ডরেমনে শিশুর মন by সোহেল নওরোজ

তামজীদের বয়স ছয়। নার্সারিতে পড়ে। স্কুলে সে একেবারেই অনিয়মিত। বেশিরভাগ দিন ক্লাসে যেতে পারে না সকালে ঘুম না ভাঙায়। অনেক রাত অবধি জেগে থাকে। টেলিভিশন চ্যানেলে ডরেমন কার্টুন শেষ করে তবে ঘুমাতে যায়। বাবা-মা দু'জনেই চাকরিজীবী। সারাদিন অফিস করে বাসায় ফিরে তারা সন্তানকে হাসিখুশি দেখতে চায়।


তামজীদের কাছে টেলিভিশনের রিমোট চাইলেই সে অস্থির হয়ে ওঠে; বিপত্তি ঘটায়। টিভির রিমোট তাই তার দখলেই থাকে। তাছাড়া ডরেমন দেখতে না দিলে জিদ করে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও তার বাবা-মা বিষয়টি নিয়ে এখন যথেষ্ট চিন্তিত-উদ্বিগ্ন। সারাদিন টিভির সামনে থেকে তাকে উঠানো যায় না। যতক্ষণ ডরেমন চলে ততক্ষণ নিবিষ্ট মনে দেখে। কখনও নবিতা-ডরেমনের কাণ্ড দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে, কখনোবা উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে তার আচার-আচরণ ও ভাষাগত অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ডরেমনের অনুকরণে হিন্দিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। ক্ষেত্রবিশেষে কার্টুনের চরিত্র নবিতার মতো কৌশলে মিথ্যা বলছে।
শিশুদের কাছে দুধ-ভাতের চেয়ে স্বভাবতই চকোলেট-চিপস যেমন বেশি পছন্দনীয়, তেমনি অন্য যে কোনো অনুষ্ঠানের চেয়ে কার্টুন সিরিয়াল অধিক প্রিয়। তাই তো কার্টুন নেটওয়ার্ক, নিক, এনিম্যাক্স, হাঙ্গামা, ডিজনি প্রভৃতি চ্যানেলে প্রচারিত শিংচ্যান, বেনটেন কিংবা টম অ্যান্ড জেরি জনপ্রিয়তার বিচারে বড়দের অনেক জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের ওপরে থাকে। তবে আমাদের দেশের অধুনা শহুরে শিশুদের কাছে ডরেমন এখন এক ভয়ঙ্কর নেশায় পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি_ বাড়ির সবাই যখন ঘুমে বিভোর তখন সবচেয়ে ছোট সদস্যটি চুপিসারে রিমোট এনে ডরেমন কার্টুন দেখে। কেউ সজাগ হলে তৎক্ষণাৎ টেলিভিশন বন্ধ করে ঘুমের ভান করে। সবার ঘুমের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে পুনরায় টিভি চালু করে। ডরেমনের প্রতি এ আসক্তি এমনই তীব্র যে, তা শিশুর নৈতিক অধঃপতনের কারণ হয়ে উঠছে। সারাদিন দেখার পরও আরেকটু সময় দেখার আকাঙ্ক্ষায় তাকে ভান করতে হচ্ছে বা মিথ্যা বলতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে_ কী এমন আছে ডরেমন কার্টুনে, যার জন্য শিশুরা সবকিছু বাদ দিয়ে তাতে ডুবে থাকে?
ডরেমন কার্টুর্ন সিরিয়ালটি মূলত একটি জাপানিজ অ্যানিমেশন। যার প্রকৃত নাম ডরায়মন। জাপানিজ বাচ্চাদের মধ্যেও এটি অনেক জনপ্রিয়। আমাদের শিশুরা যেটি দেখে, তা ডরায়মনের হিন্দি সংস্করণ। বাচ্চাদের ডরেমনে আসক্ত হওয়ার পেছনে মূল চরিত্রের দুঃসাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত কার্যক্রম, ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা ইত্যাদি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ডরেমনের জায়গায় নিজেদের কল্পনা করে উত্তেজিত ও শিহরিত হয়। বাচ্চারা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় যে অনুষ্ঠান দেখে, সেসব অনুষ্ঠানের চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিভিন্ন ধরনের আবেগীয় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। তার প্রকাশ ঘটে তাদের আচরণে। তেমনিভাবে নিছক বিনোদনের খাতিরে কার্টুনে আসক্তি শিশুর মনোজগৎ তথা মানসিক বিকাশকে প্রভাবিত করছে। ক্ষেত্রবিশেষে নৈতিক সংকট তৈরি করছে। আমরা জানি, শিশুদের মন যে কোনো বার্তা সহজে গ্রহণ করতে পারে। ধারাবাহিকভাবে দেখা ও শোনার ফলে নিজের অজান্তেই তারা হিন্দি ভাষায় দক্ষ হয়ে এ ভাষা ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। ইংরেজি বা হিন্দির আগে নিজের মাতৃভাষাটাকে ভালোভাবে জানছে বা শিখছে না। দিন যত যাচ্ছে, আকাশ সংস্কৃতির বিস্তার ও ভারতীয় চ্যানেলের আধিপত্যে সৃষ্ট হিন্দি ভাষা শেখার অনুকূল পরিবেশ বাংলা ভাষাকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছে। অথচ পরিবার, পারিপাশর্ি্বকের পাশাপাশি শিশুর শুদ্ধ বা প্রমিত বাংলা শেখার অন্যতম মাধ্যম হতে পারে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া।
শিশুর এ ডরেমন-জ্বরে আমাদের করণীয় কী? আমরা কি খেলার ছলে সন্তানকে ঠেলে দেব ডরেমনের দুনিয়াতে, যেখান থেকে শিশু ঝরঝরে হিন্দিতে কথা বলার ক্ষমতা আয়ত্ত করবে; আর প্রমিত বাংলা শুনে বিরক্তির সঙ্গে ভ্রু কুঁচকাবে? বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে আমাদের ভাবনার অন্ত নেই। সেমিনার, টক শোতে প্রায়ই বিষয়টি আলোচিত হয়। বিকৃত এবং আঞ্চলিক কথ্য ভাষার অযাচিত ব্যবহারের ওপর হাইকোর্টের বিধিনিষেধও আরোপিত হয়েছে। অথচ পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যটির হিন্দিপ্রীতি দেখে একটুও শঙ্কিত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব না? ভাষাগত আগ্রাসন ঠেকাতে এবং শিশুর নৈতিক বিকাশে পরিবারকে মনোযোগী হতে হবে। সরকারকেও নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। আকাশ সংস্কৃতির প্রসারতায় কতিপয় ভারতীয় চ্যানেল পরিবর্তন এনেছে বিনোদনে; আঘাত হেনেছে আমাদের ভাষার ওপর। এসব চ্যানেলে প্রচারিত হিন্দি সিরিয়ালের দর্শকদের বড় একটা অংশ আমাদের দেশের। পরিবারের বড়দের দেখে শিশুরা যেন হিন্দি শেখায় কোনোভাবে উৎসাহ না পায়। কেবল স্যাটেলাইটভিত্তিক বিনোদন-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসাটাও জরুরি হয়ে পড়েছে। বিনোদনের বিকল্প উৎস, বিশেষ করে যেখানে শিশুর সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ থাকে; শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়ক হয় এমন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সন্তান টেলিভিশন দেখলে তার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। পরিশেষে সরকারের কাছে আবেদন, সাংস্কৃতিক লেনদেনের মানে যদি হয় আমরা অন্যেরটা দেখব, শিখব, গ্রহণ করব আর তারা আমাদেরটা ছুঁয়েও দেখবে না_ তা কতটা অপরিহার্য ভেবে দেখবেন কি? যদি একান্তই ভারতীয় হিন্দি চ্যানেলগুলো আমাদের দেশে চালাতে হয়, তবে ডরেমনের মতো অনুষ্ঠানগুলো বাংলায় ভাষান্তর করে সম্প্রচারে বাধ্য করুন, যেন অন্য কোনো ভাষা বা সংস্কৃতির প্রতাপে শিশুদের মাতৃভাষাপ্রীতি ও চর্চার জায়গাটা দুর্বল ও ভোঁতা হয়ে না পড়ে।

সোহেল নওরোজ :বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আইএপিপি, সেচ ভবন, ঢাকা
snawroz.bau@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.