার জন্য প্রতি শুক্রবার পাঠকদের অধীর আগ্রহ এবং পাঠ-পরবর্তী পাঠকদের আলোচনা আমি লক্ষ করেছি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু স্থানে। গভীর চিন্তা এবং জটিল বিশ্লেষণ অতি সহজ ভাষায় প্রকাশের বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক-সাহিত্যিক সন্তোষ গুপ্ত।
পাঠকদের প্রতি সুবিচারের জন্য সাংবাদিকতায় কঠিন বিষয় সহজভাবে প্রকাশের জন্য সর্বদাই গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সহজ করে কিছু বলা বা লেখা আসলেই কঠিন। এটা আরো কঠিন গভীর চিন্তাপ্রসূত বক্তব্য উপস্থাপনের সময়। কিন্তু এই কঠিন কাজটিই অতি সহজে দিনের পর দিন করে গেছেন সন্তোষদা, অত্যন্ত নিপুণভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে। সন্তোষ গুপ্ত তাঁর কলাম ও প্রবন্ধ-নিবন্ধে নিজস্ব নিয়ম ও চিন্তাচেতনায় বহু প্রসঙ্গের যুগপৎ অবতারণা করেছেন, যা সাম্প্রতিক ও সুদূর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যসমৃদ্ধ ও যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি সমস্যাগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এবং দূরদর্শী সন্তোষদা পাঠকসমাজকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর অনিরুদ্ধের প্রতিটি কলামে বাঙালির আত্মমর্যাদা ও দেশমর্যাদার ভাবনাকে যেভাবে পরিশীলিত উপস্থাপন করা হয়েছে, তা আমাদের এক অমূল্য স্বর্ণখনি। এগুলো সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। সন্তোষদার মৃত্যুর পর তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাংবাদিক হাবিবুর রহমান মিলন লিখেছেন, 'সব দিক থেকে সন্তোষদা ছিলেন একজন বড়মাপের মানুষ। নিজের ঢাক নিজে পেটানোর মানসিকতা তাঁর ছিল না। তিনি ছিলেন নিভৃতচারী এক জ্ঞানসাধক। পড়া ও লেখা_এই দুই-ই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। যা বিশ্বাস করতেন, তা লেখার মতো সৎ সাহস তাঁর ছিল। কারো চোখরাঙানি বা চাওয়া-পাওয়া তাঁর বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারেনি। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। তবে তা দৈহিক অর্থে। মানুষকে ভালোবেসে, মানুষের ভালোবাসা নিয়ে যাঁর মৃত্যু, তিনি বেঁচে থাকেন তাঁর কর্ম ও কীর্তির মধ্যে।'
দৈনিক সংবাদের সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমান লিখেছেন, 'জীবিকা কখনোই তাঁর জীবনবোধকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন তাঁর নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু অর্থবিত্তের প্রতি তাঁর কোনো লোভ নেই। তাঁর চেয়ে ছোট মানের সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকে বাড়ি-গাড়ি করে ফেলেছেন-এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। কিন্তু সন্তোষদা সেদিকে যাননি। সংসারে থেকে, পারিবারিক জীবন যাপন করেও যেন তিনি সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী।...১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় সরকারি কর্মচারীদের অপশন দেওয়া হয়-যাঁর ইচ্ছা ভারতে থেকে যেতে পারেন, আর যাঁর ইচ্ছা পাকিস্তানে চাকরি নিয়ে যেতে পারেন। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখান থেকে দলে দলে অপশন দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। কিন্তু কী আশ্চর্য, সন্তোষ গুপ্ত কলকাতা থেকে অপশন দিয়ে চলে এলেন ঢাকায়! জেল খেটেছেন, জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন, কিন্তু মাতৃভূমি ছেড়ে যাননি। এই যে অনমনীয় দৃঢ়তা, এই যে দুর্বোধ্য জেদ, এরই নাম বোধ হয় সন্তোষ গুপ্ত।'
এ প্রসঙ্গে সন্তোষদার নিজের বক্তব্য এরূপ, 'দেশ ভাগ হওয়ার সময় আমি কাজ করতাম কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে, আইজি অব প্রিজনস অফিসে। দেশভাগের সময় অপশন দিলাম পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করার জন্য। আমার আত্মীয়স্বজন খুব রাগারাগি করলেন আমাকে এ জন্য। কিন্তু আমি বলেছিলাম, পাকিস্তান আমার জন্মভূমি। কেন আমি সেখানে যেতে পারব না। এরপর ঢাকায় এসে সরকারি চাকরি করতে থাকি। এ জন্য কখনো কোনো অসুবিধা হয়নি।' সততার সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পেঁৗছলেই একজন মানুষের পক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়। জন্মভূমির প্রতি সততা ও নিষ্ঠাই তাঁর প্রতিটি লেখাকে দেশপ্রেমে সমুজ্জ্বল রেখেছে।
সততা, প্রতিভা, সময়, শ্রম, অভিজ্ঞতা ও মেধা তিনি নিঃস্বার্থভাবে বিনিয়োগ করে গেছেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতায়। সাংবাদিকতাকে তিনি জীবন হিসেবে দেখেছিলেন; জীবিকা হিসেবে নয়। সারা জীবন শিশুসুলভ কৌতূহলী প্রবৃত্তি লালনের ফলে সন্তোষদা কখনো উৎসাহ-উদ্দীপনা হারাননি। সন্তোষদার জীবনের মূল উপজীব্য ছিল চিন্তা ও কর্মের সততা। মানুষের সব সদ্গুণের মাঝে সততাই সর্বোৎকৃষ্ট গুণ। সাংবাদিকতায় প্রবেশকালে তিনি সততাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এবং সারা জীবন সাংবাদিকতায় সততা সনি্নবিষ্ট করেছেন, সৎ সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সাংবাদিকতার মাধ্যমে সততার বিস্তৃতি ঘটানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন অবিরাম। 'সন্তোষদার জীবনসঙ্গী ছিল সততা'_কথাটি বললে কোনোভাবেই অত্যুক্তি হবে না, বরং সেটাই হবে সঠিক উক্তি। এ মুহূর্তে সন্তোষদার যে মুখাবয়ব আমার চোখে ভেসে উঠছে, তাতেও আমি সততারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিখাদ সৎ মানুষ সন্তোষদা তাঁর পুরো সাংবাদিকতাজীবনে সৎ সাংবাদিকতার ধারা অনির্বাণ রেখেছেন। সর্ব অর্থেই তিনি ছিলেন সৎ সাংবাদিকতার ভ্যানগার্ড বা পথপ্রদর্শক। সৎ সাংবাদিকতার সমুচ্চ শিখরে যাঁর অবস্থান, সেই সন্তোষদার আদর্শ, দর্শন, চিন্তাচেতনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাংবাদিকদের সততার চর্চায় উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করবে_এটা আমার স্থির বিশ্বাস।
সন্তোষ গুপ্তের মতো মানুষকে নিয়ে আলোচনা সভা করা যায়, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-ওয়ার্কশপ করা যায়, কিন্তু স্মরণসভা বা শোকসভা করা যায় না। কারণ সন্তোষ গুপ্তের মতো মানুষেরা নিজ কর্মের মাধ্যমে সর্বদাই জীবিত। সন্তোষ গুপ্তের স্মৃতি ও জীবনাদর্শ আমাদের পথনির্দেশনা।
লেখক : উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আতিকুজ্জামান খানের উদ্ধৃতি দিয়ে সন্তোষদা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'একজন ডাক্তার ভুল করলে একজন রোগী মারা যায়। এতে একটি পরিবারের লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শোকাহত হয়। কিন্তু একজন সাংবাদিক যদি ভুল করে (তা স্বেচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক), তাহলে তা একটি জাতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে।' একই সাক্ষাৎকারে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, "'আধুনিকতা' আমরা যেটাকে বলি, সেটার সঙ্গে আমরা মিলিয়ে ফেলি 'সমকালীনতা'কে। আধুনিকতা হলো মানুষকে, মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করা, সম্প্রসারিত করা। সমকালীনতা হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে উন্নতি হয়েছে, তা থেকে আমরা যে সুবিধা পেয়েছি, সেই সুবিধাগুলো গ্রহণ করা। সুবিধা গ্রহণ করেও মানুষকে 'মানুষ' হিসেবে প্রকাশ করতে হবে সাহিত্যে, তার গল্পে, তার সাংবাদিকতায়, তার লেখায়। সেই জিনিসটা যদি না আসে, সেটাকে আধুনিকতা বলি না। কিন্তু আমরা এ দুটোকে মাঝে মাঝে গুলিয়ে ফেলি। কারণ একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তিও তার ঘরে রেডিও-টেলিভিশন রাখেন, আধুনিক ব্যক্তিও রাখেন। কাজেই রেডিও-টেলিভিশন বা আধুনিক প্রযুক্তির অন্যান্য যে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে চলেছি, সেগুলো কিন্তু সমকালীনতা; আধুনিকতা নয়। এটা পার্থক্য করা দরকার। এ বিষয়টি অবশ্য আমরা অনেক সময় পার্থক্য করতে ভুলে যাই-তাড়াহুড়ার মধ্যেই হোক আর খেয়াল না করার জন্যই হোক।"
বহু আলোচনা সভায় তাঁকে দেখেছি, কথা বলতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন, মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করতে ভালোবাসতেন। সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত উপস্থিত থেকে সবার বক্তব্য শুনতেন। নিজে বক্তব্য দিয়ে কখনো সভাস্থল ত্যাগ করতেন না। স্বভাবসুলভ নিচু গলায় তিনি কথা বলতেন এবং সভাগুলোতে সর্বদাই নতুন আঙ্গিকে নবতর বিশ্লেষণে বক্তব্য উপস্থাপন করতেন, যা শ্রোতা-দর্শকের অন্তরের অন্তস্তলে পৌঁছে যেত। তিনি বলতেন, আলোচনা সভায় মানুষ আসে নতুন কিছু শুনতে। তিনি এ ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকতেন। পাঠক-শ্রোতার চাহিদার প্রতি তীক্ষ্ন দৃষ্টি তাঁর সার্বিক সততার এক অনন্য নজির। সন্তোষ গুপ্তের কলামগুলো পাঠ করলে বোঝা যায় সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও ইতিহাস কত নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। মনে হয়, সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও ইতিহাস যেন একই বিষয়। সাংবাদিকতাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে 'Literature in hurry' বা 'History on the wing' যে কারণে বলা হয়, তার টেঙ্ট বই উদাহরণ পাওয়া যাবে সন্তোষ গুপ্ত রচিত প্রবন্ধ ও কলামে।
দেশের সমসাময়িক ঘটনাবলিসংক্রান্ত তাঁর কলামগুলো পড়ার সময় প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক জেমস রেস্টনের একটি উক্তি প্রায়ই আমার মনে পড়ে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে রেস্টন বলেছিলেন, 'If it is far away it is news, but if it is close at home, it is sociology।' সন্তোষ গুপ্তের কলামে আমরা বারবার সমাজকেই পেয়েছি, সমাজমুক্তির প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের সূত্র পেয়েছি। তাঁর কলামে বিশদভাবে সমাজচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। সন্তোষ গুপ্ত বিশ্বাস করতেন, The truth shall make us free। সমসাময়িক তথ্যের নির্ভুল উপস্থাপনা, ইতিহাসের নিরিখে তাঁর নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং নীতি-নৈতিকতার কষ্টিপাথরে তাঁর নিখুঁত যাচাই-বাছাই যেভাবে অনিরুদ্ধ করে গেছেন জীবনভর, তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক পরম সম্পদ। কলাম লেখায় বিবর্তন এনে তিনি বাংলাদেশের পাঠকসমাজের কাছে কলামকে জনপ্রিয় আইটেমে রূপান্তর করেছেন। তাঁর multi-topical column পড়ার জন্য প্রতি শুক্রবার পাঠকদের অধীর আগ্রহ এবং পাঠ-পরবর্তী পাঠকদের আলোচনা আমি লক্ষ করেছি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু স্থানে। গভীর চিন্তা এবং জটিল বিশ্লেষণ অতি সহজ ভাষায় প্রকাশের বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক-সাহিত্যিক সন্তোষ গুপ্ত।
পাঠকদের প্রতি সুবিচারের জন্য সাংবাদিকতায় কঠিন বিষয় সহজভাবে প্রকাশের জন্য সর্বদাই গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সহজ করে কিছু বলা বা লেখা আসলেই কঠিন। এটা আরো কঠিন গভীর চিন্তাপ্রসূত বক্তব্য উপস্থাপনের সময়। কিন্তু এই কঠিন কাজটিই অতি সহজে দিনের পর দিন করে গেছেন সন্তোষদা, অত্যন্ত নিপুণভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে। সন্তোষ গুপ্ত তাঁর কলাম ও প্রবন্ধ-নিবন্ধে নিজস্ব নিয়ম ও চিন্তাচেতনায় বহু প্রসঙ্গের যুগপৎ অবতারণা করেছেন, যা সাম্প্রতিক ও সুদূর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যসমৃদ্ধ ও যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি সমস্যাগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এবং দূরদর্শী সন্তোষদা পাঠকসমাজকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর অনিরুদ্ধের প্রতিটি কলামে বাঙালির আত্মমর্যাদা ও দেশমর্যাদার ভাবনাকে যেভাবে পরিশীলিত উপস্থাপন করা হয়েছে, তা আমাদের এক অমূল্য স্বর্ণখনি। এগুলো সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। সন্তোষদার মৃত্যুর পর তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাংবাদিক হাবিবুর রহমান মিলন লিখেছেন, 'সব দিক থেকে সন্তোষদা ছিলেন একজন বড়মাপের মানুষ। নিজের ঢাক নিজে পেটানোর মানসিকতা তাঁর ছিল না। তিনি ছিলেন নিভৃতচারী এক জ্ঞানসাধক। পড়া ও লেখা_এই দুই-ই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। যা বিশ্বাস করতেন, তা লেখার মতো সৎ সাহস তাঁর ছিল। কারো চোখরাঙানি বা চাওয়া-পাওয়া তাঁর বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারেনি। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। তবে তা দৈহিক অর্থে। মানুষকে ভালোবেসে, মানুষের ভালোবাসা নিয়ে যাঁর মৃত্যু, তিনি বেঁচে থাকেন তাঁর কর্ম ও কীর্তির মধ্যে।'
দৈনিক সংবাদের সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমান লিখেছেন, 'জীবিকা কখনোই তাঁর জীবনবোধকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন তাঁর নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু অর্থবিত্তের প্রতি তাঁর কোনো লোভ নেই। তাঁর চেয়ে ছোট মানের সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকে বাড়ি-গাড়ি করে ফেলেছেন-এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। কিন্তু সন্তোষদা সেদিকে যাননি। সংসারে থেকে, পারিবারিক জীবন যাপন করেও যেন তিনি সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী।...১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় সরকারি কর্মচারীদের অপশন দেওয়া হয়-যাঁর ইচ্ছা ভারতে থেকে যেতে পারেন, আর যাঁর ইচ্ছা পাকিস্তানে চাকরি নিয়ে যেতে পারেন। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখান থেকে দলে দলে অপশন দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। কিন্তু কী আশ্চর্য, সন্তোষ গুপ্ত কলকাতা থেকে অপশন দিয়ে চলে এলেন ঢাকায়! জেল খেটেছেন, জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন, কিন্তু মাতৃভূমি ছেড়ে যাননি। এই যে অনমনীয় দৃঢ়তা, এই যে দুর্বোধ্য জেদ, এরই নাম বোধ হয় সন্তোষ গুপ্ত।'
এ প্রসঙ্গে সন্তোষদার নিজের বক্তব্য এরূপ, 'দেশ ভাগ হওয়ার সময় আমি কাজ করতাম কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে, আইজি অব প্রিজনস অফিসে। দেশভাগের সময় অপশন দিলাম পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করার জন্য। আমার আত্মীয়স্বজন খুব রাগারাগি করলেন আমাকে এ জন্য। কিন্তু আমি বলেছিলাম, পাকিস্তান আমার জন্মভূমি। কেন আমি সেখানে যেতে পারব না। এরপর ঢাকায় এসে সরকারি চাকরি করতে থাকি। এ জন্য কখনো কোনো অসুবিধা হয়নি।' সততার সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পেঁৗছলেই একজন মানুষের পক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়। জন্মভূমির প্রতি সততা ও নিষ্ঠাই তাঁর প্রতিটি লেখাকে দেশপ্রেমে সমুজ্জ্বল রেখেছে।
সততা, প্রতিভা, সময়, শ্রম, অভিজ্ঞতা ও মেধা তিনি নিঃস্বার্থভাবে বিনিয়োগ করে গেছেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতায়। সাংবাদিকতাকে তিনি জীবন হিসেবে দেখেছিলেন; জীবিকা হিসেবে নয়। সারা জীবন শিশুসুলভ কৌতূহলী প্রবৃত্তি লালনের ফলে সন্তোষদা কখনো উৎসাহ-উদ্দীপনা হারাননি। সন্তোষদার জীবনের মূল উপজীব্য ছিল চিন্তা ও কর্মের সততা। মানুষের সব সদ্গুণের মাঝে সততাই সর্বোৎকৃষ্ট গুণ। সাংবাদিকতায় প্রবেশকালে তিনি সততাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এবং সারা জীবন সাংবাদিকতায় সততা সনি্নবিষ্ট করেছেন, সৎ সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সাংবাদিকতার মাধ্যমে সততার বিস্তৃতি ঘটানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন অবিরাম। 'সন্তোষদার জীবনসঙ্গী ছিল সততা'_কথাটি বললে কোনোভাবেই অত্যুক্তি হবে না, বরং সেটাই হবে সঠিক উক্তি। এ মুহূর্তে সন্তোষদার যে মুখাবয়ব আমার চোখে ভেসে উঠছে, তাতেও আমি সততারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিখাদ সৎ মানুষ সন্তোষদা তাঁর পুরো সাংবাদিকতাজীবনে সৎ সাংবাদিকতার ধারা অনির্বাণ রেখেছেন। সর্ব অর্থেই তিনি ছিলেন সৎ সাংবাদিকতার ভ্যানগার্ড বা পথপ্রদর্শক। সৎ সাংবাদিকতার সমুচ্চ শিখরে যাঁর অবস্থান, সেই সন্তোষদার আদর্শ, দর্শন, চিন্তাচেতনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাংবাদিকদের সততার চর্চায় উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করবে_এটা আমার স্থির বিশ্বাস।
সন্তোষ গুপ্তের মতো মানুষকে নিয়ে আলোচনা সভা করা যায়, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-ওয়ার্কশপ করা যায়, কিন্তু স্মরণসভা বা শোকসভা করা যায় না। কারণ সন্তোষ গুপ্তের মতো মানুষেরা নিজ কর্মের মাধ্যমে সর্বদাই জীবিত। সন্তোষ গুপ্তের স্মৃতি ও জীবনাদর্শ আমাদের পথনির্দেশনা।
লেখক : উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments