গোলটেবিল বৈঠক-পাহাড়ধসে গণমৃত্যু: প্রতিকার ও করণীয়

৩ জুলাই ২০১২ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘পাহাড়ধসে গণমৃত্যু: প্রতিকার ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত বৈঠকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।


যাঁরা অংশ নিলেন
মোহাম্মদ মন্জুর আলম
মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী
সাবেক মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
আবদুচ ছালাম
চেয়ারম্যান, সিডিএ
মুহাম্মদ সিকান্দার খান
উপাচার্য, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম
জাহাঙ্গীর আলম
উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
শফিক হায়দার চৌধুরী
অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বিধান বড়ুয়া
স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ
আলী আশরাফ
প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদ
জাফর আলম
পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম
আখতার কবির চৌধুরী
আইনজীবী
বনজ কুমার মজুমদার
উপপুলিশ কমিশনার, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ
মাহফুজুল হক শাহ
পরিচালক, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ
বিশ্বজিৎ চৌধুরী
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো।
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
বিশ্বজিৎ চৌধুরী
প্রথম আলো আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাই। চট্টগ্রাম শহর পৃথিবীর সেই বিরল শহরের একটি—যেখানে পাহাড়, নদী, সমুদ্র ও অরণ্যের সমাহার ঘটেছে। কিন্তু প্রকৃতির এই অপার, উদার উপহার আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। তাই আমাদের সম্পদই আমাদের কাছে বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং পাহাড়ধসে গণমৃত্যুর ব্যাপারটি প্রায় নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে ১২০ জনের মৃত্যুর পর গঠিত হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা পরিষদ। তারা নানা রকম সভা ও সিদ্ধান্ত নিলেও আমাদের দুর্ভাগ্য ঠেকানো যায়নি। কয়েক দিন আগেও ঘটে গেল ভয়াবহ এক দুর্যোগ। এই বিষয়ে আলোচনার জন্য আজকের এ আয়োজন। আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এখানে আসার জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

আব্দুল কাইয়ুম
আমি শুরুতে চট্টগ্রামসহ কক্সবাজার-বান্দরবানে পাহাড়ধসে যারা মারা গেছেন তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাদের পরিবার-পরিজন শোক কাটিয়ে উঠুক, এই আমাদের একান্ত কামনা।
আমরা প্রথম আলোর পক্ষ থেকে পত্রিকার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মানুষের দুঃখ-দুর্দশায়ও পাশে গিয়ে দাঁড়াই। মাদকের বিরুদ্ধে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করি, এসিডদগ্ধদের পাশে দাঁড়াই, কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিয়ে তাদের উৎসাহিত করি। আজকে এসেছি এখানে বারবার পাহাড়ধসের কারণগুলো চিহ্নিত করে এর প্রতিরোধে করণীয় কী, সে ব্যাপারে কিছু দিকনির্দেশনা বের করতে। আপনাদের আলোচনায় সেই নির্দেশনা বেরিয়ে আসবে। আমরা কিছু বাড়িয়েও বলব না, আবার প্রভাবশালীদের চোখ রাঙানিতে সত্য বলা থেকে বিরতও থাকব না। এখানে বর্তমান মেয়র, সাবেক মেয়র, নগর পরিকল্পনাবিদ, বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, শিক্ষকসহ অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আছেন। প্রথমে আমি অনুরোধ করছি মাননীয় মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলমকে তাঁর বক্তব্য শুরু করতে।

মোহাম্মদ মন্জুর আলম
২০০৭ সালে আমি সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে থাকাকালে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক নারী-পুরুষ মৃত্যুবরণ করে। আমরা খবর পেয়েছিলাম সকালে। ঘটনাস্থল এমন জায়গায় ছিল যে প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে সেখানে আমাদের যাওয়াটা ছিল দুঃসাধ্য। ২০০৭ সালে যে কমিটি হয়েছে, এতে সিডিএ, জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন এবং অন্য সংস্থা আছে।
এই কমিটি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছিল। চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে নিহত ব্যক্তিদের বিভিন্ন রকমের সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া হয়েছিল।
প্রশ্ন হলো, পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে কে? পাহাড়ের মালিক অন্যজন। বিশেষত শহরের বেশির ভাগ পাহাড়ের মালিক বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। এর মধ্যে বেশির ভাগ রেলওয়ের। এ ছাড়া ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, পূর্ত বিভাগ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন কিছু পাহাড়ও আছে। এর স্থায়ী সমাধান হোক সেটা সিটি করপোরেশন চায়। কিন্তু কিছু করতে হলে সমন্বিতভাবে করতে হবে। পাহাড়ের মালিক ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
পাহাড়ধসে মৃত্যুর ঘটনা রোধের জন্য বসবাসকারী এক হাজার ৩০০ পরিবারের পুনর্বাসন জরুরি। সিটি করপোরেশনের একটি পাহাড়ে ১৬০টি পরিবার বসবাস করে। আমরা তাদের পুনর্বাসনের একটি পরিকল্পনা নিয়েছি। প্রতিটি পরিবারকে ২৫০ বর্গফুটের একটি করে ঘর ১৫ বছর মেয়াদে প্রতি মাসে দুই হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধের শর্তে বরাদ্দ দেওয়া হবে।
অন্যান্য সংস্থাকেও আমরা আহ্বান করেছিলাম। প্রশ্ন আসে, এখানে লাভবান কে হবে। বসবাসকারী ভাড়াটিয়া, মাঝখানে জমিদার না পাহাড়ের মালিক। কমিটি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পুনর্বাসিতরা প্রতি মাসে সরকারকে এক হাজার ২০০ টাকা ভাড়া দেবে। কিন্তু সেটা তারা মানেনি। এই বৃষ্টিপাতের মধ্যেও তাদের জীবন রক্ষার জন্য সরে আসার অনুরোধ জানানো হলেও তারা আসতে চায় না। বরং উল্টো তেড়ে আসে।
তাই আমার মনে হয়, বসবাসকারীদের বুঝিয়ে একটি নিয়মের মধ্যে আনতে হবে এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থা যদি কিছু জায়গা দেয়, সেখানে বহুতলবিশিষ্ট ভবন তৈরি করে এক হাজার ২০০ পরিবারকে পুনর্বাসন করা সমস্যা হবে না। এখানে বেশির ভাগ পাহাড় রেলওয়ের। তারা জমি দিলে পুনর্বাসনের বিষয়ে সিটি করপোরেশন চিন্তা করতে পারে। সিটি করপোরেশন জনগণের সেবার জন্য। আজকের এই বৈঠকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যেকোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে সেখানে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে যেটুকু সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন, তা আমরা করব এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

আব্দুল কাইয়ুম
আমি গতকাল বিকেলে আকবর শাহ এলাকায় গিয়েছিলাম সেখানকার পরিস্থিতি দেখতে। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে অবস্থা জানার চেষ্টা করেছি। তুহিনা বেগম নামে একজনের পরিবারের আটজন সদস্য দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে। তারা সবাই কাদামাটিতে প্রায় ডুবে গিয়েছিল। স্থানীয় লোকজন ও নিজ পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে উদ্ধার করেছে। তারা সবাই আতঙ্কে আছে। তারা বলছে, ‘একদিকে আমাদের ভূমিধসে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। এরপর উচ্ছেদ করে দিলে আমরা বাঁচব কী করে?’ আজ মেয়র মহোদয় কিছু পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলো খুবই মূল্যবান।
এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, বেলার উপদেষ্টা শফিক হায়দারকে বলার জন্য অনুরোধ করছি।

শফিক হায়দার চৌধুরী
কিছুক্ষণ আগে মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলম পাহাড় কাটা সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন। আসলে একদল লোক পাহাড় কেটে মাটিগুলো নিয়ে যায় অন্য কোথাও ব্যবহার করার জন্য। অনেক সময় নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য পাহাড়ের পাদদেশে কিছু লোককে বসানো হয়। এরা মধ্যস্বত্বভোগী। মাটি কাটার পর থাকার জায়গা নেই এমন কিছু গরিব মানুষকে অনেকটা দাওয়াত করেই নিয়ে যাওয়া হয়। তারা সেখানে ঘরবাড়ি তৈরি করে থাকে। অথচ আমরা দুর্নীতির কথা বলার সময় মধ্যস্বত্বভোগীদের কথা কখনো উল্লেখ করি না। সংবাদপত্রেও তাদের কথা বা নাম আসে না। অথচ তারা নিজেদের কিছু আর্থিক সুবিধা এবং নানা কাজে ব্যবহারের জন্য এই গরিব মানুষগুলোকে জেনেশুনে মৃত্যুর ফাঁদে নিয়ে যায়।
অন্যদিকে গরিব মানুষেরা বলে, ‘এরা (পাহাড়ে আশ্রয়দাতারা) আমাদের ত্রাণকর্তা। আমরা রাস্তার পাশে থাকতাম। এরা আমাদের সেখান থেকে এনে থাকার জায়গা দিয়েছে, পলিথিনের ছাদ দিয়ে হলেও আমরা থাকতে পারছি।’ কিন্তু এই ত্রাণের পেছনে তাদের লোভী রূপটা আশ্রিত ব্যক্তিরা দেখেনি।
আর এই পাহাড় কেটে সেখানে লোক রাখার পেছনে যারা কাজ করে, তারা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টে ফেলে। এ ছাড়া নতুন সরকারের দলীয় লোক বা দলের নাম ভাঙিয়ে কিছু লোক এসব কাজ করে। রাজনীতিক এবং প্রশাসন তাদের প্রশ্রয় দেয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত মানুষেরা এসব বিষয়ে সোচ্চার হই না কেন? মধ্যস্বত্বভোগীদের কেন আইনের আওতায় আনা হয় না? আলোচনায় এসব বিষয় আসা উচিত এবং এসব লোকের ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ কাজগুলো করতে না পারে, নির্দয়ভাবে কিছু মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে না পারে।

জাহাঙ্গীর আলম
আসলে পাহাড় কাটা ও ধসের সমস্যাটা অনেক দিনের। এর কারণগুলো চিহ্নিত করার জন্য চট্টগ্রাম প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় গত তিন বছরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার ১২টা পাহাড়ের ওপর একটা মূল্যায়ন করেছে। এতে পাহাড়গুলোর গঠন এবং তার প্রাকৃতিক অবস্থা তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা যায়, পাহাড়গুলো কেটে কেটে এমন অবস্থা করা হয়েছে যে একেকটা স্লোপ (ঢাল) ৮০ ডিগ্রির ওপর। এটাকে সাংঘাতিক ঢালু, ‘এক্সস্ট্রিম স্লোপ’ বলে। এগুলো আগে হালকা ঢালে, ‘মাইল্ড স্লোপে’ ছিল। কিন্তু কেটে কেটে এক্সস্ট্রিম করা হয়েছে যাতে সামান্য বৃষ্টি হলে এখানে ধস নামে এবং সহজে জমি তৈরি করা যায়।
পাহাড়ের ভেতরে সব বালুমাটি। ওপরের সব গাছ কেটে ফেলার কারণে সেখানে পকেট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ভেতরে ঢুকে যায় এবং মাটি ধসে পড়ে। সেখান থেকে বেরোনোর কোনো ব্যবস্থা নেই।
এরপর জায়গার দখল বজায় রাখার জন্য চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘর বানিয়ে দরিদ্র মানুষকে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। সেখানে পানি, গ্যাস এবং বিদ্যুৎ লাইন দেওয়া হয়েছে। আর সেখান থেকে ভাড়ার আয় যাচ্ছে বড়লোকদের কাছে।
এ সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে আমাদের একটা পরামর্শ ছিল। সরকারি বা বেসরকারি মালিকানায় যার যে পাহাড়ই হোক না কেন, সেটাকে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। পাহাড়ের পাশে লোক থাকলে তাকে সরানোর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিমালিক বা সরকারি সংস্থার ওপর বর্তাবে।
২০০৭ সালে এই লোকজনকে একত্র করে কৈবল্য ধাম এবং হাটহাজারীতে গুচ্ছগ্রামের মতো করে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুই মাস ধরে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু একটা লোকও সেখানে যাওয়ার জন্য পাওয়া যায়নি।
তাই আগে পাহাড় কাটার জন্য দায়ীদের শাস্তি পেতে হবে। পাহাড়ের পাশে যাতে লোক থাকতে না পারে সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা করতে হবে।
পাহাড়ের পাশে বসবাসকারীদের সচেতন করে তুলতে হবে। সিটি করপোরেশন, সিডিএর লোকজনসহ সমাজের সচেতন নেতারা গিয়ে লোকজনকে বুঝিয়ে সরানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ নিয়ে কোনো রাজনীতি যাতে না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

আলী আশরাফ
এখানে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে যেসব কথা আলোচিত হচ্ছে, এ রকম কথা আগেও বলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করতে হবে। সিডিএ, ওয়াসা, রেলওয়ে বা সিটি করপোরেশন যারা পাহাড়ের মালিক তারা দায়ী থাকবে।
কিন্তু এই লোকগুলো পাহাড়ে কেন আসছে এবং থাকছে সেটাও ভেবে দেখতে হবে। এরা মূলত উপকূলীয় এলাকা ভোলা, হাতিয়া, বরিশাল প্রভৃতি জেলার নদীভাঙনের শিকার হয়ে অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এখানে আসছে।
কাকতালীয়ভাবে হোক বা ভাগ্যক্রমে হোক চট্টগ্রামে পাহাড়সহ সরকারি জায়গার পরিমাণ বেশি। যেহেতু ব্যক্তিমালিকানার খালি জায়গায় থাকার জন্য ঘর করতে দেওয়া হয় না, তাই সরকারি জায়গাগুলোতে ওরা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেয়। বস্তিবাসীদের একটি বড় অংশ সেনানিবাস এলাকায়ও বাস করছে।
এখন দেখতে হবে পুনর্বাসনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাতে ফল কী হবে। কিছুদিন আগে আকবর শাহ এলাকায় ধস নামার পর সেদিন সেখানে মাইকিং করতে গেলে পাহাড়ের মালিক সিটি করপোরেশনের লোকজনের ওপর হামলা চালানো হয়।
ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি, কৈবল্যধামে হাউজিং অ্যান্ড সেটেলমেন্ট বিশাল প্রকল্প করে ছোট ছোট প্লট দেওয়ার চেষ্টা করেছে গরিব মানুষকে। এখন খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সেই জমিগুলো তাদের হাতে নেই। কারণ ১০ টাকার জিনিসে ৫০ টাকা পেলে সেটা ওরা বিক্রি করবেই। তাই ওই সব জায়গার বেশির ভাগ চলে গেছে আমাদের মতো পরিচ্ছন্ন সচ্ছলদের হাতে।
এখন শোনা যাচ্ছে, বসবাসকারীদের হাটহাজারী কিংবা কৈবল্যধামে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু তারা সেখানে থাকবে না। কারণ তারা শহরকেন্দ্রিক, হাতের কাছে কর্মসংস্থান এবং কর্মস্থলের কাছাকাছি থাকতে চায়। এ ছাড়া আমাদের আয়ের উৎস, কলকারাখানা, বন্দর অর্থাৎ অর্থনীতির চাকা এসব মানুষের ওপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা সচল রাখার লক্ষ্যে এদের শহরে থাকতে দিতে হবে।
এই অবস্থায় আমার একটা প্রস্তাব আছে। পরীক্ষামূলকভাবে এটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা যেতে পারে।
রেলওয়ের ৩০-৪০ বছর ধরে পড়ে থাকা পাঁচ শতাধিক একর জায়গা থেকে ২৫ একর জায়গা পাওয়া গেলে সেখানে ছয়তলা পর্যন্ত বহুতল ভবন করে এসব মানুষকে রাখা যাবে। ২৫-৩০ কোটি টাকা খরচে এ ধরনের বহুতল ভবন করা সম্ভব। প্রস্তাবিত ভবনে আনা গেলে তাদের গণনায় ধরা যাবে, তাদের পরিচয়পত্র থাকবে।
কিন্তু এটা লোভনীয় হলে অপেক্ষাকৃত সচ্ছলরাও এখানে আসতে চাইবে। তাই প্রতিটি ঘরের আয়তন হবে ১৫০ বর্গফুট। কারণ তারা এখন যেসব বস্তিঘরে থাকে সেগুলো ১৫০ ফুটের বেশি নয়। ভবনের এক পাশে (কমন) সাধারণ শৌচাগার, আরেক পাশে রান্নাঘর। মালিকানা দিয়ে দিলে তারা একপর্যায়ে তা বিক্রি করে চলে যাবে। তাই মালিকানা দেওয়া যাবে না।
তারা যেমন বর্তমানে বস্তি এলাকায় ভাড়া দেয়, এখানেও সিটি করপোশেন, সিডিএ বা রেলওয়েকে ভাড়া দেবে। প্রয়োজন ফুরোলে এক পরিবার এখান থেকে চলে যাবে; অন্য এক পরিবারকে তা ভাড়ায় দেওয়া হবে।

আখতার কবির চৌধুরী
পাহাড়ধসে প্রতিবছরই মূল্যবান প্রাণহানি ঘটছে। কিন্তু এর প্রতিকারে আইনি ব্যবস্থা খুবই সীমিত। ১৯৯৫ সালে পরিবেশবিষয়ক আইন এবং ৯৭ সালে বিধি প্রণয়ন করার সময় পাহাড় কাটা সম্পর্কে ব্যাখ্যা ছিল না। ২০১০ সালে আইনটি সংশোধন করে সরকারি-বেরসকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় কাটার ব্যাপারে শাস্তির যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, প্রথমবার পাহাড় কাটার জন্য অনধিক দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। এই বিকল্প থাকার কারণে যারা পাহাড় কাটে তারা পার পেয়ে যায়।
২০১০ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে যে সংশোধন করা হয়েছে, তাতে শাস্তির বিধান রয়েছে দুই বছরের কারাদণ্ডের। সেটিও জামিনযোগ্য। ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তি সহজে জামিন পাচ্ছে। অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের জেলহাজতে যাওয়াটা আত্মসম্মানে লাগে। তাই তারা বিধানের ‘অথবা’কে কাজে লাগিয়ে জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যায়। তাই উভয় দণ্ডের বিধান করলে সুফল কিছুটা হলেও পাওয়া যেত।
এ ছাড়া, দ্বিতীয়বার পাহাড় কাটার শাস্তি দুই থেকে ১০ বছর জেল অথবা দুই লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে। এখানেও ‘অথবা’ দিয়ে শাস্তির বিধানকে দুর্বল করা হয়েছে। এ বিষয়টি যুগোপযোগী করে সংশোধন দরকার।
পুনর্বাসনের বিষয়ে আমার একটা কথা আছে। বলা হচ্ছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা কর্মসংস্থানের জন্য মানুষ শহরমুখী হচ্ছে, তারা আসতেই থাকবে। তাহলে পুনর্বাসনের পর অন্য খালি জায়গায় আর একটা গ্রুপ এসে অবস্থান নেবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? তাই পাহাড় ব্যবস্থাপনাটা শক্তিশালী হতে হবে, যাতে পুনর্বাসনের পর নতুন লোক এসে খালি জায়গাগুলোতেও বসতি স্থাপন করতে না পারে। নইলে আর একটি সমস্যার জন্ম হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
এখন আইন এবং আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে বলবেন নগর উপপুলিশ কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার।

বনজ কুমার মজুমদার
পাহাড় কাটার ব্যাপারে প্রথমে আমি একটু অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে চাই। ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামে থাকার সময় লালখান বাজারের একটি ঘটনার পর আমরা সেখানে যাই। ভেতর দিকে গিয়ে দেখি, একটা পাহাড়ের সামনের দিকে পাহাড়ের অবয়ব থাকলেও পেছনের দিকে পাহাড় কেটে সমান করে ফেলা হয়েছে। সেখানে ভবন হয়েছে। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সবই গেছে। প্রশ্ন হতে পারে, বড় একটি পাহাড় কেটে এসব হলো—পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা সিটি করপোরেশনের মাঠ পর্যায়ের লোকজন কি এসব জানে না? অবশ্যই জানে। আমি তো নিজে গিয়ে দেখেছি, সেখানে সিডিএর অনুমতি নিয়েই ঘর হয়েছে। আবার ২০০৮ সালে দেখেছি, পাহাড় কেটে চারপাশে সীমানাপ্রাচীর দেওয়া হয়েছে। সেখানে যাতে কেউ যেতে না পারে, তার জন্য আনসার মোতায়েন হয়েছে।
এসব বলছি, তার মানে আইনে বহু ফাঁক রয়েছে। এই দুর্বলতার কারণে পাহাড় রক্ষা বা ব্যবস্থাপনায় জড়িত সংস্থাগুলো পাহাড় কাটা ঠেকাতে পারে না। পুলিশ ইতিমধ্যে ৪৯টি মামলা করেছে। অভিযোগপত্র দিয়েছে ৪৬টির ব্যাপারে, ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে দুটি। পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা দিয়েছে আটটি। পাঁচটি অভিযোগপত্র দিয়েছে। সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে এবং জেলা প্রশাসন কোনো মামলা করেনি।
পাহাড় কাটার পর প্রায় সমতল হয়ে গেলে সমস্ত প্রশাসন সেখানে যায়। এরপর দেখা যায় সিডিএর অনুমোদন, গ্যাস, ওয়াসা, বিদ্যুৎ, পানি, রাস্তা সবই হয়। তাহলে পাহাড় কাটা হবে না কেন?
আমার কথা হলো, এত কিছু না করে সব সংস্থা মিলে একটা বিধি তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে পারে। সেটি সংসদে পাস করতে হবে। শক্তিশালী আইন ছাড়া কিছু করা যাবে না।
এ ছাড়া, আইন অনুযায়ী পাহাড় যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় থাকবে। কেউ কিছু করলে সেখানে কোনো দিন কোনো সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি কোনো কিছু সরবরাহ করতে পারবে না। তারপর পুনর্বাসনের কথা চিন্তা করা যায়। এ ব্যাপারে একটা ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করতে হবে। ম্যাপের বাইরে কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করা হলে তাকে আাাইনের আওতায় আনতে হবে।

মাহফুজুল হক শাহ
ইতিমধ্যে কারিগরি বিষয় এবং পাহাড়ধসের কারণগুলো আলোচনা হয়েছে। তাই সেসব বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাই না। তবে পাহাড়ের মালিক সম্পর্কে আমার কিছু বক্তব্য আছে। এখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় কম। সরকারি সংস্থাগুলোর পাহাড় বেশি।
২০০৮ সালে পাহাড়ধস-বিষয়ক একটি কমিটি হয়েছিল। এতে চেম্বারের পক্ষ থেকে আমিও সদস্য ছিলাম। দেখেছি বিষয়টি নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু গত চার বছরে সেসব বিশ্লেষণ বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
পুনর্বাসনের ব্যাপারে মেয়র মহোদয়সহ অন্যরা যা বলেছেন, তা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। এটা আজকে শুরু হলেও পাঁচ-সাত বছর পর হয়তো বাস্তবায়িত হবে। তাও যদি অর্থের বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন করে। এর আগে সিডিএ ও সিটি করপোরেশন ন্যাড়া পাহাড়গুলোতে বনায়নের উদ্যোগ নিতে পারে।
আর একটি বিষয় গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সেটা হলো, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা অনেক সময় বস্তিবাসীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে যেতে এমনকি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে বাধ্য করে। এসব বিষয়ে নেতাদের নজর দিতে হবে। যেকোনো পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হলে তাতে সুফল বেশি পাওয়া যায়। বিষয়টি মাথায় রাখার অনুরোধ করছি।

বিধান বড়ুয়া
চট্টগ্রাম শহরের জায়গাগুলো তিন ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ রেলওয়ের, এক ভাগ সিটি করপোরেশনের এবং আর এক ভাগ সেনাবাহিনীর।
আমাদের বোঝা দরকার যে পাহাড় কেটে বসবাসকারীদের সেবা আমরা নগরবাসী ব্যবহার করি। নগরে যেমন আমাদের ওদের প্রয়োজন, তেমনি আমাদেরকেও ওদের প্রয়োজন। এ জন্যই ওরা এখানে থাকে। পাহাড়ের পাশে থাকাটা যে বিপজ্জনক, সেটা তারাও জানে।
অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। পাহাড়ধসে বছরে আনুমানিক ১০০ জন মারা যায়। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় প্রায় চার হাজার। তাই বিষয়টি সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে এবং সামাজিক সাম্য মাথায় রেখে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
পুনর্বাসন সহজ ব্যাপার নয়। সেখানেও অর্থের প্রয়োজন। তাই গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। শহরে এত সমস্যার মূল কারণ জনসংখ্যা। এই জনসংখ্যা কমাতে হবে। মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এর ভিত্তি হবে অর্থবহ প্রাথমিক শিক্ষা। মানুষের শহরমুখিনতা ঠেকানোর জন্য স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করতে হবে।

মুহাম্মদ সিকান্দার খান
আমার মতে, আলোচকেরা সরাসরি গুরুত্ব দেননি এমন একটা পক্ষ হচ্ছে রাজনৈতিক পক্ষ। দেশের জনগণ রাজনীতিকদের পাঁচ বছরের জন্য অভিভাবকের দায়িত্ব দিয়েছে। তারা যদি বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে আমানতের খেয়ানত হচ্ছে কি না দেখত, তা হলে এ অবস্থা হতো না। আবার আমরাও এই দায়িত্বপ্রাপ্তদের পেছনে লেগে থেকে তাঁদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিচ্ছি না। এটা আমাদের দোষ। দেশের নাগরিক সমাজ ও সুশীল সমাজকে রাজনীতিবিদদের পেছনে লেগে থেকে তাঁদের সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও সতর্ক করতে হবে।
সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সামাজিক ব্যবসা আমাদের দেশের উপকারে আসতে পারে। দশের উপকার করতে হলে ভালো হাউজিং কোম্পানি গড়ে তুলতে হবে। আমাদের হাউজিং কোম্পানি বানানোর সুযোগ দেওয়া হোক। এটা হবে সোস্যাল হাউজিং কোম্পানি। সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি গ্রুপভিত্তিক ব্যবসা করবে। তাঁরা ক্ষতিও করবেন না আবার পকেটে করে টাকা নিয়ে বাড়িতেও চলে যাবেন না। এখানে যাঁরা জড়িত হবেন, তাঁরা অন্য কোনো কোম্পানিতে কাজ করে যে রকম বেতন-সম্মানী পেতেন, এখান থেকেও তাই নেবেন।

আব্দুল কাইয়ুম
নতুন একটা ধারণা পাওয়া গেল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এ ব্যাপারে অগ্রসর হতে হবে। এখন অনুরোধ করছি পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক মো. জাফর আলমকে।

জাফর আলম
চট্টগ্রামে ২০০৭ সাল থেকে প্রশাসনের লোকজন এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত, আমিও এর সঙ্গে জড়িত। ২০০৭ সালের কমিটি সুপারিশ করেছিল অনেক বিষয়। পুনর্বাসনের পরিকল্পনাও সেখানে ছিল। ২০০৮ সালে একটা প্ল্যান হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে সেটি আর এগোয়নি।
গতকালের এক মিটিংয়ে বলা হয়েছে, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি সুপারিশ প্রণয়ন ছাড়া কিছুই করতে পারে না। কিন্তু কমিটি একেবারে কিছুই করেনি, এই সিদ্ধান্তে আসা ঠিক নয়। কমিটিতে যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের সর্বোচ্চ মেধা দিয়ে এ পর্যায়ে এসেছেন। আসলে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিপুল অর্থ প্রয়োজন। কমিটি এত অর্থ জোগাড় করতে পারে না। এটি সম্ভব যদি সরকার জোগান দিতে পারে।
আসলে চট্টগ্রামে ভূমিধস নতুন বিষয় নয়। কারণ এখানে ভূমির যে গঠন, তাতে বালু ও কাদার মিশ্রণ রয়েছে। এতে যদি ১৫০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে ধস নামবে।
গত ২৬ জুন চট্টগ্রামে প্রায় ১৫০-২০০ জায়গায় ধস নেমেছে। কিন্তু মানুষ মারা গেছে মাত্র দুটি জায়গায়। কারণ হচ্ছে, এরা পাহাড়ের পাদদেশে ছিল। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পাদদেশে মানুষ থাকতে পারবে না।
আমরা দেখছি পাহাড় কাটা, ভারী বৃষ্টিপাত এবং মাটির গঠন, এই তিনটা বিষয় একসঙ্গে হলে এবং ওই সময় পাহাড়ে মানুষ থাকলে তারা মারা যাবে। এই যে বাটালি হিল ৯০ ডিগ্রিতে দাঁড়িয়ে আছে, সেটি যদি কখনো ভেঙে পড়ে, তার নিচে এক-দেড় কিলোমিটারজুড়ে কলোনির বাসিন্দাদের অবস্থা হবে করুণ। তাই পাহাড় কিংবা পাহাড়ের পাদদেশ থেকে এই মুহূর্তে নির্দয়ভাবে লোকজনকে সরাতে হবে।
আইনের দুর্বলতাগুলোও দূর করা দরকার। আকবর শাহ পাহাড়ের ব্যাপারে একটি রিট মামলার আদেশের কারণে সেখানকার বস্তিগুলো উচ্ছেদ করা যাবে না। এবার ধসের সময় সরকারি কর্মকর্তারা সেখানে মাইকিং করতে গেলে দা নিয়ে তেড়ে আসে লোকজন।
প্রায়ই পাহাড় কাটা হয় রাতে। আগে একটি টিনের ঘর তৈরি করা হয়। সেখানে যারা কাজ করে তারা দীনহীন। তাদের পাশে আর একটি ঘর তৈরি করে থাকতে দেওয়া হয়। সেখানে গেলে মালিক পাওয়া যায় না। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি কিংবা হলফনামা দিয়ে মালিকানার দলিল হস্তান্তরের মাধ্যমে কৌশলে কাজ করা হয়। একেকটা জায়গা নিয়ে চার-পাঁচটা হলফনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) পর্যন্ত করা হয়।
আমার প্রস্তাব হলো, যে পাহাড়গুলো কাটা হয়েছে সেগুলোর উচ্চতা বজায় রেখে রক্ষণাবেক্ষণ করা। এ ব্যাপারে করণীয় আমাদের ঠিক করা আছে। প্রয়োজন অর্থ বরাদ্দের। রেলওয়ের ২৫ একর জায়গা পাওয়া সাপেক্ষ পুনর্বাসনের ব্যাপারে প্রস্তাবটি ভালো লেগেছে। আমলাতন্ত্রের লোক হলেও আমি বিশ্বাস করি, স্থানীয় সরকারকে যুক্ত করা না গেলে সমস্যার কার্যকর সমাধান করা যাবে না।

আবদুচ ছালাম
আমরা সবাই জানি, চুরি করলে শাস্তি হয়। তার পরও আমরা ঘরে শক্ত তালা দিয়ে রাখি, যাতে চোরের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি।
আপনারা দেখছেন, যেসব পাহাড়ের ওপর স্থাপনা আছে সেখানে পাহাড় এখন কাটা হয় না। কোর্ট বিল্ডিং, ইস্পাহানি বিল্ডিং, ডিসির পাহাড়, বাটালি হিল এবং বায়েজিদ বোস্তামির পাহাড়ে স্থাপনা থাকায় সেগুলো কাটা হয় না।
পাহাড় কাটা বন্ধে আমার প্রথম প্রস্তাব হলো, মজবুত আইন তৈরি ও প্রয়োগ করতে হবে। যেসব কারণে পাহাড় কাটা হয় সেসব কারণ দূর করতে হলে শক্ত আইনের বিধান করতে হবে। কীভাবে সেটা হবে আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
আমার মতে, মালিকানাবিহীন কোনো পাহাড় নেই, সেটি রেলওয়ে হোক, ওয়াসা হোক কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন। মালিকানাধীন হলে আইনের প্রয়োগটা কার ওপরে হবে। জাহাঙ্গীর সাহেব বলেছেন, প্রয়োগ হবে পাহাড় যার, তার ওপর। যারা সেখানে থাকে কিংবা পাহাড় কাটে তারা মালিক নয় ঠিক। কিন্তু মালিক চিহ্নিত করা কঠিন নয়। তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং আইনের প্রয়োগ তাদের ওপর করতে হবে। আরও কঠিন প্রস্তাব হলো পাহাড় বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া।

আব্দুল কাইয়ুম
এখন অনুরোধ করছি প্রাক্তন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে তাঁর বক্তব্য দেওয়ার জন্য।

এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী
আজকের আলোচ্য বিষয়ের মূল কথা হলো, পাহাড়ধসে যারা মারা যাচ্ছে আর যারা পাহাড় কাটছে তাদের চিহ্নিত করে পাহাড় কাটা বন্ধ করা এবং সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর উপায় খুঁজে বের করা। এ ব্যাপারে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
পাহাড় কাটা বন্ধের জন্য উত্তম হলো আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা। কিন্তু এ দেশের আইন খুব হালকা। তাই পাহাড় কাটা বন্ধের জন্য উপযুক্ত আইন তৈরি করতে হবে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীরা ভূমিহীন নয় বরং ভাড়াটিয়া। কিছু মাস্তান পাহাড়ি এলাকায় ঘর তৈরি করে ভাড়া দেয়। ঘর তৈরিকারীরা ভূমিসন্ত্রাসী। গরিব অসহায়, রিকশাচালক, ঠেলাগাড়িচালক, গার্মেন্টেসের চাকরিজীবীরা সেখানে স্বল্প ভাড়ায় থাকার সুযোগ নেয়। কম ভাড়ায় শহরে থাকার সুযোগ সবাই চায়। তাই প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে আইনের মাধ্যমে ভূমিদস্যুদের গ্রেপ্তার এবং সেখানে যাতে কোনো স্থাপনা না থাকে এবং কেউ ঘর তৈরি করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বল্প সময়ের এই প্রস্তাব কার্যকর করতে পারলে পরবর্তী সময়ে আর খুব বেশি সমস্যা হবে না।
এ ছাড়া স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের তুলে দিয়ে তাদের রেলওয়ের খালি জায়গায় অস্থায়ীভাবে হলেও ঘর তৈরি করে দিয়ে আপাতত থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
কম খরচে থাকতে আগ্রহীদের বড় অংশ পোশাককর্মী। তাঁদের জন্য শহরে ডরমেটরি করে দিতে মালিকদের প্রতি অনুরোধ করা যায়। ডরমেটরিতে কম খরচে থাকার সুযোগ পেলে তাঁদের একটি বড় অংশ সেখানে চলে যাবে। এ ব্যাপারে ধারাবাহিকভাবে পরিকল্পনা নেওয়া হলে গরিব মানুষকে অবশ্যই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।
আজকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘমেয়াদি একটি পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বলতে হবে। স্থানীয় সরকারকে টাকা বরাদ্দ দিলে সিটি করপোরেশন তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিতে পারে। আমি মনে করি। দায়িত্ব নেওয়ার সেই যোগ্যতা সিটি করপোরেশনের আছে।

মোহাম্মদ মন্জুর আলম
আমি শুরুতে বক্তব্য দিয়েছি। ইতিমধ্যে বিশেষজ্ঞ, নগর পরিকল্পনাবিদসহ সাবেক মেয়র মূল্যবান বক্তব্য ও পরামর্শ দিয়েছেন।
যারা সেখানে বসবাস করে তারা আমাদের সমাজের গরিব একটি অংশ। তাদের পুনর্বাসনের জন্য সাবেক মেয়র মহোদয় যে প্রস্তাব দিয়েছেন, রেলওয়ের প্রতি ২৫ একর জমি দানের ব্যাপারে যে প্রস্তাব এসেছে, তা গ্রহণ করা হলে আমার মনে হয় সিটি করপোরেশন সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবে। এ রকম আরও আলোচনার উদ্যোগ আমরা নেব। সবাইকে ধন্যবাদ।

আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনায় বেশ কয়েকটি কার্যকর সুপারিশ এসেছে। সরকার ও কর্তৃপক্ষ সেগুলো নিশ্চয়ই বিবেচনায় নেবে। ভবিষ্যতে যেন আবার কোনো পাহাড়ধসে কাউকে মৃত্যুবরণ করতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আজকের আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।

No comments

Powered by Blogger.