বাংলাদেশের ৪০ বছর-অতীতের ভাবনা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

গত শতকে মুসলিম মধ্যবিত্তের উত্থান ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ তারা উপমহাদেশের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অংশো মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে নতুন কয়েকটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি পাস করে। তা সত্ত্বেও এক দশকের কম সময়ে তারা একক পাকিস্তান পায়। ১৯৪৮ সালে পূর্ববাংলার তরুণ ছাত্ররা বাংলাকে দুটি রাষ্ট্রভাষার অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানায়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে তাদের সেই দাবি স্বীকৃত হয়।


১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ছয় দফা ঘোষণার মাধ্যমে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করা হয়। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতাসংগ্রামের ডাক দেন, ডাক দেন মুক্তিসংগ্রামের। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যামূলক আক্রমণ শুরু করে। ১০ মাসেরও কম সময়ে বাংলাদেশ ভারতের সামরিক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কূটনৈতিক সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জন করে।
আমাদের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এক লাফে পূর্ণ স্বাধীনতাসংগ্রামে উন্নীত হলে পরে আমরা দেখলাম, আমাদের চিন্তাভাবনা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য অনুপযুক্ত। অনভিজ্ঞতা, বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তির অভাবসহ নানাবিধ অসুবিধার মধ্যে আমাদের শুরু করতে হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও নিখরচা করা ছিল প্রথম পদক্ষেপ।
এখনো আমাদের শাসন পরিচালনা ভালো নয়। তত্ত্বাবধান এবং সময়োচিত হস্তক্ষেপ না থাকায় সরকারি খাসজমি, এজমালি সম্পত্তি, রেলের জমি, নদীর পাড় এবং নদীগুলোর অংশবিশেষ পেশিশক্তি ও প্রভাবশালীদের দ্বারা দখল হয়ে গেছে।
১৯৭২ সালে একটি আদর্শ সংবিধান নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম। কিন্তু শিগগিরই সংবিধান সংশোধিত হলো। প্রতিটি সামরিক শাসনে সামরিক শাসকদের যাবতীয় অনিয়মকে ঢাকা দিতে সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। একেকজন ব্যক্তির বিশেষাধিকারের জন্য তিনবার সংবিধানে বদল আনা হয়েছে; ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৮১ সালে আবদুস সাত্তার এবং ১৯৯১ সালে সাহাবুদ্দীন আহমদের জন্য।
সুপ্রিম কোর্ট সামরিক শাসনের সময়ের সংশোধনীগুলো বাতিল করেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনী এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এটি সংবিধানের প্রস্তাবনায় একসঙ্গে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম এবং পালাক্রমে শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ও ইসলামকে একসঙ্গে রেখেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল হয়েছে।
শেখ মুজিবকে হত্যার পর রাজনীতি ও শাসনকার্যে নির্ধারক শক্তি হিসেবে সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। রাজনীতির আকর্ষণ চলে গেছে এবং এটা এক ব্যবহারিক কাজে পরিণত হয়েছে। গত ৪০ বছরে রাজনীতি সামান্যই এগিয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা তলাহীন ঝুড়ি থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রান্তসীমায় ঠাঁই পেয়েছি। এখন আমাদের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি সঞ্চালনের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখানো হয়। তাহলেও বর্তমানের দুই অঙ্কের মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়া উদ্বেগের ব্যাপার।
১৯৯০-এ পুনর্জাগ্রত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনীতি জনগণের সেবার হাতিয়ার না হয়ে ক্রমশ বিনিয়োগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সাংসদদের ৬৪ শতাংশই ব্যবসায়ী, আইনজীবী মাত্র ১৬ শতাংশ। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকও সম্প্রতি বলেছেন, পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র দেশ, যেখানে প্রধান দুটি দলের কাছ থেকে মনোনয়ন কেনা যায়। ট্রেড ইউনিয়নসহ সরকারি কর্মচারীদের প্রতিটি সংস্থাই চরমভাবে রাজনীতিকৃত হয়েছে।
মন্ত্রীরা, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো লাগাতারভাবে বিলখেলাপি। ঋণখেলাপিরা ব্যাপক ছাড় পেয়ে আসছে। সরকারি সেবাগুলোকে দলীয় লোক দিয়ে ভরিয়ে বিপর্যস্ত করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করে তাঁদের জায়গায় বাইরে থেকে বিশ্বস্ত লোক এনে, অথবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। উপদেষ্টাদের দেওয়া হচ্ছে মন্ত্রীর পদমর্যাদা, তাঁদেরই এখন সুসময়।
ভাষাশহীদদের অবদানে একুশে ফেব্রুয়ারি বৈশ্বিক মাতৃভাষা দিবস হলেও আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষার বিকাশে ব্যবস্থা নিইনি, যেমনটা নিয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক।
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শাসনকার্যের সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের প্রতিষ্ঠান বানাতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ ব্যাপকভাবে নির্ভর করছে মানবসম্পদের ওপর। ব্যাপকভিত্তিক শিক্ষা হচ্ছে তার জরুরি পূর্বশর্ত। ২০২১ সালের মধ্যে ‘মধ্য আয়ের দেশ’ হওয়ার স্বপ্নপূরণে এটা গুরুত্বপূর্ণ।
এক হিসাবে, আমাদের বেকারদের সংখ্যা বিশ্বের ১৪৩টি দেশের জনসংখ্যার সমান। বেকারত্ব আরও বাড়লে, শিক্ষা-প্রক্রিয়া থেকে ঝরে পড়ার হার বাড়লে, উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান অর্জনে ব্যর্থ হলে, জন্মহার সামলাতে না পারলে, বাড়তে থাকা বৈষম্যকে না ঠেকালে, লাগাতারভাবে রাস্তায় ঘেরাও আর সংসদ বর্জনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের অধঃপতন বন্ধ করতে না পারলে দিনদুপুরে আমাদের ওপর অন্ধকার নেমে আসবে।
খুব কঠিন এক দেশ আমাদের। আমরা দুজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছি, জেলের ভেতরে বিনাশ করেছি মুক্তিযুদ্ধের চার জাতীয় নেতাকে। একটি ছাড়া আমাদের সব জেলায় সিরিজ বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে এবং দুজন বিচারক আদালতের মধ্যে নিহত হয়েছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রীসহ বেশ কজন বড় রাজনৈতিক নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও সম্পন্ন হয়নি।
খুব কঠিন এক দেশ আমাদের। পরপর পাঁচবার এ দেশ সর্বোচ্চ দুর্নীতির শিরোপা পেয়েছে। দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরিবেশই সবচেয়ে সহিংস। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয়তম বিপজ্জনক। তবু বাংলাদেশ এখনো ব্যর্থ রাষ্ট্র নয়। আমি চাই, সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের ঘোষণা অনুসারে বাংলাদেশ একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হোক এবং জনগণের চাহিদা পূরণ করুক। মানুষ বিদ্রোহকেই শেষ আশ্রয় মনে করার আগেই তা করতে হবে।
মানুষ যাতে বিদ্রোহকেই শেষ আশ্রয় না করে, তার জন্য ১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকারের সনদ ঘোষিত হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যেও সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের উল্লেখ ছিল। ১৯৪৮ সালের অনেক আগে মানবতাবাদী কবি লালন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের কাছ থেকে আমরা মানবাধিকারের শিক্ষা পেয়েছি। আমাদের সংবিধানেও বেশির ভাগ মানবাধিকারের ধারণা অন্তর্ভুক্ত আছে। সহিংসতার শিকার না হওয়ার রক্ষাকবচও আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তবু ২০০৩ সালে অপারেশন ক্লিন হার্টকে দায়মুক্তি দেওয়ার আইন আমাদের ইতিহাসের এক কলঙ্ক। আন্দোলন বা ধর্মের নামে অথবা এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নরহত্যা অবশ্যই তিরস্কারযোগ্য। অপরাধী বা দুষ্কৃতিকারীকে অবশ্যই জীবিত ধরতে হবে, তাকে ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারে মেরে ফেলা পুলিশের জন্য কোনো কৃতিত্বের কাজ নয়।
আমরা প্রমাণ করেছি, আমরা যেকোনো ধরনের বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে। দেশ পরিচালনায় জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণে স্থানীয় সরকার এত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সর্বদাই একে অবহেলা করা হয়েছে। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের শেষ নির্দেশনাটিও এখনো পালিত হয়নি। আগেও বলেছি আবারও বলি, আমাদের যদি সাম্রাজ্য থাকত, তাহলে অধীনস্থ একটা উপনিবেশও কোনো দিন আমাদের হাত থেকে স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতে পারত না। কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ২০৩১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার হীরকজয়ন্তী পালন করবে, তখন বাংলাদেশ সর্বোচ্চ যুক্তরাষ্ট্রের মানের দারিদ্র্যসীমায় পৌঁছতে পারে। আগামী দুই দশকে তার জন্য আমাদের গড় জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ করে হতে হবে। ভবিষ্যতে মোট জাতীয় প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। এমনকি তখনো অনেক মানুষই অতি নিম্নমানের জীবনে আটক থাকবে।
রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, গাড়ি, তেল ব্যবসায়ী ও ঋণদাতারা সবাই চান, আরও সড়ক বানানো হোক। এতে করে কৃষিজমি যেমন কমবে, তেমনি সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতা। স্বাধীনতার সময় আমাদের ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ, এখন অযত্ন-অবহেলায় তার কেবল ছয় হাজার মাইল অবশিষ্ট আছে।
ব্রিটিশ শাসকেরা কখনো তাদের কর্মকর্তাদের ওপর নজরদারি করতে ভোলেনি। লন্ডনের ভারত দপ্তর থেকে বরিশালের জেলা শহর পর্যন্ত নিয়মিত যোগাযোগ ও তথ্যবিনিময় হতো। কিন্তু গত ৪০ বছরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধস্তন কর্মকর্তাদের তদারকি করা গোল্লায় ঠেলে দিয়েছেন। এখনকার বেশির ভাগ জেলা কর্মকর্তারা জেলা সদরে বিধবার মতো জীবনে থাকেন। তাঁদের স্ত্রীরা ঢাকায় বাস করে সন্তানদের লেখাপড়ার দেখাশোনা করেন। শেষ সম্মেলনে কর্মকর্তারা তাঁদের বিচারিক ক্ষমতা ফিরে পেতে চেয়েছেন। তাঁরা চান, তাঁদের যাতে কোনো অভিযোগে আদালতে দাঁড়াতে না হয়।
স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল। অথচ দুই দশক ধরে আমরা মারাত্মক বিদ্যুৎ-ঘাটতিতে ভুগছি। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের বদলে আমরা স্বল্পমেয়াদি অথচ ব্যয়বহুল ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে গিয়েছি। পরিণামে লোডশেডিং কমার লক্ষণ দেখা না গেলেও তেল আমদানি ব্যয় ও জ্বালানির শুল্ক ক্রমেই বাড়ছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য আমাদের অবশ্যই কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে হবে। নতুন গ্যাস ও কয়লা ক্ষেত্রে অনুসন্ধান এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি তৈরির পথ তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের কারণে আমাদের সেরা মেধাগুলো অব্যবহূত থেকে গেছে।
গত ৩৫ বছরে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা বদল হয়েছে সাতবার। আর আমাদের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ৩০ বছর যাবৎ কায়েম আছে। তারা যখন পরাজিতও হয়, তাদের কাউকেই দেখা যায় না পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করতে। আমাদের দলগুলো দুজন ব্যক্তির নাম ঘিরে জড়ো হয়েছে—শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁর নামে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং জিয়াউর রহমান, যিনি শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। প্রতিটি নির্বাচনে এ দুই নেতার আত্মীয়স্বজনের অনেকেই দুই দলের মনোনয়ন পান। আমাদের রাজনীতি দুটি বিখ্যাত পরিবার ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। বটগাছ ছায়ার জন্য ভালো, কিন্তু সেগুলোর নিচে নবীন বৃক্ষ বাড়তে পারে না।
২০১১ সালের মার্চে আইনমন্ত্রী সংসদে জানালেন, আদালতে প্রায় ২০ লাখ মামলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। আইনের আশ্রয়ের প্রতি মানুষের বিশ্বাস টলে যায়, যখন তারা দেখে, সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা করা হচ্ছে। এখানে দলীয় বিবেচনায় যেমন মামলা করা হয়, তেমনি দলীয় বিবেচনায় অনেকের মামলা প্রত্যাহারও করা হয়।
নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য সংবিধান সংশোধন করে আমরা তার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ঢুকিয়েছি। কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে না। পৃথিবীতে এমন দেশও আছে, যেখানে গৃহযুদ্ধের মধ্যেও নির্বাচন হয়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রম ছাড়াও ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে।
আমাদের নির্বাচিত সরকার এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ১৯৪১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট চারটি মুক্তির কথা বিবেচনা করেছিলেন। আমি এখানে পঞ্চম এক স্বাধীনতার কথা বলতে চাই—নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ভয় থেকে মুক্তি। যত দিন না আমরা হাসিমুখে অথবা বিষণ্ন বদনে নির্বাচনের ফলকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে পারছি, তত দিন সফল গণতন্ত্র নির্মাণ আমাদের সাধ্যের বাইরে রয়ে যাবে।
আমাদের কেবল ইতিহাস থেকেই শিক্ষা নিতে হবে না, কিছু ইতিহাস ঝেড়েও ফেলতে হবে। অতীতে যেভাবে সবকিছু চলে এসেছে, সেসব বদ্ধ মানসিকতা আমাদের ঝাঁকুনি দিয়ে কাটাতে হবে। আমরা আমাদের নেতাদের বন্দনা করতে ভালোবাসি। কিন্তু দীর্ঘ সময় লেগেছে জাতীয় জীবন থেকে কালো দাগগুলো মুছে ফেলতে। অংশত এর জন্য আমাদের তদন্তকারী সংস্থাগুলোর অদক্ষতা, অবিশ্বস্ততা, অবিশ্বাস্য ধীরগতি ও দুর্নীতি দায়ী। আশা করা হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করে জাতীয় সংহতি আরও অটুট করবে।
সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা বাংলাদেশের প্রতি সত্যিকার আস্থা ও আনুগত্য বজায় রাখব। আমরা আমাদের সংবিধান রক্ষা ও প্রহরা দিয়ে যাব এবং আইন অনুসারে কোনো রকম পক্ষপাত বা অসদুদ্দেশ্য ছাড়া সব ধরনের নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখব। সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে উল্লেখিত এ শপথ নিয়েই যেকোনো নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আমি আবার তা উচ্চারণ করলাম আমাদের সাথি নাগরিকদের উদ্দীপ্ত করার জন্য। আকার, উৎস্য, জাতীয়তা, বর্ণ, সংস্কৃতি ও ধর্ম যা-ই হোক, সব সম্প্রদায়ের সব নাগরিকের মর্যাদা ও স্বার্থ তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। ঐক্য ও সংহতির নামে ভিন্নমত ও ভিন্ন পথের চিন্তাকে আমরা দোষারোপ করব না। বরং ভাষাতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে উৎসাহিতই করতে হবে। যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে অবশ্যই আমাদের জনগণকে বিশ্বাস করতে হবে এবং তাদের অন্তর্নিহিত শুভবোধের ওপর আস্থা রাখতে হবে, মধ্যস্থতার জন্য জেনারেল বা বিচারপতিদের দ্বারস্থ হওয়া উচিত নয়।
বাংলাদেশের ৪০ বছর উপলক্ষে ২৬ নভেম্বর ২০১১, ব্র্যাক সেন্টার ইনে ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স স্টাডিজ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত সেমিনারে পঠিত নিবন্ধের সারসংক্ষেপ।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।

No comments

Powered by Blogger.