সময়ের প্রতিধ্বনি-রমজানেই হোক দুই নেত্রীর সমঝোতা বৈঠক by মোস্তফা কামাল
পবিত্র রমজানের কারণে জাতীয় রাজনীতির উত্তাপ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেছে। রাজপথের উত্তাপ কিছুটা ক্যাম্পাসে ছড়ালেও সেখানে চলছে অন্য খেলা। কেউ কেউ অবশ্য সেখানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, দেশের অভ্যন্তরে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে একটি পক্ষ সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাসে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের পেছন থেকে ইন্ধন জোগাচ্ছে সরকারবিরোধী একটি পক্ষ। এ বিষয়ে সরকার কতটা সজাগ রয়েছে তা আমাদের জানা নেই।
তবে 'ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার'-এর মতো শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বেশ চেষ্টা-তদবির করছেন। জাবি বা বুয়েট যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সে জন্য তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁকে কখনো কখনো বেশ অসহায় মনে হয়। শিক্ষা খাতে তিনি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁকে নির্লিপ্ত দেখা যায়। তিনি কি কখনো কখনো অদৃশ্য কোনো ইশারায় নিজেকে গুটিয়ে রাখেন? এর নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, অশুভ রাজনীতির খেলোয়াড়রা বেশ তৎপর। শিক্ষাঙ্গনের চলমান ঘটনাগুলো বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অস্থিরতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে না তো!
আশঙ্কা করা হচ্ছে, ক্যাম্পাসের রাজনীতি জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনকে উত্তপ্ত করতে পারে। এখন সিয়াম সাধনার মাস। এখনকার রাজনীতি ইফতার পার্টি আর টিভি টক শোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ঈদের পরেই নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে বিরোধী দল তুখোড় আন্দোলন শুরু করবে। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ লাগাতার হরতালের আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী ও জোটের শরিকদের সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে বলা হচ্ছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, ঈদের পর এমন আন্দোলন শুরু হবে যে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে বাধ্য হবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক দিন আগেই আওয়ামী লীগের এক সহযোগী সংগঠনের কাউন্সিলে বক্তৃতাকালে বলেছেন, নির্বাচিত সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে। এটা যদি তাঁর মনের কথা হয় তাহলে রাজনীতি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতেই আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। আবার জ্বালাও-পোড়াও-হরতালের রাজনীতি জনগণকে সহ্য করতে হবে! অতীতেও সরকার ও বিরোধী দলের একগুঁয়েমির কারণে দেশের সাধারণ মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। ভবিষ্যতেও কত রক্ত ঝরাতে হয় কে জানে!
তবে আমরা মনে করি, এবারের সিয়াম সাধনার মাসটি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছার একটা বড় সুযোগ। এই সুযোগকে উভয় পক্ষের কাজে লাগানো উচিত। রমজানে সাধারণত প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রীকে এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে ইফতারের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এ ধরনের লোক-দেখানো আমন্ত্রণের কোনো মানে হয় না। আমরা দেখতে চাই, প্রধানমন্ত্রী নিজে বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাসায় গিয়ে গণভবনে ইফতারের আমন্ত্রণ জানাবেন। তাহলে নিশ্চয়ই বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ ফেলতে পারবেন না। তাঁকে গণভবনে যেতেই হবে। তখন তাঁরা দুজন একসঙ্গে বসে ইফতার খেতে খেতে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সংকট নিরসনের পথ বেরিয়ে আসবে। সংকট সমাধানের এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পন্থা। তাঁরা দুজন যে সমাধান দেবেন, সেটা সব পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে।
অতীতে যে দুই নেত্রীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা হয়নি তা নয়। আমরা তো দেখেছি, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে দুই নেত্রী বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, স্বৈরাচারের পতন ঘটানো ছাড়া তাঁরা ঘরে ফিরবেন না। কার্যত তাই হয়েছিল। তাঁরা যুগপৎ আন্দোলন শুরু করায় এরশাদের বিদায় ত্বরান্বিত হয়েছিল। এখনো দেশের স্বার্থে তাঁদের মধ্যে সমঝোতা হওয়া একান্তভাবে প্রয়োজন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানাবেন কি না। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনদের কাছে শুনেছি, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তিনি বৈঠক করতে চান না। তিনি বলেছেন, বেগম জিয়া ১৫ আগস্ট (বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত দিবস) জন্মদিন পালন করেন। তিনি জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ বানানোর অপচেষ্টা করেছেন এবং করছেন। পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতি করেছেন। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। খুনিদের চাকরিতে পদোন্নতিসহ রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত বানিয়েছেন। এখনো তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন। এসব জানার পরও তিনি বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন কী করে! নৈতিক কারণেই তিনি তা পারেন না।
শেখ হাসিনার অভিযোগের হয়তো সত্যতা আছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে, সেগুলোর বিচারের ভার না হয় জনগণের ওপরই থাকুক। এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে বেগম জিয়া একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের প্রধান। তিনি ব্যক্তিগতভাবে তুমুল জনপ্রিয়। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির শক্ত ভিত্তি রয়েছে। বেগম জিয়া দুই-দুইবার পূর্ণ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ভবিষ্যতেও হয়তো প্রধানমন্ত্রী হবেন। কাজেই রাজনৈতিক কারণেই তাঁর সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে। তা ছাড়া দেশের সামগ্রিক স্বার্থের কথাও প্রধানমন্ত্রীকে ভাবতে হবে। হাসানুল হক ইনু সাহেব যা-ই বলুন, বেগম জিয়াকে কি রাজনীতি থেকে মাইনাস করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় তাহলে তো সমঝোতার পথেই যেতে হবে। সমঝোতা না হলে বিরোধ আরো প্রকট হবে। অনিশ্চয়তা বাড়বে। এমনিতেই আওয়ামী লীগ-বিএনপির সম্পর্ক শত্রুতাপূর্ণ হয়ে উঠছে। উভয় দলের নেতা-কর্মীদের ব্যক্তিগত সম্পর্কও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কলুষিত হচ্ছে দেশের রাজনীতি। আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে কি এই অপরাজনীতি সমর্থন করতেন?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কাছ থেকে রাজনীতিটা খুব ভালো করেই রপ্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে কখনোই ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট করেননি। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন। এ কথা জেনেও বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ করেননি। আবার বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তাঁর সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন মওলানা ভাসানী। অথচ যেকোনো সংকটে তিনি ভাসানীর কাছেই পরামর্শ নেওয়ার জন্য ছুটে যেতেন। তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা চাইতেন। আর তাই বঙ্গবন্ধু বিব্রত হতে পারেন এমন কোনো কাজ ভাসানী করেননি।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা পিতার সেই আদর্শের রাজনীতি থেকে কি অনেক দূরে? বঙ্গবন্ধুর বিশালত্ব, তাঁর উদারতার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। শেখ হাসিনা কি সেই দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারেন না! তিনি ক্ষুদ্রতাকে দূরে ঢেলে উদার মানসিকতা নিয়ে বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করবেন- এটা দেশবাসী আশা করে। দেশের মানুষ যখন দেখে শেখ হাসিনা সরাসরি খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন, তখন তারা কষ্ট পায়। দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ দেখতে চায় না।
লোকমুখে শুনি, দুই নেত্রীর চার পাশে কিছু চাটুকার রয়েছে। তারা চায় না, দুই নেত্রীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠুক। তারা দুজনের বিরোধ জিইয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। তাতে যে দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যায় সে চিন্তা তারা করে না। এই চাটুকারদের কথায় কান না দিয়ে তাঁরা নিজেরাই কথা বলার উদ্যোগ নিতে পারেন। তা ছাড়া দুটি প্রধান দলের শীর্ষ দুই নেত্রীর মধ্যে কেন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক থাকবে না? কেন দেখা-সাক্ষাৎ হবে না? কেন একজন আরেকজনের পারিবারিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দেবেন না? বাংলাদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি তো এমনই।
অথচ দুই নেত্রীর কারণে বাঙালির হাজার বছরের চিরায়ত কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে উল্টো স্রোত বইছে। তাঁদের মতবিরোধের নেতিবাচক প্রভাব শুধু রাজনীতিতে নয়, একেকটি পরিবারেও পড়ছে। রাজনীতিতে মতবিরোধ থাকতে পারে, শত্রুতা থাকবে কেন? আমেরিকাতেও তো দ্বিদলীয় রাজনীতি বিদ্যমান। কই, সেখানে তো দুই দলের সম্পর্ক এমন শত্রুভাবাপন্ন নয়! এখানে কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? বিষয়টি কি দুই নেত্রী ভেবে দেখবেন?
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
e-mail : mostofakamalbd@yahoo.com
No comments