বাংলাদেশ-ভারত সংলাপ-ইলিশ সংরক্ষণে একযোগে কাজ করার ঘোষণা by শরিফুল হাসান

ভোজনরসিক বাঙালির রসনাতৃপ্তির মস্ত উপাদান ইলিশ। কিন্তু ভরা মৌসুমেও উপাদানটি দিন দিন দুর্লভ হয়ে উঠছে।
ইলিশপ্রাপ্তির এই সংকটের মুহূর্তে ‘ইলিশ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আন্তসীমান্ত সংলাপ’-এ একসঙ্গে কাজ করার কথা বলল বাংলাদেশ ও ভারত। ভারতের কলকাতা শহরের একটি হোটেলে ইলিশ নিয়ে আয়োজিত এক সংলাপে গতকাল মঙ্গলবার এই ঘোষণা আসে।


প্রকৃতি সংরক্ষণে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) এই সংলাপের আয়োজন করে।
‘জীবনের জন্য জীববৈচিত্র্য: বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ পদক্ষেপ’ শীর্ষক এই সংলাপে দুই দেশের রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, নদী ও মৎস্যবিজ্ঞানী এমনকি জেলে প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
সংলাপেই ইলিশ নিয়ে দুই দেশের একটি যৌথ গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন মৎস্যবিজ্ঞানীরা, যাতে উঠে এসেছে ইলিশের জীবনচক্র, সংকট এবং সম্ভাবনার কথা। সংলাপ শেষে বাঙালির পাতে স্বাদের-সাধের-ঐতিহ্যের ইলিশ ফেরানোর আশা নিয়ে তা সংরক্ষণে উঠে আসে ২২টি সুপারিশ।
সংলাপে পশ্চিমবঙ্গের মৎস্য প্রতিমন্ত্রী সুব্রত সাহা আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষের বাড়ি বাংলাদেশের যশোরে। আজ হয়তো আমাদের দুই দেশের সীমান্ত আলাদা, কিন্তু মনের দিক থেকে আমরা আলাদা নই। ইলিশ আমাদের সেই বন্ধন আরও দৃঢ় করতে পারে। তাই ইলিশ নিয়ে আমরা একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করব।’
সুব্রত সাহা বলেন, ‘ইলিশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। তাই এই সংলাপে যেসব সুপারিশ আসবে, আমরা সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য জাফর ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, ‘ইলিশ হচ্ছে এমন একটা মাছ, যার জন্য ভারতের নিরামিষভোজী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে গেলে ইলিশ খেয়ে দেখেন।’ তিনি বলেন, ‘ইলিশ বাঁচাতে হলে আমাদের দুই দেশকে এক হয়ে নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে।’
একই সংসদীয় কমিটির আরেক সদস্য মকবুল হোসেন বলেন, ‘ইলিশ যেহেতু অভিপ্রয়াণ (মাইগ্রেটরি) মাছ, আর যেহেতু আমাদের দুই দেশের নদীগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, কাজেই আমাদের একসঙ্গে কাজ করা ছাড়া বিকল্প নেই।’
সংলাপে ‘বাংলাদেশ ও ভারতের ইলিশ মাছের অভিপ্রয়াণ এবং প্রজননক্ষেত্রগুলো সংরক্ষণের গুরুত্ব’ শীর্ষক যৌথ গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান দেওয়ান আলী আহসান এবং ভারতের মৎস্য ইনস্টিটিউটের নদী ও মৎস্য বিভাগের প্রধান উৎপল ভৌমিক।
দেওয়ান আলী আহসান গবেষণাপত্র উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশের পদ্মার গোদাগাড়ী, পবা, চারঘাট, মহানন্দা, যমুনা, তিস্তাসহ অনেক নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। কিন্তু ভারত থেকে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় অনেক স্থানেই এখন ইলিশ মিলছে না। বর্তমানে সন্দ্বীপের কালিয়ারচর, হাতিয়ার কাছে মৌলভীরচর, ভোলার মনপুরা ও চরফ্যাশন এবং ঢালের চর—এই স্থানগুলোতে ইলিশের প্রজনন হয়। এ ছাড়া পাঁচটি স্থান আছে, যেখানে মাছ বড় হয়। কিন্তু নাব্যতাসংকটে ইলিশের চলাচল ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে ইলিশের অস্তিত্বই সংকটে পড়বে।
উৎপল ভৌমিক বলেন, ইলিশ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ অনেক পদক্ষেপ নিলেও ভারতে জাটকা ধরা বা মা মাছ না ধরার বিষয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে ভারতে দিন দিন ইলিশ হারিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শামসুল কিবরিয়া বলেন, আশির দশকে বাংলাদেশে ইলিশের সংকট দেখা যায়। এরপর সরকার জাটকা ও মা মাছ ধরা বন্ধের মতো নানা পদক্ষেপ এবং জেলেদের সহায়তা দিতে থাকে। এখন এর সুফল মিলছে। তবে ইলিশ বাঁচাতে হলে নদীগুলো বাঁচাতে হবে। আর সে কারণেই দুই দেশকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
অভিন্ন আহ্বান ছিল গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল নেসারের বক্তব্যেও।
ভারতের জাতীয় মৎস্য উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী সি ভাসুদেপ্পা বলেন, ‘ইলিশ বাঁচাতে হলে বাংলাদেশ যা করছে, আমাদের সেসব কাজ করতে হবে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশি জেলে ফণীভূষণ মালো বলেন, ‘আমি বিজ্ঞানী নই, কিন্তু বংশানুক্রমে ছোটবেলা থেকেই মাছ ধরছি। এখন পানির গভীরতা কমে যাচ্ছে বলে ইলিশ কমে যাচ্ছে। কাজেই নদীর স্বাভাবিক পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে।’
দিনব্যাপী এই সংলাপ শেষে একই সময়ে দুই দেশে জাটকা ও মা মাছ ধরা বন্ধ, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, নদীদূষণ বন্ধ, সাগর ও নদীতে ইলিশের পরিমাণ নির্ধারণ, পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখাসহ মোট ২২টি সুপারিশ উঠে আসে। দুই দেশের বিশেষজ্ঞদের আশা, এগুলো বাস্তবায়িত হলে ইলিশ নিয়ে হাহাকার কমবে। ভরা মৌসুমে মিলবে ইলিশ। আর সার্বিকভাবে আরও দৃঢ় হবে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক।

No comments

Powered by Blogger.