বিশ্বকাপ ক্রিকেট-শান্তি ও সৌহার্দ্যের সোপান by আবু সাঈদ খান

বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ক্ষেত্রে বড় সংযোজন শান্তি ও কূটনীতি। এ অঞ্চলে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে কমবেশি সমস্যা আছে। তবে আঞ্চলিক সংহতির জন্য বড় হুমকি হচ্ছে পাক-ভারত সম্পর্কের জটিলতা। বহুদিন ধরে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দুটি পরস্পরের প্রতি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। একে অন্যের সঙ্গে একাধিকবার সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণও হয়েছে।


এ ক্ষেত্রে কূটনীতি যা পারেনি, ক্রিকেট সেই অসাধ্য সাধন করেছে। মুম্বাই সন্ত্রাসের কারণে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়েছিল, ক্রিকেট তা ঘুচিয়ে দিল। খুলে দিল বল্পুব্দত্বের দ্বার। ক্রিকেটের এই প্রাপ্তি অনেক বড়



বাণিজ্য-অর্থনীতি, কূটনীতি আর রাজনীতিতে ভারতের যখন জয়জয়কার, চীনের পাশে উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে দেশটির নাম যখন সর্বত্র উচ্চারিত, তখন ক্রিকেটের মহারণে ভারত পেল এক অবিস্মরণীয় বিজয়। 'শাইনিং ইন্ডিয়া', 'রাইজিং ইন্ডিয়া' বা 'ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া'র বাহারি তকমার পাশে ভারত এখন ক্রিকেটেও পরাশক্তি। ২৮ বছর আগে লর্ডসের মাঠে ক্রিকেটার কপিল দেবের হাত ধরে ভারত পেয়েছিল বিশ্বকাপ ট্রফি। তারপর থেকে ১২০ কোটি মানুষের দেশ ভারত বারবার প্রত্যাশা জাগিয়েও বিশ্ব ক্রিকেট-যুদ্ধ থেকে শূন্য হাতে ফিরেছে। এবার নিজভূমে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ধোনি-টেন্ডুলকারের ভারত নতুন ইতিহাস গড়ল।
খেলার ফল বলছে, ক্রিকেট-নৈপুণ্যে ভারতই শ্রেষ্ঠ। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রীলংকাকেও খাটো করে দেখবার জো নেই। শুধু শ্রীলংকা নয়_ অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড কেউ কারও চেয়ে কম নয়। অতীতে দলগুলো ভালো খেলেছে, জয়ও পেয়েছে কমবেশি। কিন্তু বিশ্বকাপের জটিল হিসাব-নিকাশের যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত যে জয়ী তাকে সেরা মানতে হবে। ভারত কী কী নৈপুণ্যে জিতল আর শ্রীলংকা কেন হারল_ সেটির পোস্টমর্টেম ক্রিকেটবোদ্ধারা করছেন। আমি বরং ভিন্নতর প্রসঙ্গে যাই।
ক্রিকেট আজ আর নিছক খেলার মধ্যে নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাণিজ্য, কূটনীতি_ চূড়ান্ত বিচারে রাজনীতিও। শুধু তাই নয়, ক্রিকেট নিয়ে বাজিকরদের তৎপরতাও এখন আলোচিত বিষয়। বাজির ছক বাস্তবায়নে নাকি খেলোয়াড়দের মাথা কেনা হয়। কৃতী খেলোয়াড়রা অদৃশ্য সুতার টানে হাত গুটিয়ে নেন। স্বেচ্ছায় আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন। নীতিনৈতিকতা-যশখ্যাতির বিনিময়ে লাভ করেন মোটা অঙ্কের টাকা। এ এক কলঙ্কিত অধ্যায়। তবে এবার বিশ্বকাপে এমন কলঙ্কের সঙ্গে কারও জড়ানোর কাহিনী শুনিনি। তবে বড় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। জাঁদরেল খেলোয়াড়ও যে কোনো সময় ধরাশায়ী হতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে কাউকে অমূলকভাবে সন্দেহ করা হলে সেটি তার বা দলের জন্য চরম দুর্ভাগ্য বয়ে আনতে পারে।
সে যাই হোক, প্রতিবেশী ভারতের বিজয়ে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। তবে অস্বীকার করব না, খেলা চলাকালে আমি শ্রীলংকানদের পক্ষাবলম্বন করেছিলাম। সমর্থনের পেছনে মুরালিধরন-জয়াবর্ধনে-মালিঙ্গাদের ক্রীড়ানৈপুণ্য তো ছিলই, সে সঙ্গে ভিন্ন মনস্তত্ত্বও কাজ করতে পারে। আসলে খেলাকে কেবল বিনোদন হিসেবে কি দেখা সম্ভব? এর সঙ্গে দেশপ্রেম, অঞ্চলপ্রেমসহ অনেক কিছুই এসে যায়। আমার দল বাংলাদেশ। এ দল ভালো-খারাপ যা-ই খেলুক, কোনো দলকে এ দলের ওপরে স্থান দেওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ দলের সীমাবদ্ধতা অজানা নয়। তারপরও এবারের বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় অনেকেই আকাশ-কুসুম কল্পনা করেছেন। আমি ভেবেছি, এমনকি হতে পারে না যে, বিশ্বকাপ ট্রফি সাকিব বাহিনীর হাতে এলো! আসেনি, তবু বলব, আমাদের ছেলেরা ইংল্যান্ডসহ তিনটি শক্তিশালী দলকে পরাজিত করেছে। সাহস, উদ্যম আর চর্চার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পারলে সুদূর ভবিষ্যতে বিশ্বকাপ আমাদের অধরা রইবে না। এবারের বিশ্বকাপ যুদ্ধে কেবল ভারত নয়, সমগ্র উপমহাদেশই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। বিশ্বকাপ আয়োজনটি হয়েছে এখানে। কোনো অঘটন, মনোমালিন্য, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ছাড়াই সুন্দর-সুচারুরূপে আয়োজনটি সম্পন্ন হলো। এ কৃতিত্ব বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলংকার।
সকলেই জানেন, ক্রিকেটের সূতিকাগার ইউরোপ। সাহেবদের শীতকালীন এ অভিজাত খেলা ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছে ঔপনিবেশিক শাসকের হাত ধরে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় মনে হচ্ছে, ক্রিকেটই যেন উপমহাদেশের নিজস্ব খেলা। এখানে ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের যে জনপ্রিয়তা, মিডিয়ায় তাদের নিয়ে যে উচ্ছ্বাস তা বোধহয় ইউরোপে এখন আর দেখা যাবে না। এবারের বিশ্বকাপে উপমহাদেশের দলগুলো ইউরোপীয় দলগুলোকে আগেভাগেই বিদায় করেছে। সেমিফাইনাল-ফাইনালে প্রাধান্য বিস্তার করেছে পাকিস্তান-শ্রীলংকা-ভারত। এ প্রসঙ্গে মুম্বাইয়ের 'লগান' ছবিটির কথা মনে পড়বে অনেকেরই। ছবিটি তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ ভারতে স্থানীয় জনগণের গড়া টিমের কাছে ব্রিটিশ টিমের পরাজয়ের এক অনবদ্য কাহিনীকে ঘিরে। এবারের বিশ্বকাপ যুদ্ধে উপমহাদেশের দলগুলোর কাছে ইউরোপীয় ও অন্যান্য দলের একের পর এক ধরাশায়ী হওয়া, সেই সিনেমাটিক কল্প-কাহিনীকে সত্য করে তুলল। লগানের ঘটনাটি কাল্পনিক হলেও এর সঙ্গে সত্যের ছোঁয়া নেই_ তা নয়। ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজদের ক্রিকেট টিমগুলোর স্থানীয় জনগণের টিমের কাছে পরাজিত হওয়ার ঘটনা কোনো কোনো সময়ই ঘটত। এমন একটি ঘটনার উল্লেখ শৈশবে শুনেছি, নৌবন্দর গোয়ালন্দে 'আর এস অ্যান্ড এন কোম্পানি'র ইংরেজ কর্মচারীরা ফরিদপুরে ক্রিকেট খেলত। তাদের দেখাদেখি স্থানীয় যুবকরাও ক্রিকেট খেলতে শুরু করে। কোনো এক বড়দিনে ইংরেজ ও স্থানীয় টিমের মধ্যে খেলা হয়েছিল। এতে ইংরেজ টিম পরাজিত হয়ে নীরবে মাঠ ছেড়েছিল। এটি ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্থানীয় অধিবাসীদের মর্যাদার লড়াই। যাদের কাছে দিনের পর দিন শাসিত-শোষিত-লাঞ্ছিত-অপমানিত হচ্ছিল, তাদের পরাজিত করার পেছনে যে উদ্যম কাজ করেছে, সেটি ছিল সে সময়ে অঙ্কুরিত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাকার।
খেলার সঙ্গে সেদিন রাজনীতির যোগ ঘটেছিল। উত্তরকালে সে মানসিকতা আমরা সচেতন বা অবচেতনভাবে বহন করি। তাই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে ইংল্যান্ডের পরাজয়ে অধিকতর উল্লসিত বোধ করি। রাজনৈতিক কারণেই পাকিস্তানের খেলায় মুগ্ধ হয়েও তাদের সমর্থন করতে পারি না। দেশে পাকিস্তান টিমের সমর্থক কম নেই। তাদের দেশপ্রেমকে কটাক্ষ করব না। কিন্তু যারা পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে লড়েছে, মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছে_ তাদের পক্ষে পাকিস্তান টিমকে সমর্থন করা কি সম্ভব? একাত্তর এবং এর আগে-পরে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ কোনো অপরাধ করেনি। অপরাধ করেছিল সামরিক জান্তা, শাসকগোষ্ঠী। তবু খেলার মাঠের নির্মল আনন্দের মধ্যে এসে ইতিহাস মনের অজান্তেই উঁকি দেয়। তাই ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে খেলা হলে ভারতকেই সমর্থন করি।
এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ক্ষেত্রে বড় সংযোজন শান্তি ও কূটনীতি। এ অঞ্চলে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে কমবেশি সমস্যা আছে। তবে আঞ্চলিক সংহতির জন্য বড় হুমকি হচ্ছে পাক-ভারত সম্পর্কের জটিলতা। বহুদিন ধরে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দুটি পরস্পরের প্রতি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। একে অন্যের সঙ্গে একাধিকবার সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণও হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কূটনীতি যা পারেনি, ক্রিকেট সেই অসাধ্য সাধন করেছে।
অতীতেও দু'দেশের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়েছে ক্রিকেট। ১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধীর আমন্ত্রণে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক পাক-ভারত টেস্ট দেখতে জয়পুরের সোয়াই মানসিংহ স্টেডিয়ামে এসেছিলেন এবং ২০০৫ সালে ফিরোজ শাহ কোটলায় প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ এসেছিলেন। শীতল সম্পর্কের বরফ খানিকটা গলেছিল। আর এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমন্ত্রণে মোহালিতে খেলা উপভোগ করলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি। দুই প্রধানমন্ত্রী পাশাপাশি বসে খেলা দেখেছেন, কথা বলেছেন, লাঞ্চ-ডিনারে মিলেছেন। পাশাপাশি সচিব পর্যায়ের বৈঠকও হয়েছে।
মনমোহনের আমন্ত্রণের পর করাচির কারাগারে ২৭ বছর ধরে আটক এক বন্দিকে ক্ষমা করে ভারতে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন গিলানি। পাকসেনাদের জন্য শিখ গুরুদ্বারের জায়গা অধিগ্রহণের যে সিদ্ধান্ত ছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। আর গিলানি মোহালিতে পেঁৗছার আগেই ভারতের জেল থেকে ২৯ পাকিস্তানি নাগরিককে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মুম্বাই সন্ত্রাসের কারণে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়েছিল, ক্রিকেট তা ঘুচিয়ে দিল। খুলে দিল বল্পুব্দত্বের দ্বার। ক্রিকেটের এই প্রাপ্তি অনেক বড়।
সার্ক গঠনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সংহতি ও সহযোগিতার যে প্রচেষ্টা চলছে, তা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রিকেট অমোঘ শক্তি। খেলা শেষে আমি অপেক্ষায় থাকি সেই দৃশ্য দেখার জন্য_ যখন বিজয়ী দলের খেলোয়াড়রা সর্বাগ্রে বিজিত দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলান। আর বিজিতরাও বিজয়ীদের করেন অভিনন্দিত।
তখন আমার মনে হয়, ওরা ওদের খেলোয়াড় পরিচয়কেই ঊধর্ে্ব তুলে ধরছেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ওরা খেলোয়াড়, ওরা শান্তির দূত। মানুষে মানুষে সৃষ্ট বিভেদ রেখা মুছে দিয়ে তারা দেশ-দেশান্তরে ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। সেই নৈপুণ্য দেখতে দেখতে আমরা দেশপ্রেমিক হয়ে উঠি। বাংলাদেশের খেলাকে সামনে রেখে দল-গোত্রে বিভক্তির চিহ্ন মুছে ফেলে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা যে ঐক্য প্রদর্শন করি, তা অন্য কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় না। একইভাবে খেলা দেখতে দেখতে আমরা দেশ-জাতির ভেদরেখার ঊধর্ে্ব উঠে বিশ্ব নাগরিকে পরিণত হই। দেশপ্রেম ও বিশ্ব নাগরিকতাবোধ সৃষ্টিতে খেলার চেয়ে বড় মাধ্যম আর নেই।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.