কালের পুরাণ-ধাপ্পাবাজি! by সোহরাব হাসান
গেল শনিবার প্রথম আলো-ট্রাস্ট ব্যাংক রাজউক কলেজ আয়োজিত বিতর্কের সমাপনী অনুষ্ঠানটি ছিল খুব প্রাণবন্ত ও উত্তেজনাপূর্ণ। ইংরেজি মাধ্যমের বিতর্কের বিষয় ছিল, ‘ইসরায়েলকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত’ আর বাংলা মাধ্যমের বিতর্কের বিষয় ছিল ‘১/১১ বারবার ফিরে আসে’।
প্রথমেই বলে রাখছি, আলোচনাটি রাজনৈতিক নয়, একাডেমিক বা তাত্ত্বিক। বিতর্কে অংশগ্রহণকারী সব বিতার্কিকই প্রস্তাবের পক্ষে ও বিপক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন। ঘণ্টা খানেকের এই বিতর্কে কারও প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ বা বিদ্বেষ ছিল না। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ‘দেশদ্রোহী’, ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ কিংবা ‘ভারতের দালাল’ বলেও গাল দেয়নি। বরং তারা প্রতিপক্ষের বক্তব্য খণ্ডন করেছে শাণিত যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত পেশের মধ্য দিয়ে।
ঢাকা শহরের ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিতার্কিকেরা এই আয়োজনে অংশ নেন এবং সেরাদের মধ্যে সেরারাই চূড়ান্ত পর্বে আসার সুযোগ পান। যেহেতু এটি নিছক একাডেমিক আলোচনা, সেহেতু বিতর্কের বিষয় নিয়ে আমাদের বক্তব্য নেই। কিন্তু ১/১১ বারবার ফিরে আসে প্রস্তাবের বিপক্ষে যে তিন চৌকস বিতার্কিক অংশ নেন, তাঁদের যুক্তিটি পাঠকের কাছে তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। বিতার্কিকদের মূল কথা ছিল, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন, তারা কেউ-ই চাইবে না ১/১১ ফিরে আসুক। কেননা, ১/১১-পরবর্তী দুই বছরের শাসন দুই দলকেই নানাভাবে হেনস্তা করেছে, নেতা-নেত্রীদের জেলে পুরেছে। অন্তত সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা মনে রেখে তাদের একটি সমঝোতায় আসা উচিত। দুই দলই যদি ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে ওঠে, তাহলেও ১/১১-এর ফিরে আসাটা তাদের কাম্য হতে পারে না।
১/১১-এর অর্থ হলো, রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে রাজনীতিকদের বিদায়। ১/১১-এর অর্থ হলো, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ছিন্ন হওয়া।
বিতর্ক অনুষ্ঠানে তরুণ বিতার্কিকদের বক্তব্য শুনতে শুনতে মনে হলো, একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা যেই সত্যটি উপলব্ধি করছেন, সেই সত্যটি কেন আমাদের বিজ্ঞ নেতা-নেত্রীরা উপলব্ধি করতে পারছেন না? রাজনীতিকেরা জনগণের ভালো না চাইতে পারেন, নিজেদের ভালো নিশ্চয়ই চাইবেন।
রাজনীতি ও রাজনীতিকেরা যত খারাপই হোন, বিরাজনীতিকরণ তার প্রতিকার হতে পারে না। মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটা নয়, বরং ব্যাধির প্রতিষেধক খুঁজে বের করতে হবে। সৎ ও যোগ্য লোকদের রাজনীতিতে নিয়ে আসতে হবে। গায়ের জোরে সবকিছু করার চিন্তা বাদ দিয়ে যুক্তির পথে এগোতে হবে।
২.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সপ্তাহে বাংলাদেশ কৃষক লীগের সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বিএনপি বলেছে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা দুটি পদ্মা সেতু করবে। যেখানে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে একটি সেতুও তারা বানাতে পারেনি, সেখানে দুটি পদ্মা সেতু বানাবে কীভাবে? ভাঁওতাবাজি আর ধোঁকাবাজির একটি সীমা আছে।’ সেই অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আরও বলেছেন,‘ বিশ্বের অন্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের মতোই এ দেশের নির্বাচনও হবে। গণতন্ত্র যাতে অব্যাহত থাকে, সেই চেষ্টাই সরকার করবে।’ (সমকাল, ২০ জুলাই ২০১২)
প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্যে দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। এক. বিএনপির নেতাদের দুটি পদ্মা সেতু করার ঘোষণা ধোঁকাবাজি। দুই. অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে।
আমরা পদ্মা সেতু নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য আলোচনা করলে দেখতে পাব, গত দুই-তিন সপ্তাহে তাঁরা দেশে শত শত প্রস্তাব এনেছেন, হাজার হাজার কোটি টাকার সংস্থান করে ফেলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বিএনপির নেতাদের বক্তব্যকে ধোঁকাবাজি বলে উল্লেখ করেছেন। ধোঁকা শব্দের আভিধানিক অর্থ ধাপ্পা, প্রবঞ্চনা। কথা দিয়ে কথা না রাখা। অর্থাৎ প্রতারণা করা।
প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের যেসব অভিযোগ এনেছেন, এর অনেকটাই কি তাঁর সরকারের জন্যও প্রযোজ্য নয়? দায়িত্ব নেওয়ার পর সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিলেন, এই সরকারের আমলে পদ্মা সেতুর কাজ শুধু শুরুই হবে না, কাজ শেষ করে তা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। কিন্তু সরকারের তিন বছর সাড়ে সাত মাস পর এসে দেখা গেল, সেতু কীভাবে করা হবে, কার অর্থে হবে—সেই বিতর্কে গোটা দেশ তোলপাড়।
এই মহাবিতর্কের জন্য মহাজোট সরকার, বিশেষ করে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন বৈকি। কয়েক দিন আগে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু কাজটি গত ২৯ জুনের আগে করলে হয়তো বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল হতো না। শেখ হাসিনার সরকারকেও আর পদ্মা সেতু না করতে পারার দায় বয়ে বেড়াতে হতো না।
এখন সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, ‘বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করেছে তো কী হয়েছে, নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। আর বিরোধী দল বলছে, “সরকার সেতুর নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। তারা কখনোই পদ্মা সেতু করতে পারবে না। আমরা ক্ষমতায় এলে দুটি পদ্মা সেতু করব।”’
আসলে পদ্মা সেতু নিয়ে দুই দলই রাজনীতি করছে। সেতু নির্মাণে যত বিলম্ব হবে, তাদের গলার স্বর সপ্তমে চড়বে। অথচ পদ্মা সেতু তো রাজনীতির বিষয় নয়, একেবারেই অর্থনীতির হিসাবনিকাশ। কাজটি কোন সরকার শুরু করল বা শেষ করল, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেতুটি হওয়া।
যমুনা সেতুর কাজ শুরু হয়েছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। এ জন্য তিনি জনগণের ওপর সারচার্জ আরোপ করেছিলেন। পরে সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ খালেদা জিয়ার আমলে শুরু হলেও তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। খালেদা জিয়ার অসমাপ্ত কাজ শেখ হাসিনার সরকার এসে সমাপ্ত করে। যমুনা সেতুর কৃতিত্ব তিন সরকারকেই দিতে হবে।
তাই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেখ হাসিনার সরকার শুরু করে বিএনপির নেতাদের সমস্যাটা কোথায়?
পদ্মা সেতু নিয়ে চলছে এখন ধাপ্পাধাপ্পির রাজনীতি।
বিএনপি মনে করছে, সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলে জনগণকে ধাপ্পা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ ভাবছে, বিএনপি দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলে জনগণকে ধাপ্পা দিচ্ছে। এই বাহাসে ৪১ বছর কেটে গেল। কেউ কথা রাখেনি। ভবিষ্যতে রাখবে, সেই সম্ভাবনাও কম।
৩.
এবার আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের দ্বিতীয় দিকটি নিয়ে আলোচনা করব। তিনি বলেছেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবে হবে। এর মাধ্যমে তিনি বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাকচ করে দিতে চাইছেন। হতে পারে সেটি আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের রাজনৈতিক অবস্থান। সরকার যদি দেশবাসীকে তাদের বক্তব্য বোঝাতে পারে, তাহলে তাদের পছন্দসই সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে।
আর বিরোধী দল যদি জনমত তাদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ দিয়েছেন, তখন সবিনয়ে তাঁকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কি একটি সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় আরেকটি সংসদ নির্বাচন হয়? পঞ্চদশ সংশোধনীতে তাঁরা এই আত্মঘাতী ও সর্বনাশা বিধান আপনারা কীভাবে রাখলেন? পঞ্চদশ সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে।’ সাংসদেরা পদত্যাগ করবেন না। সংসদও বহাল থাকবে।
যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নিই, নির্বাচন কমিশন সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের যেকোনো তারিখে নির্বাচন করে ফেলল (হতে পারে সেটি মেয়াদ শেষের ১০ দিন বা ৮৯ দিন থাকতে)। তখন কি একই দেশে দুই সেট সংসদ সদস্য থাকবেন না? আপনারা যেহেতু সংসদ ভেঙে দেননি, সেহেতু মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন পর্যন্ত তাঁরা সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকবেন। আবার যাঁরা নতুন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন, তাঁরাও শপথ নিয়ে সংসদে বসার যোগ্য হবেন।
তাহলে জিজ্ঞাসা, একই সময়ে দেশে কয়টি সংসদ কার্যকর থাকবে? কতজন সংসদ সদস্য থাকবেন। যদি বর্তমান সংসদের কোনো সদস্য পরবর্তী নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন না পান বা তাঁর স্থলে অন্য কেউ নির্বাচিত হন, তখন সেই সংসদীয় এলাকায় কজন সাংসদ প্রতিনিধিত্ব করবেন?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যদি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের নীতি মানেন ও পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তাহলে আপনাকে সংসদ ভেঙে দিয়েই নির্বাচন করতে হবে। একটি সংসদ বহাল রেখে যেমন আরেকটি সংসদ গঠন করা যায় না, তেমনি একটি সংসদীয় এলাকার প্রতিনিধি থাকা অবস্থায়ও আরেকজন প্রতিনিধি নির্বাচিত করা যাবে না।
সরকারি দলে এত বিজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তি থাকতেও পঞ্চদশ সংশোধনীতে এ রকম একটি বেআইনি ধারা কী করে সন্নিবেশিত হলো?
ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে শুনেছি, কিন্তু জ্ঞানশূন্য করার কথা শুনিনি। মহাজোট নেতারা কি রাজনীতির সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
ঢাকা শহরের ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিতার্কিকেরা এই আয়োজনে অংশ নেন এবং সেরাদের মধ্যে সেরারাই চূড়ান্ত পর্বে আসার সুযোগ পান। যেহেতু এটি নিছক একাডেমিক আলোচনা, সেহেতু বিতর্কের বিষয় নিয়ে আমাদের বক্তব্য নেই। কিন্তু ১/১১ বারবার ফিরে আসে প্রস্তাবের বিপক্ষে যে তিন চৌকস বিতার্কিক অংশ নেন, তাঁদের যুক্তিটি পাঠকের কাছে তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। বিতার্কিকদের মূল কথা ছিল, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন, তারা কেউ-ই চাইবে না ১/১১ ফিরে আসুক। কেননা, ১/১১-পরবর্তী দুই বছরের শাসন দুই দলকেই নানাভাবে হেনস্তা করেছে, নেতা-নেত্রীদের জেলে পুরেছে। অন্তত সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা মনে রেখে তাদের একটি সমঝোতায় আসা উচিত। দুই দলই যদি ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে ওঠে, তাহলেও ১/১১-এর ফিরে আসাটা তাদের কাম্য হতে পারে না।
১/১১-এর অর্থ হলো, রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে রাজনীতিকদের বিদায়। ১/১১-এর অর্থ হলো, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ছিন্ন হওয়া।
বিতর্ক অনুষ্ঠানে তরুণ বিতার্কিকদের বক্তব্য শুনতে শুনতে মনে হলো, একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা যেই সত্যটি উপলব্ধি করছেন, সেই সত্যটি কেন আমাদের বিজ্ঞ নেতা-নেত্রীরা উপলব্ধি করতে পারছেন না? রাজনীতিকেরা জনগণের ভালো না চাইতে পারেন, নিজেদের ভালো নিশ্চয়ই চাইবেন।
রাজনীতি ও রাজনীতিকেরা যত খারাপই হোন, বিরাজনীতিকরণ তার প্রতিকার হতে পারে না। মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটা নয়, বরং ব্যাধির প্রতিষেধক খুঁজে বের করতে হবে। সৎ ও যোগ্য লোকদের রাজনীতিতে নিয়ে আসতে হবে। গায়ের জোরে সবকিছু করার চিন্তা বাদ দিয়ে যুক্তির পথে এগোতে হবে।
২.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সপ্তাহে বাংলাদেশ কৃষক লীগের সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বিএনপি বলেছে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা দুটি পদ্মা সেতু করবে। যেখানে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে একটি সেতুও তারা বানাতে পারেনি, সেখানে দুটি পদ্মা সেতু বানাবে কীভাবে? ভাঁওতাবাজি আর ধোঁকাবাজির একটি সীমা আছে।’ সেই অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আরও বলেছেন,‘ বিশ্বের অন্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের মতোই এ দেশের নির্বাচনও হবে। গণতন্ত্র যাতে অব্যাহত থাকে, সেই চেষ্টাই সরকার করবে।’ (সমকাল, ২০ জুলাই ২০১২)
প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্যে দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। এক. বিএনপির নেতাদের দুটি পদ্মা সেতু করার ঘোষণা ধোঁকাবাজি। দুই. অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে।
আমরা পদ্মা সেতু নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য আলোচনা করলে দেখতে পাব, গত দুই-তিন সপ্তাহে তাঁরা দেশে শত শত প্রস্তাব এনেছেন, হাজার হাজার কোটি টাকার সংস্থান করে ফেলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বিএনপির নেতাদের বক্তব্যকে ধোঁকাবাজি বলে উল্লেখ করেছেন। ধোঁকা শব্দের আভিধানিক অর্থ ধাপ্পা, প্রবঞ্চনা। কথা দিয়ে কথা না রাখা। অর্থাৎ প্রতারণা করা।
প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের যেসব অভিযোগ এনেছেন, এর অনেকটাই কি তাঁর সরকারের জন্যও প্রযোজ্য নয়? দায়িত্ব নেওয়ার পর সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিলেন, এই সরকারের আমলে পদ্মা সেতুর কাজ শুধু শুরুই হবে না, কাজ শেষ করে তা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। কিন্তু সরকারের তিন বছর সাড়ে সাত মাস পর এসে দেখা গেল, সেতু কীভাবে করা হবে, কার অর্থে হবে—সেই বিতর্কে গোটা দেশ তোলপাড়।
এই মহাবিতর্কের জন্য মহাজোট সরকার, বিশেষ করে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন বৈকি। কয়েক দিন আগে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু কাজটি গত ২৯ জুনের আগে করলে হয়তো বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল হতো না। শেখ হাসিনার সরকারকেও আর পদ্মা সেতু না করতে পারার দায় বয়ে বেড়াতে হতো না।
এখন সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, ‘বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করেছে তো কী হয়েছে, নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। আর বিরোধী দল বলছে, “সরকার সেতুর নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। তারা কখনোই পদ্মা সেতু করতে পারবে না। আমরা ক্ষমতায় এলে দুটি পদ্মা সেতু করব।”’
আসলে পদ্মা সেতু নিয়ে দুই দলই রাজনীতি করছে। সেতু নির্মাণে যত বিলম্ব হবে, তাদের গলার স্বর সপ্তমে চড়বে। অথচ পদ্মা সেতু তো রাজনীতির বিষয় নয়, একেবারেই অর্থনীতির হিসাবনিকাশ। কাজটি কোন সরকার শুরু করল বা শেষ করল, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেতুটি হওয়া।
যমুনা সেতুর কাজ শুরু হয়েছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। এ জন্য তিনি জনগণের ওপর সারচার্জ আরোপ করেছিলেন। পরে সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ খালেদা জিয়ার আমলে শুরু হলেও তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। খালেদা জিয়ার অসমাপ্ত কাজ শেখ হাসিনার সরকার এসে সমাপ্ত করে। যমুনা সেতুর কৃতিত্ব তিন সরকারকেই দিতে হবে।
তাই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেখ হাসিনার সরকার শুরু করে বিএনপির নেতাদের সমস্যাটা কোথায়?
পদ্মা সেতু নিয়ে চলছে এখন ধাপ্পাধাপ্পির রাজনীতি।
বিএনপি মনে করছে, সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলে জনগণকে ধাপ্পা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ ভাবছে, বিএনপি দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলে জনগণকে ধাপ্পা দিচ্ছে। এই বাহাসে ৪১ বছর কেটে গেল। কেউ কথা রাখেনি। ভবিষ্যতে রাখবে, সেই সম্ভাবনাও কম।
৩.
এবার আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের দ্বিতীয় দিকটি নিয়ে আলোচনা করব। তিনি বলেছেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবে হবে। এর মাধ্যমে তিনি বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাকচ করে দিতে চাইছেন। হতে পারে সেটি আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের রাজনৈতিক অবস্থান। সরকার যদি দেশবাসীকে তাদের বক্তব্য বোঝাতে পারে, তাহলে তাদের পছন্দসই সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে।
আর বিরোধী দল যদি জনমত তাদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ দিয়েছেন, তখন সবিনয়ে তাঁকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কি একটি সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় আরেকটি সংসদ নির্বাচন হয়? পঞ্চদশ সংশোধনীতে তাঁরা এই আত্মঘাতী ও সর্বনাশা বিধান আপনারা কীভাবে রাখলেন? পঞ্চদশ সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে।’ সাংসদেরা পদত্যাগ করবেন না। সংসদও বহাল থাকবে।
যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নিই, নির্বাচন কমিশন সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের যেকোনো তারিখে নির্বাচন করে ফেলল (হতে পারে সেটি মেয়াদ শেষের ১০ দিন বা ৮৯ দিন থাকতে)। তখন কি একই দেশে দুই সেট সংসদ সদস্য থাকবেন না? আপনারা যেহেতু সংসদ ভেঙে দেননি, সেহেতু মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন পর্যন্ত তাঁরা সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকবেন। আবার যাঁরা নতুন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন, তাঁরাও শপথ নিয়ে সংসদে বসার যোগ্য হবেন।
তাহলে জিজ্ঞাসা, একই সময়ে দেশে কয়টি সংসদ কার্যকর থাকবে? কতজন সংসদ সদস্য থাকবেন। যদি বর্তমান সংসদের কোনো সদস্য পরবর্তী নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন না পান বা তাঁর স্থলে অন্য কেউ নির্বাচিত হন, তখন সেই সংসদীয় এলাকায় কজন সাংসদ প্রতিনিধিত্ব করবেন?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যদি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের নীতি মানেন ও পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তাহলে আপনাকে সংসদ ভেঙে দিয়েই নির্বাচন করতে হবে। একটি সংসদ বহাল রেখে যেমন আরেকটি সংসদ গঠন করা যায় না, তেমনি একটি সংসদীয় এলাকার প্রতিনিধি থাকা অবস্থায়ও আরেকজন প্রতিনিধি নির্বাচিত করা যাবে না।
সরকারি দলে এত বিজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তি থাকতেও পঞ্চদশ সংশোধনীতে এ রকম একটি বেআইনি ধারা কী করে সন্নিবেশিত হলো?
ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে শুনেছি, কিন্তু জ্ঞানশূন্য করার কথা শুনিনি। মহাজোট নেতারা কি রাজনীতির সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments