বাঙালি বিজ্ঞানী-অমল কুমার রায়চৌধুরী by অভীক রায়
বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেওয়া যে কয়েকজন পদার্থবিজ্ঞানীর কীর্তি সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছে, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন অমল কুমার রায়চৌধুরী। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও বিশ্বতত্ত্ব-সম্পর্কিত আধুনিক গবেষণায় তাঁর আবিষ্কৃত সমীকরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তাঁর নামানুসারে সমীকরণটি এখন ‘রায়চৌধুরী সমীকরণ’ নামে পরিচিত। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে সম্মানিত অমল কুমার রায়চৌধুরীর জন্ম ১৯২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, বরিশালে। তাঁর বাবা সুরেশ চন্দ্র রায়চৌধুরী স্কুলে গণিত পড়াতেন। বাবাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই ছোটবেলা থেকে অমল গণিতে আগ্রহী হন। তিনি গণিতের সমস্যা সমাধান করতে ভালোবাসতেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সে (আইএসিএস) যোগ দেন। কিন্তু দীর্ঘ চার বছর গবেষণা করেও কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল বের করতে না পেরে তিনি বেশ হতাশ হয়ে পড়েন। সে সময় তিনি আশুতোষ কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তখন অধ্যাপক এন আর সেন সেখানে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব পড়াতেন। অমল অধ্যাপক সেনের সান্নিধ্যে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব শিখতে শুরু করেন এবং তাঁর সাহায্যেই প্রথম কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। পরে তিনি একাই গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। গবেষণার একপর্যায়ে এসে তিনি বিখ্যাত সমীকরণটি আবিষ্কার করেন। কাছাকাছি সময়ে তিনি আইএসিএসে দ্বিতীয় দফায় গবেষণা-সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। অমল কুমার রায়চৌধুরী এই সমীকরণ ১৯৫৩ সালে বের করলেও এটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করার জন্য তাঁকে দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৫৫ সালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় বিখ্যাত জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউয়ে। এই গবেষণা প্রবন্ধের হাত ধরেই অমল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তখনো তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেননি। তাঁর পিএইচডি শেষ হয় ১৯৫৯ সালে।
রায়চৌধুরী সমীকরণ আধুনিক পদার্থবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। চতুর্মাত্রিক জগৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে বিবর্তিত হয়—সেটার ব্যাখ্যা মেলে এই সমীকরণ থেকে। এটি থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ব্যাখ্যা করা যায়। নিউটন তাঁর বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্রে বলেছিলেন, মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি বস্তুকণার মধ্যে মহাকর্ষ নামের একটি আকর্ষণধর্মী বল কাজ করে। কিন্তু এই বলের উৎস কী, সেটা নিউটন কখনোই বলে যেতে পারেননি। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে এটা প্রমাণিত হয়, মহাকর্ষ কোনো বল নয়, এটা আমাদের চতুর্মাত্রিক স্থান-কালের একটা বৈশিষ্ট্য। কোনো বস্তুর উপস্থিতিতে স্থান-কাল বেঁকে যায় আর সেই বক্রতার জন্যই আমরা মহাকর্ষের প্রভাব দেখতে পারি। এখন প্রশ্ন হলো, মহাকর্ষের আকর্ষণধর্মিতার ব্যাখ্যা কী? প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখি, গাছ থেকে ফল মাটিতে পড়ছে, চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। অথচ আইনস্টাইনের দেওয়া ব্যাখ্যায় মহাকর্ষ একটি সম্পূর্ণ জ্যামিতিক ব্যাপার। তাহলে সেই জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের কোথায় এই আকর্ষণধর্মিতার ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে? রায়চৌধুরী সমীকরণ থেকে আমরা এর খুব সুন্দর একটা ব্যাখ্যা পাই। কোনো ধরনের বলের প্রভাব ছাড়া একটি বস্তু যে পথে চলাচল করে, সেটাকে বলা হয় জিওডেসিক। রায়চৌধুরী দেখান, যেকোনো ভারী বস্তুর উপস্থিতিতে তার আশপাশের জিওডেসিকগুলো বস্তুটির দিকে বেঁকে যায়। এটাই মহাকর্ষের আকর্ষণধর্মিতার ব্যাখ্যা দেয়।
রায়চৌধুরী সমীকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল রয়েছে। আমরা জানি, এই মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে বিগ ব্যাং নামের এক বড় বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। ধরে নেওয়া যাক, আমি কোনো একটি বস্তুর পুরো জীবনের ইতিহাস জানতে চাই। তাহলে আমাকে যেটা করতে হবে সেটা হলো, চার মাত্রার জগতে বস্তুটি যে পথে চলেছে, সেই পথ ধরে সময়ের পেছন দিকে যেতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই পেছনে যেতে যেতে যখন আমরা বিগ ব্যাংয়ের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছাব, তখন আর বলতে পারব না, এর আগে কী হয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের জগতের যেকোনো বস্তুর চলার শুরু ওই বিগ ব্যাং থেকেই, এর আগের কিছু জানা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। যখনই জগতের কোনো এক জায়গায় আমরা এভাবে আটকে যাই, আমরা বলি, সেখানটায় একটা সিঙ্গুলারিটি আছে। প্রশ্ন হলো, জগৎ সৃষ্টি হওয়ার তত্ত্বে এই সিঙ্গুলারিটি কি কোনোভাবে এড়ানো সম্ভব? আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে আমরা এমন কোনো বিশ্বজগতের ধারণা কি পেতে পারি, যেখানে কোনো সিঙ্গুলারিটি নেই? এই প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাওয়া যায় রায়চৌধুরী সমীকরণ থেকে। সেখান থেকে এটা দেখানো যায়, আমাদের মহাবিশ্বে যেকোনো দুটি বস্তুকণার চলার পথ ধরে সময়ের পেছন দিকে যেতে থাকলে সেগুলো একটা জায়গায় গিয়ে জড়ো হতে চাইছে, সেটাই বিগ ব্যাং। অমল রায়চৌধুরীই প্রথম ধারণা দেন, সিঙ্গুলারিটি এড়িয়ে যাওয়া আমাদের জন্য সম্ভব নয়। পরে ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের দিকে রায়চৌধুরী সমীকরণের ওপর ভিত্তি করেই স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ এ ব্যাপার গাণিতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। একজন মেধাবী বিজ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি অমল কুমার রায়চৌধুরী ছিলেন একজন প্রাণবন্ত শিক্ষক। ক্লাসে শিক্ষার্থীরা তাঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। তিনি ছিলেন একজন কর্মপ্রাণ মানুষ। মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে তাঁর শেষ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। বই পড়তে ভালোবাসতেন তিনি, ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর; প্রত্যক্ষ অংশ না নিলেও বিভিন্ন প্রবন্ধে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা উল্লেখ করেছেন। কর্মনিষ্ঠ এই বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী ২০০৫ সালের ১৮ জুন মারা যান।
রায়চৌধুরী সমীকরণ আধুনিক পদার্থবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। চতুর্মাত্রিক জগৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে বিবর্তিত হয়—সেটার ব্যাখ্যা মেলে এই সমীকরণ থেকে। এটি থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ব্যাখ্যা করা যায়। নিউটন তাঁর বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্রে বলেছিলেন, মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি বস্তুকণার মধ্যে মহাকর্ষ নামের একটি আকর্ষণধর্মী বল কাজ করে। কিন্তু এই বলের উৎস কী, সেটা নিউটন কখনোই বলে যেতে পারেননি। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে এটা প্রমাণিত হয়, মহাকর্ষ কোনো বল নয়, এটা আমাদের চতুর্মাত্রিক স্থান-কালের একটা বৈশিষ্ট্য। কোনো বস্তুর উপস্থিতিতে স্থান-কাল বেঁকে যায় আর সেই বক্রতার জন্যই আমরা মহাকর্ষের প্রভাব দেখতে পারি। এখন প্রশ্ন হলো, মহাকর্ষের আকর্ষণধর্মিতার ব্যাখ্যা কী? প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখি, গাছ থেকে ফল মাটিতে পড়ছে, চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। অথচ আইনস্টাইনের দেওয়া ব্যাখ্যায় মহাকর্ষ একটি সম্পূর্ণ জ্যামিতিক ব্যাপার। তাহলে সেই জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের কোথায় এই আকর্ষণধর্মিতার ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে? রায়চৌধুরী সমীকরণ থেকে আমরা এর খুব সুন্দর একটা ব্যাখ্যা পাই। কোনো ধরনের বলের প্রভাব ছাড়া একটি বস্তু যে পথে চলাচল করে, সেটাকে বলা হয় জিওডেসিক। রায়চৌধুরী দেখান, যেকোনো ভারী বস্তুর উপস্থিতিতে তার আশপাশের জিওডেসিকগুলো বস্তুটির দিকে বেঁকে যায়। এটাই মহাকর্ষের আকর্ষণধর্মিতার ব্যাখ্যা দেয়।
রায়চৌধুরী সমীকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল রয়েছে। আমরা জানি, এই মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে বিগ ব্যাং নামের এক বড় বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। ধরে নেওয়া যাক, আমি কোনো একটি বস্তুর পুরো জীবনের ইতিহাস জানতে চাই। তাহলে আমাকে যেটা করতে হবে সেটা হলো, চার মাত্রার জগতে বস্তুটি যে পথে চলেছে, সেই পথ ধরে সময়ের পেছন দিকে যেতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই পেছনে যেতে যেতে যখন আমরা বিগ ব্যাংয়ের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছাব, তখন আর বলতে পারব না, এর আগে কী হয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের জগতের যেকোনো বস্তুর চলার শুরু ওই বিগ ব্যাং থেকেই, এর আগের কিছু জানা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। যখনই জগতের কোনো এক জায়গায় আমরা এভাবে আটকে যাই, আমরা বলি, সেখানটায় একটা সিঙ্গুলারিটি আছে। প্রশ্ন হলো, জগৎ সৃষ্টি হওয়ার তত্ত্বে এই সিঙ্গুলারিটি কি কোনোভাবে এড়ানো সম্ভব? আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে আমরা এমন কোনো বিশ্বজগতের ধারণা কি পেতে পারি, যেখানে কোনো সিঙ্গুলারিটি নেই? এই প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাওয়া যায় রায়চৌধুরী সমীকরণ থেকে। সেখান থেকে এটা দেখানো যায়, আমাদের মহাবিশ্বে যেকোনো দুটি বস্তুকণার চলার পথ ধরে সময়ের পেছন দিকে যেতে থাকলে সেগুলো একটা জায়গায় গিয়ে জড়ো হতে চাইছে, সেটাই বিগ ব্যাং। অমল রায়চৌধুরীই প্রথম ধারণা দেন, সিঙ্গুলারিটি এড়িয়ে যাওয়া আমাদের জন্য সম্ভব নয়। পরে ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের দিকে রায়চৌধুরী সমীকরণের ওপর ভিত্তি করেই স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ এ ব্যাপার গাণিতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। একজন মেধাবী বিজ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি অমল কুমার রায়চৌধুরী ছিলেন একজন প্রাণবন্ত শিক্ষক। ক্লাসে শিক্ষার্থীরা তাঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। তিনি ছিলেন একজন কর্মপ্রাণ মানুষ। মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে তাঁর শেষ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। বই পড়তে ভালোবাসতেন তিনি, ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর; প্রত্যক্ষ অংশ না নিলেও বিভিন্ন প্রবন্ধে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা উল্লেখ করেছেন। কর্মনিষ্ঠ এই বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী ২০০৫ সালের ১৮ জুন মারা যান।
No comments