সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-নিরীহ গোবেচারারা যখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকি by ইমতিয়াজ আহমেদ
গরু চোরাচালান বন্ধ করে এর ব্যবসা বৈধ করার উদ্যোগও তাই আপাতত হিমাগারে থেকে যাওয়ার কথা। অথচ এর সমাধানের জন্য প্রত্যাশা করা হয় সংকীর্ণ স্বার্থের ঊধর্ে্ব উঠে পদক্ষেপের। কারণ এখন যে ব্যবস্থা চলছে তাতে অবোধ প্রাণী বধ থেমে থাকছে না, একই সঙ্গে নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটছে, যার নিন্দায় সোচ্চার অনেক অনেক মানুষ।
এমনকি ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও দাবি তুলছে শান্তির সীমান্ত গড়ে তোলার। নির্বিচারে গুলি করে নিরীহ মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে তাদের সাহসী উচ্চারণ আমাদেরও ভরসা জোগায়
শিক্ষার মাধ্যমে গরু-গাধা তৈরি হয়_ এমন কথা আমরা প্রায়ই শুনি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মনে করতেন যে, এমনটি ঘটতে পারে। বাস্তবে গরুর সঙ্গে তুলনা করলে কোনো মানুষই খুশি হয় না। এ ধরনের ঘটনায় গরুর কী প্রতিক্রিয় হয়, সেটা জানার উপায় নেই। তাদের কি আত্মসম্মানে লাগে! কে জানে।
আজকের লেখা মানুষ ও গরু নিয়ে এবং এ বিষয়টি শুধু এই দুই ধরনের প্রাণীর নয়, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কেও জটিলতা সৃষ্টি করে চলেছে। বাস্তব জীবনে গরু ছাড়া আমাদের একদিনও চলে না। সঙ্গত কারণেই এ অবোধ প্রাণীর কারণে যে সমস্যা প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে সেটাও উপেক্ষার উপায় নেই।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে দীর্ঘ স্থল সীমান্ত। এ পথে প্রতিদিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ বৈধভাবে যাতায়াত করে। ব্যবসা-বাণিজ্যও চলে। আবার পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া মানুষ চলাচলের ঘটনাও একেবারে কম বলা যাবে না। ব্যবসার ক্ষেত্রেও অনেকে চলে ঘুরপথে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আলোচনায় রয়েছে গরু চোরাচালান। বিষয় কেবল অর্থনীতির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই, এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যা। ভারতের তরফে তো বিষয়টিকে প্রায়শই তাদের নিরাপত্তা সমস্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। নিরীহ গোবেচারারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে গণ্য হতে থাকলে সেটা রুখতে সীমান্ত প্রহরীরা 'আইনি' পদক্ষেপ নিতেই পারে। প্রকৃত তথ্যও কিন্তু তারই সাক্ষ্য দেয়। ভারত তার সীমান্তের সুরক্ষার জন্য বিএসএফ নামে যে রক্ষীদের দায়িত্ব দিয়েছে তাদের গুলিতে গত ১০ বছরে এক হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে এবং তাদের বেশিরভাগ বাংলাদেশি। এ প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো সাংবাদিকের লেখায় শিরোনাম হয়েছে_ এ সাউথ এশিয়ান কিলিং ফিল্ড। বিএসএফের দাবি যে কেবল ক্রিমিনালদেরই তারা গুলি করে এবং তাদের বেশিরভাগ চোরকারবারি। নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তাদের একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ২০০৭ সালে সীমান্তে বিএসএফের গুলিবর্ষণের ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছিল সর্বোচ্চ_ ৭৯১টি। ২০০৮ সালে ৫৭২টি, ২০০৯ সালে ৫৯৮টি এবং ২০১০ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ২১৮টি। এ চার বছরে নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৮১, ৪৬, ৪৮ ও ২২ জন। অন্যদিকে ভারতীয় নিহত হয়েছে যথাক্রমে ৫৬, ৩৭, ৩৯ ও ১৮ জন। বিএসএফের দাবি অনুযায়ী তাদের গুলিতে চার বছরে বাংলাদেশি নিহত হয়েছে ১৯৭ জন এবং ভারতীয় নিহত হয়েছে ১৫০ জন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বা বিজিবি-বিএসএফের গুলিবর্ষণে বাংলাদেশি নিহতের সংখ্যা বলছে আরও বেশি। তারা একটি হিসাব দিয়েছে এভাবে_ ১৯৭২ থেকে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশিদের মধ্যে বেসামরিক লোক রয়েছে ১১৫৪ জন এবং বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী ১৬ জন। এ হিসাবে বিএসএফের গুলিতে ভারতীয় কতজনের মৃত্যু হয়েছে সে তথ্য নেই। তবে ওপরের তথ্য থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত, গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে ভারতীয় ভূখণ্ডে এবং দ্বিতীয়ত, গুলিবর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনা গরু চোরাচালান সংশ্লিষ্ট।
একটি তথ্য এখানে উল্লেখ করা যায়। সংখ্যাটি একেবারে নির্ভুল, সেটা বলা যাবে না। তবে একেবারে অনুমাননির্ভরও নয়। এ তথ্য বলছে_ প্রতি বছর বাংলাদেশে চোরাপথে আসছে ১৫ লাখ গরু। এর মূল্য মোটামুটি ৫০ কোটি মার্কিন ডলার_ বাংলাদেশের মুদ্রায় যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, এত গরু কেন চোরাপথে আসে? বৈধ পথে কেন ভারত থেকে এ পশু আমদানি করা হয় না? ২০১১ সালের ১৬ জুলাই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশিদের এক 'ট্রাক-২' সংলাপে এ প্রশ্ন উঠলে ভারতীয়দের তরফে বলা হয়, ধর্মীয় কারণে ভারত জীবিত গরু রফতানি করতে পারে না। যেহেতু ভারতের হিন্দুদের কাছে গরু পবিত্র প্রাণী, এ কারণে বৈধ পথে তা রফতানির উদ্যোগে উগ্রপন্থিদের কাছ থেকে বাধা আসবে। কোনো রাজনৈতিক দলই এ বিষয়টিতে ঝুঁকি নিতে চায় না। এমনকি প্রকাশ্যে ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে দাবিদার কংগ্রেসও ব্যতিক্রম নয়।
কিন্তু এ মত কতটা গ্রহণযোগ্য? ভারত জীবিত প্রাণী রফতানি করে না এবং গরুও এ দলভুক্ত। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নেপালে ভারতীয় জীবিত প্রাণী কীভাবে রফতানি হচ্ছে? ভারতের রফতানি নীতিতে অবশ্য বলা রয়েছে যে, জীবিত গরু ও মহিষ রফতানি 'নিয়ন্ত্রিত'। অর্থাৎ লাইসেন্স থাকলে অনুমোদিত। কিন্তু গরু, ষাঁড় ও বাছুরের মাংস রফতানি 'নিষিদ্ধ'। কিন্তু ভারতীয় গবাদিপশু ও পশুজাত দ্রব্য বিষয়ে রিতাম্ভরা সিং ২০১০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছেন, দুধ দেওয়ার বয়স পেরিয়ে যায় যেসব মহিষ সাধারণভাবে সেগুলোই মাংসের জন্য জবাই করা হয়। ভারতে এখন প্রায় ৩ হাজার ৯০০ পশু জবাই ঘর রয়েছে। স্থানীয় সরকার এর অনুমতি দিয়ে থাকে। এর বাইরেও অননুমোদিত জবাই ঘর রয়েছে প্রায় ২৬ হাজার। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত আধুনিক রফতানিমুখী মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৩টি। পৌরসভাগুলোও মাংস রফতানির জন্য ২৪টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছে। ভারতের রফতানি বাজারের প্রতি লক্ষ্য রেখে আরও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।
ভারতের কয়েকটি রাজ্যে গোবধ নিষিদ্ধ আইন রয়েছে। কিন্তু যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বেশিরভাগ গরু অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসছে সেখানে এ আইন বলবৎ নেই। পশ্চিমবঙ্গে গরুর মাংস বিক্রি ও খাওয়া হয়। তাহলে বাংলাদেশে রফতানি বন্ধ রাখা কেন? এর একটি কারণ হতে পারে যে, গরুর চোরাচালান থেকে লাভের পরিমাণ খুব বেশি এবং এ কারণে একটি প্রভাবশালী মহল তা বন্ধ করতে আগ্রহী নয়। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ভারতের বিহার সংলগ্ন ঝাড়খণ্ডে যে গরুর দাম ১০০ ডলার, বাংলাদেশে প্রবেশ করলে তার দাম উঠে যায় ৩৫০ থেকে ৯০০ ডলারে। আরেকটি হিসাবে বলা হয়, বিএসএফ ২০০৮ সালে ৬ কোটি ২০ লাখ ডলার মূল্যের ৭০ হাজার গরু বাংলাদেশ সীমান্তে আটক করেছিল। ২০০২ সালের এক জরিপে দেখা যায়, অবৈধ পথে যেসব পণ্য ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে তার মধ্যে ৪৩ শতাংশই জীবিত গরু ও মহিষ। উচ্চমাত্রায় লাভের কারণেই কি গরুর চোরাচালান বন্ধ করা হচ্ছে না?
কিন্তু সীমান্তে বিএসএফ অব্যাহতভাবে গুলিবর্ষণ করে যেতে থাকায় বাংলাদেশিদের ওপর যে বিরূপ প্রতিক্রিযা হচ্ছে তার মূল্য কীভাবে নিরূপণ করা যাবে? দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের পথে এর ফলে মনস্তাত্তি্বক বাধা তৈরি হয়ে আছে, সেটা তারা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন।
ভারত একজন বাঙালি রাষ্ট্রপতি পেয়েছে_ প্রণব মুখার্জি। তিনি আজীবন রাজনীতিক। চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি সক্রিয় ছিলেন দিলি্লতে। এ সময়ে তার নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে, কিন্তু তাতে তেমন সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুযোগ তার ছিল না। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর আমলে অর্থমন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রিসভায় তার অবস্থান ছিল প্রধানমন্ত্রীর পরেই। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, এমন ধারণা অনেকে করছিলেন। কিন্তু নেহরু-গান্ধী পরিবারেরই কারও এ দায়িত্ব পাওয়া উচিত_ এমন ভাব থেকেই কংগ্রেসের পাওয়ার ব্রোকাররা অরাজনৈতিক ব্যক্তি রাজীব গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসায়। ক্ষুব্ধ প্রণব মুখার্জি কংগ্রেস থেকে সরে গিয়ে নতুন দল গঠন করেন। তবে নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হলে তাকে পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ সময়ে ভারতে অর্থনীতি উদার করার নীতি গ্রহণ করা হয়, যার কৃতিত্ব দেওয়া হয় মনমোহন সিংকে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, এ সংক্রান্ত নীতি ও কর্মকৌশল প্রণয়নে প্রণব মুখার্জির অবদান যথেষ্ট ছিল, যা আড়ালে রয়ে গেছে। এ সময়ে তিনি দলে সোনিয়া গান্ধীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা নেন, যার মূল্যায়ন পরে করা হয়েছে বলেই ধারণা করা হয়। কিন্তু ২০০৪ সালে বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেস অনেকটা আকস্মিকভাবেই ক্ষমতায় ফিরে এলে প্রণব মুখার্জি ফের আশাহত হন। সোনিয়া গান্ধী 'অন্তরাত্মার আহ্বানে' প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয় ড. মনমোহন সিংয়ের হাতে। আর প্রণব মুখার্জিকে দেওয়া হয় তার অধীনে একটি মন্ত্রীর পদ।
অবশেষে তিনি উঠে এলেন শীর্ষ পদে, তবে সেটা এখন পর্যন্ত একেবারেই আলঙ্কারিক। প্রথা অনুযায়ী তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন বলেই ধারণা করা যায়। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নত করায় ভূমিকা রাখার সুযোগও তার জন্য সীমিত হয়ে পড়বে। ভারতের রাষ্ট্রপতি সবসময় দলের ঊধর্ে্ব থাকার চেষ্টা করেন। তিনি দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ একেবারেই করেন না। এ ক্ষেত্রে তার আমলে ব্যতিক্রম ঘটে কিনা, সেটা দেখার বিষয়। যদি ব্যতিক্রম ঘটে তাহলে বিতর্কিত হওয়ার শঙ্কাও থেকে যায়, যাতে ঝুঁকি অনেক।
বাংলাদেশের সুহৃদ হিসেবে অনেকে তাকে মনে করেন। তবে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের যে ধারা বাংলাদেশ নতুন সরকারের আমলে সূচিত হয়েছিল তার পথে বড় একটি বাধা হয়ে আছেন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। তার ওপর নতুন রাষ্ট্রপতি প্রভাব খাটাতে পারবেন, এমন সম্ভাবনা কম। তাছাড়া ভারতে সাধারণ নির্বাচন সামনে। বাংলাদেশেও প্রায় একই সময়ে নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, কোনো দেশের জন্যই তার আগাম ধারণা করা চলে না। এ প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথের বাধাগুলো দূর করায় সাহসী ও সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ দিলি্লর তরফে নেওয়া হবে, এমন আশা করা কঠিন বৈকি।
গরু চোরাচালান বন্ধ করে এর ব্যবসা বৈধ করার উদ্যোগও তাই আপাতত হিমাগারে থেকে যাওয়ার কথা। অথচ এর সমাধানের জন্য প্রত্যাশা করা হয় সংকীর্ণ স্বার্থের ঊধর্ে্ব উঠে পদক্ষেপের। কারণ এখন যে ব্যবস্থা চলছে তাতে অবোধ প্রাণী বধ থেমে থাকছে না, একই সঙ্গে নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটছে, যার নিন্দায় সোচ্চার অনেক অনেক মানুষ। এমনকি ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও দাবি তুলছে শান্তির সীমান্ত গড়ে তোলার। নির্বিচারে গুলি করে নিরীহ মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে তাদের সাহসী উচ্চারণ আমাদেরও ভরসা জোগায়।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ :রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং অধ্যাপক; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষার মাধ্যমে গরু-গাধা তৈরি হয়_ এমন কথা আমরা প্রায়ই শুনি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মনে করতেন যে, এমনটি ঘটতে পারে। বাস্তবে গরুর সঙ্গে তুলনা করলে কোনো মানুষই খুশি হয় না। এ ধরনের ঘটনায় গরুর কী প্রতিক্রিয় হয়, সেটা জানার উপায় নেই। তাদের কি আত্মসম্মানে লাগে! কে জানে।
আজকের লেখা মানুষ ও গরু নিয়ে এবং এ বিষয়টি শুধু এই দুই ধরনের প্রাণীর নয়, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কেও জটিলতা সৃষ্টি করে চলেছে। বাস্তব জীবনে গরু ছাড়া আমাদের একদিনও চলে না। সঙ্গত কারণেই এ অবোধ প্রাণীর কারণে যে সমস্যা প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে সেটাও উপেক্ষার উপায় নেই।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে দীর্ঘ স্থল সীমান্ত। এ পথে প্রতিদিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ বৈধভাবে যাতায়াত করে। ব্যবসা-বাণিজ্যও চলে। আবার পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া মানুষ চলাচলের ঘটনাও একেবারে কম বলা যাবে না। ব্যবসার ক্ষেত্রেও অনেকে চলে ঘুরপথে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আলোচনায় রয়েছে গরু চোরাচালান। বিষয় কেবল অর্থনীতির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই, এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যা। ভারতের তরফে তো বিষয়টিকে প্রায়শই তাদের নিরাপত্তা সমস্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। নিরীহ গোবেচারারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে গণ্য হতে থাকলে সেটা রুখতে সীমান্ত প্রহরীরা 'আইনি' পদক্ষেপ নিতেই পারে। প্রকৃত তথ্যও কিন্তু তারই সাক্ষ্য দেয়। ভারত তার সীমান্তের সুরক্ষার জন্য বিএসএফ নামে যে রক্ষীদের দায়িত্ব দিয়েছে তাদের গুলিতে গত ১০ বছরে এক হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে এবং তাদের বেশিরভাগ বাংলাদেশি। এ প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো সাংবাদিকের লেখায় শিরোনাম হয়েছে_ এ সাউথ এশিয়ান কিলিং ফিল্ড। বিএসএফের দাবি যে কেবল ক্রিমিনালদেরই তারা গুলি করে এবং তাদের বেশিরভাগ চোরকারবারি। নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তাদের একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ২০০৭ সালে সীমান্তে বিএসএফের গুলিবর্ষণের ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছিল সর্বোচ্চ_ ৭৯১টি। ২০০৮ সালে ৫৭২টি, ২০০৯ সালে ৫৯৮টি এবং ২০১০ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ২১৮টি। এ চার বছরে নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৮১, ৪৬, ৪৮ ও ২২ জন। অন্যদিকে ভারতীয় নিহত হয়েছে যথাক্রমে ৫৬, ৩৭, ৩৯ ও ১৮ জন। বিএসএফের দাবি অনুযায়ী তাদের গুলিতে চার বছরে বাংলাদেশি নিহত হয়েছে ১৯৭ জন এবং ভারতীয় নিহত হয়েছে ১৫০ জন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বা বিজিবি-বিএসএফের গুলিবর্ষণে বাংলাদেশি নিহতের সংখ্যা বলছে আরও বেশি। তারা একটি হিসাব দিয়েছে এভাবে_ ১৯৭২ থেকে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশিদের মধ্যে বেসামরিক লোক রয়েছে ১১৫৪ জন এবং বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী ১৬ জন। এ হিসাবে বিএসএফের গুলিতে ভারতীয় কতজনের মৃত্যু হয়েছে সে তথ্য নেই। তবে ওপরের তথ্য থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত, গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে ভারতীয় ভূখণ্ডে এবং দ্বিতীয়ত, গুলিবর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনা গরু চোরাচালান সংশ্লিষ্ট।
একটি তথ্য এখানে উল্লেখ করা যায়। সংখ্যাটি একেবারে নির্ভুল, সেটা বলা যাবে না। তবে একেবারে অনুমাননির্ভরও নয়। এ তথ্য বলছে_ প্রতি বছর বাংলাদেশে চোরাপথে আসছে ১৫ লাখ গরু। এর মূল্য মোটামুটি ৫০ কোটি মার্কিন ডলার_ বাংলাদেশের মুদ্রায় যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, এত গরু কেন চোরাপথে আসে? বৈধ পথে কেন ভারত থেকে এ পশু আমদানি করা হয় না? ২০১১ সালের ১৬ জুলাই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশিদের এক 'ট্রাক-২' সংলাপে এ প্রশ্ন উঠলে ভারতীয়দের তরফে বলা হয়, ধর্মীয় কারণে ভারত জীবিত গরু রফতানি করতে পারে না। যেহেতু ভারতের হিন্দুদের কাছে গরু পবিত্র প্রাণী, এ কারণে বৈধ পথে তা রফতানির উদ্যোগে উগ্রপন্থিদের কাছ থেকে বাধা আসবে। কোনো রাজনৈতিক দলই এ বিষয়টিতে ঝুঁকি নিতে চায় না। এমনকি প্রকাশ্যে ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে দাবিদার কংগ্রেসও ব্যতিক্রম নয়।
কিন্তু এ মত কতটা গ্রহণযোগ্য? ভারত জীবিত প্রাণী রফতানি করে না এবং গরুও এ দলভুক্ত। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নেপালে ভারতীয় জীবিত প্রাণী কীভাবে রফতানি হচ্ছে? ভারতের রফতানি নীতিতে অবশ্য বলা রয়েছে যে, জীবিত গরু ও মহিষ রফতানি 'নিয়ন্ত্রিত'। অর্থাৎ লাইসেন্স থাকলে অনুমোদিত। কিন্তু গরু, ষাঁড় ও বাছুরের মাংস রফতানি 'নিষিদ্ধ'। কিন্তু ভারতীয় গবাদিপশু ও পশুজাত দ্রব্য বিষয়ে রিতাম্ভরা সিং ২০১০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছেন, দুধ দেওয়ার বয়স পেরিয়ে যায় যেসব মহিষ সাধারণভাবে সেগুলোই মাংসের জন্য জবাই করা হয়। ভারতে এখন প্রায় ৩ হাজার ৯০০ পশু জবাই ঘর রয়েছে। স্থানীয় সরকার এর অনুমতি দিয়ে থাকে। এর বাইরেও অননুমোদিত জবাই ঘর রয়েছে প্রায় ২৬ হাজার। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত আধুনিক রফতানিমুখী মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৩টি। পৌরসভাগুলোও মাংস রফতানির জন্য ২৪টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছে। ভারতের রফতানি বাজারের প্রতি লক্ষ্য রেখে আরও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।
ভারতের কয়েকটি রাজ্যে গোবধ নিষিদ্ধ আইন রয়েছে। কিন্তু যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বেশিরভাগ গরু অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসছে সেখানে এ আইন বলবৎ নেই। পশ্চিমবঙ্গে গরুর মাংস বিক্রি ও খাওয়া হয়। তাহলে বাংলাদেশে রফতানি বন্ধ রাখা কেন? এর একটি কারণ হতে পারে যে, গরুর চোরাচালান থেকে লাভের পরিমাণ খুব বেশি এবং এ কারণে একটি প্রভাবশালী মহল তা বন্ধ করতে আগ্রহী নয়। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ভারতের বিহার সংলগ্ন ঝাড়খণ্ডে যে গরুর দাম ১০০ ডলার, বাংলাদেশে প্রবেশ করলে তার দাম উঠে যায় ৩৫০ থেকে ৯০০ ডলারে। আরেকটি হিসাবে বলা হয়, বিএসএফ ২০০৮ সালে ৬ কোটি ২০ লাখ ডলার মূল্যের ৭০ হাজার গরু বাংলাদেশ সীমান্তে আটক করেছিল। ২০০২ সালের এক জরিপে দেখা যায়, অবৈধ পথে যেসব পণ্য ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে তার মধ্যে ৪৩ শতাংশই জীবিত গরু ও মহিষ। উচ্চমাত্রায় লাভের কারণেই কি গরুর চোরাচালান বন্ধ করা হচ্ছে না?
কিন্তু সীমান্তে বিএসএফ অব্যাহতভাবে গুলিবর্ষণ করে যেতে থাকায় বাংলাদেশিদের ওপর যে বিরূপ প্রতিক্রিযা হচ্ছে তার মূল্য কীভাবে নিরূপণ করা যাবে? দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের পথে এর ফলে মনস্তাত্তি্বক বাধা তৈরি হয়ে আছে, সেটা তারা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন।
ভারত একজন বাঙালি রাষ্ট্রপতি পেয়েছে_ প্রণব মুখার্জি। তিনি আজীবন রাজনীতিক। চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি সক্রিয় ছিলেন দিলি্লতে। এ সময়ে তার নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে, কিন্তু তাতে তেমন সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুযোগ তার ছিল না। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর আমলে অর্থমন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রিসভায় তার অবস্থান ছিল প্রধানমন্ত্রীর পরেই। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, এমন ধারণা অনেকে করছিলেন। কিন্তু নেহরু-গান্ধী পরিবারেরই কারও এ দায়িত্ব পাওয়া উচিত_ এমন ভাব থেকেই কংগ্রেসের পাওয়ার ব্রোকাররা অরাজনৈতিক ব্যক্তি রাজীব গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসায়। ক্ষুব্ধ প্রণব মুখার্জি কংগ্রেস থেকে সরে গিয়ে নতুন দল গঠন করেন। তবে নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হলে তাকে পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ সময়ে ভারতে অর্থনীতি উদার করার নীতি গ্রহণ করা হয়, যার কৃতিত্ব দেওয়া হয় মনমোহন সিংকে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, এ সংক্রান্ত নীতি ও কর্মকৌশল প্রণয়নে প্রণব মুখার্জির অবদান যথেষ্ট ছিল, যা আড়ালে রয়ে গেছে। এ সময়ে তিনি দলে সোনিয়া গান্ধীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা নেন, যার মূল্যায়ন পরে করা হয়েছে বলেই ধারণা করা হয়। কিন্তু ২০০৪ সালে বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেস অনেকটা আকস্মিকভাবেই ক্ষমতায় ফিরে এলে প্রণব মুখার্জি ফের আশাহত হন। সোনিয়া গান্ধী 'অন্তরাত্মার আহ্বানে' প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয় ড. মনমোহন সিংয়ের হাতে। আর প্রণব মুখার্জিকে দেওয়া হয় তার অধীনে একটি মন্ত্রীর পদ।
অবশেষে তিনি উঠে এলেন শীর্ষ পদে, তবে সেটা এখন পর্যন্ত একেবারেই আলঙ্কারিক। প্রথা অনুযায়ী তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন বলেই ধারণা করা যায়। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নত করায় ভূমিকা রাখার সুযোগও তার জন্য সীমিত হয়ে পড়বে। ভারতের রাষ্ট্রপতি সবসময় দলের ঊধর্ে্ব থাকার চেষ্টা করেন। তিনি দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ একেবারেই করেন না। এ ক্ষেত্রে তার আমলে ব্যতিক্রম ঘটে কিনা, সেটা দেখার বিষয়। যদি ব্যতিক্রম ঘটে তাহলে বিতর্কিত হওয়ার শঙ্কাও থেকে যায়, যাতে ঝুঁকি অনেক।
বাংলাদেশের সুহৃদ হিসেবে অনেকে তাকে মনে করেন। তবে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের যে ধারা বাংলাদেশ নতুন সরকারের আমলে সূচিত হয়েছিল তার পথে বড় একটি বাধা হয়ে আছেন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। তার ওপর নতুন রাষ্ট্রপতি প্রভাব খাটাতে পারবেন, এমন সম্ভাবনা কম। তাছাড়া ভারতে সাধারণ নির্বাচন সামনে। বাংলাদেশেও প্রায় একই সময়ে নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, কোনো দেশের জন্যই তার আগাম ধারণা করা চলে না। এ প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথের বাধাগুলো দূর করায় সাহসী ও সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ দিলি্লর তরফে নেওয়া হবে, এমন আশা করা কঠিন বৈকি।
গরু চোরাচালান বন্ধ করে এর ব্যবসা বৈধ করার উদ্যোগও তাই আপাতত হিমাগারে থেকে যাওয়ার কথা। অথচ এর সমাধানের জন্য প্রত্যাশা করা হয় সংকীর্ণ স্বার্থের ঊধর্ে্ব উঠে পদক্ষেপের। কারণ এখন যে ব্যবস্থা চলছে তাতে অবোধ প্রাণী বধ থেমে থাকছে না, একই সঙ্গে নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটছে, যার নিন্দায় সোচ্চার অনেক অনেক মানুষ। এমনকি ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও দাবি তুলছে শান্তির সীমান্ত গড়ে তোলার। নির্বিচারে গুলি করে নিরীহ মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে তাদের সাহসী উচ্চারণ আমাদেরও ভরসা জোগায়।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ :রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং অধ্যাপক; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments