উপাচার্য উপাখ্যান by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
সম্প্রতি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গোলযোগ দেখা যাচ্ছে এবং এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হচ্ছে, এর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কারণটা অদ্ভুত। সাধারণত উপাচার্য কিংবা উপ-উপাচার্য অপসারণের জন্য এ আন্দোলন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বলাবাহুল্য, একপর্যায়ে ছাত্ররা জড়িয়ে পড়েন।
সাধারণত মনে করা হয় যে ছাত্রদের কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনেক সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, যা আগেই উল্লেখ করেছি। তবে স্বাধীন দেশের জন্য এটি চরম অশুভ। এ ব্যাখ্যায় পরে আসছি। ষাটের দশকে আমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে ছাত্র আন্দোলনে জড়িত ছিলাম। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গণবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা এবং প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। এর আগে পঞ্চাশের দশকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছেন। এক কথায় বলা চলে যে পুরো বিষয়টা শুধু ছাত্রদের নিজেদের স্বার্থ ছিল না, তথা গোটা জাতির মর্যাদা এবং অস্তিত্বের জন্য এই সংগ্রাম হয়েছে। আর সে জন্যই ২৫ মার্চ দিবাগত রাতের প্রথম প্রহরে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী যখন বাঙালি নিধনে নামে তখন তাদের প্রধান টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার ফলে প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। আমাদের জাতীয় সরকার দলমত-নির্বিশেষে কম-বেশি সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি করতে চেষ্টা করছে আর নিরক্ষরতা দূরীকরণ তো মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল্ড। এ কারণে পাকিস্তান আমলের মতো দীর্ঘমেয়াদি ছাত্র আন্দোলন করার প্রয়োজন হয় বা হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের জন্য ছাত্ররা এক হয়ে আন্দোলন করেছিল। সামনে এ রকম কোনো রাজনৈতিক সংকট আসবে কি না তা সময় বলে দেবে। দেশে গণতন্ত্র রয়েছে, প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচন হচ্ছে এবং সরকারও পরিবর্তন হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ধনুকভাঙা পণ করে ছাত্র আন্দোলন করার প্রয়োজন হয়তো হবে না। এ অবস্থায় একটা সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ থাকার কথা, শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে আজ এ পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। বর্তমান যুগের পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্যের কর্তব্যে শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি কি গৌণ? এ কথা মাথায় এলো ষাটের দশকের একটি ঘটনা মনে পড়ায়। অবাঙালি ড. মাহমুদ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর বড় ভাই ড. জাকির হোসেন ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সম্ভবত ড. জাকির হোসেনের ছেলে ভারতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অনুগত মোনায়েম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর খুব ইচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আসবেন। ড. মাহমুদ হোসেন জানিয়ে দিলেন যে ছাত্ররা তাঁকে পছন্দ করে না, সমস্যা দেখা দেবে। মোনায়েম খানের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চলে যান। সেখান থেকে পরে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে শিক্ষকতা করেছেন। ঢাকা থেকে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি বিদায় সংবর্ধনায় বলেছিলেন যে তিনি পুলিশ নন, শিক্ষক- ছাত্র পড়ানো তাঁর কাজ। আমার বাবা সরকারি চাকরিজীবী হলেও বহুবার আমাদের বলেছেন যে বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ আর কোনো পদ নেই। কেননা, তাঁরা সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অবস্থান করে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন। যত গবেষণা, যত আবিষ্কার সব তো বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে থাকে। তাঁর এই ইঙ্গিত সত্ত্বেও আমরা দুই ভাইয়ের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। এ নিয়ে তাঁর কোনো মনোবেদনা ছিল কি না তা তিনি অবশ্য বলেননি। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র সংকট চলছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রদান পর্যন্ত স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সুনাম অর্জন করে আসছে। আজ তাঁদের কী সংকট দেখা দিল তা জানি না। তবে অত্যন্ত হতাশ হতে হয় এ জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানচর্চা যে প্রতিষ্ঠানের মূল আদর্শ অর্থাৎ বাস্তববাদী তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে পারে না। উপাচার্যের উচিত তাঁর পদত্যাগে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে তাহলে তাঁর সে পদ ছেড়ে চলে যাওয়া। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সুনাম অর্জন কি কোনো নির্বাহী পদ আঁকড়ে ধরলেই বাড়বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু উপাচার্য আসছেন-যাচ্ছেন, কজনই তাঁদের নাম মনে রাখবেন। কিন্তু ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজি মোতাহার হোসেন কিংবা ঐতিহাসিক ড. হালিম কিংবা ড. হাবিবুল্লাহ- এঁদের নাম কি সুশীল সমাজ কোনো দিন ভুলতে পারবে? অবশ্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের অবস্থান ভিন্ন। বর্তমানে বুদ্ধিজীবী সমাজে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের নাম কি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন না। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মোস্তফা নুরুল ইসলামের খ্যাতির কথা কি নতুন করে বলার প্রয়োজন আছে? তাঁদের জ্ঞানচর্চা এবং জ্ঞানপিপাসা উচ্ছাসনে আসীন করেছে। কোনো নির্বাহী পদ এ মর্যাদা দিতে পারে না। অবশ্য কেউ যদি ভোগবিলাসী হয়ে থাকেন তাহলে আলাদা কথা। ইংরেজ নাট্যকার মার্লোর নাটকে পড়েছিলাম যে অসীম পণ্ডিত ড. ফস্টাস সীমিত সময়ের ভোগবিলাসের উদ্দেশ্যে মেফিস্টোফিলিসের কাছে আত্মা বন্ধক রেখেছিলেন চিরদিনের জন্য, যা কিনা অনন্তকাল ধরে নিগৃহীত ও নির্যাতিত হবে। আমাদের দেশে ড. ফস্টাসের সংখ্যা বাড়ছে নাকি? প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন চাঙ্গা রাখার জন্য বাইরে থেকে সুস্বাদু খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে- এ রকম কথাও পত্রিকায় পড়েছি। উপাচার্যের কিছু ত্রুটি ছিল হয়তো, কিন্তু শিক্ষকরাই কেন আলোচনায় না বসে এ ধরনের হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, যাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং যাঁরা করছেন তাঁরা তো সবাই একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। তাহলে কেন তাঁরা একত্রে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না। অর্থাৎ তাঁরা প্রকৃত সত্য খুঁজে পাচ্ছেন না। তাহলে তাঁদের হৃদয়ে অনুসন্ধিৎসা কিংবা সত্যানুসন্ধান কাজ করছে না। এ অবস্থায় তাঁরা কতটা প্রকৃত জ্ঞানদান করতে পারবেন- এ রকম কোনো প্রশ্ন করলে সেটা কি অন্যায় হবে? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী উপাচার্য প্যানেল তৈরি করা হোক। এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কেননা, এটি গণতান্ত্রিক। কার্যকর করতে গিয়ে যদি কোনো সম্ভাব্য সমস্যা দেখা দেয় তাহলে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এটা কোন ধরনের আহ্লাদ যে এ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হোক। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত উপাচার্য কি নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের চেয়ে বেশি কাম্য নয়? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতির জন্য উপাচার্য এককভাবে দায়ী বললে অন্যায় হবে না। কেননা, তিনি একটি দলীয় সংগঠনের চাঁদা সংগ্রহের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে এ অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। আমরা জানি, প্রতিটি ছাত্র সংগঠন নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত- বিষয়টি তারা তাদের সঙ্গে রফা করতে পারত। পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা সংগ্রহ নিঃসন্দেহে প্রশংসীয় উদ্যোগ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চাঁদা সংগ্রহ করে যে অবস্থা চলে আসছে তাতে উপাচার্যের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে কী পদ্ধতিতে চাঁদা গ্রহণ করলে স্বচ্ছতা থাকবে, তা স্থির না হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী নিজেই অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে একটি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া চাঁদা গ্রহণ করেননি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ব্যয়ভার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় করা হয়। অর্থাৎ এটি জনগণের টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ব্যক্তিগতভাবে নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক মতবাদ পোষণ করতে পারেন এবং সংশ্লিষ্ট দলে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারেন। তবে ততটা সক্রিয় হওয়া উচিত নয়, যা তার প্রধান পেশা অর্থাৎ শিক্ষকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র কিংবা ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীগত স্বার্থে জড়িয়ে শিক্ষা প্রদানের মহৎ কাজকে যেন বাধাগ্রস্ত না করা হয়। দেশের মানুষ এটাই প্রত্যাশা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ট্রেড ইউনিয়ন স্টাইলে আন্দোলন শোভা পায় না। হৃদয় যত জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত হবে, ততই অবশ্য এ ধরনের মানসিকতা কমে আসবে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মুড়ির টিন মার্কা বাসে চড়ে চকবাজার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে আসতেন- এতে তাঁর মানসম্মান এতটুকু কমেনি। দলীয় রাজনীতি কিংবা ক্ষমতা ভোগের চোরাবালিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেন তলিয়ে না যান, সেটাই আমাদের কাম্য। কেননা, আমরাও তো জাতি হিসেবে অজ্ঞতার এবং অন্ধকারের চোরাবালিতে ডুবে যাব। তাঁরা আমাদের আলোকবর্তিকা, এটা তো অস্বীকার করতে পারব না।
লেখক : সাবেক ইপিসিএস
স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার ফলে প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। আমাদের জাতীয় সরকার দলমত-নির্বিশেষে কম-বেশি সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি করতে চেষ্টা করছে আর নিরক্ষরতা দূরীকরণ তো মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল্ড। এ কারণে পাকিস্তান আমলের মতো দীর্ঘমেয়াদি ছাত্র আন্দোলন করার প্রয়োজন হয় বা হবে বলে মনে হয় না। অবশ্য স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের জন্য ছাত্ররা এক হয়ে আন্দোলন করেছিল। সামনে এ রকম কোনো রাজনৈতিক সংকট আসবে কি না তা সময় বলে দেবে। দেশে গণতন্ত্র রয়েছে, প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচন হচ্ছে এবং সরকারও পরিবর্তন হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ধনুকভাঙা পণ করে ছাত্র আন্দোলন করার প্রয়োজন হয়তো হবে না। এ অবস্থায় একটা সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ থাকার কথা, শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে আজ এ পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। বর্তমান যুগের পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্যের কর্তব্যে শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি কি গৌণ? এ কথা মাথায় এলো ষাটের দশকের একটি ঘটনা মনে পড়ায়। অবাঙালি ড. মাহমুদ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর বড় ভাই ড. জাকির হোসেন ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সম্ভবত ড. জাকির হোসেনের ছেলে ভারতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অনুগত মোনায়েম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর খুব ইচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আসবেন। ড. মাহমুদ হোসেন জানিয়ে দিলেন যে ছাত্ররা তাঁকে পছন্দ করে না, সমস্যা দেখা দেবে। মোনায়েম খানের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চলে যান। সেখান থেকে পরে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে শিক্ষকতা করেছেন। ঢাকা থেকে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি বিদায় সংবর্ধনায় বলেছিলেন যে তিনি পুলিশ নন, শিক্ষক- ছাত্র পড়ানো তাঁর কাজ। আমার বাবা সরকারি চাকরিজীবী হলেও বহুবার আমাদের বলেছেন যে বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ আর কোনো পদ নেই। কেননা, তাঁরা সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অবস্থান করে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন। যত গবেষণা, যত আবিষ্কার সব তো বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে থাকে। তাঁর এই ইঙ্গিত সত্ত্বেও আমরা দুই ভাইয়ের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। এ নিয়ে তাঁর কোনো মনোবেদনা ছিল কি না তা তিনি অবশ্য বলেননি। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র সংকট চলছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রদান পর্যন্ত স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সুনাম অর্জন করে আসছে। আজ তাঁদের কী সংকট দেখা দিল তা জানি না। তবে অত্যন্ত হতাশ হতে হয় এ জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানচর্চা যে প্রতিষ্ঠানের মূল আদর্শ অর্থাৎ বাস্তববাদী তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে পারে না। উপাচার্যের উচিত তাঁর পদত্যাগে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে তাহলে তাঁর সে পদ ছেড়ে চলে যাওয়া। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সুনাম অর্জন কি কোনো নির্বাহী পদ আঁকড়ে ধরলেই বাড়বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু উপাচার্য আসছেন-যাচ্ছেন, কজনই তাঁদের নাম মনে রাখবেন। কিন্তু ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজি মোতাহার হোসেন কিংবা ঐতিহাসিক ড. হালিম কিংবা ড. হাবিবুল্লাহ- এঁদের নাম কি সুশীল সমাজ কোনো দিন ভুলতে পারবে? অবশ্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের অবস্থান ভিন্ন। বর্তমানে বুদ্ধিজীবী সমাজে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের নাম কি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন না। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মোস্তফা নুরুল ইসলামের খ্যাতির কথা কি নতুন করে বলার প্রয়োজন আছে? তাঁদের জ্ঞানচর্চা এবং জ্ঞানপিপাসা উচ্ছাসনে আসীন করেছে। কোনো নির্বাহী পদ এ মর্যাদা দিতে পারে না। অবশ্য কেউ যদি ভোগবিলাসী হয়ে থাকেন তাহলে আলাদা কথা। ইংরেজ নাট্যকার মার্লোর নাটকে পড়েছিলাম যে অসীম পণ্ডিত ড. ফস্টাস সীমিত সময়ের ভোগবিলাসের উদ্দেশ্যে মেফিস্টোফিলিসের কাছে আত্মা বন্ধক রেখেছিলেন চিরদিনের জন্য, যা কিনা অনন্তকাল ধরে নিগৃহীত ও নির্যাতিত হবে। আমাদের দেশে ড. ফস্টাসের সংখ্যা বাড়ছে নাকি? প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন চাঙ্গা রাখার জন্য বাইরে থেকে সুস্বাদু খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে- এ রকম কথাও পত্রিকায় পড়েছি। উপাচার্যের কিছু ত্রুটি ছিল হয়তো, কিন্তু শিক্ষকরাই কেন আলোচনায় না বসে এ ধরনের হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, যাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং যাঁরা করছেন তাঁরা তো সবাই একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। তাহলে কেন তাঁরা একত্রে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না। অর্থাৎ তাঁরা প্রকৃত সত্য খুঁজে পাচ্ছেন না। তাহলে তাঁদের হৃদয়ে অনুসন্ধিৎসা কিংবা সত্যানুসন্ধান কাজ করছে না। এ অবস্থায় তাঁরা কতটা প্রকৃত জ্ঞানদান করতে পারবেন- এ রকম কোনো প্রশ্ন করলে সেটা কি অন্যায় হবে? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী উপাচার্য প্যানেল তৈরি করা হোক। এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কেননা, এটি গণতান্ত্রিক। কার্যকর করতে গিয়ে যদি কোনো সম্ভাব্য সমস্যা দেখা দেয় তাহলে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এটা কোন ধরনের আহ্লাদ যে এ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হোক। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত উপাচার্য কি নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের চেয়ে বেশি কাম্য নয়? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতির জন্য উপাচার্য এককভাবে দায়ী বললে অন্যায় হবে না। কেননা, তিনি একটি দলীয় সংগঠনের চাঁদা সংগ্রহের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে এ অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। আমরা জানি, প্রতিটি ছাত্র সংগঠন নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত- বিষয়টি তারা তাদের সঙ্গে রফা করতে পারত। পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা সংগ্রহ নিঃসন্দেহে প্রশংসীয় উদ্যোগ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চাঁদা সংগ্রহ করে যে অবস্থা চলে আসছে তাতে উপাচার্যের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে কী পদ্ধতিতে চাঁদা গ্রহণ করলে স্বচ্ছতা থাকবে, তা স্থির না হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী নিজেই অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে একটি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া চাঁদা গ্রহণ করেননি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ব্যয়ভার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় করা হয়। অর্থাৎ এটি জনগণের টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ব্যক্তিগতভাবে নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক মতবাদ পোষণ করতে পারেন এবং সংশ্লিষ্ট দলে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারেন। তবে ততটা সক্রিয় হওয়া উচিত নয়, যা তার প্রধান পেশা অর্থাৎ শিক্ষকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র কিংবা ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীগত স্বার্থে জড়িয়ে শিক্ষা প্রদানের মহৎ কাজকে যেন বাধাগ্রস্ত না করা হয়। দেশের মানুষ এটাই প্রত্যাশা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ট্রেড ইউনিয়ন স্টাইলে আন্দোলন শোভা পায় না। হৃদয় যত জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত হবে, ততই অবশ্য এ ধরনের মানসিকতা কমে আসবে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মুড়ির টিন মার্কা বাসে চড়ে চকবাজার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে আসতেন- এতে তাঁর মানসম্মান এতটুকু কমেনি। দলীয় রাজনীতি কিংবা ক্ষমতা ভোগের চোরাবালিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেন তলিয়ে না যান, সেটাই আমাদের কাম্য। কেননা, আমরাও তো জাতি হিসেবে অজ্ঞতার এবং অন্ধকারের চোরাবালিতে ডুবে যাব। তাঁরা আমাদের আলোকবর্তিকা, এটা তো অস্বীকার করতে পারব না।
লেখক : সাবেক ইপিসিএস
No comments