প্রতিক্রিয়া-সন্ত্রাসের মারেফতি তত্ত্ব: চোখের আড়ে লুকাল পাহাড় by ফারুক ওয়াসিফ

জগতে দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে এবং দুঃখের প্রতিকার সম্ভব—বলেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। এই গভীর কিন্তু সরল কথাটি তিন আর্যসত্য হিসেবে পরিচিত। সন্ত্রাস-সহিংসতা আজ আমাদের দুঃখ দিচ্ছে। মনে ভয়ও জন্মাচ্ছে, আমি বা আমার সন্তান কিংবা পয়পরিজন কি নিরাপদ? এত ভয় আর এত দুঃখ যেখানে, সেখানে প্রতিকার হচ্ছে না কেন?


কেন বন্ধ হচ্ছে না খুন-ধর্ষণ-নির্যাতন? কারণ, বুদ্ধকথিত সেই ‘দুঃখের কারণ’ যারা, তাদের হাতেই যে প্রতিকারের দায়িত্ব! সেই নেতা-রাজনীতিবিদ-প্রশাসক যাঁরা সন্ত্রাস দমনের সিদ্ধান্ত দেবেন, কিংবা সেই পুলিশ-আইন-আদালত, যাঁরা অপরাধীদের বিচার করবেন, তাঁরা বসে আছেন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে। নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে তাঁরা সন্ত্রাস-সহিংসতার কেষ্টু-বিষ্টুদের সামনে বর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
মানুষ এখন সন্ত্রাসের ভয়ে ভীত, প্রতিকার না হওয়ার ভয়ে ভীত, নিরাপত্তা হারানোর ঝুঁকিতে ভীত। এর জন্য তাঁরা ভাগ্য বা কোনো গায়েবি শক্তিকে নয়, সরকার-প্রশাসনকেই দোষ দেন। এই সত্য সবাই জানে, কিন্তু মনে হয় সুমন রহমান জানেন না। তাই তিনি তাঁর ‘তরল ভয়ের স্বরলিপি’ (প্রথম আলো, ৬ এপ্রিল) লেখায় বলেন, সন্ত্রাসীকে ‘এখন আর শ্রেণী দিয়ে, বর্ণ দিয়ে, ধর্ম দিয়ে আলাদা করে চেনা যাবে না...কিছু ভয় আছে, যা পুরো প্রাকৃতিকও নয়, আবার পুরো সাংস্কৃতিকও নয়। এদের কোনো নাম নেই, এরা থাকে মাঝখানে ধূসর এলাকায়। ...এই জোনে আপনার বিবেক-বুদ্ধির বিশেষ ভূমিকা নেই, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রও এখানে কখনো বধির কখনো বা অকেজো।’ এই বিশ্লেষণ থেকে মনে হতে পারে, সমাজ-রাষ্ট্রের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা নয়, রাজনীতিতে পেশিশক্তির দাপট নয়, দুর্নীতি ও দখলের লাঠিয়াল সন্ত্রাসীদের আধিপত্য নয়, ভয়ের কারণ কোনো রহস্যময় গায়েবি শক্তি।
কথায় বলে, ছাগল নড়ে খুঁটির জোরে। গরিব কি বড়লোক, যে পরিবার থেকেই সন্ত্রাসী আসুক, বড় দু-তিনটি দলের কারও না কারও খুঁটির জোর তার লাগবেই। লাগবে পুলিশের অভিযোগপত্র থেকে নাম কাটানো, সাক্ষ্য-প্রমাণ গায়েব করে দেওয়া কিংবা ফরিয়াদিকে থানা-আদালতের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে না দেওয়ার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক এবং চরিত্রে পুরুষালি। এদের রাজনীতি আছে, শ্রেণীচরিত্র আছে, আছে লিঙ্গপরিচয়। এরাই আজ আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার খুঁটি। রাজনৈতিক সন্ত্রাস আর সামাজিক সন্ত্রাস পরস্পর ভাই ভাই—বোনদের বিপদ তাই বেড়েছে।
এ জন্যই আমি আমার আগের লেখাটিতে বলেছিলাম, ‘আমাদের সমস্যা বাস্তব ও জমাট নৈরাজ্য, ‘‘তরল ভয়’’ নয়।...কারণ সরকার-প্রশাসন শিথিল, আর সমাজ প্রতিরোধহীন। এই সহিংসতা ও অসন্তোষ বিদ্যমান ব্যবস্থারও খেসারত।...এই সন্ত্রাস-দুর্নীতি-নির্যাতন ও বলপ্রয়োগের রাজনীতির কারণে বাংলাদেশে নিম্নমাত্রার, কিন্তু মোটামুটি স্থায়ী এক নৈরাজ্য চলছে।’ সহিংসতার ‘ভয়’ এই বাস্তবতার ফল, অথচ সুমন রহমান ভয়কেই ভয় ছড়িয়ে পড়ার কারণ ঠাউরেছেন। ফলকে তিনি কারণ ভেবেছেন, তাই কারণ রয়ে গেছে তাঁর চিন্তার আঁকশির নাগালের বাইরে। তাঁর ‘তরল ভয়’ তাই মারেফতি তত্ত্ব হয়েছে সমাজতত্ত্ব নয়।
তিনি বলেছেন, তাঁর পদ্ধতি আরোহী, অর্থাৎ একটা একটা ঘটনা দেখে দেখে তারপর সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। অথচ দেখা যাচ্ছে, তিনি গুলশানের ওই জোড়া খুনের ঘটনার বিন্দুতেই আটকে আছেন। একটি ঘটনা থেকেই সব ঘটনার চরিত্র বিচার করার এই পদ্ধতি যুক্তিসংগত নয়। দরকার ঘটনার বিন্দুগুলোকে রেখা দিয়ে যোগ করে পুরো ছবিটি ধরতে পারা এবং সে অনুযায়ী সমাধান খোঁজা। তরল ভয়ের তত্ত্বটি ইউরোপ থেকে আমদানি করে যেভাবে ফিট করেছেন, তাতে তত্ত্বের মুখরক্ষা হয়েছে বটে, কিন্তু সমস্যাটি তাঁর হাত গলে পারদের মতো পড়ে গেছে। আমাদের নাগরিকের সমস্যা পাশ্চাত্যের অতি-আধুনিক জীবনের অস্তিত্ববাদী সংকট নয়; আমাদের অনেক মানুষ না খেতে পাওয়ার ভয়ে ভীত, অনেক কৃষক ফসল মার যাওয়া বা উপযুক্ত দাম না পাওয়ার ভয়ে তটস্থ, অনেক নারীকেই উত্ত্যক্ত অথবা নিপীড়িত হওয়ার আতঙ্ক তাড়া করে, আমাদের তরুণেরা কেউ বখাটে-মাস্তান আর কেউ সেই মাস্তানদের শিকার আর কিশোরী-তরুণীদের ধাওয়া করছে উঠতি মাস্তানের বাসনার আগুন।
বাস্তব সমস্যার কার্যকারণ বাস্তবতার মধ্যেই খুঁজতে হবে। সেই বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি কায়েমি ক্ষমতার মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া দাপট। দেখছি বিকৃত যৌনস্বাধীনতার ফসল পর্নোগ্রাফির বিস্তার এবং ভোগতাড়িত সংস্কৃতির রসায়নে তীব্র হওয়া ভোগবাসনা। এই বাসনার আগুন ক্ষমতার ঘিয়ের সংস্পর্শে এসে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। এই বেপরোয়া ক্ষমতার লাগামহীন বাসনারই প্রকাশ নারীর প্রতি সহিংসতা।
সুমন রহমান এগুলো দেখলেন না, বরং তিনি আবিষ্কার করলেন, ‘কন্যার বিয়েতে মাতাপিতা গররাজি হওয়ায় তাঁরা খুন হলেন, কিন্তু কন্যাটি অপহূত হলো না বা অন্য কোনো রকম সহিংসতার শিকার হলো না।’ এই আবিষ্কারে স্বয়ং তিনিই হতবাক হয়ে বললেন, ‘...বিদ্যমান যে ভয়ের সংস্কৃতি, সেটা আমাদের অনুমিত পথে সব সময় চলছে না।’ সন্ত্রাসের অরণ্যে একটি বৃক্ষ অন্য রকম হলেই কি সন্ত্রাসের সামাজিক ব্যাকরণ বাতিল হয়ে যায়? সন্ত্রাসের বাস্তব চেহারা ও কার্যকারণকে আড়াল করে তিনি কথিত ‘সমাজ-ভাবুকের’ কাজ করেননি, সমাজতাত্ত্বিক জিগম্যান্ট বম্যানের ‘তরল ভয়’ তত্ত্বের বেখাপ্পা ব্যবহার করে দিশেহারা হয়েছেন। তাই চলমান সহিংসতার প্রতিকারের চিন্তা ছেড়ে ঘটনাগুলোর মধ্যকার ‘সূক্ষ্ম পার্থক্যের’ গলিপথে ঢুকলেন তো ঢুকলেন আর বেরোতে পারলেন না। লিখলেন, ‘সমাজ নিজে নিজেই এক ভয়ংকর পথে রওনা দিয়েছে। সে পথের খুঁটিনাটিগুলো খেয়াল করাকে আমি দায়িত্ব মনে করি।’ ভালো কথা, কিন্তু খুঁটিনাটির নুড়িপাথর ঘাঁটতে ঘাঁটতে পাহাড়সমান সমস্যাটাই যে দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেল? একেই বলে চোখের আড়ে পাহাড় লুকানোর কসরত।
সূর্য নয় বরং পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে, এই সত্য বলার জন্য ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে ধর্মীয় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল। আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি পুরোহিতদের বারবার বলছিলেন, একবার আমার টেলিস্কোপে চোখ রাখুন, নিজের চোখে দেখুন! কিন্তু পুরোহিতেরা তাঁর কথা শোনার দরকার মনে করেননি। কারণ তাঁদের বিশ্বাস, সত্য দেখা যায় না, তা ধর্মগ্রন্থে লেখা থাকে! আর বাইবেল বলছে, সূর্যই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। সুমন রহমানও তেমনি বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও সামাজিক সহিংসতার বাস্তব ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ না করেই, এক ভাবুকের বই মেলে ধরে আমাদের ‘তরল ভয়’ বোঝাতে বসলেন। অথচ আমাদের দরকার বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করায় আগ্রহী নতুন গবেষক, নতুন তত্ত্ব ও অনুসন্ধান। যাঁরা বাংলাদেশের বাস্তবতাকে নতুন আলোকে বুঝিয়ে দেবেন। সমস্যার চোরাবালিতে ক্রমশ নিমজ্জিত হওয়া বাংলাদেশে এমন গণগবেষক আজ খুব প্রয়োজন। অথচ তিনি বোঝালেন, ‘সে সমাজ-বিপ্লবীর কাজ, সমাজ-ভাবুকের নয়।’
এই কসরত কিন্তু ‘তরল ভয়’ তত্ত্বের প্রবক্তা বম্যান সাহেব প্রশ্রয় দিতেন না। লিকুইড ফিয়ার বইটিতে বম্যান বলেন, প্রয়োগ করা যায় না এমন তত্ত্বের কী দরকার! বম্যানের পরামর্শ হলো, দৃষ্টি পরিষ্কার করে নিন (ক্লিয়ারিং দ্য সাইট)। গুরুবাক্য শিরোধার্য। আমারও মত সেটাই।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.