শ্রাবণধারায়, চোখের জলে ভিজল ভক্তরা by শরীফ আহমেদ শামীম

বাংলা সাহিত্যের রূপকথার রাজপুত্র, খ্যাতিমান নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ স্বজন-শুভানুধ্যায়ী আর ভক্তকুলের চোখের পানি ও বুকভরা ভালোবাসায় শেষ বিদায় নিলেন। শ্রাবণ-বর্ষণে সিক্ত হয় তাঁর কফিন। সবাইকে কাঁদিয়ে, শোকে ভাসিয়ে হুমায়ুন আহমেদ আশ্রয় নেন তাঁর নিজের হাতে গড়া অতিপ্রিয় নুহাশপল্লীর লিচুতলায়।


ভোর হওয়ার আগেই ভক্তকুল, গাজীপুরের মানুষ টেলিভিশনের মাধ্যমে জেনে যায় শেষ শয্যা নিতে নুহাশপল্লীতেই আসছেন হুমায়ূন আহমেদ। গুণী এ কথাশিল্পীকে শ্রদ্ধা এবং শেষ বিদায় জানানোর জন্য শুরু হয় প্রস্তুতি। ভোর থেকে মানুষ ছুটতে থাকে নুহাশপল্লী অভিমুখে।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে ঢাকার বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে নন্দিত লেখকের কফিন একটি অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে নুহাশপল্লীর উদ্দেশে রওনা হন তাঁর নিকটজনরা। কফিন পৌঁছে দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে।

কিন্তু তার আগেই প্রিয় লেখককে শেষবারের মতো দেখতে হাজার হাজার শোকাতুর মানুষ জড়ো হতে শুরু করে নুহাশপল্লীতে। শুধু গাজীপুর নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দল বেঁধে মানুষ আসতে থাকে। সকাল ১০টায় তা রূপ নেয় জনস্রোতের। মানুষ ও যানবাহনের চাপে হোতাপাড়া-নুহাশপল্লী সড়ক অচল হয়ে পড়ে।
এলাকার সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ, শিশু, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, গৃহবধূ, সাংস্কৃতিক নেতা-কর্মীর শোকার্ত স্রোত আছড়ে পড়তে থাকে নুহাশপল্লীতে। প্রকৃতি-প্রেমিক হুমায়ূন আহমেদের নিজ হাতে গড়া ঔষধি গাছের বাগান, লীলাবতী দিঘি, মৎস্যকুমারী লেক প্রভৃতি ঘুরে দেখে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে না ফিরে আসার দেশে চলে যাওয়া মানুষটিকে। কফিন আসার আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় নুহাশপল্লীর মাঠ, খোলা জায়গা। জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শুরু হয় সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা। কয়েক দফা বৃষ্টিতে ভিজে প্রাণপ্রিয় মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানাতে তারা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। সবার মুখই বিষণ্ন, মলিন। কারো চোখ অশ্রুভেজা, কেউ ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রেখেছে। প্রিয় লেখক-নির্মাতা ও নাট্যকারকে হারিয়ে সবার হৃদয় যেন ভেঙে গেছে।
শ্রদ্ধা জানাতে আসা গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র ওয়াকিল হোসেন, শহীদ ও সজীব জানান, 'তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি হিমু চরিত্রের মাধ্যমে এ দেশের অসংখ্য তরুণ মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছে। তিনি আমাদের বই পড়তে এবং কিনতে শিখিয়েছেন। এই লেখক আর কোনো দিন আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। তাই ক্লাসে না গিয়ে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি।'
পিরুজালী গ্রামের যে স্থানে নুহাশপল্লী সে স্থান থেকে বৃদ্ধ সাহেদ আলী (৭৫) ও আবদুল হাকিমের (৮০) বাড়ির দূরত্ব আধা কিলোমিটারেরও কম। নিজেরা কাপড় কিনে বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়ে নুহাশপল্লীতে এসেছেন তাঁরা সকাল ৭টার দিকে। তাঁরা বললেন, 'আমরা মূর্খ মানুষ। তাঁর বই পড়িনি। আমাদের বাড়িতে তিনি অনেক নাটক-সিনেমার শুটিং করেছেন। তাঁর নাটক খুব ভালো লাগত। এত মজার মজার নাটক আর তৈরি হবে না। তাই জোহরের নামাজের পর জানাজার কথা জেনেও আগেই এসেছি প্রিয় মানুষটাকে শেষবারের মতো দেখব এ আশা নিয়ে।'
হুমায়ূন আহমেদের নিজ জেলা নেত্রকোনার কেন্দুয়ার রোয়াইলবাড়ি থেকে দেলোয়ার হোসেন এসেছেন তাঁর ছোট বোন কলেজছাত্রী তাসলিমা জাহান লিপিকে নিয়ে। তিনি বললেন, 'তিনি দেশের গর্ব। মরদেহ নেত্রকোনায় নিতে তাঁর মা আয়েশা ফয়েজের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু মৃত্যুর পর পাঁচ দিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার কারণে সম্ভব হয়নি। সোমবার অনেকেই ঢাকায় গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। আমরা যেতে পারিনি। তাই এখানে এসেছি।'
হুমায়ূন আহমেদ নুহাশপল্লীতে এলে যে বাংলোতে থাকতেন তার উত্তর দিকের খোলা ব্যালকনির পাশেই বড় একটি কদমগাছ। এ গাছের নিচে বসে তিনি সাহিত্য রচনা করতেন। গতকাল মঙ্গলবার ভোর থেকে ওই ব্যালকনিতে বসেছিলেন পিরুজালী গ্রামের আমেনা (৬০), কমলা (৪৫), তহুরা (৫০) ও সাহেরা (৫২)। আমেনা, কমলা ও সাহেরা নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের শুটিং থাকলে রান্নার কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে এই নারীদের রয়েছে বহু স্মৃতি। তাঁদের প্রত্যেকের চোখ গড়িয়ে পড়ছে পানি। কমলা জানান, 'স্যার অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন। মুখ দেখেই স্যার আমাদের মনের কষ্ট বুঝতে পারতেন। স্যার একটু পরপর চা খেতে চাইতেন। আমি স্যারকে চা বানিয়ে খাওয়াতাম। স্যার আর কোনো দিন আমার কাছে চা চাইবেন না- এটা ভাবতে পারছি না। আল্লাহ যেন স্যারকে কবরে শান্তিতে রাখেন, সেই কামনা করি।'
পাশেই শোকার্ত, উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা স্নাতক সম্মানের ছাত্রী ইশরাত জাহান। তিনি বললেন, 'তাঁর মৃত্যুতে এ দেশের সাহিত্য ও বিনোদন জগতের যে ক্ষতি হলো, তা কেউ পূরণ করতে পারবে না। বইমেলায় তাঁর নতুন বই আসবে না, ঈদে তাঁর নতুন নাটক-সিনেমা দেখতে পাব না- ভাবতেই খারাপ লাগছে।'
প্রিয় নাট্যকারকে শেষ দেখা দেখতে সিরাজগঞ্জ শহরের কোনাগাতী থেকে এসেছেন ব্যবসায়ী আল-আমিন তালুকদার (৩৫)। সেহরি খেয়ে রওয়ানা দিয়ে গাজীপুরের হোতাপাড়ায় এসেছেন সকাল ১০টায়। যানবাহন না পেয়ে ৮ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে নুহাশপল্লীতে পৌঁছান সকাল ১১টায়। রোজা রেখে এত কষ্ট করেও তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই। প্রিয় মানুষটির মুখ না দেখতে পারলেও তাঁর কফিনে ফুল দিতে পেরেছেন- এটাই শান্তি।
৯ বছর আগে দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছেন পিরুজালী গ্রামের আবদুল হামিদ খলিফা (৬০)। চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। তারপরও স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে এসেছেন প্রিয় লেখককে, প্রিয় মানুষটাকে শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি বললেন, 'স্যার এত বড় মাপের মানুষ। অথচ সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে তিনি মিশতেন। সবাইকে আপন করে নিতেন। তিনি গাজীপুরের সন্তান নন- আমরা কখনো এমনটা মনে করিনি। আমরা তাঁকে নিয়ে, তাঁর নুহাশপল্লীকে নিয়ে গর্ববোধ করি।'
পিরুজালী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী নুরুন্নাহার, নাজমা, তমা, রূপা, তাহমিনা, দিপা ও আফরিন স্কুল কামাই দিয়ে এসেছে সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে। রূপা বলল, 'হুমায়ূন স্যার অনেক উপন্যাস ও গল্পে রূপা নামটি ব্যবহার করেছেন। এটি আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগত। আমরা আর কখনো তাঁকে খুঁজে পাব না। এ নুহাশপল্লীতে তিনি আর কখনো ঔষধি বাগানে ঘুরে বেড়াবেন না। নতুন কোনো গাছের চারা লাগাবেন না, এটা ভীষণ কষ্টের। তাঁর মতো এত শক্তিশালী লেখক আর জন্মাবেন কি না সন্দেহ আছে।'
রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে দেড় বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে বরেণ্য নির্মাতাকে এক নজর দেখতে এসেছেন গৃহবধূ ইসমত আরা লিপি। তিনি বললেন, 'তাঁর উপন্যাস পড়ে ভক্ত হয়ে যাই। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসের ভাষাই সহজ-সরল। নাটক, সিনেমা, কবিতা, উপন্যাস সব কিছুতেই তিনি ছিলেন অসাধারণ। সব থেকে ভালো তিনি শাওনের স্বামী। তাই কষ্ট হলেও তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি।'
শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকা থেকে এসেছেন হুমায়ূন আহমেদের আরেক আবিষ্কার দেশবরেণ্য শিল্পী আবদুল কুদ্দুস বয়াতি। তিনি বলেন, 'তাঁকে ছাড়া আমি কিভাবে ভালো থাকব? এলাকার হাটে-বাজারে গান করে বেড়াতাম। তিনি আমাকে কুদ্দুইচ্চা থেকে আবদুল কুদ্দুস বয়াতি বানিয়েছেন। বৃষ্টি হলে বা মন খারাপ হলে দলবল নিয়ে চলে আসতে বলতেন। আমার মতো অনেককে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। গ্রামবাংলার হারানো গান নতুন করে শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। এমন সোনার মানুষ, গান ও দেশপ্রেমিক আর আসবে না। তাঁর অভাব পূরণ হবে না।'

No comments

Powered by Blogger.