জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর উপায়-৬-শিক্ষায় সাফল্য কিনতে হচ্ছে দাম দিয়ে by টিটু দত্ত গুপ্ত ও অভিজিৎ ভট্টাচার্য
পড়তে চাওয়ায় জয়পুরহাটের কামরুলকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন দরিদ্র বাবা। রিকশা না চালিয়ে স্কুলে যাওয়ায় বাবার পিটুনি খেয়েছিল বাগেরহাটের শিমুল। এবারের এসএসসিতে গ্রামের সেই দুই ছেলের একজন জিপিএ ৫, আরেকজন গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে। পত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হয়েছে।
তবে তাদের স্কুল বা শিক্ষকদের ছবি নেই। ফল প্রকাশের পরদিন পত্রিকার পাতায় পাতায় দেখা গেছে ঢাকার নামিদামি স্কুলের জিপিএ ৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের আনন্দ-উল্লাসের ছবি, কোথাও কোথাও বিজয়ের ভি-চিহ্ন প্রদর্শন করেছেন প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ অন্য শিক্ষকরা।
শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা বলেছেন, শিক্ষার্থীপ্রতি রাষ্ট্রের মাথাপিছু বরাদ্দ যা ছিল, তার বাইরে গ্রামের ওই শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবারের খরচ করার সামর্থ্য ছিল না। সেখানে শিক্ষকদের পেশাদারিই কাজ করেছে বেশি। আর ঢাকার 'সেরা' স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যের জন্য অনেক দাম দিতে হয়েছে অভিভাবকদের। নামে সেরা স্কুল হলেও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার পড়া তৈরি করতে হয়েছে ক্লাসের বাইরে, শিক্ষকের বাসায় কিংবা কোচিং সেন্টারে।
একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীপ্রতি বছরে সরকারের খরচ পাঁচ হাজার ২৩২ টাকা। বেসরকারি স্কুলে দুই হাজার ৪৬১ টাকা। ঢাকার মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে পরিবারের ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। মিছবাহেল মোকাররাবির হিমুর মেয়ে ঢাকার নামী এক স্কুলে পড়ে। তিনি বলেন, গত বছর অষ্টম শ্রেণীর বেতন ছিল ৬২৫ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭০০ টাকা। তবু মেয়ের বিভিন্ন বিষয়ে কোচিংয়ের জন্য মাসে খরচ হচ্ছে দুই হাজার ৫০০ টাকা। বেতন ও কোচিং বাবদ বছরে তাঁর খরচ হচ্ছে ৩৮ হাজার ৪০০ টাকা। আরেক অভিভাবক আনোয়ার হোসেনের হিসাবে, গত তিন বছরে শিক্ষার পেছনে তাঁর পরিবারের খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ সময়ে কাগজের দাম যেমন বেড়েছে তেমনি টিউশন ফি, কোচিং ফি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত ভাড়া- সবই বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১২ শতাংশ। নতুন অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বাজেটের ১৪ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে শিক্ষাবিষয়ক এনজিওদের মোর্চা 'গণসাক্ষরতা অভিযান'। এ সংগঠনের প্রধান নির্বাহী এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ড. রাশেদা কে চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, শিক্ষা খাতে সরকারও প্রচুর খরচ করছে। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীর জন্য মাথাপিছু বার্ষিক সরকারি ব্যয় এখনো খুবই কম। মানসম্মত শিক্ষার জন্য এ ব্যয় আরো বাড়ানো জরুরি। তিনি বলেন, সরকারি ব্যয় সীমিত থাকায় ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য অভিভাবকদের প্রচুর খরচ করতে হয়।
অর্থনীতিবিদ ও সমাজ গবেষকদের মতে, সন্তানের শিক্ষা রাজধানীর মধ্য আয়ের পরিবারের খরচের অন্যতম প্রধান খাত। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি মোট সংসার খরচের ২০-২৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেও শিক্ষার মাধ্যম ও স্তর অনুযায়ী এটি অনেক পরিবারের খাবারের ব্যয়কে ছাড়িয়ে যায়। স্কুলের বেতন ও উপকরণ খরচের চেয়ে অনেক বেশি খরচ কোচিংয়ে। এর বাইরে রয়েছে স্কুল ও কোচিংয়ে যাতায়াত ব্যয়, সময়ের অপচয়।
অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন গবেষক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, দুটি সন্তান আছে এমন অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারে শিক্ষার ব্যয় খাওয়া ও চিকিৎসার খরচকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার ব্যয় নিয়ে 'গণসাক্ষরতা অভিযান'-এর তিন বছর আগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং সরকারি সহায়তাপুষ্ট বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যয়ের ৫৯ ও ৭১ শতাংশ পারিবারিকভাবে মেটানো হয়। প্রাইভেট টিউশনি পারিবারিক পর্যায়ে ব্যয়ের একক বৃহত্তম খাত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর প্রাইভেট শিক্ষক আছে।
ড. রাশেদা বলেন, তদারকির দুর্বলতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান কমছে। এ কারণেও শিক্ষার্থীদের পেছনে পরিবারের খরচ বাড়ছে। কাগজ-কলমের দাম বাড়ছে, সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কোচিংয়ের খরচ। সব স্কুলে ভালো পড়াশোনা হলে অভিভাবকদের এ বাড়তি খরচ হতো না।
একই মন্তব্য করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি। এ জন্য তদারকির দুর্বলতাকে দায়ী করে তিনি বলেন, শিক্ষকরা যাতে ক্লাসরুমে ঠিকমতো পড়ান সে জন্য তদারকি বাড়াতে হবে। তাহলে কোচিংয়ের পেছনে বাচ্চাদের দৌড়াতে হবে না, পরিবারের খরচও কমবে।
কোচিংকে শিক্ষকদের ব্যবসার একটি অশুভ চক্র বলে উল্লেখ করেন সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, 'শিক্ষকরা কোচিংয়ের ব্যবসায় নেমেছেন। তাঁদের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট রয়েছে। তাঁরা ঠিক করেছেন, স্কুলে পড়াব না, বাচ্চারা বাধ্য হবে কোচিং সেন্টারে যেতে, প্রাইভেট টিউটর রাখতে। এ জন্য শিক্ষার পেছনে পারিবারিক ব্যয় বাড়ছে। তদারকিতে যাঁরা আছেন, স্কুল ইন্সপেক্টর, তাঁরা তো ভালো রিপোর্ট দেন। এটি একটি বিজনেস নেক্সস।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. অহিদুজ্জামান বলেন, সারা দেশে তত্ত্বাবধান জোরদার করায় মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান বাড়ছে। পাবলিক পরীক্ষায় এখন গ্রামের শিক্ষার্থীরা ভালো করছে। তবে ঢাকায় তদারকির কোনো ব্যবস্থা কাজ করছে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, 'কোচিং ব্যবসা এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। চারদিকে যেসব স্কুলের খুব নাম শোনা যায়, গবেষণার কাজে সে স্কুলগুলোতে ক্লাস নিতে গিয়ে তাদের পড়ানোর নমুনা দেখেছি। কোন স্কুলকে ভালো বলছি আমরা?'
ঢাকার অভিভাবকদের প্রতিও খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করে এ শিক্ষাবিদ বলেন, তাঁরা পড়াশোনা বা মেধার বিকাশ চান না, তাঁরা চান রেজাল্ট।
ঐতিহ্য, খেলার মাঠ, প্রশস্ত স্কুল ভবন, ল্যাবরেটরি, এমনকি ছাত্রাবাস আছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার এমন অনেক স্কুল এখন আর আলোচনায় নেই। ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা হয়ে উঠেছে একটি অঘোষিত শিক্ষা এলাকা। এখানে ভাড়া বাড়িতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। সারা শহর থেকে শিক্ষার্থীরা আসছে এখানে।
ড. অহিদুজ্জামান বলেন, সরকার যদি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্কুলগুলোর সম্পদ ও অবকাঠামো ব্যবহার করে, স্থানীয় কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে ব্যবস্থাপনা ও পড়াশোনার উন্নয়ন করতে পারে, তাহলে সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের সারা শহর পাড়ি দিয়ে ধানমণ্ডির স্কুলে আসতে হয় না। এতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট কমবে, অভিভাবকদের যাতায়াতজনিত ব্যয় ও সময় বাঁচবে।
ড. অহিদুজ্জামান বলেন, পারিবারিক শিক্ষা ব্যয় কমাতে হলে ঢাকার স্কুলগুলোতে তদারকি বাড়াতে হবে। তথাকথিত কয়েকটি ভালো স্কুলের ওপর থেকে নজর সরাতে হবে। পর্যায়ক্রমে 'ক্যাচমেন্ট এরিয়া' পদ্ধতি চালু করতে হবে, অর্থাৎ যিনি যে এলাকায় থাকেন সে এলাকার স্কুলে সন্তান ভর্তি করাবেন। সে জন্য খেলার মাঠ, ল্যাবরেটরিসহ অবকাঠামো আছে এলাকাভিত্তিক এমন স্কুলগুলো চিহ্নিত করে সেখানে পড়াশোনার মানোন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। অবশ্য ঢাকা শহরে পাবলিক স্কুলও বাড়াতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সব স্কুলকে মানসম্মত পর্যায়ে নিয়ে আসাই আমাদের মূল চেষ্টা। বইয়ের মান উন্নত করেছি। তিন বছরে তিন লাখ মাধ্যমিক শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিন হাজার স্কুল, এক হাজার মাদ্রাসা ও দেড় হাজার কলেজে ভবন তৈরি করে দিয়েছে সরকার। ছাত্রীদের স্কুলে ধরে রাখার জন্য উপবৃত্তি অব্যাহত রয়েছে।' তিনি বলেন, ঢাকায় ১১টি স্কুল ও কলেজ তৈরি করছে সরকার। ইতিমধ্যে হাজারীবাগে জায়গা ঠিক করা হয়েছে, বাকিগুলোর স্থান নির্ধারণসহ অন্যান্য কাজ চলছে।
শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা বলেছেন, শিক্ষার্থীপ্রতি রাষ্ট্রের মাথাপিছু বরাদ্দ যা ছিল, তার বাইরে গ্রামের ওই শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবারের খরচ করার সামর্থ্য ছিল না। সেখানে শিক্ষকদের পেশাদারিই কাজ করেছে বেশি। আর ঢাকার 'সেরা' স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যের জন্য অনেক দাম দিতে হয়েছে অভিভাবকদের। নামে সেরা স্কুল হলেও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার পড়া তৈরি করতে হয়েছে ক্লাসের বাইরে, শিক্ষকের বাসায় কিংবা কোচিং সেন্টারে।
একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীপ্রতি বছরে সরকারের খরচ পাঁচ হাজার ২৩২ টাকা। বেসরকারি স্কুলে দুই হাজার ৪৬১ টাকা। ঢাকার মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে পরিবারের ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। মিছবাহেল মোকাররাবির হিমুর মেয়ে ঢাকার নামী এক স্কুলে পড়ে। তিনি বলেন, গত বছর অষ্টম শ্রেণীর বেতন ছিল ৬২৫ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭০০ টাকা। তবু মেয়ের বিভিন্ন বিষয়ে কোচিংয়ের জন্য মাসে খরচ হচ্ছে দুই হাজার ৫০০ টাকা। বেতন ও কোচিং বাবদ বছরে তাঁর খরচ হচ্ছে ৩৮ হাজার ৪০০ টাকা। আরেক অভিভাবক আনোয়ার হোসেনের হিসাবে, গত তিন বছরে শিক্ষার পেছনে তাঁর পরিবারের খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ সময়ে কাগজের দাম যেমন বেড়েছে তেমনি টিউশন ফি, কোচিং ফি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত ভাড়া- সবই বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১২ শতাংশ। নতুন অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বাজেটের ১৪ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে শিক্ষাবিষয়ক এনজিওদের মোর্চা 'গণসাক্ষরতা অভিযান'। এ সংগঠনের প্রধান নির্বাহী এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ড. রাশেদা কে চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, শিক্ষা খাতে সরকারও প্রচুর খরচ করছে। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীর জন্য মাথাপিছু বার্ষিক সরকারি ব্যয় এখনো খুবই কম। মানসম্মত শিক্ষার জন্য এ ব্যয় আরো বাড়ানো জরুরি। তিনি বলেন, সরকারি ব্যয় সীমিত থাকায় ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য অভিভাবকদের প্রচুর খরচ করতে হয়।
অর্থনীতিবিদ ও সমাজ গবেষকদের মতে, সন্তানের শিক্ষা রাজধানীর মধ্য আয়ের পরিবারের খরচের অন্যতম প্রধান খাত। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি মোট সংসার খরচের ২০-২৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেও শিক্ষার মাধ্যম ও স্তর অনুযায়ী এটি অনেক পরিবারের খাবারের ব্যয়কে ছাড়িয়ে যায়। স্কুলের বেতন ও উপকরণ খরচের চেয়ে অনেক বেশি খরচ কোচিংয়ে। এর বাইরে রয়েছে স্কুল ও কোচিংয়ে যাতায়াত ব্যয়, সময়ের অপচয়।
অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন গবেষক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, দুটি সন্তান আছে এমন অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারে শিক্ষার ব্যয় খাওয়া ও চিকিৎসার খরচকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার ব্যয় নিয়ে 'গণসাক্ষরতা অভিযান'-এর তিন বছর আগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং সরকারি সহায়তাপুষ্ট বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যয়ের ৫৯ ও ৭১ শতাংশ পারিবারিকভাবে মেটানো হয়। প্রাইভেট টিউশনি পারিবারিক পর্যায়ে ব্যয়ের একক বৃহত্তম খাত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর প্রাইভেট শিক্ষক আছে।
ড. রাশেদা বলেন, তদারকির দুর্বলতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান কমছে। এ কারণেও শিক্ষার্থীদের পেছনে পরিবারের খরচ বাড়ছে। কাগজ-কলমের দাম বাড়ছে, সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কোচিংয়ের খরচ। সব স্কুলে ভালো পড়াশোনা হলে অভিভাবকদের এ বাড়তি খরচ হতো না।
একই মন্তব্য করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি। এ জন্য তদারকির দুর্বলতাকে দায়ী করে তিনি বলেন, শিক্ষকরা যাতে ক্লাসরুমে ঠিকমতো পড়ান সে জন্য তদারকি বাড়াতে হবে। তাহলে কোচিংয়ের পেছনে বাচ্চাদের দৌড়াতে হবে না, পরিবারের খরচও কমবে।
কোচিংকে শিক্ষকদের ব্যবসার একটি অশুভ চক্র বলে উল্লেখ করেন সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, 'শিক্ষকরা কোচিংয়ের ব্যবসায় নেমেছেন। তাঁদের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট রয়েছে। তাঁরা ঠিক করেছেন, স্কুলে পড়াব না, বাচ্চারা বাধ্য হবে কোচিং সেন্টারে যেতে, প্রাইভেট টিউটর রাখতে। এ জন্য শিক্ষার পেছনে পারিবারিক ব্যয় বাড়ছে। তদারকিতে যাঁরা আছেন, স্কুল ইন্সপেক্টর, তাঁরা তো ভালো রিপোর্ট দেন। এটি একটি বিজনেস নেক্সস।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. অহিদুজ্জামান বলেন, সারা দেশে তত্ত্বাবধান জোরদার করায় মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান বাড়ছে। পাবলিক পরীক্ষায় এখন গ্রামের শিক্ষার্থীরা ভালো করছে। তবে ঢাকায় তদারকির কোনো ব্যবস্থা কাজ করছে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, 'কোচিং ব্যবসা এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। চারদিকে যেসব স্কুলের খুব নাম শোনা যায়, গবেষণার কাজে সে স্কুলগুলোতে ক্লাস নিতে গিয়ে তাদের পড়ানোর নমুনা দেখেছি। কোন স্কুলকে ভালো বলছি আমরা?'
ঢাকার অভিভাবকদের প্রতিও খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করে এ শিক্ষাবিদ বলেন, তাঁরা পড়াশোনা বা মেধার বিকাশ চান না, তাঁরা চান রেজাল্ট।
ঐতিহ্য, খেলার মাঠ, প্রশস্ত স্কুল ভবন, ল্যাবরেটরি, এমনকি ছাত্রাবাস আছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার এমন অনেক স্কুল এখন আর আলোচনায় নেই। ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা হয়ে উঠেছে একটি অঘোষিত শিক্ষা এলাকা। এখানে ভাড়া বাড়িতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। সারা শহর থেকে শিক্ষার্থীরা আসছে এখানে।
ড. অহিদুজ্জামান বলেন, সরকার যদি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্কুলগুলোর সম্পদ ও অবকাঠামো ব্যবহার করে, স্থানীয় কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে ব্যবস্থাপনা ও পড়াশোনার উন্নয়ন করতে পারে, তাহলে সেখানকার ছাত্রছাত্রীদের সারা শহর পাড়ি দিয়ে ধানমণ্ডির স্কুলে আসতে হয় না। এতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট কমবে, অভিভাবকদের যাতায়াতজনিত ব্যয় ও সময় বাঁচবে।
ড. অহিদুজ্জামান বলেন, পারিবারিক শিক্ষা ব্যয় কমাতে হলে ঢাকার স্কুলগুলোতে তদারকি বাড়াতে হবে। তথাকথিত কয়েকটি ভালো স্কুলের ওপর থেকে নজর সরাতে হবে। পর্যায়ক্রমে 'ক্যাচমেন্ট এরিয়া' পদ্ধতি চালু করতে হবে, অর্থাৎ যিনি যে এলাকায় থাকেন সে এলাকার স্কুলে সন্তান ভর্তি করাবেন। সে জন্য খেলার মাঠ, ল্যাবরেটরিসহ অবকাঠামো আছে এলাকাভিত্তিক এমন স্কুলগুলো চিহ্নিত করে সেখানে পড়াশোনার মানোন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। অবশ্য ঢাকা শহরে পাবলিক স্কুলও বাড়াতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সব স্কুলকে মানসম্মত পর্যায়ে নিয়ে আসাই আমাদের মূল চেষ্টা। বইয়ের মান উন্নত করেছি। তিন বছরে তিন লাখ মাধ্যমিক শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিন হাজার স্কুল, এক হাজার মাদ্রাসা ও দেড় হাজার কলেজে ভবন তৈরি করে দিয়েছে সরকার। ছাত্রীদের স্কুলে ধরে রাখার জন্য উপবৃত্তি অব্যাহত রয়েছে।' তিনি বলেন, ঢাকায় ১১টি স্কুল ও কলেজ তৈরি করছে সরকার। ইতিমধ্যে হাজারীবাগে জায়গা ঠিক করা হয়েছে, বাকিগুলোর স্থান নির্ধারণসহ অন্যান্য কাজ চলছে।
No comments