বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুদিবসের প্রাক্কালে পেছন ফিরে দেখা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
অনেক আগে তুরস্কের প্রখ্যাত কবি নাজিম হিকমত তাঁর এক কবিতায় বলেছিলেন, 'বিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু হবে মাত্র এক বছর।' দূরদর্শী এ কবির বক্তব্যের সত্যাসত্য অন্তত বাংলাদেশে অহরহই মিলছে। গত এপ্রিলের ২৮ তারিখে হুমায়ুন আজাদের ছিল ৬০তম জন্মদিন। আর আসছে ১১ আগস্ট তাঁর মৃত্যুদিবস।
২০০৪ সালের ওই দিনে তাঁর প্রশ্নবিদ্ধ জীবনাবসান ঘটে প্রবাসে। প্রয়াত সরব ওই ব্যক্তিত্বের নীরব জন্মদিন পালনের বিষয়টি তাঁর মৃত্যুদিবসের প্রাক্কালে নাজিম হিকমতের কবিতাটির কথাই মনে করিয়ে দেয়। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলার প্রধান ফটকের কাছেই হুমায়ুন আজাদ অজ্ঞাত আততায়ীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। বহুমাত্রিক প্রথাবিরোধী লেখক, ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথমে ঢাকার সিএমএইচে এবং পরে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বর্ধিত জীবন নিয়ে দেশে ফিরে এলেও এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দেশত্যাগ করেন। তারপর জার্মানির মিউনিখে তাঁর প্রশ্নবিদ্ধ জীবনাবসান হয়। এসবই সচেতন মহলের জানা। দীর্ঘদিন পর হুমায়ুন আজাদের ওপর আক্রমণকারীদের পরিচয় মেলে তাদের নিজ জবানিতেই। আটক শীর্ষ জঙ্গি, ইতিমধ্যে যাদের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়েছে, তারা স্বীকার করেছিল এর দায়, কিন্তু এর পশ্চাৎ কারণসহ কারা এ ব্যাপারে কলকাঠি নেড়েছিল, তা আজও রহস্যাবৃত। এবং ড. হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হওয়ার মামলাটি চলে গেছে প্রায় হিমাগারে। আজ প্রায় আট বছর পর দেশের প্রেক্ষাপট যখন ভিন্নরূপ ধারণ করেছে, তখন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষ সংগতই প্রত্যাশা করছেন, মহাজোট সরকার এ দিকটায় হাত দিয়ে রহস্য উন্মোচন করবে। হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে তারা সক্রিয় পদক্ষেপ নেবে_এ প্রত্যাশা নিশ্চয়ই অসংগত নয়। হুমায়ুন আজাদ নিহত, কিন্তু বিগত ও বিস্মৃত নন। লেখায় এবং ব্যক্তিগত আলাপে অত্যন্ত স্পষ্টভাষী মানুষ ড. হুমায়ুন আজাদ কোনো দলীয় রাজনীতি করতেন না। তিনি কোনো দলের সদস্য বা নেতাও ছিলেন না। তিনি ছিলেন ধ্যানে-জ্ঞানে, মননে-প্রজ্ঞায় একজন লেখক। তাঁর সাহস ও লেখা মানুষকে আলো দেখাত, স্বপ্ন দেখাত; দেশ, ভাষা ও বাঙালিত্বকে ভালোবাসার কথা বলত। এসব কারণেই ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসীরা তাঁর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কেন ওই হামলা, কারা হামলাকারী_এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে দেশের তখনকার রাজনীতির বিশ্লেষণটা জরুরি। তিনি কোনো দলের সদস্য ছিলেন না, তবে রাজনীতিমুক্তও ছিলেন না। তিনি যে রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করতেন, সে রাজনীতি হলো মুক্তচিন্তার, মুক্তবুদ্ধির এবং অনিবার্যভাবে প্রথাবিরোধী। ২০০৩ সালের বইমেলায় হুমায়ুন আজাদের 'আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম' বইটি প্রকাশ হওয়ার পর চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বইটি প্রত্যেক দেশপ্রেমিক নাগরিককে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করায়। যে কথা বা বক্তব্য ছিল বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে, সে কথাই হুমায়ুন আজাদ তীব্র-তীক্ষ্ন, সাবলীল ও কাব্যধর্মী ভাষায় তুলে ধরেন। এই বইটিকে বলা যায়, ২০০১ সাল-উত্তর বাংলাদেশের একটি প্রামাণ্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলো কিভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে, ধ্বংস করার কাজে কারা জড়িত ছিল_তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আছে এ বইয়ে। তাঁর 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' উপন্যাসের ভাষা তীক্ষ্ন, তির্যক ও আক্রমণাত্মক। ১১২ পৃষ্ঠার নাতিদীর্ঘ আয়তনের এ উপন্যাসটির পটভূমি বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে সংকীর্ণ ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনীতি; যে রাজনীতি যুক্তি মানে না, গণতন্ত্র মানে না, অন্যের মতামতকে স্বীকার করে না, সেই সহিংস ও সন্ত্রাসী রাজনীতি। বিগত সংসদে জামায়াতের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এমপি হুমায়ুন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি পাকিস্তানের মতো এ দেশেও ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদকে মুরতাদ ঘোষণা করার কথাও বলেছিলেন তিনি। তাই স্পষ্ট করে বলা যায়, ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না। যে চক্রটি হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল, তারা তৎপর ছিল বহুদিন থেকে এবং এখনো যে তৎপর নেই, সে কথা বলা যায় না।
ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর কারা হামলা চালিয়েছিল, হামলার আগে কারা তাঁকে টেলিফোনে হত্যার হুমকি দিত, কারা তাঁকে মুরতাদ ঘোষণা করেছিল, সেসব খবর তৎকালীন সরকারের অজানা ছিল না। অতএব হামলাকারীদের খুঁজে বের করার দায়িত্বটা ছিল ওই সরকারেরই। কিন্তু তারা তো তখন তা করেইনি, উল্টো ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিতেই ছিল তৎপর। ড. আজাদের ওপর আক্রমণকারীদের গ্রেপ্তার এবং ওই হত্যাচেষ্টার তদন্তের চেয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অতীতের মতোই 'ব্লেইম গেম'-এ মেতে ওঠেন। ওই ঘটনার পরদিন রাজধানী ঢাকার বাসাবোতে এক জনসভায় তিনি বলেন, 'হরতাল সফল করতে একজন সম্মানিত শিক্ষককে আক্রমণ করা হয়েছে।' অন্যদিকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকার নিশ্চিত হয়েছিল যে ড. আজাদ বেঁচে উঠতে পারেন, ততক্ষণ তারা তাঁর শারীরিক অবস্থা গোপন করতেই তৎপর ছিল। ওই পর্যন্ত সরকার কিছুটা আত্মরক্ষামূলক কৌশল নিলেও যে মুহূর্তে ড. আজাদ একটু সুস্থ হন, অমনি সরকারের চেহারা পাল্টে যায়। এর আগে পর্যন্ত সরকারের চেষ্টা ছিল ওই হত্যাচেষ্টার কারণ লঘু করে দেখানো এবং তাকে রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা। মহাজোট সরকার কি বিষয়গুলো আমলে নেবে?
ড. আজাদের ওপর আক্রমণ সম্পর্কে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের ওই প্রতিক্রিয়ার পেছনে রাজনীতিটা ছিল স্পষ্ট। ওই ঘটনায় জোট সরকার তার প্রতিক্রিয়া সামলাতে যে নগ্ন পদক্ষেপ নিয়েছিল, তাতেই মনে হয়, তারা যেন কী গোপন বা আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। ড. আজাদের ওপর আক্রমণ যে নিছক মাস্তানদের হাইজ্যাকের ঘটনা ছিল না, সেটা কিন্তু তখন পুলিশও বলেছিল। যারা হুমায়ুন আজাদকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছিল, তাও লক্ষ করার বিষয়। জামায়াত এ ব্যাপারে তখন কোনো নিন্দা-প্রতিবাদ জানায়নি। কেবল তাদের উদ্দেশ করে যে কথা বলা হয়েছিল, তার প্রতিবাদ করেছিল মাত্র। ভাব দেখে মনে হয়েছিল, তারা মনে করছে যেন কিছুই ঘটেনি। জামায়াত এসব ব্যাপারে নিরুত্তাপ থাকলেও বিএনপি নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল তাদের রক্ষা করার। জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগকে নিজেদের গায়ে টেনে নিয়ে তারা রক্ষাকর্তার ভূমিকায় নেমেছিল। এর আগে যখন জামায়াত বিএনপির ক্ষমতার শরিক ছিল না, তখনো ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের বিরুদ্ধে তারা এ ধরনের ভূমিকাই নিয়েছিল। গণ-আদালতে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়েছিল। ড. আজাদ যখন আক্রান্ত হন, তখন জামায়াতিরা বিএনপির ক্ষমতার শরিক, মন্ত্রিসভার সদস্য। বিএনপি স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য নাজমুল হুদা তো তখন বলেই ফেলেছিলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে দাঁড়িয়ে জামায়াত কোনো অপরাধ করেনি। এটা জামায়াতের আত্মপক্ষ সমর্থনে যে কথা বলা হয়, তারই প্রতিধ্বনি। ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' বইয়ে এ উভয় ব্যাপারেই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তিনি ওই বইয়ে দেখিয়েছেন, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর 'শান্তির আগুনে' কিভাবে সংখ্যালঘু জনপদ ধ্বংস হয়ে যায়, তার চেহারা পাল্টে যায়, তার নারীরা কী নির্মমভাবে ধর্ষিত হয়। একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে হুমায়ুন আজাদকে বেছে নিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ এবং সে ব্যাপারে সরকারের আচরণ ওই রাজনীতির বাইরে কিছু নয়। পরিকল্পিত নিপুণতায় তারা হুমায়ুন আজাদকে আক্রমণ করেছিল। আবার তাঁকে হত্যাচেষ্টা সম্পর্কে এক ধরনের কুহেলিকাও সৃষ্টি করেছিল। শারীরিকভাবে হুমায়ুন আজাদকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে বটে, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে মুছে দেওয়া যায়নি, যাবেও না। তিনি আমাদের কাছে কখনোই বিগত হবেন না। তাঁর মৃত্যুদিবসের প্রাক্কালে এ কথা স্মরণে আনা জরুরি।
বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, নীতিনির্ধারক মহলের অনেকেরই ড. হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হওয়ার পূর্বাপর সব ঘটনা বিশেষভাবে জানা থাকার কথা। বর্ণিত ঘটনাবলির বাইরেও আরো অনেক ঘটনা বা বিষয় আছে, যার ওপর ভিত্তি করে সভ্যতা, মানবতাবিরোধী ওই বর্বরোচিত ঘটনার উৎস সন্ধান করা যায় সহজেই। বর্তমান বাংলাদেশ তো বটেই, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্যও তা প্রয়োজন। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, ধর্মান্ধদের শিকড় উৎপাটনসহ নেতিবাচক সব কিছুর যদি অবসান ঘটাতে হয়, তবে এসব বিষয় উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। আমাদের প্রত্যাশা, মহাজোট সরকার বিষয়টি আমলে নেবে সার্বিক প্রয়োজন ও স্বার্থেই। মনে রাখা প্রয়োজন, হুমায়ুন আজাদ এক চলমান সত্তার নাম। তিনি জীবন্ত, যার ফলে তাঁকে মৃত ও বিস্মৃতদের কাতারে রাখা যায় না। তাঁকে স্মরণে রাখতে হবে আমাদেরই প্রয়োজনে। তাঁকে চিনতে হলে স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক কাল চিনতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর কারা হামলা চালিয়েছিল, হামলার আগে কারা তাঁকে টেলিফোনে হত্যার হুমকি দিত, কারা তাঁকে মুরতাদ ঘোষণা করেছিল, সেসব খবর তৎকালীন সরকারের অজানা ছিল না। অতএব হামলাকারীদের খুঁজে বের করার দায়িত্বটা ছিল ওই সরকারেরই। কিন্তু তারা তো তখন তা করেইনি, উল্টো ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিতেই ছিল তৎপর। ড. আজাদের ওপর আক্রমণকারীদের গ্রেপ্তার এবং ওই হত্যাচেষ্টার তদন্তের চেয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অতীতের মতোই 'ব্লেইম গেম'-এ মেতে ওঠেন। ওই ঘটনার পরদিন রাজধানী ঢাকার বাসাবোতে এক জনসভায় তিনি বলেন, 'হরতাল সফল করতে একজন সম্মানিত শিক্ষককে আক্রমণ করা হয়েছে।' অন্যদিকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকার নিশ্চিত হয়েছিল যে ড. আজাদ বেঁচে উঠতে পারেন, ততক্ষণ তারা তাঁর শারীরিক অবস্থা গোপন করতেই তৎপর ছিল। ওই পর্যন্ত সরকার কিছুটা আত্মরক্ষামূলক কৌশল নিলেও যে মুহূর্তে ড. আজাদ একটু সুস্থ হন, অমনি সরকারের চেহারা পাল্টে যায়। এর আগে পর্যন্ত সরকারের চেষ্টা ছিল ওই হত্যাচেষ্টার কারণ লঘু করে দেখানো এবং তাকে রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা। মহাজোট সরকার কি বিষয়গুলো আমলে নেবে?
ড. আজাদের ওপর আক্রমণ সম্পর্কে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের ওই প্রতিক্রিয়ার পেছনে রাজনীতিটা ছিল স্পষ্ট। ওই ঘটনায় জোট সরকার তার প্রতিক্রিয়া সামলাতে যে নগ্ন পদক্ষেপ নিয়েছিল, তাতেই মনে হয়, তারা যেন কী গোপন বা আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। ড. আজাদের ওপর আক্রমণ যে নিছক মাস্তানদের হাইজ্যাকের ঘটনা ছিল না, সেটা কিন্তু তখন পুলিশও বলেছিল। যারা হুমায়ুন আজাদকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছিল, তাও লক্ষ করার বিষয়। জামায়াত এ ব্যাপারে তখন কোনো নিন্দা-প্রতিবাদ জানায়নি। কেবল তাদের উদ্দেশ করে যে কথা বলা হয়েছিল, তার প্রতিবাদ করেছিল মাত্র। ভাব দেখে মনে হয়েছিল, তারা মনে করছে যেন কিছুই ঘটেনি। জামায়াত এসব ব্যাপারে নিরুত্তাপ থাকলেও বিএনপি নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল তাদের রক্ষা করার। জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগকে নিজেদের গায়ে টেনে নিয়ে তারা রক্ষাকর্তার ভূমিকায় নেমেছিল। এর আগে যখন জামায়াত বিএনপির ক্ষমতার শরিক ছিল না, তখনো ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের বিরুদ্ধে তারা এ ধরনের ভূমিকাই নিয়েছিল। গণ-আদালতে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়েছিল। ড. আজাদ যখন আক্রান্ত হন, তখন জামায়াতিরা বিএনপির ক্ষমতার শরিক, মন্ত্রিসভার সদস্য। বিএনপি স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য নাজমুল হুদা তো তখন বলেই ফেলেছিলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে দাঁড়িয়ে জামায়াত কোনো অপরাধ করেনি। এটা জামায়াতের আত্মপক্ষ সমর্থনে যে কথা বলা হয়, তারই প্রতিধ্বনি। ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' বইয়ে এ উভয় ব্যাপারেই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তিনি ওই বইয়ে দেখিয়েছেন, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর 'শান্তির আগুনে' কিভাবে সংখ্যালঘু জনপদ ধ্বংস হয়ে যায়, তার চেহারা পাল্টে যায়, তার নারীরা কী নির্মমভাবে ধর্ষিত হয়। একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে হুমায়ুন আজাদকে বেছে নিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ এবং সে ব্যাপারে সরকারের আচরণ ওই রাজনীতির বাইরে কিছু নয়। পরিকল্পিত নিপুণতায় তারা হুমায়ুন আজাদকে আক্রমণ করেছিল। আবার তাঁকে হত্যাচেষ্টা সম্পর্কে এক ধরনের কুহেলিকাও সৃষ্টি করেছিল। শারীরিকভাবে হুমায়ুন আজাদকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে বটে, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে মুছে দেওয়া যায়নি, যাবেও না। তিনি আমাদের কাছে কখনোই বিগত হবেন না। তাঁর মৃত্যুদিবসের প্রাক্কালে এ কথা স্মরণে আনা জরুরি।
বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, নীতিনির্ধারক মহলের অনেকেরই ড. হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হওয়ার পূর্বাপর সব ঘটনা বিশেষভাবে জানা থাকার কথা। বর্ণিত ঘটনাবলির বাইরেও আরো অনেক ঘটনা বা বিষয় আছে, যার ওপর ভিত্তি করে সভ্যতা, মানবতাবিরোধী ওই বর্বরোচিত ঘটনার উৎস সন্ধান করা যায় সহজেই। বর্তমান বাংলাদেশ তো বটেই, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্যও তা প্রয়োজন। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, ধর্মান্ধদের শিকড় উৎপাটনসহ নেতিবাচক সব কিছুর যদি অবসান ঘটাতে হয়, তবে এসব বিষয় উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। আমাদের প্রত্যাশা, মহাজোট সরকার বিষয়টি আমলে নেবে সার্বিক প্রয়োজন ও স্বার্থেই। মনে রাখা প্রয়োজন, হুমায়ুন আজাদ এক চলমান সত্তার নাম। তিনি জীবন্ত, যার ফলে তাঁকে মৃত ও বিস্মৃতদের কাতারে রাখা যায় না। তাঁকে স্মরণে রাখতে হবে আমাদেরই প্রয়োজনে। তাঁকে চিনতে হলে স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক কাল চিনতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments