বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৬৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মালু মিয়া, বীর প্রতীক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সুরমা নদীর তীরে ছাতক। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০-১১ মাইল দূরে। ১৯৭১ সালে ছাতকে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি।


নিয়োজিত ছিল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এফএফ), ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (ইপিসিএফ) ও স্থানীয় রাজাকার।
১৪ অক্টোবর ভোরে মুক্তিবাহিনীর ব্যাটালিয়ন শক্তির একটি দল সেখানে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন কয়েকটি দলে বিভক্ত। এই আক্রমণে চার্লি (সি) দলে ছিলেন মালু মিয়া। এই দলের ওপর দায়িত্ব ছিল কাটঅফ পার্টি হিসেবে কাজ করার। যাতে দোয়ারা বাজার হয়ে ওয়াপদার বাঁধ বা সুরমা নদীপথ ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কোনো রিইনফোর্সমেন্ট না আসতে পারে।
১৩ অক্টোবর রাতে মালু মিয়ারা ভারতের বাঁশতলা থেকে রওনা হন। তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থান নেওয়ার কথা ছিল ছাতকের কাছে টেংরাটিলায়। খুব ভোরে কয়েকটি নৌকায় সেখানে পৌঁছামাত্র তাঁদের নৌকার দিকে ধেয়ে আসে গুলিবৃষ্টি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের সব নৌকায় একযোগে আক্রমণ চালায়।
আকস্মিক এই ঘটনার জন্য মালু মিয়ারা মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। প্রথম ধাক্কাতেই তাঁদের দলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাঁর সহযোদ্ধা অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ বা আহত হন। গুলিবৃষ্টির মধ্যে জীবন বাঁচাতে তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা পানিতে ঝাঁপ দেন। নৌকাগুলো পানিতে ডুবে যায়। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কারও কারও অস্ত্র হাত থেকে পানিতে পড়ে হারিয়ে যায়।
জীবন-মৃত্যুর চরম এই সন্ধিক্ষণে মালু মিয়া মনোবল হারাননি। চারদিকে গভীর পানি। আশপাশে ছিল না কোনো শুকনা স্থান বা আশ্রয় নেওয়ার জায়গা। গুলিবৃষ্টির মধ্যে সেখানে থাকা মানে নির্ঘাত প্রাণ হারানো। তার পরও সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে তিনি সাঁতাররত অবস্থায় তাঁর অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি শুরু করেন।
তাঁর সাহসিকতা দেখে অন্যান্য যাঁদের অস্ত্র হারিয়ে যায়নি তাঁরা কেউ কেউ অনুপ্রাণিত হয়ে গুলি করা শুরু করেন। এতে অস্ত্রহীন মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণে সুবিধা হয়। সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণে ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও অনেকে আহত হন।
মালু মিয়া চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। তাঁকে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি (সি) কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ, দেওয়ানগঞ্জ, সিলেট জেলার ছাতক, সালুটিকর, টেংরাটিলাসহ আরও কয়েকটি স্থানে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মালু মিয়াকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৯১।
মালু মিয়া স্বাধীনতার পর বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) থেকে হাবিলদার হিসেবে অবসর নেন। ২০০৯ সালে মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুর উপজেলার দড়িগাঁও গ্রামে। তবে চাকরির সুবাদে খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার উত্তর শান্তিপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে খাগড়াছড়ি বিজিবি সেক্টর সদর দপ্তর তাঁর পরিবারের জন্য উপজেলা সদরে ২ নম্বর পৌর ওয়ার্ডের নতুন পাড়ায় দুই কামরার একটি টিনের ঘর তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে তাঁর স্ত্রী ও কনিষ্ঠ পুত্র জাহাঙ্গীর আলম অভাব-অনটনের মধ্যে বসবাস করছেন।
মালু মিয়ার বাবার নাম আফতাবউদ্দিন মিয়া। স্ত্রী আমেনা বেগম। তাঁদের তিন মেয়ে, চার ছেলে। তিন মেয়ের সবার বিয়ে হয়েছে।
সূত্র: প্রথম আলোর খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি সৈকত দেওয়ান, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.