স্মরণ-প্রিয় কণ্ঠ, প্রিয় মানুষ by এম ওবায়দুর রহমান
‘আমাদের স্টুডিওর ঘড়িতে এখন সময় দুপুর ১২টা বেজে ৩০ মিনিট হয়ে সাত সেকেন্ড। বাণিজ্যিক কার্যক্রম, বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা। শ্রোতাবন্ধুরা, আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে আজকের বিজ্ঞাপন তরঙ্গের অনুষ্ঠান ঘোষণা শুরু করছি আমি হেনা কবীর...’
প্রিয় পাঠক, যিনি দশকের পর দশক ধরে এমন সব কথামালার উচ্চারণে এ দেশের লাখো-কোটি বেতার শ্রোতাকে মুগ্ধ-মোহিত করে রেখেছিলেন, তিনি আমাদের সবার প্রিয় উপস্থাপনা শিল্পী হেনা কবীর, যাঁকে আমরা হারিয়েছি ২০১১ সালের এই দিনে। সারা জীবন নীরোগ, প্রাণোচ্ছল এই শিল্পী মানুষটি অকস্মাৎ হার মানলেন মরণব্যাধি ক্যানসারের কাছে। আমরা যারা ছিলাম বেতারঘোষক, তাঁর খুব কাছের মানুষ, কখনোই ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন তিনি। মৃত্যুর মাস কয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিকিৎসা করিয়ে ফিরেছিলেন হেনা কবীর। আবারও যোগ দিয়েছিলেন বেতারের অনুষ্ঠান ঘোষণায়। প্রিয় সহকর্মীকে কাছে পেয়ে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে বেতারঘোষকদের মধ্যে। কিন্তু গত বছরের ২৫ জুলাই তাঁর প্রিয় মাইক্রোফোন আর অগণন ভক্ত-অনুরাগীকে ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিলেন এ দেশের উপস্থাপনা শিল্পের অন্যতম পুরোধা-ব্যক্তিত্ব হেনা কবীর।
মিডিয়া জগতে হেনা কবীরের আত্মপ্রকাশ নাট্যশিল্পী হিসেবে। সময়টা ১৯৫৬ সাল। মা গান করতেন তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে। ছোট্ট হেনা মাঝেমধ্যেই মায়ের সঙ্গী হয়ে যেতেন নাজিমউদ্দিন রোডের বেতার ভবনে। সেখানেই একদিন ধরা পড়ে গেলেন নাট্যগুরু রণেন কুশারীর কাছে। আর যায় কোথায়? তখনই তিনি একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এ্যায় মেয়ে, এই সংলাপটুকুন অভিনয় করে শোনাও তো?’ কোনো রকম ভয়-ডর-জড়তার তোয়াক্কা না করে হেনা তাঁর সাবলীল ভঙ্গিতে নাটকের কঠিন সব সংলাপ আওড়াতে লাগলেন। কিছু দূর যেতেই রণেন কুশারী তাঁকে থামিয়ে দিয়ে চোখে-মুখে উচ্ছ্বাসের ভঙ্গি নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এ্যায় মেয়ে, তুমি পাস!’ সেই থেকে বেতারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলেন হেনা কবীর।
২৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৪। এ দেশের ইতিহাসে ঘটে গেল এক বিস্ময়কর ঘটনা। ঢাকার ডিআইটি ভবন থেকে শুরু হলো দেশের প্রথম টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার। ডাক পড়ল হেনা কবীরের। তাঁর সুললিত কণ্ঠের উদ্বোধনী ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশ টেলিভিশনের। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ বেতারের পাঁচ দশকের শ্রোতানন্দিত বাকিশল্পী এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ঘোষিকাকে রাষ্ট্রীয় এই প্রচারমাধ্যম দুটি তাঁর জীবদ্দশায় কিংবা মৃত্যুর পরও যোগ্য কোনো সম্মান দেয়নি।
শ্রদ্ধেয় হেনা কবীরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বেতারের জনপ্রিয় বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অধিবেশন-ঘোষক হিসেবে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর। মনে পড়ে, একজন নবীন ঘোষক হিসেবে আমাকে যখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো, সেই সময়টায় আমার বিস্ময়ের ঘোরই কাটতে চায়নি অনেকক্ষণ! এই সেই হেনা কবীর, যাঁর সমৃদ্ধ কণ্ঠ আর অনন্য উপস্থাপনাশৈলীতে মোহাবিষ্ট থেকেছি আমার কৈশোরের তারুণ্যের কটা বছর! কী সৌভাগ্য আমার, আজ আমিই কিনা সেই মহারথীর পাশে...একই মাইক্রোফোনে ‘প্রিয় শ্রোতা’ বলার অপেক্ষায়! ভাবলে এখনো কেমন জানি একটা সুখের পরশ হূদয়-মনকে নাড়া দিয়ে যায়!
হেনা কবীর শুধু অগণিত বেতার শ্রোতার প্রিয় উপস্থাপকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন নবীন-প্রবীণ সব ঘোষক ও সংবাদ পাঠকের প্রিয় মানুষ। গানের মানুষ তিনি ছিলেন না, কিন্তু আমৃত্যু গানকে ভালোবেসেছেন মনে-প্রাণে। তাই তো তাঁকে ঘিরে দেশের খ্যাতিমান প্রায় সব সংগীতশিল্পীর মিলনমেলা বসত তাঁর বাসায়। আমাদের সংগীতের মূলধারার চর্চা ও প্রচার-প্রসারের একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হেনা কবীর। তাঁর প্রাণের সংগঠন ‘সেতুবন্ধ’র ব্যানারে তিনি একক প্রচেষ্টায় আয়োজন করেছেন বেশ কটি সংগীত সম্মেলনের। পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের গুণী সংগীতশিল্পী এবং ওস্তাদদের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় এ দেশে তিনিই প্রথম আয়োজন করেন আন্তর্জাতিক সংগীত সম্মেলন। এ ক্ষেত্রে একাধিকবার আর্থিক ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেননি তিনি। শুদ্ধ সংগীতের এই আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে গিয়ে তিনি একবার ঢাকার অভিজাত এলাকায় অবস্থিত তাঁর একমাত্র বাড়িটি বন্ধক রেখেও অর্থ জোগাড় করেছিলেন। আমৃত্যু তিনি উপমহাদেশের গুণী সংগীতশিল্পী ও ওস্তাদদের মধ্যে একটি স্থায়ী সেতুবন্ধন রচনার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সংগীতশিল্পী না হয়েও সংগীতাঙ্গনে তাঁর এই অনন্য অবদানের কথা চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে দেশের শিল্পীসমাজ।
হেনা কবীরের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৭ মার্চ, ফরিদপুরের গোপালপুরে। সবাই জানে, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মতারিখ ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের হেনা আপুর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাই জীবদ্দশায় তিনি কখনোই তাঁর জন্মদিন ঘটা করে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেননি। তাঁর একজন প্রিয়ভাজন হিসেবে একবার শাহবাগ স্টুডিওতে খুব করে ধরেছিলাম জন্মদিন পালনের জন্য। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘জানো ওটা কার জন্মদিন? ওটা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, আমাদের জাতির পিতার জন্মদিন!’
দীর্ঘ দেড় দশকের অফুরান স্নেহ-ভালোবাসার আনুকূল্যেও তাঁকে জানাতে পারিনি জন্মদিনের শুভেচ্ছা-ভালোবাসা। তাই প্রথম প্রয়াণবার্ষিকীতে তাঁর অম্লান স্মৃতিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা, অনিশ্বেষ ভালোবাসা।
এম ওবায়দুর রহমান
নির্বাহী প্রযোজক ও সংবাদ উপস্থাপক, এটিএন বাংলা
মিডিয়া জগতে হেনা কবীরের আত্মপ্রকাশ নাট্যশিল্পী হিসেবে। সময়টা ১৯৫৬ সাল। মা গান করতেন তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে। ছোট্ট হেনা মাঝেমধ্যেই মায়ের সঙ্গী হয়ে যেতেন নাজিমউদ্দিন রোডের বেতার ভবনে। সেখানেই একদিন ধরা পড়ে গেলেন নাট্যগুরু রণেন কুশারীর কাছে। আর যায় কোথায়? তখনই তিনি একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এ্যায় মেয়ে, এই সংলাপটুকুন অভিনয় করে শোনাও তো?’ কোনো রকম ভয়-ডর-জড়তার তোয়াক্কা না করে হেনা তাঁর সাবলীল ভঙ্গিতে নাটকের কঠিন সব সংলাপ আওড়াতে লাগলেন। কিছু দূর যেতেই রণেন কুশারী তাঁকে থামিয়ে দিয়ে চোখে-মুখে উচ্ছ্বাসের ভঙ্গি নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এ্যায় মেয়ে, তুমি পাস!’ সেই থেকে বেতারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলেন হেনা কবীর।
২৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৪। এ দেশের ইতিহাসে ঘটে গেল এক বিস্ময়কর ঘটনা। ঢাকার ডিআইটি ভবন থেকে শুরু হলো দেশের প্রথম টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার। ডাক পড়ল হেনা কবীরের। তাঁর সুললিত কণ্ঠের উদ্বোধনী ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো বাংলাদেশ টেলিভিশনের। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ বেতারের পাঁচ দশকের শ্রোতানন্দিত বাকিশল্পী এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ঘোষিকাকে রাষ্ট্রীয় এই প্রচারমাধ্যম দুটি তাঁর জীবদ্দশায় কিংবা মৃত্যুর পরও যোগ্য কোনো সম্মান দেয়নি।
শ্রদ্ধেয় হেনা কবীরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বেতারের জনপ্রিয় বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অধিবেশন-ঘোষক হিসেবে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর। মনে পড়ে, একজন নবীন ঘোষক হিসেবে আমাকে যখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো, সেই সময়টায় আমার বিস্ময়ের ঘোরই কাটতে চায়নি অনেকক্ষণ! এই সেই হেনা কবীর, যাঁর সমৃদ্ধ কণ্ঠ আর অনন্য উপস্থাপনাশৈলীতে মোহাবিষ্ট থেকেছি আমার কৈশোরের তারুণ্যের কটা বছর! কী সৌভাগ্য আমার, আজ আমিই কিনা সেই মহারথীর পাশে...একই মাইক্রোফোনে ‘প্রিয় শ্রোতা’ বলার অপেক্ষায়! ভাবলে এখনো কেমন জানি একটা সুখের পরশ হূদয়-মনকে নাড়া দিয়ে যায়!
হেনা কবীর শুধু অগণিত বেতার শ্রোতার প্রিয় উপস্থাপকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন নবীন-প্রবীণ সব ঘোষক ও সংবাদ পাঠকের প্রিয় মানুষ। গানের মানুষ তিনি ছিলেন না, কিন্তু আমৃত্যু গানকে ভালোবেসেছেন মনে-প্রাণে। তাই তো তাঁকে ঘিরে দেশের খ্যাতিমান প্রায় সব সংগীতশিল্পীর মিলনমেলা বসত তাঁর বাসায়। আমাদের সংগীতের মূলধারার চর্চা ও প্রচার-প্রসারের একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হেনা কবীর। তাঁর প্রাণের সংগঠন ‘সেতুবন্ধ’র ব্যানারে তিনি একক প্রচেষ্টায় আয়োজন করেছেন বেশ কটি সংগীত সম্মেলনের। পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের গুণী সংগীতশিল্পী এবং ওস্তাদদের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় এ দেশে তিনিই প্রথম আয়োজন করেন আন্তর্জাতিক সংগীত সম্মেলন। এ ক্ষেত্রে একাধিকবার আর্থিক ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেননি তিনি। শুদ্ধ সংগীতের এই আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে গিয়ে তিনি একবার ঢাকার অভিজাত এলাকায় অবস্থিত তাঁর একমাত্র বাড়িটি বন্ধক রেখেও অর্থ জোগাড় করেছিলেন। আমৃত্যু তিনি উপমহাদেশের গুণী সংগীতশিল্পী ও ওস্তাদদের মধ্যে একটি স্থায়ী সেতুবন্ধন রচনার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সংগীতশিল্পী না হয়েও সংগীতাঙ্গনে তাঁর এই অনন্য অবদানের কথা চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে দেশের শিল্পীসমাজ।
হেনা কবীরের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৭ মার্চ, ফরিদপুরের গোপালপুরে। সবাই জানে, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মতারিখ ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের হেনা আপুর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাই জীবদ্দশায় তিনি কখনোই তাঁর জন্মদিন ঘটা করে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেননি। তাঁর একজন প্রিয়ভাজন হিসেবে একবার শাহবাগ স্টুডিওতে খুব করে ধরেছিলাম জন্মদিন পালনের জন্য। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘জানো ওটা কার জন্মদিন? ওটা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, আমাদের জাতির পিতার জন্মদিন!’
দীর্ঘ দেড় দশকের অফুরান স্নেহ-ভালোবাসার আনুকূল্যেও তাঁকে জানাতে পারিনি জন্মদিনের শুভেচ্ছা-ভালোবাসা। তাই প্রথম প্রয়াণবার্ষিকীতে তাঁর অম্লান স্মৃতিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা, অনিশ্বেষ ভালোবাসা।
এম ওবায়দুর রহমান
নির্বাহী প্রযোজক ও সংবাদ উপস্থাপক, এটিএন বাংলা
No comments