অনন্তযাত্রায় সমকাল বিজয়ী লেখক by হারুন হাবীব

১৯ তারিখ সন্ধ্যায় লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে পৌঁছার খানিকক্ষণ বাদেই আমাদের মেয়ে শুক্লা প্রথমেই দুঃসংবাদটি জানাল। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাড়িঁয়ে রইলাম। এমন অবেলায় চলে যাবেন হুমায়ূন ভাবিনি। ব্যক্তিজীবনে খুব একটা কাছাকাছি ছিলাম না আমরা। কালেভদ্রে দেখা। বেশির ভাগই তাঁর বাড়ির আড্ডায়।


এসব আড্ডায় অনেকটাই জোর করে নিয়েছেন সালেহ ভাই, অর্থাৎ সাংবাদিক-লেখক সালেহ চৌধুরী- যিনি দীর্ঘকাল হুমায়ূনের ঘনিষ্ঠজন। হুমায়ূন তাঁকে নানাজি বলে ডাকতেন। খবরটা পাওয়ার পর থেকেই ভাবছি, বড্ড অবেলায় চলে গেলেন লেখক। এতটাই অবেলায় অনন্ত যাত্রায় পা রাখলেন যে শোকের সুবিশাল পাথরের পর পাথরচাপা পড়া ভক্তকুল স্বাভাবিকভাবেই হতবিহ্বল, শোকার্ত। কে যেতে চায়, তাও এমন অবেলায়? যেতে তো হবেই; কিন্তু ডাক এলেই যেতে হবে কোন যুক্তিতে? এর পরও হুমায়ূনের সুবিশাল ভক্তকুল, প্রিয়জনের আকুতি ও শত কান্না মৃত্যুর কাছে হার মানা থেকে সরাতে পারেনি। অনন্ত যাত্রায় পাড়ি দিলেন এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। আমেরিকার এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে দেশে ফিরে চিরদিনের মতো ঠাঁই নিলেন তাঁরই স্বদেশের, তাঁরই নুহাশপল্লীতে। ৯ মাস দুরারোগ্য ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে তাঁকে হার মেনে নিতে হলো।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সমসাময়িককালে আমাদের সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের নাম হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর জনপ্রিয়তার পেছনে আছে সহজ-সাবলীল ভাষা ও ভঙ্গিতে গল্প বলার অনায়াস সক্ষমতা এবং বিরল দক্ষতা। মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার গল্প বলার এমন নিপুণ কারিগর এর আগে দেখা যায়নি। জনজীবনের প্রত্যাশার সঙ্গে শিল্পের এই দূরত্ব বেশির ভাগ শিল্পীই ঘোচাতে পারেন না। হুমায়ূন পেরেছিলেন। সে কারণেই হুমায়ূন প্রবেশ করেছিলেন বিপুলসংখ্যক পাঠকের অন্তরে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠেছিলেন বিস্ময়কর ক্রেজ। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর 'নন্দিত নরকে', 'শঙ্খনীল কারাগার' উপন্যাসগুলোর একনিষ্ঠ ভক্ত। হুমায়ূনের প্রতি আমার আরো একটা বড় টান ছিল। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শহীদের সন্তান। তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় অবস্থান আছে। বাবা হারানোর পারিবারিক আবেগ ছাড়িয়ে গোটা জাতির দুঃখ-বেদনা ও সংগ্রামের ছবি ফুটে ওঠে তাঁর নানা গল্প-উপন্যাসে। বাংলাদেশের একজন লেখকের জন্য এ কৃতিত্ব ছোট কিছু নয়। অন্যদিকে সবাই জানবেন, অধ্যাপক-লেখক হুমায়ূন ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, বুদ্ধিদীপ্ত ও বিদ্বান মানুষ। তিনি বিশেষ ধরনের সায়েন্সফিকশন লেখকও। অবশ্য কেউ কেউ বলতেই পারেন যে তাঁর সায়েন্সফিকশনগুলো প্রচলিত ঘরানা থেকে আলাদা, যা দেশীয় সাহিত্যে আগে দেখা যায়নি। বাংলাদেশে তাঁর সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের নাম যদি বলতে হয় সে নাম স্বতঃসিদ্ধভাবেই হুমায়ূন আহমেদের। নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের সাধারণ একটি ছেলে বাংলা পাঠকের দরজায় এমনভাবে কড়া নাড়বেন- কে তা ভাবতে পেরেছিল! প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে লিখেই তিনি বোদ্ধা মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। এরপর আর কখনোই থেমে থাকেননি। একের পর এক উপন্যাস, গল্প ও নাটক লিখে গেছেন হুমায়ূন। লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প- যার অনেকই অসামান্য। আমার বিশ্বাস, হুমায়ূনের বেশ কিছু উপন্যাস ও ছোটগল্প কালকে অতিক্রম করেছে, সাহিত্যকে সমৃদ্ধি দান করেছে। অনেক লেখককে যেভাবে জোর করে প্রতিষ্ঠা আহরণের কৌশল রপ্ত করতে হয়, হুমায়ূনকে তা করতে হয়নি। তাঁর রচনাকৌশল এতটাই তাঁকে গ্রহণযোগ্য করেছে যে সেটি অস্বীকার করার জো নেই কারো। এর পরও কথা থাকেই। হুমায়ূন সাহিত্যের সব বোদ্ধার কাছে, সব পাঠকের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেননি। অবশ্য এমনটা খুব কমই ঘটে। এমন অভিযোগও কম নেই যে তাঁর লেখালেখির কাটতি বেশুমার বলে কলমকে তিনি অবলীলায় নিছক বাণিজ্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। হয়তো করেছেন। এর পরও স্বীকার করতেই হবে যে হুমায়ূন আহমেদের গল্প বলার স্বতন্ত্র রীতি, আলাদা ঢং, ভিন্ন স্বাদের গদ্যশৈলী বা বৈশিষ্ট্য তাঁকে পাঠকের কাছে বিপুল জনপ্রিয় করে তোলে।
যাঁরা মনে করেন যে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের একটি প্রজন্মকে বই পড়া শিখিয়েছেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত পোষণ করি। দেশের প্রকাশনা শিল্পকেও তিনি দাঁড় করিয়েছেন। তিন দশক ধরে হুমায়ূনের প্রতিটি বই বেস্টসেলার, যা ইচ্ছে তাই লিখেছেন হুমায়ূন এবং যা লিখেছেন তা-ই বেস্টসেলার। এ এক অসম্ভব কৃতিত্ব বা সৌভাগ্য। বাংলাদেশের একজন লেখক বই লিখে বিশাল বিত্তের মালিক হয়ে উঠবেন, সে দৃষ্টান্ত একমাত্র হুমায়ূনই রাখতে পেরেছিলেন। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান দিকপাল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, জনপ্রিয়তার দিক থেকে হুমায়ূন শরৎচন্দ্রকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। হয়তোবা। তবে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে হুমায়ূনের তুলনা করার কোনো কারণ দেখি না আমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছেড়ে লেখালেখিতে মগ্ন হয়েছিলেন হুমায়ূন। নাটক, উপন্যাস, চলচ্চিত্র নির্মাণ ইত্যাদি কাজে গভীর মনোনিবেশ করেছিলেন। আশির দশকে বিটিভিতে হুমায়ূনের সিরিয়াল নাটকগুলোর কথা কেউ ভুলতে পারবে না? এরপর মনোযোগ দিয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। হুমায়ূনকে হারানোর বেদনা ভুলতে কষ্ট হবে বাংলাদেশের। তাঁর সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে মানুষের হৃদয়ের এতটা কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন বলেই বিদায়বেলায় অগণিত পাঠক-ভক্ত চোখের জলে ভেসেছেন। একনিষ্ঠ ও বিশাল পাঠকশ্রেণী তৈরির মাধ্যমে তিনি দেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রবৃদ্ধিতে রেখেছেন বড় ভূমিকা। নিজস্ব কথনরীতি ও নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের নিবিড় বর্ণনার জন্য অনেক সমালোচকের চোখেও তিনি বিশিষ্ট। কারণ, তিনি মধ্যবিত্ত জীবনের নিস্পন্দ রোমান্টিকতাকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর সংলাপনির্ভর উপন্যাসমালায়। শুধু স্বদেশ নয়, হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা উভয় বাংলায়। এতটা জনপ্রিয়তা খুব কম লেখকের ভাগ্যে ঘটে থাকে।
আমাদের মতো কার কতটা হুমায়ূনের বই পড়া হয়েছে বা হয়নি তার চেয়ে বড় হচ্ছে, হুমায়ূনের বই পড়েননি এমন তরুণ প্রজন্মের পাঠক বাংলাদেশে একজনও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। বাংলা ভাষী ভারতীয় অঞ্চলেও হুমায়ূন যথেষ্ট জনপ্রিয়। বলা যায়, চার দশক ধরে বাংলাদেশে কাটতির শীর্ষে থাকা ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ। বেস্টসেলার উপন্যাসের অব্যর্থ কারিগর। অসীম জনপ্রিয়তা এনে দেয় তাঁকে তাঁর নন্দিত টিভি নাটক, ছোটগল্প ও কয়েক বছর ধরে বিস্তৃত তাঁর নিজস্ব ধারার চলচ্চিত্রে। আমি বিশ্বাস করি, হুমায়ূন তাঁর সমকালকে জয় করার দুর্লভ কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। খুব কম লেখকের ভাগ্যে এমন কৃতিত্ব জোটে। একনিষ্ঠ ও বিশাল পাঠকশ্রেণী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। বিনির্মাণ করতে পেরেছিলেন গল্প বলার নিজস্ব রীতি, যা নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের নিবিড় বর্ণনায় সিক্ত। আমি হুমায়ূনের প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে'র একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁর আরো কিছু বই পড়া হয়েছে আমার। সব বই পড়ার সময় বা ইচ্ছে যে হয়েছে- এমনটা না বলাই সংগত। বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনের নিস্পন্দ রোমান্টিকতাকে নিখুঁতভাবে তুলে আনার মুনশিয়ানায় সিক্ত এ লেখক- বলতেই হবে, তাঁর নিজস্ব এক যুগ তৈরি করে গেছেন। যতটা জানি, তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা দুই শতাধিক।
কবিতা ও নাটকে বাংলাদেশ যতটা এগিয়েছে, গদ্যে ততটা পারেনি। কাজেই পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই ছাড়া এ দেশের পাঠকদের পড়ার তেমন কিছু ছিল না একসময়। একমাত্র হুমায়ূন আহমেদ এ ধারার পরিবর্তন আনতে পেরেছিলেন। পরিবর্তন বললেই শেষ হয় না। হুমায়ূন একটা বিপ্লব এনেছিলেন। এ লেখকের অকাল অনন্ত যাত্রা ইত্যাদি কারণেই বড় দুর্ভাগ্যের।
লেখক : কথাশিল্পী ও সাংবাদিক
e-mail : hh1971@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.