বাঙালির বন্ধু অধ্যাপক কাজুও আজুমা স্মরণে by প্রবীর বিকাশ সরকার
‘আবার যদি কোনোদিন মানুষ হয়ে জন্ম নিই, তাহলে যেন বাঙালি হয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারি’ এই ছিল তাঁর শেষ কথা। বলা যায়, ২০০০ সাল থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থা ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করতে থাকে। চোখের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে আসে। কিডনির অবস্থা খুবই খারাপ। এই বছরই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দেশিকোত্তম’ সম্মানে ভূষিত হন। অসুস্থ শরীর নিয়ে ভারতে যান।
কলকাতায় ঘটা করে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাপী প্রচারিত সংবাদ আমার চোখেও পড়ে। জাপানে ফিরে এলে পরে স্যারকে ফোনে অভিনন্দন জানাই। বিনম্রকন্ঠে জানান, “এত বড় সম্মান আমায় দেয়া কী সাজে!”
জাপানিরা বিনয় ও ভদ্রতার চূড়ান্ত। কিন্তু এই স্বীকৃতি থেকে তিনি অধিক মানসিক শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন। তারই প্রমাণ ২০০৭ সালে কলকাতার সল্টলেক সিটিতে প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন।’ উদ্বোধন করেন তৎকালীন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। বলাই বাহুল্য, তিনিও একেবারে অচল অবস্থায় সেই মহাঅনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। ভারত ও জাপানের ইতিহাসে এটা অবিস্মরণীয় ঘটনা। আবার প্রায় একই সময়ে তিনি বাংলাদেশের সিলেটের বড়লেখা অঞ্চলে অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। অর্থাৎ যেখানে রবীন্দ্রনাথ এবং বাঙালি আছে তিনি সেখানে আছেন। দুই বাংলাকেই আপন দুচোখের মতো আপন ভেবেছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের আনাচেকানাচে যেভাবে তিনি পদব্রজে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালিত্বকে আবিষ্কার করেছেন পূর্ববাংলায়ও একাধিক স্থান ভ্রমণ করেছেন। পাকিস্তান আমলেই বাংলাদেশের রবীন্দ্রভক্ত বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে গভীর ভাববিনিময় গড়ে উঠেছিল তাঁর যেমন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, অধ্যাপক আবদুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, টোকিওর পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা শেখ আহমেদ জালাল প্রমুখ। তাঁদের কারও কারও কাছে বাংলা ভাষাও শিখেছেন। এক এক করে ইহলোক ত্যাগ করেছেন সবাই, গত বছর ২৮ জুলাই তিনিও চলে গেলেন ৭৯ বছর বয়সে।
তাঁর দীর্ঘ জীবনের অর্ধেকের বেশি কেটেছে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালিকে নিয়ে-এমনটি আর কাউকে এই জাপানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে ধৈর্যশীলতা, কর্মযজ্ঞ এবং দূরদর্শী শিক্ষামূলক কাজের সাফল্য তিনি রেখে গেছেন তার তুলনা করা সত্যিই দুঃসাধ্য। একমাত্র জাপানি বলেই যে সম্ভব হয়েছে এটা আমাদের জন্য অনুকরণযোগ্য। বাঙালি হয়েও আমরা বাঙালি, বাঙালি সংস্কৃতি এবং রবীন্দ্রনাথকে যতখানি না বুঝতে পারি তার চেয়ে কয়েক গুণ তিনি অনুধাবন করেছেন নিরলস গবেষণা ও সাধনাবলে।
তিনি বহুশ্রুত নাম জাপানি রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা। ২০০৮ সালে জাপান সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করেছে এই কর্মবীর মানুষটিকে তাঁর ভারত-জাপান মৈত্রী সম্পর্ককে জোরদার করার অবদানস্বরূপ। ৪০ বছরের অধিককাল তাঁর বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে সাধনা হলেও রবীন্দ্ররচনার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধশেষের প্রাক্কালে মার্চ মাসের ১০ তারিখে টোকিওর ওপর মার্কিন বিমানহামলার মহাবোমাবর্ষণে রাতারাতি প্রায় এক লাখ লোক মারা যায়। ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় রাজধানী টোকিওর অধিকাংশ। সেই সময় চতুর্দিকে ধ্বংসস্তুপ আর মৃতদেহ। আজুমা স্যার তখন থাকতেন টোকিওর এদোগাওয়া-ওয়ার্ডের উপশহর কোমাৎসুগাওয়াতে-নিজ বিদ্যালয়ের ২০০ ছাত্র-ছাত্রী নিহত হয়েছে। অগণিত মৃতদেহ সৎকার করতে গিয়ে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। অভাব অনটন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে সংসারে। সেই অবস্থায় অসুস্থ বালক আজুমা রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ পাঠ করে নায়ক অমলের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেন। এক এক করে ‘গীতাঞ্জলি’, ‘রক্তকরবী’ ইত্যাদি পড়ে গভীরভাবে রবীন্দ্রপ্রেমে নিমজ্জিত হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ১৯৫৯ ও ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ভারতীয় দর্শন এবং জার্মান ভাষা ও সাহিত্যে দুবার এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন জাপানশ্রেষ্ঠ টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর ইয়োকোহামা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। এখানে কয়েক বছর অধ্যাপনা করা অবস্থায় একই সময়ে জার্মানি ও ভারত থেকে অধ্যাপনা করার জন্য আমন্ত্রণ আসে। তিনি জার্মানিতে গেলে পরে আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হতেন ঠিকই কিন্তু একমাত্র গুরুদেবের টানে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে চলে যান ১৯৬৭ সালে। এর আগে জাপানেই তিনি অধ্যাপক ড. শোওকো ওয়াতানাবে এবং অধ্যাপক ড.ৎসুজি নাওশিরোর কাছে বাংলা ও সংস্কৃতভাষা শিক্ষালাভ করেন। নির্ধারিত সময়ের অধিককাল বিশ্বভারতীতে থাকার ফলে জাপানে ফিরে এসে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন ১৯৭১ সালে। তিনি ও তাঁর মহীয়সী স্ত্রী অধ্যাপিকা ড. কেইকো আজুমা যিনি নিজেও রবীন্দ্র অন্তপ্রাণ এনএইচকে বেতারে খণ্ডকালীন চাকরি করে কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালান। জীবনে হেরে যাবার পাত্র ছিলেন না বিধায় ‘একলা চলোরে’ নামে একটি সংগঠনও দাঁড় করিয়েছিলেন আপন শহরে অধ্যাপক আজুমা। তারপর অধ্যাপনার চাকরি হয়েছে মর্যাদাসম্পন্ন ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এরপর জাতীয় ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস প্রফেসর হয়েছেন। জীবনের শেষ দিকে এসে রেইতাকু বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে অবসর নিয়েছেন।
১৯৭১ সালেই দাঁড় করিয়েছেন জাপান টেগোর সমিতি (বর্তমানে জাপান-ভারত রবীন্দ্র সংস্থা)। চেয়ারম্যান ছিলেন আজীবন রবীন্দ্রভক্ত মাদাম ড. তোমি কোরা, প্রেসিডেন্ট ছিলেন রবীন্দ্রঅনুরাগী অধ্যাপক ড.ৎসুশো বিয়োদো আর তিনি কর্মসচিব। কত কাজই না করেছে এই সংস্থাটি জাপানে, ভারতে ও বাংলাদেশে! বিশেষ করে জাপানে বাঙালি কাবাডি খেলাকে পরিচিত করা, এদেশে ঘটা করে রবীন্দ্র উৎসবের আয়োজন, জাপানি ভাষায় ১২ খণ্ডে সমগ্র রবীন্দ্ররচনার অনুবাদ প্রকাশ, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের মননে লালিত স্বপ্ন: নিপ্পনভবন প্রতিষ্ঠা, জাপান-ভারত সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এর প্রতিটির পেছনে অধ্যাপক আজুমার অক্লান্ত পরিশ্রম, কর্মনিষ্ঠা আর অজস্র বাধাবিপত্তিকে ডিঙিয়ে যাওয়ার সাহসী কাহিনী খুব কম বাঙালিই জানেন। সেসব লবনাক্ত ঝড়ের অভিজ্ঞতা স্যার আমাকে নিভৃতে বহুদিন বলেছেন তাঁর বাড়িতে। তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমার স্ত্রী বাংলা শিখেছেন তাঁর স্ত্রীর কাছে। আমার বাড়ি থেকে স্যারের বাড়ি সাইকেলে করে এক ঘণ্টার পথ। যখনই গিয়েছি দেখেছি নিবিষ্ট মনে তাঁরা দুজন কাজ করছেন রবীন্দ্রনাথ না হয় বাঙালিসংস্কৃতি নিয়ে। তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলোতে ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালির মনন, সংস্কৃতি বারংবার। শেষ গ্রন্থ ‘টেগোর’ লিখেছেন মাতৃভাষায় এক কপি স্বাক্ষরসহ উপহার দিয়েছেন আমাকে।
যখনই বাংলাদেশ নিয়ে কথা উঠত তিনি জিজ্ঞেস করতেন, বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা কেমন আছেন?
আমি বলতাম, স্যার, আপনি তো ভালো জানার কথা যেহেতু বঙ্গবন্ধুর আপনি একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর মেয়েরা কি আপনার খোঁজ-খবর নেন না?
স্যার স্মিত হেসে বলতেন, সবাই তো খুব ব্যস্ত। তাঁরাও ব্যস্ত আছেন ঘরে-বাইরে। আপনি তো জাপানে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করেছেন তাই জিজ্ঞেস করছি।
আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু পরিষদ রাজনৈতিক সংগঠন নয়। বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের নিয়ে আমি ভাবি না। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা এক জিনিস নয়। বঙ্গবন্ধু যা দিতে পারতেন জাতিকে তা শেখ হাসিনা দিতে চাইলেও তাঁকে সফল হতে দেবে না ঘরে-বাইরে এখনো সক্রিয় তাঁর পিতার শত্রুরা বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যাবেনও। বর্তমান বাংলাদেশে প্রগতিশীল রাজনীতির শেষ ভরসা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার পর বাংলাদেশে একটা দীর্ঘ অন্ধকার যুগ নেমে আসতে পারে।
স্যার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ঠিকই বলেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা হয়। পিতৃহারা দুটো মেয়ের জন্যও বড় কষ্ট হয় আমার। তারচেয়ে বড় কষ্ট অনুভব করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। কী অসাধারণ একটা মানুষ ছিলেন তিনি! তাঁকেও মিসগাইড করেছে অনেকে। মনে পড়ে তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে আমরা জাপানে উদ্বেলিত হয়ে পড়েছিলাম। শেখ মুজিবের দেশ মানেই গুরুদেবের দেশ। মনে হয়েছিল আমরাও স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির সঙ্গে সংগ্রামে নামি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা জাপানে জনমত গঠন করেছি, প্রচার করেছি, চাঁদা তুলেছি, পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরে সাহায্য পাঠিয়েছি। স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশে গিয়ে স্তম্ভিত হয়েছি ধ্বংসস্তুপ দেখে! খুব শোকাহত হয়েছি আমার বন্ধু মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করা হয়েছে জেনে। তারপর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু জাপান সফরে এলে পরে তাঁর দোভাষী এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলাম আমি। আমরা এত বড় সম্মান রবীন্দ্রনাথের পর আর কাউকে দিইনি! তাঁকেই যখন মাত্র দুবছর পরে ১৫ আগস্ট হত্যা করা হল আমি বিশ্বাসই করতে পারলাম না! অবিশ্বাস্য! তাঁর অপরাধ থাকতে পারে তার জন্য আইন-আদালত ছিলÑÑবিচার হতে পারত কিন্তু সপরিবারে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা আমি কোনোদিন মেনে নিতে পারিনি। এজন্য আমি বাংলাদেশের লোক দেখলেই অভিযুক্ত করি: তোমরা প্রত্যেকই অবিবেচক এবং বঙ্গবন্ধুর খুনি! মনে হয় ১৪ আগস্ট আমার জন্মদিন আর ১৫ আগস্ট আমার মৃত্যুদিবস!
এতেই বোঝা যায় কতখানি তিনি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন! আজুমা স্যার কোনোদিন বাঙালির দুর্নাম করেছেন এমনটি কেউ শোনেনি। তিনি বাঙালিকে অনেক ঊর্ধ্বে রেখেছেন।
মত বিনিময়কালে তাঁকে আমি বলেছি: স্যার, আমার এটা বিশ্বাস যে, রবীন্দ্রনাথের মতো বঙ্গবন্ধুকেও বাঙালিরা কোনোদিন বুঝতে পারেনি-যেমনভাবে বিদেশিরা বুঝতে পেরেছেন। এটা জাতি হিসেবে আমাদের অন্ধকার দিক স্বীকার না করে উপায় কী? বাঙালির অনেক অসঙ্গতি, অনেক দীনতা আছে। যেমন ধরুন, আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি রবীন্দ্রপুরস্কার প্রচলন করতে পারিনি। একটি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিনি। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে সংরক্ষণ করি না। তাঁর একটি স্মারক মূর্তি রাজধানী ঢাকার কোথাও নেই-অথচ তাঁর লিখিত গান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত! আলাদাভাবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়ানো বা গবেষণা হয় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরে যেসকল বিদেশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন তাঁদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে পারিনি। অধিকাংশই এখন অবর্তমান।
আমার মুখে এইসব অভিযোগ শুনে তিনি দুঃখ পেয়েছেন। বললেন, এসব আমি জানি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এসব হয়ে যেত। এটা দুর্ভাগ্য। তবুও আমি বলবো, বাঙালি একদিন রবীন্দ্রনাথকে, বঙ্গবন্ধুকে চিনতে, বুঝতে পারবে। সেদিন বদলে যাবে বাঙালি। আমি হয়তো দেখে যেতে পারবো না, ভবিষ্যৎ বাঙালিরা পাবে সেটাই আনন্দের, সেটাই আশার কথা।
হ্যাঁ, এটাই আমাদের জন্য আনন্দের এবং আশাব্যঞ্জক যে শত সমস্যা-সংকট, রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক অসঙ্গতির মধ্যেই আলোর পথ দেখাবে বাঙালির বন্ধু কাজুও আজুমার চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত দুটি প্রতিষ্ঠান। একটি ১৯৯৪ সালে বিশ্বভারতীতে প্রতিষ্ঠিত ‘নিপ্পনভবন’ আর অন্যটি কলকাতায় ২০০৭ সালে উদ্বোধন হওয়া ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন।’
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বাংলাদেশের সিলেটেও বিপুল টাকার তহবিলসহ তাঁর এক শিষ্য দারাদ আহমেদকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য। এবং কলকাতা ও সিলেটে একই সময়ে দুটি প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনের কথা ছিল। কলকাতারটা হলেও বাংলাদেশেরটা হয়নি। দারাদ সমস্ত টাকা আত্মসাৎ করে দিয়ে প্রমাণ করে দিল: পূর্ব বাংলার বাঙালি প্রতারক! বাংলাদেশের মুখে চুনকালি লেপন করে দিয়ে এখনো দিব্যি সে কোথাও পালিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে, সরকার তার টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি! তথাপি মৃত্যুকালে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন তিনি এই ঘটনা। ২০১০ সালে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে অনুরোধ করে তাঁকে একাডেমীর ফেলোশিপ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম এটাই তাঁর বাংলাদেশ থেকে পাওয়া সর্বোচ্চ স্বীকৃতি।
জাপান প্রবাসী লেখক, গবেষক ও মাসিক কিশোরচিত্র সম্পাদক
জাপানিরা বিনয় ও ভদ্রতার চূড়ান্ত। কিন্তু এই স্বীকৃতি থেকে তিনি অধিক মানসিক শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন। তারই প্রমাণ ২০০৭ সালে কলকাতার সল্টলেক সিটিতে প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন।’ উদ্বোধন করেন তৎকালীন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। বলাই বাহুল্য, তিনিও একেবারে অচল অবস্থায় সেই মহাঅনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। ভারত ও জাপানের ইতিহাসে এটা অবিস্মরণীয় ঘটনা। আবার প্রায় একই সময়ে তিনি বাংলাদেশের সিলেটের বড়লেখা অঞ্চলে অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। অর্থাৎ যেখানে রবীন্দ্রনাথ এবং বাঙালি আছে তিনি সেখানে আছেন। দুই বাংলাকেই আপন দুচোখের মতো আপন ভেবেছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের আনাচেকানাচে যেভাবে তিনি পদব্রজে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালিত্বকে আবিষ্কার করেছেন পূর্ববাংলায়ও একাধিক স্থান ভ্রমণ করেছেন। পাকিস্তান আমলেই বাংলাদেশের রবীন্দ্রভক্ত বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে গভীর ভাববিনিময় গড়ে উঠেছিল তাঁর যেমন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, অধ্যাপক আবদুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, টোকিওর পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা শেখ আহমেদ জালাল প্রমুখ। তাঁদের কারও কারও কাছে বাংলা ভাষাও শিখেছেন। এক এক করে ইহলোক ত্যাগ করেছেন সবাই, গত বছর ২৮ জুলাই তিনিও চলে গেলেন ৭৯ বছর বয়সে।
তাঁর দীর্ঘ জীবনের অর্ধেকের বেশি কেটেছে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালিকে নিয়ে-এমনটি আর কাউকে এই জাপানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে ধৈর্যশীলতা, কর্মযজ্ঞ এবং দূরদর্শী শিক্ষামূলক কাজের সাফল্য তিনি রেখে গেছেন তার তুলনা করা সত্যিই দুঃসাধ্য। একমাত্র জাপানি বলেই যে সম্ভব হয়েছে এটা আমাদের জন্য অনুকরণযোগ্য। বাঙালি হয়েও আমরা বাঙালি, বাঙালি সংস্কৃতি এবং রবীন্দ্রনাথকে যতখানি না বুঝতে পারি তার চেয়ে কয়েক গুণ তিনি অনুধাবন করেছেন নিরলস গবেষণা ও সাধনাবলে।
তিনি বহুশ্রুত নাম জাপানি রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা। ২০০৮ সালে জাপান সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করেছে এই কর্মবীর মানুষটিকে তাঁর ভারত-জাপান মৈত্রী সম্পর্ককে জোরদার করার অবদানস্বরূপ। ৪০ বছরের অধিককাল তাঁর বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে সাধনা হলেও রবীন্দ্ররচনার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধশেষের প্রাক্কালে মার্চ মাসের ১০ তারিখে টোকিওর ওপর মার্কিন বিমানহামলার মহাবোমাবর্ষণে রাতারাতি প্রায় এক লাখ লোক মারা যায়। ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় রাজধানী টোকিওর অধিকাংশ। সেই সময় চতুর্দিকে ধ্বংসস্তুপ আর মৃতদেহ। আজুমা স্যার তখন থাকতেন টোকিওর এদোগাওয়া-ওয়ার্ডের উপশহর কোমাৎসুগাওয়াতে-নিজ বিদ্যালয়ের ২০০ ছাত্র-ছাত্রী নিহত হয়েছে। অগণিত মৃতদেহ সৎকার করতে গিয়ে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। অভাব অনটন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে সংসারে। সেই অবস্থায় অসুস্থ বালক আজুমা রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ পাঠ করে নায়ক অমলের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেন। এক এক করে ‘গীতাঞ্জলি’, ‘রক্তকরবী’ ইত্যাদি পড়ে গভীরভাবে রবীন্দ্রপ্রেমে নিমজ্জিত হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ১৯৫৯ ও ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ভারতীয় দর্শন এবং জার্মান ভাষা ও সাহিত্যে দুবার এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন জাপানশ্রেষ্ঠ টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর ইয়োকোহামা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। এখানে কয়েক বছর অধ্যাপনা করা অবস্থায় একই সময়ে জার্মানি ও ভারত থেকে অধ্যাপনা করার জন্য আমন্ত্রণ আসে। তিনি জার্মানিতে গেলে পরে আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হতেন ঠিকই কিন্তু একমাত্র গুরুদেবের টানে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে চলে যান ১৯৬৭ সালে। এর আগে জাপানেই তিনি অধ্যাপক ড. শোওকো ওয়াতানাবে এবং অধ্যাপক ড.ৎসুজি নাওশিরোর কাছে বাংলা ও সংস্কৃতভাষা শিক্ষালাভ করেন। নির্ধারিত সময়ের অধিককাল বিশ্বভারতীতে থাকার ফলে জাপানে ফিরে এসে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন ১৯৭১ সালে। তিনি ও তাঁর মহীয়সী স্ত্রী অধ্যাপিকা ড. কেইকো আজুমা যিনি নিজেও রবীন্দ্র অন্তপ্রাণ এনএইচকে বেতারে খণ্ডকালীন চাকরি করে কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালান। জীবনে হেরে যাবার পাত্র ছিলেন না বিধায় ‘একলা চলোরে’ নামে একটি সংগঠনও দাঁড় করিয়েছিলেন আপন শহরে অধ্যাপক আজুমা। তারপর অধ্যাপনার চাকরি হয়েছে মর্যাদাসম্পন্ন ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এরপর জাতীয় ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস প্রফেসর হয়েছেন। জীবনের শেষ দিকে এসে রেইতাকু বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে অবসর নিয়েছেন।
১৯৭১ সালেই দাঁড় করিয়েছেন জাপান টেগোর সমিতি (বর্তমানে জাপান-ভারত রবীন্দ্র সংস্থা)। চেয়ারম্যান ছিলেন আজীবন রবীন্দ্রভক্ত মাদাম ড. তোমি কোরা, প্রেসিডেন্ট ছিলেন রবীন্দ্রঅনুরাগী অধ্যাপক ড.ৎসুশো বিয়োদো আর তিনি কর্মসচিব। কত কাজই না করেছে এই সংস্থাটি জাপানে, ভারতে ও বাংলাদেশে! বিশেষ করে জাপানে বাঙালি কাবাডি খেলাকে পরিচিত করা, এদেশে ঘটা করে রবীন্দ্র উৎসবের আয়োজন, জাপানি ভাষায় ১২ খণ্ডে সমগ্র রবীন্দ্ররচনার অনুবাদ প্রকাশ, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের মননে লালিত স্বপ্ন: নিপ্পনভবন প্রতিষ্ঠা, জাপান-ভারত সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এর প্রতিটির পেছনে অধ্যাপক আজুমার অক্লান্ত পরিশ্রম, কর্মনিষ্ঠা আর অজস্র বাধাবিপত্তিকে ডিঙিয়ে যাওয়ার সাহসী কাহিনী খুব কম বাঙালিই জানেন। সেসব লবনাক্ত ঝড়ের অভিজ্ঞতা স্যার আমাকে নিভৃতে বহুদিন বলেছেন তাঁর বাড়িতে। তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমার স্ত্রী বাংলা শিখেছেন তাঁর স্ত্রীর কাছে। আমার বাড়ি থেকে স্যারের বাড়ি সাইকেলে করে এক ঘণ্টার পথ। যখনই গিয়েছি দেখেছি নিবিষ্ট মনে তাঁরা দুজন কাজ করছেন রবীন্দ্রনাথ না হয় বাঙালিসংস্কৃতি নিয়ে। তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলোতে ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালির মনন, সংস্কৃতি বারংবার। শেষ গ্রন্থ ‘টেগোর’ লিখেছেন মাতৃভাষায় এক কপি স্বাক্ষরসহ উপহার দিয়েছেন আমাকে।
যখনই বাংলাদেশ নিয়ে কথা উঠত তিনি জিজ্ঞেস করতেন, বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা কেমন আছেন?
আমি বলতাম, স্যার, আপনি তো ভালো জানার কথা যেহেতু বঙ্গবন্ধুর আপনি একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর মেয়েরা কি আপনার খোঁজ-খবর নেন না?
স্যার স্মিত হেসে বলতেন, সবাই তো খুব ব্যস্ত। তাঁরাও ব্যস্ত আছেন ঘরে-বাইরে। আপনি তো জাপানে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করেছেন তাই জিজ্ঞেস করছি।
আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু পরিষদ রাজনৈতিক সংগঠন নয়। বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের নিয়ে আমি ভাবি না। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা এক জিনিস নয়। বঙ্গবন্ধু যা দিতে পারতেন জাতিকে তা শেখ হাসিনা দিতে চাইলেও তাঁকে সফল হতে দেবে না ঘরে-বাইরে এখনো সক্রিয় তাঁর পিতার শত্রুরা বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যাবেনও। বর্তমান বাংলাদেশে প্রগতিশীল রাজনীতির শেষ ভরসা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার পর বাংলাদেশে একটা দীর্ঘ অন্ধকার যুগ নেমে আসতে পারে।
স্যার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ঠিকই বলেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা হয়। পিতৃহারা দুটো মেয়ের জন্যও বড় কষ্ট হয় আমার। তারচেয়ে বড় কষ্ট অনুভব করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। কী অসাধারণ একটা মানুষ ছিলেন তিনি! তাঁকেও মিসগাইড করেছে অনেকে। মনে পড়ে তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে আমরা জাপানে উদ্বেলিত হয়ে পড়েছিলাম। শেখ মুজিবের দেশ মানেই গুরুদেবের দেশ। মনে হয়েছিল আমরাও স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির সঙ্গে সংগ্রামে নামি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা জাপানে জনমত গঠন করেছি, প্রচার করেছি, চাঁদা তুলেছি, পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরে সাহায্য পাঠিয়েছি। স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশে গিয়ে স্তম্ভিত হয়েছি ধ্বংসস্তুপ দেখে! খুব শোকাহত হয়েছি আমার বন্ধু মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করা হয়েছে জেনে। তারপর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু জাপান সফরে এলে পরে তাঁর দোভাষী এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলাম আমি। আমরা এত বড় সম্মান রবীন্দ্রনাথের পর আর কাউকে দিইনি! তাঁকেই যখন মাত্র দুবছর পরে ১৫ আগস্ট হত্যা করা হল আমি বিশ্বাসই করতে পারলাম না! অবিশ্বাস্য! তাঁর অপরাধ থাকতে পারে তার জন্য আইন-আদালত ছিলÑÑবিচার হতে পারত কিন্তু সপরিবারে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা আমি কোনোদিন মেনে নিতে পারিনি। এজন্য আমি বাংলাদেশের লোক দেখলেই অভিযুক্ত করি: তোমরা প্রত্যেকই অবিবেচক এবং বঙ্গবন্ধুর খুনি! মনে হয় ১৪ আগস্ট আমার জন্মদিন আর ১৫ আগস্ট আমার মৃত্যুদিবস!
এতেই বোঝা যায় কতখানি তিনি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন! আজুমা স্যার কোনোদিন বাঙালির দুর্নাম করেছেন এমনটি কেউ শোনেনি। তিনি বাঙালিকে অনেক ঊর্ধ্বে রেখেছেন।
মত বিনিময়কালে তাঁকে আমি বলেছি: স্যার, আমার এটা বিশ্বাস যে, রবীন্দ্রনাথের মতো বঙ্গবন্ধুকেও বাঙালিরা কোনোদিন বুঝতে পারেনি-যেমনভাবে বিদেশিরা বুঝতে পেরেছেন। এটা জাতি হিসেবে আমাদের অন্ধকার দিক স্বীকার না করে উপায় কী? বাঙালির অনেক অসঙ্গতি, অনেক দীনতা আছে। যেমন ধরুন, আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি রবীন্দ্রপুরস্কার প্রচলন করতে পারিনি। একটি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিনি। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে সংরক্ষণ করি না। তাঁর একটি স্মারক মূর্তি রাজধানী ঢাকার কোথাও নেই-অথচ তাঁর লিখিত গান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত! আলাদাভাবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়ানো বা গবেষণা হয় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরে যেসকল বিদেশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন তাঁদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে পারিনি। অধিকাংশই এখন অবর্তমান।
আমার মুখে এইসব অভিযোগ শুনে তিনি দুঃখ পেয়েছেন। বললেন, এসব আমি জানি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এসব হয়ে যেত। এটা দুর্ভাগ্য। তবুও আমি বলবো, বাঙালি একদিন রবীন্দ্রনাথকে, বঙ্গবন্ধুকে চিনতে, বুঝতে পারবে। সেদিন বদলে যাবে বাঙালি। আমি হয়তো দেখে যেতে পারবো না, ভবিষ্যৎ বাঙালিরা পাবে সেটাই আনন্দের, সেটাই আশার কথা।
হ্যাঁ, এটাই আমাদের জন্য আনন্দের এবং আশাব্যঞ্জক যে শত সমস্যা-সংকট, রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক অসঙ্গতির মধ্যেই আলোর পথ দেখাবে বাঙালির বন্ধু কাজুও আজুমার চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত দুটি প্রতিষ্ঠান। একটি ১৯৯৪ সালে বিশ্বভারতীতে প্রতিষ্ঠিত ‘নিপ্পনভবন’ আর অন্যটি কলকাতায় ২০০৭ সালে উদ্বোধন হওয়া ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন।’
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বাংলাদেশের সিলেটেও বিপুল টাকার তহবিলসহ তাঁর এক শিষ্য দারাদ আহমেদকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য। এবং কলকাতা ও সিলেটে একই সময়ে দুটি প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনের কথা ছিল। কলকাতারটা হলেও বাংলাদেশেরটা হয়নি। দারাদ সমস্ত টাকা আত্মসাৎ করে দিয়ে প্রমাণ করে দিল: পূর্ব বাংলার বাঙালি প্রতারক! বাংলাদেশের মুখে চুনকালি লেপন করে দিয়ে এখনো দিব্যি সে কোথাও পালিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে, সরকার তার টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি! তথাপি মৃত্যুকালে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন তিনি এই ঘটনা। ২০১০ সালে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে অনুরোধ করে তাঁকে একাডেমীর ফেলোশিপ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম এটাই তাঁর বাংলাদেশ থেকে পাওয়া সর্বোচ্চ স্বীকৃতি।
জাপান প্রবাসী লেখক, গবেষক ও মাসিক কিশোরচিত্র সম্পাদক
No comments