রাজনীতি-প্লিজ বলুন, সেই পথ কী by মাহমুদুর রহমান মান্না

বিদেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এসে বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা দেশের কূটনীতিকরা বলেছেন_ এভাবে দেশ চলতে থাকলে আবার কোনো অশুভ শক্তি গ্রাস করবে আমাদের। আর সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, যারা জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে তাদের সঠিক পথে আনার উপায় তার জানা আছে।


এর চেয়ে আশ্বস্ত হওয়ার কথা আর কী হতে পারে? প্রধানমন্ত্রী প্লিজ বলুন, সেই পথ কী। আমরাও সেই পথে হাঁটতে চাই, যাতে দেশে শান্তি ফিরে আসে

হঠাৎ করেই যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে। প্রায় একই সময়ে তিনজন বিশেষ বিদেশি অতিথি ঢাকা সফর করে গেলেন। প্রথমে এলেন জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা কাতসুয়া ওকাদা। তিনি যেতে না যেতেই চীন সফর শেষে ভারত যাওয়ার পথে ঢাকায় পা রাখলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। ১৭ বছর আগে ফার্স্টলেডি হিসেবে তিনি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাণপুরুষ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে। হিলারি ক্লিনটন থাকাকালেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শ'তম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে প্রতিবেশী ভারতের অর্থমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য প্রণব মুখার্জি ঢাকা পেঁৗছালেন। তাকে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সবচেয়ে আস্থাভাজন মনে করা হয়। এ তিন অতিথির একে অপরের সঙ্গে দেখা হবে, এমন সুযোগ ছিল না। একই ধরনের অনুষ্ঠানেও তারা আসেননি। কিন্তু কিছু বিষয়ে তারা ঢাকা ত্যাগের আগে কথা বলে গেছেন, যার বিষয়বস্তু সম্পর্কে কেউ বলতে পারেন একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ। বাংলাদেশের ইতিহাসে সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের এমন সফর ঘটেছে বলে মনে পড়ে না।
একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, একজন অর্থমন্ত্রী এবং একজন উপপ্রধানমন্ত্রী_ যে তিনটি দেশের তারা প্রতিনিধি তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ব্যাপক। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের রফতানি পণ্যের বড় বাজার। অন্যদিকে ভারত ও জাপান থেকে বাংলাদেশ প্রচুর পণ্য আমদানি করে। বাংলাদেশকে সহজ শর্তে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানকারী দেশের তালিকাতেও শীর্ষস্থানটি জাপানের দখলে অনেক বছর ধরে। তবে এ তিনটি সফরের কতখানি অর্থনৈতিক তাৎপর্য তা এখন পর্যন্ত বোঝা যায়নি, কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া খুবই ব্যাপক। বিশেষ করে হিলারি ক্লিনটনের ২৪ ঘণ্টারও কম সময় ঢাকায় অবস্থানের। ওবামা প্রশাসন যে বাংলাদেশ সরকারের ওপর খুবই অসন্তুষ্ট, এ সময়ে সেটা উৎকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
কেউ কেউ বলছেন (আওয়ামী লীগের একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যকে টেলিভিশনে বলতেও শুনেছি), এটা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি হিলারি ক্লিনটনের মাত্রাতিরিক্ত ভালো লাগা বা পছন্দের প্রমাণ। সফর কিংবা হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যের রাজনৈতিক তাৎপর্য তেমন কিছু নেই। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হলেও হিলারি ক্লিনটন আগামী বছর থেকে আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে থাকছেন না। তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণে রাজি হননি, সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জানা গেছে, এর প্রধান কারণ কন্যার প্রতি আরও সময় দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন তিনি। তিনি না থাকলে আগামীতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কতখানি ইউনূসপন্থি থাকবে, সেটা দেখার বিষয়। তাছাড়া সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন, বিশেষ করে পররাষ্ট্র বিভাগ, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এবং পেন্টাগন বাংলাদেশের বর্তমান ভূমিকায় মোটামুটি সন্তুষ্ট। অন্যদিকে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের ভূমিকা নিয়ে ছিল অসন্তুষ্ট। বিশেষ করে ২০০১ সালের পর বিএনপি সরকার যেভাবে আসামের উলফাকে প্রশ্রয়দানসহ প্রতিবেশী ভারতবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিল তাকে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা মনে করছে ভারত সরকার। এ অবিশ্বাসের চিড় আর সহজে জোড়া লাগানো মুশকিল বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরে এ কথা মনে করার কারণ রয়েছে যে, তারা বিএনপিকে নিয়ে নতুন করে ভাবছে। নইলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার জন্য ২৫ মিনিটের বেশি সময় দেওয়া না গেলেও হিলারি ক্লিনটন খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলেন এবং মজা করে পাটিসাপ্টা পিঠাও খেয়ে নিলেন। আর এই একই রাতে বিএনপির পলাতক নেতারা চুপি চুপি হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়লেন, আশ্রয় নিলেন এবং পরদিন জামিনের আবেদন করে জামিন নিয়ে নিলেন।
লেখাটা শুরু করেছিলাম রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলানোর কথা দিয়ে। সরকার বিএনপি এবং তার মিত্রদের প্রতি আরও বেশি হার্ডলাইন বা কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এর পাশাপাশি বিএনপিও সেই তুলনায় কৌশলী হওয়ার চেষ্টা করছে। হাইকোর্ট থেকে তাদের জামিন পাওয়া এর প্রমাণ দেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো থেমে থাকা বা দমে যাওয়ার দল নয়। বিএনপি যতই কৌশল করুক, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারকে হাত-পা নুলা করে দিয়ে যতই ক্ষমতা থেকে বিদায় করে দিতে চান না কেন, আওয়ামী লীগ তা পরোয়া করছে না। বরং পাল্টা ধমক দিচ্ছে_ ওসব ভয় আমাদের দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা জানি, কী করে আন্দোলন দমন করতে হয়।
অতএব উচ্চ আদালতে জামিনপ্রাপ্ত বিএনপি নেতারা নিম্ন আদালতে তা হারালেন এবং একসঙ্গে বিএনপি ও জোটনেতাদের ৩৩ জন শীর্ষনেতাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বাংলাদেশে তো বটেই, এমনকি পাকিস্তান আমলেও এমন ঘটনা বিরল। যে হরতালে বাস পোড়ানোর অভিযোগে এসব নেতার নামে মামলা দেওয়া হয়েছিল সেই নেতাদের গ্রেফতার আরেকটি নতুন হরতালের জন্ম দিল। মজার ব্যাপার যে, ঠিক সেই হরতালের দিনেই (১৭ মে) আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ও সমুদ্র জয় উপলক্ষে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দিল। হরতাল উপেক্ষা করে হাজার হাজার নেতাকর্মী সারাদেশ থেকে এসে সেই সংবর্ধনায় যোগ দিল। সয়লাব হয়ে গেল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের বিশাল চত্বর।
পাঠকবৃন্দ, বুঝে দেখুন_ একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারতের অর্থমন্ত্রী সংলাপের পরামর্শ দিচ্ছেন, ব্যবসায়ীসহ দেশের নাগরিক সমাজ এ থেকে আশাবাদী হওয়ার চেষ্টা করছেন_ তখন স্পষ্টতই দুই দল পরস্পরকে শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে চাইছে। ছাত্রলীগের দেওয়া সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বক্তব্য রাখলেন সেটা প্রণিধানযোগ্য। এবং আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য সেটাই। তিনি বললেন, 'তত্ত্বাবধায়করূপী দানবকে মানুষ আর দেখতে চায় না। হরতালের নামে যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে তাদের সঠিক পথে আনার উপায় আমার জানা আছে। আমি যে সহ্য করছি তাকে আমার দুর্বলতা মনে করবেন না। আমরা যখন দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করছি তখন তারা ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত। যারা এ ধরনের কাজ করবে, মানুষ পুড়িয়ে মারবে, জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে তাদের কীভাবে সঠিক পথে আনতে হয় সেটা জানা আছে। তবে আমরা তা করতে চাই না। আমরা চাই, তারা সঠিক পথে চলুক। তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।'
এ বক্তৃতার একদিন আগে নির্বাচিত সরকারের পুলিশের দানবীয় রূপ মানুষ দেখেছে। শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত যে কোনো মানুষের হাতেখড়ি দেন যে মানুষটি তিনি একজন প্রাইমারি শিক্ষক। তাদের শাহবাগের মোড়ের রাজপথে যেভাবে বেধড়ক লাঠিপেটা করা হয়েছে, গাড়ি থেকে গরম পানি ছিটিয়ে ঝলসে দেওয়া হয়েছে সেটা যে কাউকে ব্যথিত করবে। পুলিশের মারে আর গরম পানিতে একজন শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় একত্র হয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রত্যাশী প্রাইমারি শিক্ষকদের সময় দেননি। বরং তিনি পরদিন বললেন, যারা মানুষ পুড়িয়ে মারছে কিংবা ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে তাদের কীভাবে সঠিক পথে আনতে হয় সেটা তার জানা আছে। এই যে পুলিশ ও র‌্যাব মানুষের ওপর নির্যাতন করছে তাদের ঠিক করার উপায় কি প্রধানমন্ত্রীর জানা আছে? অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ১৯৮১ সালের ১৭ মে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের স্মরণে আয়োজিত সভায় তাদের উদ্দেশ করে কথাগুলো বলেননি। তারপরও মানুষ তো আশা করতেই পারে, অন্তত একজন শিক্ষকের এভাবে যে করুণ মৃত্যু হলো তার যেন তদন্ত হয়, কিছু একটা প্রতিবিধান হয়। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দল সম্পর্কে কথা বলেছেন। আমি তাতেও আশ্বস্ত হতে চাই, আস্থা রাখতে চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যার কথা বলেছেন। যখন তিনি বক্তৃতা করছেন তার কিছু আগে ও পরে রাজধানীর একটি হোটেলে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা মিলে অর্থমন্ত্রীকে রাজনীতির অঙ্গনের অশান্তি দূর করার অনুরোধ করে বলেন, অন্যথায় দেশে শান্তি আসবে না। বিদেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এসে বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা দেশের কূটনীতিকরা বলেছেন_ এভাবে দেশ চলতে থাকলে আবার কোনো অশুভ শক্তি গ্রাস করবে আমাদের। আর সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, যারা জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে তাদের সঠিক পথে আনার উপায় তার জানা আছে। এর চেয়ে আশ্বস্ত হওয়ার কথা আর কী হতে পারে? প্রধানমন্ত্রী প্লিজ বলুন, সেই পথ কী। আমরাও সেই পথে হাঁটতে চাই, যাতে দেশে শান্তি ফিরে আসে। শান্তি যে কেবল আপনি চান তা তো নয়। শান্তি দেশের ১৬ কোটি মানুষ চায়। কিন্তু আপনি এ কথা বললেন কেন যে আপনি সেই পথে চলতে চান না। আপনি আশা করছেন যে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। কীভাবে সেটা সম্ভব? আপনি যে পথ বা পদ্ধতির কথা বলছেন সেভাবে নির্বাচনে দলগুলো এলেই আমাদের ধরে নিতে হবে যে শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে? দেশের ১৬ কোটি মানুষ চায় সরকার ভালোভাবে দেশ পরিচালনা করুক। ঝড়-বন্যা-আইলার মধ্যেও মানুষ আশাবাদী যে, বাংলাদেশ সামনে এগুবে। দুটি বড় দলের মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক থাকার পরও মানুষ আশা করে যে আমাদের দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র্রের ধারা গড়ে উঠবে, টিকে থাকবে। আজ যে জটিলতার মধ্যে পড়েছি, উত্তরণের পথ খুঁজছি, তখন আপনি বলছেন, এ থেকে বের হয়ে আসার পথ আপনি জানেন। সবাই আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আপনি কী নির্দেশনা দেন, সেটা দেখতে চায়।

মাহমুদুর রহমান মান্না :ডাকসুর সাবেক ভিপি ও রাজনীতিক
 

No comments

Powered by Blogger.