দূরদেশ-পাকিস্তানের মেমোগেট: কে হারে, কে জেতে? by আলী রীয়াজ

মার্কিন সেনাধ্যক্ষ এডমিরাল মাইক মালেনকে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরবিহীন যে চিঠিটি এ বছরের মে মাসে পাঠানো হয়েছিল সেটা কে লিখেছিলেন তা এখন সবারই জানা। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী মনসুর এজাজ চিঠির লেখক ও বার্তাবাহক। এজাজ কেবল যে তা স্বীকারই করেছেন তা নয়, তিনি এ নিয়ে কোনো রকম ভান-ভণিতারও আশ্রয় নেননি।


চিঠিটি যে যুক্তরাষ্ট্রের ত ৎকালীন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফস এডমিরাল মাইক মালেনের দপ্তরে পৌঁছেছিল এবং তিনি তা পড়েও ছিলেন—সেটাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। প্রশ্ন হচ্ছে তাঁকে এই চিঠি লেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত হোসেন হাক্কানি বলেছিলেন কি না, হাক্কানি এই চিঠির খসড়া অনুমোদন করেছিলেন কি না এবং সর্বোপরি পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির জ্ঞাতসারে ও তাঁর পক্ষ থেকে এই চিটি লেখা হয়েছিল কি না। এসব প্রশ্ন নিয়ে পাকিস্তানে এখন চলছে তোলপাড়। ইতিমধ্যেই হোসেন হাক্কানি দাবি করেছেন, তিনি এই চিঠি লিখতে বলেননি, তিনি ওয়াশিংটন থেকে ইসলামাবাদে ফিরে গিয়ে পদত্যাগ করেছেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি এ নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও ঝড় থামছে না, খুব শিগগিরই থামবে বলে মনেও হয় না। ইতিমধ্যে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির অনুসরণে একে পাকিস্তানের ‘মেমোগেট’ বলে বর্ণনা করাও শুরু হয়েছে।
একটি স্বাক্ষরবিহীন চিঠি নিয়ে গোটা দেশ তোলপাড় হয়ে যাওয়ার কারণ চিঠির বিষয়বস্তু। ১০ মের এই চিঠিতে বলা হয় যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও আইএসআই সেনা অভ্যুত্থানের চক্রান্ত করছে যাতে করে তারা নির্বাচিত বেসামরিক সরকারকে সরিয়ে দিতে পারে। এ অবস্থায় পাকিস্তান চায় ওবামা প্রশাসন বিশেষ করে এডমিরাল মালেন, সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি এবং আইএসআই-প্রধান আহমেদ সুজা পাশাকে এই বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দিক যে যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ সহ্য করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপের বিনিময়ে প্রেসিডেন্ট জারদারি অবিলম্বে তদন্ত শুরু করবেন যে পাকিস্তানে কারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে; এই তদন্ত হবে নিরপেক্ষ, জবাবদিহিমূলক এবং তার ফল হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভজনক। এর পাশাপাশি পাকিস্তান নতুন একটি জাতীয় নিরপত্তা-বিষয়ক কাঠামো তৈরি করবে, যারা যুক্তরাষ্ট্রকে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর অনুমতি দেবে, পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের জন্য গ্রহণযোগ্য কাঠামো তৈরি করা হবে; আইএসআইয়ের ভেতরে ‘এস ইউনিট’ বলে যে শাখা আছে, যা তালেবান, আল-কায়েদা ও হাক্কানি গোষ্ঠীকে সাহায্য করে তা ভেঙে দেওয়া হবে এবং ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার ব্যাপারে পাকিস্তান ভারতকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে।
লক্ষ করার বিষয় হলো, এই স্মারকপত্র (মেমো) পাঠানো হয়েছিল পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিনিদের অভিযানে আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে। সে সময় পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কেবল টানাপোড়েন নয়, রীতিমতো উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও বিরোধী দলগুলো জারদারির সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে এই বলে যে সরকার দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ও আইন প্রণেতাদের একাংশ সরাসরি বলেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশেষত আইএসআইয়ের জ্ঞাতসারে ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানে বসবাস করছিলেন। এই পটভূমিকায় পাকিস্তানের একটি দক্ষিণপন্থী সংবাদপত্র পাকিস্তানে নিযুক্ত সিআইএর প্রধানের নাম প্রকাশ করে দেয়। যেকোনো সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছিলেন যে পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার সেনাবাহিনীর চাপের মুখে আছে। ফলে এ ধরনের একটা স্মারকপত্র যে লেখা সম্ভব তা কমবেশি সবাই ধারণা করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জারদারি এই চিঠিতে সম্মতি দিয়েছিলেন কি না।
এই চিঠির কথা প্রথম প্রকাশিত হয় ১০ অক্টোবর লন্ডনের ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায়। মনসুর এজাজ এক নিবন্ধে লেখেন যে তিনি হোসেন হাক্কানি ও প্রেসিডেন্ট জারদারির পক্ষ থেকে একটা চিঠি মাইক মালেনকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেন, হোসেন হাক্কানি এই চিঠির খসড়া করে দিয়েছিলেন এবং তাঁকে জানিয়েছিলেন যে এই চিঠির ব্যাপারে ‘বস’-এর সম্মতি রয়েছে। পুরো চিঠিটি প্রকাশিত হয় ১৭ নভেম্বর ফরেন পলিসি নামের গবেষণাধর্মী সাময়িকপত্রে ওয়েব সংস্করণে। গোড়াতে মাইক মালেন এই চিঠির অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও পরে তাঁর দপ্তর থেকে জানানো হয় যে তাঁরা চিঠি পেয়েছিলেন। চিঠি পড়াও হয়েছিল কিন্তু স্বাক্ষরবিহীন এই চিঠিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যদিও অনেকেই এ কথা স্মরণ করিয়ে দেন যে প্রায় কাছাকাছি সময়ে এডমিরাল মালেন আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করেছিলেন।
ফরেন পলিসির সূত্রে গোটা স্মারকপত্র জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই পাকিস্তানে ঝড়ের সূচনা হয়। পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতারা রাষ্ট্রদূত হাক্কানির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনেন। তাঁরা এও বলেন যে প্রেসিডেন্ট এতে সম্মতি দিয়ে থাকলে তিনিও দেশদ্রোহী। সেই থেকেই এই ঝড় অব্যাহত রয়েছে। এই চিঠির ভাষা ও গঠনকাঠামো দেখে এটি হোসেন হাক্কানির লেখা চিঠি বলে মনে হয় না। হোসেন হাক্কানি শুধু কূটনীতিক নন, তিনি একজন গবেষক ও লেখকও বটে। অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন। তাঁর লেখা পাকিস্তান: বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি দেশটির রাজনীতি, বিশেষত ইসলাম ও সেনাবাহিনী নিয়ে লেখা বইগুলোর মধ্যে অন্যতম। ওই বইয়ে হোসেন হাক্কানি চরম ইসলামপন্থী ও সেনাবাহিনী বিষয়ে তাঁর যে মতামত দিয়েছেন তাতে স্পষ্ট যে, তিনি এদের ঘোর সমালোচক। ফলে এই মেমোর সারবস্তুর সঙ্গে হোসেন হাক্কানির ব্যক্তিগত মতামতের কোনো দূরত্ব নেই। হোসেন হাক্কানির সঙ্গে কথাবার্তার সুবাদে আমার সব সময়ই তাঁকে মেধাবী, সাহসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলে মনে হয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার জন্য তাঁর সমালোচকেরা তাঁকে ‘যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত’ না বলে ‘পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত’ বলে পরিহাস করতেন। তাঁর সঙ্গে মনসুর এজাজের যে যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব ছিল এটা প্রশ্নাতীত।
কিন্তু মনসুর এজাজের অতীত খুব চম ৎকার নয়। অভিযোগ রয়েছে যে তিনি এক সময় কাশ্মীরি জেহাদি নেতা সৈয়দ সালাউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। খালিদ খাজা বলে আইএসআইএর একজন কর্মচারী, যিনি এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁর সঙ্গে এজাজের সম্পর্ক ছিল। নব্বইয়ের দশকে এজাজ সুদান থেকে ওসামা বিন লাদেনকে বহিষ্কারে ভূমিকা রেখেছিলেন। বলা হয় যে তিনি ক্লিনটন প্রশাসনের হয়েই সুদানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। ফলে মার্কিন প্রশাসনের কাছে পৌঁছানোর জন্য যদি কোনো পেছনের দরজা ব্যবহার করতে হয় তবে মনসুর এজাজ বার্তাবাহকের ভূমিকা পালন করতেই পারেন। কিন্তু হোসেন হাক্কানি কি ভবিষ্যতে তা অস্বীকারের জন্যই এই বার্তাবাহক বেছে নিয়েছিলেন? নাকি হাক্কানির বক্তব্যই সঠিক যে তিনি এসবের কিছুই জানেন না?
পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ও রাজনীতিবিদদের লক্ষ্য হোসেন হাক্কানি বা মনসুর এজাজ নয়। তাদের লক্ষ্য প্রেসিডেন্ট জারদারি। যদিও প্রেসিডেন্ট অস্বীকার করেছিলেন যে এসবের কিছুই তাঁর জ্ঞাতসারে হয়নি, পাকিস্তানিরা তা সহজে বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। পাকিস্তান পিপলস পার্টির জনপ্রিয়তা যখন টলতে শুরু করেছে, তখন রাজনীতিবিদরা চাইবেন এই ইস্যুতে প্রেসিডেন্টকে যতটা বিপদে ফেলা যায়।
তা ছাড়া পাকিস্তানে সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নেই। ওসামা বিন লাদেনের হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে জারদারি সরকার ও সেনাবাহিনীর টানাপোড়েন বেড়েছে। পাকিস্তানের ইতিহাস যাঁরা জানেন তাঁরা এই টানাপোড়েনের মধ্যে সেনাশাসনের পদধ্বনি শুনতে পাবেন। পাকিস্তানে সেনাবাহিনী ও সেনা-আমলাতন্ত্র সব সময়ই তাদের ক্ষমতা গ্রহণের যৌক্তিকতার জন্য জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। পাকিস্তানে জাতীয় নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনী এক ও অভিন্ন বলে একটা আবহাওয়া তৈরি করে রাখা হয়েছে। ফলে অনেকেরই মনে আশঙ্কা, আবারও সেনাশাসন দরজায় কড়া নাড়ছে। এই আশঙ্কার পেছনে এও কারণ যে ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী গিলানি আইএসআইকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনার চেষ্টা করেছিলেন। ঘোষণা দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরকারকে সে পদক্ষেপ বাতিল করতে হয়েছিল। সেনাবাহিনী সেই চেষ্টার বদলা নিতে চাইছে বলে অনেকের ধারণা।
পিপলস পার্টির সরকার, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জারদারি এখন এতটা জনপ্রিয় নয় যে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেওয়ার চেষ্টা করলে জনসাধারণ তা রুখে দিতে খুব উ ৎসাহী হবেন। তাই শঙ্কাটি আরও বেশি। এই টানাপোড়েনে শেষ পর্যন্ত কে হারে, কে জেতে সেটাই লক্ষ করার বিষয়।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভারসিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.