সে রাতে পূর্ণিমা ছিল না, বৃষ্টি ছিল by রয়েল পাল

‘পূর্ণিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই গৃহত্যাগী হবার মতো জোছনা কি উঠেছে?’(হুমায়ূন আহমেদের গৃহত্যাগী জোছনা কবিতার প্রথম দুই লাইন) সে রাতে পূর্ণিমা ছিল না, বৃষ্টি ছিল। ছিল অন্ধকারের বিস্তৃত প্রান্তর আর সেই প্রান্তরেই আপনি দুদ্দার করে গৃহত্যাগী হয়ে উড়ালপঙ্খিতে চড়ে মেঘের দেশে চলে গেলেন!


হুমায়ূন প্রথম পড়ি ১৪ বছর বয়সে। তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সেদিন থেকে তাঁর কথার জাদু আমাকে বেঁধে ফেলে। তারপর কলেজ পেরিয়ে শহরে। অনার্স।
যে বয়সে ছেলেরা ক্রিকেট, ফুটবল, হিন্দি সিনেমার গানে চৈতন্য ভাসিয়ে দিচ্ছে, আমার তখন ঘরের কোনায় বসে হুমায়ূন পড়তে পড়তে চোখ ফুলে যাচ্ছে। তিনি তখন আমার স্বপ্নের নায়ক। হুমায়ূন পড়লে মনে হয় না বই পড়ছি। তাঁর ভাষা, বিস্তৃতি, রসবোধ, গল্প বলার ঢং আমাকে নেশাগ্রস্ত করে তোলে।
মধ্যবিত্ত জীবনকে তিনি এমনভাবে ফুটিয়ে তোলেন, মনে হয় যেন আমার জীবনের গল্প।
একবার লঞ্চে করে বাড়ি যাচ্ছি। পাঁচ ঘণ্টার নৌপথ। আমার কাছে এক ব্যাগ হুমায়ূন। লঞ্চে অনেক ভিড়। আমি পেছনের সিটে বসে। শঙ্খনীল কারাগার পড়ছি। গল্পের শেষের দিকে রাবেয়া আপার চিঠি পড়ে চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। সহযাত্রী আমাকে বলল, ‘তোমার চোখে সমস্যা?’ আমি কোনো কিছু না বলে লঞ্চের ছাদে চলে যাই। অনেকক্ষণ ছাদে কেঁদে আবার সিটে এসে পড়তে বসি। হুমায়ূন আহমেদ হলেন আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের এক অপরূপ ভাষ্যকার। কথাশিল্পীর এক অদ্ভুদ জাদুকর।
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়, ১৪১৭ বাংলার পয়লা বৈশাখ—নববর্ষে। নুহাশপল্লীতে সেদিন বৈশাখী মেলা বসেছিল। আমরা প্রায় ৩০ জন দেশের বিভিন্ন জায়গা দেখে নুহাশপল্লীতে এসেছিলাম। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সময় কাটাব বলে। পুরোটা দিন হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমরা সবাই বৃষ্টিবিলাসের বারান্দায় বসে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠি। সব গল্পই তাঁর জীবন, উপন্যাস, গল্প ও সিনেমা নিয়ে। আমার জীবনের অনেক শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত আছে, তার মধ্যে এটি একটি।
আমি সাহিত্য বুঝি না। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ বুঝি। তিনি আমাকে পড়তে শিখিয়েছেন। হুমায়ূন পড়তে পড়তে আমার হাতে এসেছে রবীন্দ্রনাথ। আর হুমায়ূন আহমেদ না পড়লে আমি কখনোই রবীন্দ্রনাথ পড়তে পারতাম না। আমরা যারা মাঝেমধ্যে ভাঙা ভাঙা হাতে পত্রিকায় টুকটাক লিখি, তারা কোনো-না কোনোভাবে হুমায়ূনে আক্রান্ত। তাই তিনিই আমাদের কাছে সাহিত্য, সাহিত্যের রাজপুত্র।
আমরা যারা হুমায়ূন পড়তে পড়তে বড় হয়েছি, যারা কদমকে ভালোবাসতে শিখেছে। বৃষ্টি দেখলে দৌড়ে ছাদে চলে যাই, বর্ষা নিয়ে পত্রিকার পাতায় গা ভাসিয়ে দিই, যেকোনো উৎসবে দামি দামি জিন্স শার্ট ফেলে সস্তা হলুদ পাঞ্জাবি পরে হিমু সেজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। পূর্ণিমা যাদের দর্শন, তারা কখনো হুমায়ূন আহমেদকে ভুলতে পারব না। এই বাংলা, জল, হাওয়া, মৃত্তিকা— বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন হুমায়ূন আহমেদ থাকবেন।
প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ, তুমি বেঁচে আছ তোমার তৈরি প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে। বেঁচে আছ চাঁদ-পূর্ণিমায়, বৃষ্টি-কদম-হলুদ পাঞ্জাবিতে। বেঁচে আছ আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, জোছনা ও জননীর গল্পে।
আমার কাছে বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের শাশ্বত ইতিহাসে তুমি এক অবিভাজ্য অধ্যায়।
হে মৃত্যুঞ্জয়ী, আজ বড্ড অবেলায় তোমার মৃত্যুসংবাদ শুনে ফেসবুকে হতাশ হয়ে লিখি—‘হুমায়ূন! তোমার মৃত্যু হয়নি, এক টুকরো বাংলাদেশের মৃত্যু হয়েছে!!’

No comments

Powered by Blogger.