স্বেচ্ছাচারিতার বলি হচ্ছে মানুষ by মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান
*২ ফেব্রুয়ারি ২০১২ জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, 'অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট'। এটি পরদিন কালের কণ্ঠসহ বিভিন্ন পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়েছে। তিনি সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন যে দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই।
দুর্ঘটনাকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। কিন্তু তিনি যদি বিষয়টি খুব হালকাভাবে দেখে থাকেন এবং যদি সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাগুলোকে আমলে না নিয়ে এই মন্তব্য করে থাকেন, তাহলে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তাঁর বক্তব্য অনেককে আহত ও ক্ষুব্ধ করেছে। কারণ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখ থেকে দুর্ঘটনার বিষয়কে গুরুত্ব না দেওয়ায় যাদের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে, তারা উৎসাহিত হচ্ছে। ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অতিমাত্রায় বেড়েছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে সড়ক দুর্ঘটনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তখনই ট্রাককে ঘাতক ট্রাক বলে আখ্যায়িত করা হয়। এরপর দুর্ঘটনার বিষয়টি বেশ কয়েক বছর তেমন আলোচনায় আসেনি। কিন্তু এখন সংগত কারণেই তা ব্যাপক মাত্রা লাভ করেছে। কারণ প্রায় প্রতিদিন অস্বাভাবিক হারে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু এর পরও যদি দায়িত্বশীলদের এমন বক্তব্য মেলে, তাহলে মানুষ তো আরো ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হবেই। কিছুদিন আগে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর পর সারা দেশ আন্দোলিত হয়ে ওঠে। যখন নৌ পরিবহনমন্ত্রীর একটি বক্তব্যও গণমানুষকে আহত করে, তখন তিনি এ ধরনের একটি কথা বলেন, গাড়িচালকের লেখাপড়া জানা এত জরুরি নয়। এ ছাড়া তাঁর উপস্থিতিতে পরিবহন শ্রমিকদের একটি সমাবেশে 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনের প্রবক্তা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবির প্রতি অসম্মান করা হয়। সেখানে মন্ত্রী সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের নিবৃত্ত করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। এতে গাড়িচালকরা নিজেদের সংশোধন না করে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠার সাহস পায়। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের একজন ছাত্র হাদিউল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ড্রাইভারের ত্রুটির কারণেই আমাদের মেধাবী ছাত্রটি নিহত হন। এর প্রতিবাদে আন্দোলন হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপক সম্পদ বিনষ্ট হয়। কয়েক দিন আগে আমাদেরই আরেকজন ছাত্র বাইরের পরিবহন শ্রমিকদের দ্বারা প্রহৃত হন। এতেও ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। যেকোনো সড়ক দুর্ঘটনায়ই এ ধরনের প্রতিক্রিয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একদিকে আমরা আমাদের প্রিয়জনদের হারাচ্ছি, অন্যদিকে দেশের সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া দায়িত্বশীলরা চালকদের পক্ষে যেসব কথা বলছেন, তাতেও পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। তা এখন রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে, যা প্রত্যাশিত নয়। হসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের প্রতীকী শাস্তির বিধান করা হয়। এতে গাড়িচালকরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবহনসংক্রান্ত কিছু নীতিমালা তৈরি করতে গেলে গাড়িচালকদের স্বার্থে আঘাত লাগে এবং তখন একজন ড্রাইভার এ ধরনের মন্তব্য করে, যেকোনো একজনকে গাড়িচাপা দিলে মাত্র ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়। নিশ্চয়ই চালকের এটি এক ধরনের হুমকি। এমতাবস্থায় এ ক্ষেত্রে অনুধাবন করা প্রয়োজন যে দেশের বিদ্যমান এ-সংক্রান্ত আইনও যাত্রী কিংবা পথচারীদের পক্ষে নয়, স্বেচ্ছাচারী ও বেপরোয়া গাড়িচালকদেরই পক্ষে। এ জন্য বিদ্যমান আইনের সংস্কার খুব প্রয়োজন। ঘর থেকে মানুষ বেরিয়ে নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে পারবে না কেন? একেকটা দুর্ঘটনা ঘটার পর কয়েক দিন হৈচৈ হয়, তারপর আবার সব থেমে যায়, আবার জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ঘটতে থাকে! এভাবে তো চলতে পারে না। বেপরোয়া, স্বেচ্ছাচারী চালক-মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার বলি হবে মানুষ আর এর বিপরীতে কিছুই করার থাকবে না, উপরন্তু দায়িত্বশীলদের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য ও কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হবে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সড়ক দুর্ঘটনা ভয়াবহ ব্যাধি হয়ে দেখা দিয়েছে। এর কঠোর প্রতিকার জরুরি এবং তা কালবিলম্ব না করে। অন্যায়কারীর পক্ষে সচেতন, দায়িত্ববান কেউ দাঁড়াতে পারেন_তা ভাবতেও বিস্ময় লাগে। বিশ্বের উন্নত দেশেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, কিন্তু এর প্রতিকারও কঠোর। আমাদের এখানের চিত্র সম্পূর্ণ এর বিপরীত। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কিংবা স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর অবকাশ কারোরই নেই।
লেখক : উপ-উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক : উপ-উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments