স্বামীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারছি না..

১৫ জুলাই বিকেল পাঁচটায় ধানমন্ডির ঢাকা ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে পরামর্শ সহায়তা ২৮-এর আসর অনুষ্ঠিত হয়। এ আসরে উপস্থিত ছিলেন মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামাল, তাজুল ইসলাম, আহমেদ হেলাল, অভ্রদাস ভৌমিক, মেখলা সরকার ও ক্রিয়ার পরিচালক ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘আপন’-এর পরিচালক ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল।


পরামর্শ সহায়তায় আলোচিত বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন: আমার সন্তানের বয়স ২৯ বছর। বিদেশে পড়াশোনা করতে না পেরে হতাশায় ভুগতে থাকে। দেশের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছিলাম। পড়াশোনায় অমনোযোগী থাকায় পরীক্ষা দিতে পারল না। তারপর তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন চার-পাঁচ বছর ধরে সে মাদকাসক্ত। এ অবস্থায় আমার করণীয় কী?
পরামর্শ: আপনার ছেলে পড়াশোনার জন্য বিদেশে যেতে না পারার হতাশা থেকে মাদক গ্রহণ করছেন। এ অবস্থায় আপনারা তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন; বিয়ে দিয়েছেন। তিনি যে মাদক নেন, তা বুঝেছেন অনেক পরে। যারা মাদক নেয়, প্রথম অবস্থায় তারা স্বীকার করে না। আপনার সন্তান এই ধাপ পেরিয়ে এসেছেন। এখন তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি মাদক নেন। এটি আপনার জন্য ইতিবাচক দিক। এ অবস্থায় তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে। চিকিৎসক তাঁর শরীর থেকে মাদক বের করবেন। এরপর শরীরে কিছু উপসর্গ দেখা দেবে। তখন চিকিৎসক ও মাদকাসক্তের পরিবার—সবাই তাঁকে সহযোগিতা করবেন, তাঁর পাশে থাকবেন। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি ভালো হয়ে উঠবেন। তারপর দীর্ঘ সময় ভালো থাকার জন্য তাঁকে বিভিন্ন ধরনের থেরাপি নিতে হবে। তাঁর চিকিৎসা শেষ হয়ে গেছে—এ ধারণা কখনোই করা যাবে না। তাঁকে সব সময় চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক চলতে হবে। আপনার ছেলের ব্যাপারে আমরা খুবই আশাবাদী। কারণ, তিনি নিজেই ভালো হতে চান। একজন মাদকাসক্ত রোগী যখন নিজের ভেতর থেকে ভালো হওয়ার তাগিদ অনুভব করে, কেবল তখনই তাকে চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো করা সম্ভব।

প্রশ্ন: আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত। সে কারও কথা শোনে না, কোনো নিয়ম মেনে চলে না। এখন আমার কী করা উচিত?
পরামর্শ: আমরা শুধু মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের দোষ দিই। আমরা যারা মাদকাসক্ত নই, তারা কি সব নিয়ম মেনে চলি? ডায়াবেটিস হলে নিয়ম মেনে চলতে হয়। শরীর মোটা বা দুর্বল হলে হাঁটতে হয়, ঠিকমতো ওষুধ খেতে হয়, অফিসে যেতে হয়—এসব নিয়ম আমরা মেনে চলি না। এ ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত রোগীরা যে নিয়ম মানবে না, এটা খুবই স্বাভাবিক। রোগীরা মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। মাদকের মধ্যে সে তার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা—সবকিছু খুঁজে পায়। মাদক ছাড়তে তার অনেক কষ্ট হয়। এত কষ্ট সে কেন করবে? সে কেন মাদক ছাড়বে? আপনি যদি তাকে এমন কোনো স্বপ্ন দেখাতে পারেন, যা তার জীবনকে বদলে দিতে পারে, সত্যি সত্যি জীবনে কিছু অর্জন করার সুযোগ থাকে, তাহলে সে মাদক ছাড়ার জন্য হয়তো চেষ্টা করবে। এ জন্য সব সময় তার পাশে থাকতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে। তার কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। তার সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে। সে যেন বুঝতে পারে যে মানুষ তার পাশে আছে, তাকে সবকিছু বলা যায়। তাহলে তারা নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করবে এবং জীবনে কিছু অর্জন করার স্বপ্ন দেখবে।
একটা বিষয় খুবই খেয়াল রাখতে হবে, ভালোবাসার সুযোগে সে যেন কোনো প্রকার মাদক গ্রহণ করতে না পারে। মাদক গ্রহণের সব পথ তার জন্য বন্ধ করতে হবে। আমরা অনেক সময় শুনে থাকি, মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা চাপ দিয়ে এবং অত্যাচার করে মাদকের জন্য টাকা নিয়ে যায়। একবারের জন্যও কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে এ সুযোগ দেওয়া যাবে না। একবার সুযোগ পেলে আর কখনো ভালো হওয়ার চেষ্টা করবে না। অতএব, তার সঙ্গে ভালো আচরণ ও তাকে ভালোবাসার অর্থ এই নয় যে সে মাদক গ্রহণের সুযোগ পায়।

প্রশ্ন: আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত। শ্বশুর-শাশুড়ি কোনো ধরনের সহযোগিতা করছেন না। নিজে অনেক চেষ্টা করেও পারছি না। এখন তাকে কীভাবে ভালো করব?
পরামর্শ: এটি হলো মাদকের সঙ্গে পরিবারের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয়ী হতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হয়; একার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার কথায় জেনেছি, আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি সহযোগিতা করছেন না। কারণ হিসেবে বলেছেন, তাঁরা হয়তো লোকলজ্জার ভয়ে করছেন না। তাঁদের একটা বিষয় বোঝাতে হবে, মাদক গ্রহণ করতে করতে একটা সময় রোগীরা চরমভাবে মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। তখন সে বিভিন্ন কারণে, বিশেষ করে মাদক গ্রহণের অর্থের জন্য নানা ধরনের অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকে। পুলিশসহ বিভিন্ন মানুষের কাছে লাঞ্ছিত হতে থাকে। তখন সমাজে এর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। পরিবারের জন্য তৈরি হয় বিপর্যয়কর অবস্থা। শুধু তা-ই নয়, মাদক গ্রহণ করতে করতে একসময় তার জীবন মৃত্যুর সংকটে পড়ে যেতে পারে। তাকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো চেষ্টাই আর কাজে আসে না। মুখে যা-ই বলুন না কেন, প্রত্যেক মা-বাবাই তাঁর সন্তানকে ভালোবাসেন। তার কোনো বিপর্যয় দেখতে চান না। জীবন থেকে হারাতে চান না প্রিয় সন্তানকে। প্রথমে আপনাকে তাঁদের মন জয় করতে হবে। তাঁরা যেন আপনাকে আপন করে নিতে পারেন এবং মনেপ্রাণে নিজেদের মানুষ হিসেবে বিশ্বাস করতে পারেন। তাঁদের নিয়েই আপনাকে এই যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, আপনি এটি পারবেন। কারণ, আপনার মধ্যে সেই শক্তি ও সাহস—দুটোই লক্ষ করেছি।

প্রশ্ন: আমার স্বামী মাদকাসক্ত। নিজেই উপার্জন করে মাদক গ্রহণ করে। আমার কথা শোনে না। শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে কিছু বলে না।
পরামর্শ: টাকা উপার্জন করলেই একজন যেনতেনভাবে টাকা খরচ করতে পারেন না। কোনো পরিবারের একজন টাকা উপার্জন করলে অন্যদেরও ওই টাকার ওপর অধিকার থাকে। অতএব, মাদকের জন্য তিনি যেন তাঁর উপার্জিত টাকা নষ্ট না করতে পারেন, সে ব্যাপারে আপনি তাঁকে চাপের মধ্যে রাখবেন। সঙ্গে মা-বাবাও তাঁদের সন্তানকে চাপ প্রয়োগ করবেন। বহুমুখী চাপের মধ্যে তিনি যেন বুঝতে পারেন, টাকা উপার্জন করলেই তা দিয়ে মাদক গ্রহণ করা যাবে না। সমস্যার বিভিন্ন ধরন আছে। যেমন—ব্যক্তিগত সমস্যা, পরিবারিক সমস্যা, সামাজিক সমস্যা ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা। মাদকাসক্ত সমস্যা একক কোনো সমস্যা নয়, এটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এখন নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পেরেছেন, এটি আপনার একার কোনো সমস্যা নয়, সবার সমস্যা। তাই শ্বশুর-শাশুড়ি তো বটেই, অন্যদের সহযোগিতাও নিতে হবে।

প্রশ্ন: আমার স্বামী মাদকাসক্ত। কোনোভাবেই তাকে ভালো করতে পারছি না। এ পরামর্শ সহায়তা অনুষ্ঠানে এবার নিয়ে দুবার এলাম। আমি চাই, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি—সবাই আসুক। কিন্তু তাঁদের আনতে পারছি না। কীভাবে তাঁদের আনা যেতে পারে?
পরামর্শ: সরাসরি তাঁদের এখানে আসার জন্য কিছু বলার দরকার নেই। আপনি এখানে এসে অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন। আপনার সেই অভিজ্ঞতা গল্পের ছলে তাঁদের সঙ্গে শেয়ার করুন। কোন ধরনের রোগী এখানে আসে, তারা কী কী কারণে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে, এখানে আসা মা-বাবাদের কী দুঃখ-কষ্ট, চিকিৎসকেরা কোন ক্ষেত্রে কী বলছেন—সবই গল্পের মতো করে বলুন। বিভিন্ন মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো বলুন। মাদকের ছোবলে প্রিয় সন্তানকে হারিয়েছেন, এমন মা-বাবাও আমাদের এখানে এসেছেন। এ ধরনের মা-বাবার সন্তান হারানোর দুঃখের কথা বলতে পারেন। এভাবে বলতে থাকলে একদিন তাঁরা আসার জন্য উদ্বুদ্ধ হবেন। আমাদের বিশ্বাস, আপনি তাঁদের নিয়ে আসতে পারবেন।

প্রশ্ন: আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত। সম্প্রতি সে ১২ হাজার টাকার হেরোইন সেবন করে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শ্বশুর-শাশুড়ি সম্ভবত লোকলজ্জার ভয়ে তার কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চান না। এখন তাকে কীভাবে ভালো করব?
পরামর্শ: একটা কথা সব সময় বলে থাকি, ‘আমরা মাদককে ঘৃণা করব, মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে নয়।’ আজকে তাঁদের সন্তান যদি কোনো ধরনের সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হতো বা তার অন্য কোনো ধরনের অসুখ হতো, তাহলে কি তাঁরা চিকিৎসকের কাছে নিতেন না? চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন না? অবশ্যই করতেন। সমাজের সবাইকে নিয়েই এর মোকাবিলা করতে হবে। মাদকাসক্ত রোগীকে আর দশটি স্বাভাবিক রোগীর মতো মনে করতে হবে। সবার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। সবার সাহায্য ও পরামর্শ নিতে হবে। লজ্জার ভয়ে চিকিৎসা না করালে সে একসময় নিজের ও পরিবারের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। তখন সবাই জেনে যাবে এবং সেটা হবে পরিবারের জন্য অনেক বেশি অপমানজনক। অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এ রকমই দেখে আসছি। আমরা দেখেছি, মাদকাসক্ত রোগীর কাছ থেকে একসময় আত্মীয়স্বজন, এমনকি স্ত্রীও চলে যান। শেষ পর্যন্ত যাঁরা পাশে থাকেন, তাঁরা হচ্ছেন মা-বাবা। তাই আপনার শ্বশুর-শাশুড়িকে বাস্তবতার আলোকে সবকিছু বোঝান। তাঁরা যেন সব ধরনের ভয়, সংকোচ ও লজ্জা থেকে বেরিয়ে এসে সন্তানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

প্রশ্ন: আমার স্বামী অনেক দিন ধরে মাদকাসক্ত। কোনোভাবেই তাকে নিরাময়কেন্দ্র বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারছি না। এখন কী করব?
পরামর্শ: প্রথমত, পরিবারের সবাইকে তার সঙ্গে মিশে যেতে হবে। তার সুখ-দুঃখের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। সে যেন বুঝতে পারে, পরিবারের সবাই তার পাশে আছে। মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো গল্পের মতো করে তুলে ধরতে হবে। তার সঙ্গে সবকিছু নিয়ে কথা বললে, তাকে ভালোবাসা দিলে একসময় সে তার ভুলগুলো বুঝতে পারবে এবং আপনাদের কথা শুনে ভালো হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে। সব চেষ্টার পরও যদি তাকে ভর্তি করানো না যায়, তাহলে জোর করে তাকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে। তাকে চিকিৎসার আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। বলব, যত দ্রুত সম্ভব তাকে নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করাতে হবে বা চিকিৎসকের কাছে আনতে হবে।

প্রশ্ন: আপনাদের পরামর্শে সন্তানের সঙ্গে ভালো আচরণ করছি। সে এখন কিছুটা কথা শুনছে। জানতে চাই, সে নিয়মিত মাদক নেয় কি না। তাকে কলেজে ভর্তি করিয়েছি। কোনো চিকিৎসকের কাছে এখনো নিয়ে যাইনি।
পরামর্শ: আপনি বলেছেন, সে মদ ও গাঁজা খায়। গাঁজার মধ্যে ৬০টি ক্ষতিকর উপাদান আছে। প্রতিটি টানের সঙ্গে সবগুলো উপাদান তার শরীরে ঢুকছে। ৬০টি উপাদানের মধ্যে একটি উপাদান এমন আছে, যা একবার মস্তিষ্কে ঢুকলে এক বছর স্থায়ী হয়। এ কারণে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সে পরিপূর্ণভাবে মাদক ছেড়েছে কি না, সে বিষয়। সপ্তাহে এক বা দুবার নিল কিংবা ১০ দিনে একবার—এটা ভালো-খারাপের কোনো মাপকাঠি নয়। যদি একেবারে বন্ধ না করে, তাহলে এটাকে আমরা মাদকাসক্তই বলি। আপনাকে আগে তার চিকিৎসা করাতে হবে, তাকে সম্পূর্ণ মাদকমুক্ত করতে হবে, তারপর তার লেখাপড়া। আপনার কিছুটা সুবিধা হচ্ছে, সন্তানের অবস্থা খুব বেশি খারাপ নয়। তাই তাকে ভর্তি না করালেও চলবে। আপনি মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে নিয়ে আসুন।

পরামর্শ সহায়তা আসর পরিচালন করেন সাইদুজ্জামান রওশন
গ্রন্থনা: আশফাকুজ্জামান

No comments

Powered by Blogger.