মাটির বিছানায় হুমায়ূন by আজিজুল পারভেজ ও নওশাদ জামিল
শ্রাবণের অঝোরধারা তাঁর ছিল দারুণ প্রিয়। বৃষ্টির শব্দ শোনার জন্য বানালেন 'বৃষ্টিবিলাস' নামে বিশাল টিনের ঘর। সে ঘরের চালে ঠিক দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে নামে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। শুরু হয় বৃষ্টির নাচন। ফুল ভিজছে, লতাপাতা ভিজছে, পাখি ভিজছে। এমন পবিত্র দৃশ্য তিনি কি দেখবেন না? শুনবেন না বৃষ্টির প্রিয় সুর?
'বৃষ্টিবিলাস' বাংলোর কিছুটা সামনে বিশাল শামিয়ানার নিচে শুয়ে আছেন তিনি। শেষবারের মতো বৃষ্টির ফোঁটা কি ছুঁয়ে যাবে না তাঁর চোখের পাতা? নুহাশপল্লীর ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বুলবুল কাঁদতে কাঁদতে কফিনের পাশে বসে বুকফাটা আর্তনাদে বলতে থাকেন, 'বৃষ্টি আসছে, বৃষ্টি আসছে। বৃষ্টি দেখবেন না স্যার!'
চোখের পানি আর বৃষ্টির পানিতে একাকার চারদিক। ভক্তদের কান্না দেখে আকাশও বুঝি উজাড় করে দিয়েছিল অঝোরধারা। চোখের পানি আর বৃষ্টিতে ভিজে সাহিত্যের রাজপুত্রকে বিদায় জানালেন ভক্ত-অনুরাগীরা। 'নুহাশপল্লী'র যে লিচুতলা ছিল তাঁর অতি প্রিয়, যে শ্যামল ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতেন তিনি- সেখানেই, মাটির ঘরে গতকাল মঙ্গলবার চিরবিশ্রামে চলে গেলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
গতকাল বাদ জোহর নুহাশপল্লীর লিচুতলায় তৃতীয় জানাজা শেষে হুমায়ূন আহমেদের দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় বারডেম হাসপাতালের হিমাগার থেকে নুহাশপল্লীর উদ্দেশে তাঁর মরদেহ নিয়ে রওনা হন পরিবারের সদস্যরা। দুপুর সোয়া ১২টায় তাঁর মরদেহবাহী ফ্রিজার ভ্যানটি নুহাশপল্লীতে পৌঁছে। এলাকাবাসী আর নুহাশপল্লীর কর্মচারীদের কান্না ও আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে পুরো পরিবেশ। স্বজনদের বিলাপে এ সময় চোখে অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি উপস্থিত কেউই।
'মরিলে কান্দিস না আমার দায়' গানটি হুমায়ূন আহমেদের অতি প্রিয় একটি গান। ভক্তরাও জানেন এ কথা। কিন্তু হুমায়ূনকে সমাহিত করতে গিয়ে কেঁদেছেন সবাই।
লিচুতলায় শেষ শয্যা : হুমায়ূন আহমেদ সব সময়ই প্রকৃতির মাঝেই থাকতে চাইতেন। জ্যোৎস্না রাত কিংবা বর্ষাকালে পূর্ণ চন্দ্র দর্শন ও টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনতে ছুটে যেতেন নুহাশপল্লীতে। সেই নুহাশপল্লীর প্রিয় লিচুতলায় তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। গতকাল দুপুর সোয়া ২টার দিকে লিচুগাছের তলায় তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মতো দেখেন তাঁদের প্রিয় মানুষের মুখখানি। তাঁর জ্ঞাত ও অজ্ঞাত যাবতীয় ভুলের জন্য সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন স্বজনরা। এ সময় স্ত্রী শাওন ও তাঁর দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন, প্রথম পক্ষের ছেলে নুহাশ হুমায়ূনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা ক্ষমা প্রার্থনা করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব উপস্থিত ছিলেন এ সময়।
এরপর শ্রাবণের অঝোরধারার মধ্যেই ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বড় ছেলে নুহাশ, দীর্ঘদিনের সঙ্গী মাজহারুল ইসলামসহ স্বজন-সুহৃদরা কাঁধে তুলে কবরের দিকে নিয়ে যান মরদেহ। সেখানে পরিবারের সদস্য ও সুহৃদরা মাটি দিয়ে ঢেকে দেন নন্দিত এ কথাসাহিত্যিকের নিথর দেহ।
এদিকে দাফন শেষে সাংবাদিকদের কাছে হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্ন পূরণ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন স্ত্রী শাওন। হুমায়ূন আহমেদের নিজের হাতে গড়া নুহাশপল্লীকে ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালনা করে স্বামীর অধরা স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করবেন বলে তিনি জানান।
শাওন বলেন, 'নুহাশপল্লীকে একটি ট্রাস্ট করতে চেয়েছিলেন হুমায়ূন। কিন্তু তিনি তা করে যেতে পারলেন না। আমার যদি কোনো সুযোগ থাকে তাহলে তাঁর ইচ্ছা পূরণে আমি চেষ্টা করব।'
দাফনের পর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, 'হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি পছন্দ করতেন। সেই বৃষ্টির মাঝেই তাঁর জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। নিউ ইয়র্কে তাঁর জানাজার সময়ও বৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশেও একই অবস্থা।' এ সময় তিনি সুষ্ঠুভাবে দাফন হওয়ায় পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানান।
হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শেষ জানাজা
আকাশ থেকে বিরামহীনভাবে ঝরছিল শ্রাবণ ধারা। তারই মাঝে খালি মাথায় দাঁড়িয়ে হাজারো মানুষ অংশ নেয় হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় ও শেষ জানাজায়। এর আগে নিউ ইয়র্কে শুক্রবার ও জাতীয় ঈদগাহে সোমবার তাঁর দুটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
নুহাশপল্লীতে গতকাল যোহরের নামাজ শেষে দুপুর দেড়টার দিকে স্থানীয় মসজিদের ইমাম মজিবুর রহমানের পরিচালনায় হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় ও শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে এলাকাবাসীসহ দূরদূরান্ত থেকে আসা হুমায়ূন ভক্তরা অংশ নেয়।
হুমায়ূন আহমেদের দাফন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে স্থানীয় প্রশাসন ছিল ব্যাপক তৎপর। ঢাকা থেকে গাজীপুরের হোতাপাড়ার পিরুজালী গ্রামের নুহাশপল্লীতে আসার পথে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। তাঁর মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স ছাড়াও প্রায় শখানেক গাড়ির বহরে ছিল পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তা।
অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদকে শেষ বিদায় জানাতে সকাল থেকে ভক্তরা নুহাশপল্লীতে ভিড় জমাতে থাকে। রোদ-বৃষ্টি কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি প্রিয় লেখকের প্রতি ভক্তের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিবেদনের পথে।
একপর্যায়ে পিরুজালী গ্রাম থেকে নুহাশপল্লী পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা লোকে-লোকারণ্য হয়ে যায়।
এর আগে গতকাল শাহবাগের বারডেম থেকে যাত্রা শুরু হয় সকাল ৯টায়। সেখানেও অনেক ভক্ত অপেক্ষা করেছেন প্রিয় লেখককে শেষবারের মতো দেখার জন্য। কিন্তু সেখানে কাউকে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দেখার সুযোগ দেওয়া হয়নি। সকাল ৯টার দিকে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ গ্রহণ করেন তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের বাবা প্রকৌশলী মোতাহার হোসেন। সেখান থেকে ৯টা ২৫ মিনিটে জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের একটি লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানে করে মরদেহ নিয়ে যাত্রা শুরু হয় নুহাশপল্লীর দিকে। এরপর উত্তরা থেকে শাওন ও তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য লাশবাহী গাড়ির সঙ্গে যোগ দেন।
এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রীর ছেলে নুহাশ হুমায়ূন, দুই মেয়ে নোভা ও শীলা এবং তাঁর দুই ভাই মুহম্মদ জাফর ইশবাল, আহসান হাবীব ও তাঁদের দুই বোন আলাদাভাবে নুহাশপল্লীতে পৌঁছান।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে হোতাপাড়া বাজার। সেখান থেকে পশ্চিমে আট কিলোমিটার দূরে পিরুজালী গ্রাম। ১৯৯৭ সালে ওই গ্রামে ৪০ বিঘা জমিতে বড় ছেলে নুহাশের নামে 'নুহাশপল্লী' গড়ে তোলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেখানে তিনি দুর্লভ আড়াই শ প্রজাতির বৃক্ষ ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ লাগিয়েছেন। গাছ ছাড়াও হাঁস, রাজহাঁস, গরু, কবুতরসহ বিভিন্ন প্রাণী এখানে রয়েছে। এই নুহাশপল্লীতেই হুমায়ূন আহমেদ গড়ে তুলেছেন শুটিং স্পট, দিঘি, তিনটি সুদৃশ্য বাংলো আর অনেক ভাস্কর্য। দিঘিটি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের গর্ভে মৃত কন্যা লীলাবতীর নামে। বিশাল দিঘির ওপর রয়েছে একটি কাঠের সেতু। দিঘির মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপ।
নুহাশপল্লীতে রয়েছে বিশাল এক ঔষধি গাছের বাগান। সেটির নামকরণ করেছেন প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের গর্ভে জন্ম নেওয়া প্রয়াত শিশুপুত্র রাশেদ হুমায়ূনের নামে। তিনটি বাংলোর একটির নাম 'বৃষ্টিবিলাস'। ওপরে টিনের চাল। বৃষ্টির দিনে এখানে তিনি শুনতেন বৃষ্টির নূপুর। দিঘির পশ্চিম পাড়ে একটি বাংলোর নাম 'ভূতবিলাস'। অন্য বাংলোটিতে থাকতেন তিনি। সেটি কর্মচারীদের কাছে স্যারের বাংলো নামে পরিচিত।
সবুজ নিসর্গ, পাখপাখালি আর নুহাশপল্লীর কর্মচারীরা এখন অভিভাবকহীন। শোকে ম্রিয়মাণ সবাই। মনে হয় প্রাণহীন দাঁড়িয়ে থাকা একের পর এক পাথরের ভাস্কর্য মা ও শিশু, রাক্ষস, ডাইনোসর, শালিক, মৎস্যকন্যা- সবার মধ্যেই ছড়িয়ে গেছে থমথমে শোক।
বিকেল ৩টার দিকেও ছিল ঝিরঝির বৃষ্টি। ততক্ষণে দাফন পর্ব শেষ করে ভক্তরা চোখ মুছতে মুছতে ফিরছিলেন ঘরে। পথের দুই পাশে সবুজের সারি। সেগুন, কড়ই ও শালসহ অসংখ্য গাছের সমারোহ। গাছপালা ভিজছে, শালপাতা ভিজছে। পাতা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বৃষ্টির কণা। পেছনে তখন পড়ে আছেন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। নুহাশপল্লীর প্রিয় মাটি তাঁকে ধারণ করেছে পরম মমতায়। লিচুতলায় বৃষ্টি পড়বে। কচি পাতা ভিজবে। জ্যোৎস্না রাতে ঝরবে অপূর্ব আলো। সেই মায়াবী আলো তাঁর কবরের ওপর তৈরি করবে অপূর্ব নকশা। আলো-অন্ধকারে হয়তো কেউ তা দেখে গভীর বেদনায় বলে উঠবে- আহা রে! আহা রে!
চোখের পানি আর বৃষ্টির পানিতে একাকার চারদিক। ভক্তদের কান্না দেখে আকাশও বুঝি উজাড় করে দিয়েছিল অঝোরধারা। চোখের পানি আর বৃষ্টিতে ভিজে সাহিত্যের রাজপুত্রকে বিদায় জানালেন ভক্ত-অনুরাগীরা। 'নুহাশপল্লী'র যে লিচুতলা ছিল তাঁর অতি প্রিয়, যে শ্যামল ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতেন তিনি- সেখানেই, মাটির ঘরে গতকাল মঙ্গলবার চিরবিশ্রামে চলে গেলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
গতকাল বাদ জোহর নুহাশপল্লীর লিচুতলায় তৃতীয় জানাজা শেষে হুমায়ূন আহমেদের দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় বারডেম হাসপাতালের হিমাগার থেকে নুহাশপল্লীর উদ্দেশে তাঁর মরদেহ নিয়ে রওনা হন পরিবারের সদস্যরা। দুপুর সোয়া ১২টায় তাঁর মরদেহবাহী ফ্রিজার ভ্যানটি নুহাশপল্লীতে পৌঁছে। এলাকাবাসী আর নুহাশপল্লীর কর্মচারীদের কান্না ও আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে পুরো পরিবেশ। স্বজনদের বিলাপে এ সময় চোখে অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি উপস্থিত কেউই।
'মরিলে কান্দিস না আমার দায়' গানটি হুমায়ূন আহমেদের অতি প্রিয় একটি গান। ভক্তরাও জানেন এ কথা। কিন্তু হুমায়ূনকে সমাহিত করতে গিয়ে কেঁদেছেন সবাই।
লিচুতলায় শেষ শয্যা : হুমায়ূন আহমেদ সব সময়ই প্রকৃতির মাঝেই থাকতে চাইতেন। জ্যোৎস্না রাত কিংবা বর্ষাকালে পূর্ণ চন্দ্র দর্শন ও টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনতে ছুটে যেতেন নুহাশপল্লীতে। সেই নুহাশপল্লীর প্রিয় লিচুতলায় তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। গতকাল দুপুর সোয়া ২টার দিকে লিচুগাছের তলায় তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মতো দেখেন তাঁদের প্রিয় মানুষের মুখখানি। তাঁর জ্ঞাত ও অজ্ঞাত যাবতীয় ভুলের জন্য সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন স্বজনরা। এ সময় স্ত্রী শাওন ও তাঁর দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন, প্রথম পক্ষের ছেলে নুহাশ হুমায়ূনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা ক্ষমা প্রার্থনা করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীব উপস্থিত ছিলেন এ সময়।
এরপর শ্রাবণের অঝোরধারার মধ্যেই ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বড় ছেলে নুহাশ, দীর্ঘদিনের সঙ্গী মাজহারুল ইসলামসহ স্বজন-সুহৃদরা কাঁধে তুলে কবরের দিকে নিয়ে যান মরদেহ। সেখানে পরিবারের সদস্য ও সুহৃদরা মাটি দিয়ে ঢেকে দেন নন্দিত এ কথাসাহিত্যিকের নিথর দেহ।
এদিকে দাফন শেষে সাংবাদিকদের কাছে হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্ন পূরণ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন স্ত্রী শাওন। হুমায়ূন আহমেদের নিজের হাতে গড়া নুহাশপল্লীকে ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালনা করে স্বামীর অধরা স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করবেন বলে তিনি জানান।
শাওন বলেন, 'নুহাশপল্লীকে একটি ট্রাস্ট করতে চেয়েছিলেন হুমায়ূন। কিন্তু তিনি তা করে যেতে পারলেন না। আমার যদি কোনো সুযোগ থাকে তাহলে তাঁর ইচ্ছা পূরণে আমি চেষ্টা করব।'
দাফনের পর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, 'হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি পছন্দ করতেন। সেই বৃষ্টির মাঝেই তাঁর জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। নিউ ইয়র্কে তাঁর জানাজার সময়ও বৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশেও একই অবস্থা।' এ সময় তিনি সুষ্ঠুভাবে দাফন হওয়ায় পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানান।
হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শেষ জানাজা
আকাশ থেকে বিরামহীনভাবে ঝরছিল শ্রাবণ ধারা। তারই মাঝে খালি মাথায় দাঁড়িয়ে হাজারো মানুষ অংশ নেয় হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় ও শেষ জানাজায়। এর আগে নিউ ইয়র্কে শুক্রবার ও জাতীয় ঈদগাহে সোমবার তাঁর দুটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
নুহাশপল্লীতে গতকাল যোহরের নামাজ শেষে দুপুর দেড়টার দিকে স্থানীয় মসজিদের ইমাম মজিবুর রহমানের পরিচালনায় হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় ও শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে এলাকাবাসীসহ দূরদূরান্ত থেকে আসা হুমায়ূন ভক্তরা অংশ নেয়।
হুমায়ূন আহমেদের দাফন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে স্থানীয় প্রশাসন ছিল ব্যাপক তৎপর। ঢাকা থেকে গাজীপুরের হোতাপাড়ার পিরুজালী গ্রামের নুহাশপল্লীতে আসার পথে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। তাঁর মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স ছাড়াও প্রায় শখানেক গাড়ির বহরে ছিল পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তা।
অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদকে শেষ বিদায় জানাতে সকাল থেকে ভক্তরা নুহাশপল্লীতে ভিড় জমাতে থাকে। রোদ-বৃষ্টি কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি প্রিয় লেখকের প্রতি ভক্তের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিবেদনের পথে।
একপর্যায়ে পিরুজালী গ্রাম থেকে নুহাশপল্লী পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা লোকে-লোকারণ্য হয়ে যায়।
এর আগে গতকাল শাহবাগের বারডেম থেকে যাত্রা শুরু হয় সকাল ৯টায়। সেখানেও অনেক ভক্ত অপেক্ষা করেছেন প্রিয় লেখককে শেষবারের মতো দেখার জন্য। কিন্তু সেখানে কাউকে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দেখার সুযোগ দেওয়া হয়নি। সকাল ৯টার দিকে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ গ্রহণ করেন তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের বাবা প্রকৌশলী মোতাহার হোসেন। সেখান থেকে ৯টা ২৫ মিনিটে জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের একটি লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানে করে মরদেহ নিয়ে যাত্রা শুরু হয় নুহাশপল্লীর দিকে। এরপর উত্তরা থেকে শাওন ও তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য লাশবাহী গাড়ির সঙ্গে যোগ দেন।
এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রীর ছেলে নুহাশ হুমায়ূন, দুই মেয়ে নোভা ও শীলা এবং তাঁর দুই ভাই মুহম্মদ জাফর ইশবাল, আহসান হাবীব ও তাঁদের দুই বোন আলাদাভাবে নুহাশপল্লীতে পৌঁছান।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে হোতাপাড়া বাজার। সেখান থেকে পশ্চিমে আট কিলোমিটার দূরে পিরুজালী গ্রাম। ১৯৯৭ সালে ওই গ্রামে ৪০ বিঘা জমিতে বড় ছেলে নুহাশের নামে 'নুহাশপল্লী' গড়ে তোলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেখানে তিনি দুর্লভ আড়াই শ প্রজাতির বৃক্ষ ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ লাগিয়েছেন। গাছ ছাড়াও হাঁস, রাজহাঁস, গরু, কবুতরসহ বিভিন্ন প্রাণী এখানে রয়েছে। এই নুহাশপল্লীতেই হুমায়ূন আহমেদ গড়ে তুলেছেন শুটিং স্পট, দিঘি, তিনটি সুদৃশ্য বাংলো আর অনেক ভাস্কর্য। দিঘিটি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের গর্ভে মৃত কন্যা লীলাবতীর নামে। বিশাল দিঘির ওপর রয়েছে একটি কাঠের সেতু। দিঘির মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপ।
নুহাশপল্লীতে রয়েছে বিশাল এক ঔষধি গাছের বাগান। সেটির নামকরণ করেছেন প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের গর্ভে জন্ম নেওয়া প্রয়াত শিশুপুত্র রাশেদ হুমায়ূনের নামে। তিনটি বাংলোর একটির নাম 'বৃষ্টিবিলাস'। ওপরে টিনের চাল। বৃষ্টির দিনে এখানে তিনি শুনতেন বৃষ্টির নূপুর। দিঘির পশ্চিম পাড়ে একটি বাংলোর নাম 'ভূতবিলাস'। অন্য বাংলোটিতে থাকতেন তিনি। সেটি কর্মচারীদের কাছে স্যারের বাংলো নামে পরিচিত।
সবুজ নিসর্গ, পাখপাখালি আর নুহাশপল্লীর কর্মচারীরা এখন অভিভাবকহীন। শোকে ম্রিয়মাণ সবাই। মনে হয় প্রাণহীন দাঁড়িয়ে থাকা একের পর এক পাথরের ভাস্কর্য মা ও শিশু, রাক্ষস, ডাইনোসর, শালিক, মৎস্যকন্যা- সবার মধ্যেই ছড়িয়ে গেছে থমথমে শোক।
বিকেল ৩টার দিকেও ছিল ঝিরঝির বৃষ্টি। ততক্ষণে দাফন পর্ব শেষ করে ভক্তরা চোখ মুছতে মুছতে ফিরছিলেন ঘরে। পথের দুই পাশে সবুজের সারি। সেগুন, কড়ই ও শালসহ অসংখ্য গাছের সমারোহ। গাছপালা ভিজছে, শালপাতা ভিজছে। পাতা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বৃষ্টির কণা। পেছনে তখন পড়ে আছেন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। নুহাশপল্লীর প্রিয় মাটি তাঁকে ধারণ করেছে পরম মমতায়। লিচুতলায় বৃষ্টি পড়বে। কচি পাতা ভিজবে। জ্যোৎস্না রাতে ঝরবে অপূর্ব আলো। সেই মায়াবী আলো তাঁর কবরের ওপর তৈরি করবে অপূর্ব নকশা। আলো-অন্ধকারে হয়তো কেউ তা দেখে গভীর বেদনায় বলে উঠবে- আহা রে! আহা রে!
No comments