জ্ঞানভিত্তিক কর্মজগতেই সমাধান by সঞ্জয় সরকার

বাংলাদেশের দ্রুত উন্নতি লাভের একটি মাত্র উপায় আছে, উন্নত দেশের সমমানের ট্রেনিং পাওয়া জনসম্পদ তৈরি করা। সে জন্য দরকার উচ্চশিক্ষার দ্রুত প্রসার। সেটা সম্ভব, কারণ তার জন্য যে প্রাকৃতিক সম্পদ দরকার সেটা হলো মেধা।


চিন্তাশীল পাঠক মাত্রই বুঝতে পারছেন, এই পথে গেলে বাংলাদেশের ভালো ছাড়া খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, সর্বজনীন উচ্চশিক্ষা সমাজকেও উন্নত করবে সবদিক থেকে

যারা বাংলাদেশ নিয়ে ভাবেন, তারাই জানেন পৃথিবীময় তাপমাত্রা বৃদ্ধির মহাসংকট আসছে। থারমোডিনামিক্সের অমোঘ নিয়ম, বাংলাদেশ সেটা থামাতে পারবে না। এর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল যে ডুবে যাবে, সেটা বিজ্ঞানীরা অনেক দিন থেকেই জানেন। সেখানকার মানুষ দলে দলে ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে যাবেন। যেহেতু কৃষিকাজ ছাড়া আর কোনো কর্মদক্ষতা নেই, তারা হবেন সংস্থানহীন রিফিউজি। এর ফলে দেশে ভয়াবহ ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা হবে। এ সমস্যার সমাধান কী? দেশি-বিদেশি অনেক বিশেষজ্ঞ আসবেন। কেউ বলবেন লবণাক্ততা কমাও, কেউ রিফিউজিদের পুনর্বাসনের বুদ্ধি দেবেন। আসলে এগুলো ফুটো সারানোর ব্যবস্থা। আর বাঁধ দিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে জমি উদ্ধার করার মতো টাকা-পয়সা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা বাংলাদেশের নেই।
আমার মতে, গেল্গাবাল ওয়ার্মিংয়ের ক্ষতি কমানোর একমাত্র উপায় বাংলাদেশের মূল সমস্যাগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান বের করা। সেগুলো কী তা সবাই জানেন_ মানুষ বেশি, জায়গা নেই, প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। কাজের খুব সুবিধাও নেই, ফলে অধিকাংশ মানুষই গরিব। আসলে এ সমস্যা তো আজকের নয়, চলি্লশ বছর আগেও ছিল। সমাধানের জন্য বিশেষ কিছু করা হয়নি। ফলে আজ জনসংখ্যা দুই গুণেরও বেশি_ ষোলো কোটির কাছাকাছি। পৃথিবীতে সপ্তম। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১১০০ লোক। সেদিক থেকে শুধু প্রথম নয়, কাছাকাছি ভারতের (৩৬২) তিন গুণেরও বেশি। প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে জমি; যা অল্প কিছু গ্যাস ছিল, তাও বেশি দিন থাকবে না। আর ঢাকার গাড়ি, বাড়ি আর শপিংমল দেখে ভুলবেন না, মানুষ এখনও গরিবই রয়ে গেছে। এদিকে জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এখন জমি ডোবার ফলে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ।
এ সমস্যার সমাধান হলো মানুষ কমানো আর দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির ব্যবস্থা করা। মানুষের সংখ্যা কমাতেই হবে, কারণ বর্তমান জনসংখ্যাই প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য মিলিয়ে থাকার তুলনায় অনেক বেশি। আমরা জানি যে, গড়ে যদি প্রত্যেক নারীর ২.১ সন্তান হয় তাহলে জনসংখ্যা সমান থাকে। বাংলাদেশের বর্তমান ফার্টিলিটি রেট ২.৬২। আমার ধারণা, নারীশিক্ষার, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার দ্রুত প্রসার, মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি, বিশেষ করে বুড়ো বয়সে কিছুটা অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা দিতে পারলে এ রেট দ্রুত কমবে। এটা আমরা ইউরোপের দেশগুলো এবং জাপানকে দেখে বুঝতে পারি। সেখানে স্থানীয়দের সংখ্যা দ্রুত কমছে, সেটা ওদের বড় সমস্যা। এশিয়াতে ভিয়েতনামের (রেট ১.৯১) অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ শিখতে পারে, যেহেতু ভিয়েতনামও জনবহুল গরিব দেশ, যেটা এখন দ্রুত উন্নতির পথে। ভিয়েতনামের সাক্ষরতার হার শতকরা ৯৬, মেয়েদের ৯২। বাংলাদেশে ৫৪ আর ৪১।
শিল্পায়ন : দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন কী করে হবে_ বাংলাদেশের না আছে পুঁজি, না আছে খনিজ সম্পদ। আসলে এসবের এখন আর দরকার নেই। দরকার সুদক্ষ জনসম্পদ তৈরি করা। এটা আমরা পূর্ব এশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই জানি। আজকাল আবার শ্রমিকরা শুধু মাঠ আর কলকারখানায় কাজ করে না, একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বব্যপী কর্মস্থলে অনেক কাজই হলো সার্ভিস সেক্টরে, একটা বড় অংশ জ্ঞানভিত্তিক। যে কাজই করতে চান, আপনার পেতে হবে উন্নত দেশের সমমানের প্রশিক্ষণ। যেমন ধরুন, অনেকেই বিদেশে কাজ করতে যান, তাদের পাঠানো টাকা বাংলাদেশের জিডিপির একটা বড় অংশ। সমস্যা একটাই_ অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশি খুব কম রোজগারে কাজ করেন, কারণ বেশি রোজগারের পেশাদারি বা সার্ভিস সেক্টরে কাজ করার মতো দক্ষতা (স্কিল) নেই। তার জন্য দরকার শিক্ষার।
বাংলাদেশের অন্য রফতানি দ্রব্য হলো জামা-কাপড়। অনেক অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ লোক এই শিল্পে কাজ করে; কিন্তু রোজগার খুবই কম। কারণ বাংলাদেশে তৈরি জামা আমেরিকায় বিক্রি হয় দশ ডলারে। অন্যদিকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো রফতানি করে তিনশ' ডলারের টেলিভিশন, সাতশ' ডলারের রেফ্রিজারেটর আর হাজার ডলারের কম্পিউটার। সেজন্য বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বাড়ছে বছরে বড়জোর ৪ পার্সেন্ট হিসাবে। এই হারে একজন বাংলাদেশির রোজগার দ্বিগুণ হতে লাগবে ১৭-১৮ বছর। মালয়েশিয়ার কথা বাদই দিলাম, ততদিনে একজন ভারতীয়র রোজগার হবে প্রায় সাতগুণ। মালয়েশিয়ার বর্তমান পর্যায়ে পেঁৗছতে লাগবে ৫৫ বছর। এতে সমস্যার সমাধান হবে না।
এ পদ্ধতিতে দ্রুত উন্নতি করতে হলে বাংলাদেশেরও এমন দামি জিনিস রফতানি করতে হবে, যাতে জিডিপি ১৫ পার্সেন্ট হারে বাড়ে। সেটা কি সম্ভব? অবশ্যই। মহাদেশের সমান চীন দেশ তা করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। সমস্যা হলো বাংলাদেশের পক্ষে টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটরের মতো শিল্পজাত দ্রব্যের বাজারে ঢোকা প্রায় অসম্ভব, ভারতও পারেনি। চীন এগুলো দখল করে আছে। যেটা করা যায় সেটা হলো যন্ত্রের অংশ (পার্টস) তৈরি করা। এতেও সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হবে না। কারণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা খুবই জোরালো। তবু এ ধরনের মানুফ্যাকচারিং কিছু করা সম্ভব, যতক্ষণ আপনি সস্তায় সুদক্ষ শ্রম দিতে পারছেন। কিন্তু এখন যেসব কাজ করতে হয় তার দরকার বিশ্বমানের টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ, ক্লাস সেভেনের বিদ্যায় কুলাবে না।
জ্ঞানভিত্তিক নতুন কর্মক্ষেত্র : পূর্ব এশিয়ার পদ্ধতি নকল করে খুব সুবিধা না হলেও আমি সম্পূর্ণ নিরাশ হবো না। কারণ ইতিমধ্যে জ্ঞানভিত্তিক নতুন একটা বিশাল কর্মস্থল তৈরি হয়েছে পৃথিবীব্যাপী। এখানে সুযোগ বেশি, রোজগারও বেশি। এ জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় শতকরা ৫০-৬০ ভাগ ছাত্র হাই স্কুল পাস করে কলেজে পড়তে যায়। তারা কাজ করে সার্ভিস সেক্টরে, যার অনেকটাই জ্ঞানভিত্তিক। এ সব ক্ষেত্রেও দক্ষ শ্রমিকের অনেক চাহিদা। যেহেতু সে দক্ষতা মেধাভিত্তিক, এসব কাজে বাংলাদেশিদের অনেক সুবিধা আছে। কারণ আর কিছু না থাকুক, মেধার তো অভাব নেই। এটা দিতে প্রকৃতি কাউকে খাতির করে না। দরকার হবে এমন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা, যাতে মেধার দিক থেকে সর্বোচ্চ, অন্তত ১০% ছাত্র এসব কাজে ঢুকতে পারে। উন্নত দেশের ওপরের ৫০ ভাগ হবে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, কে জিতবে বুঝতেই পারছেন।
আমি ইঞ্জিনিয়ার বা কম্পিউটার প্রোগ্রামারদের কথা বলছি না। তারা আর ক'জন! জ্ঞানভিত্তিক কাজ এত রকমের যে এখানে সব বিবরণ দেওয়ার জায়গা নেই। শুধু কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমেরিকায় হাজার হাজার ছোট ব্যবসা, কর্মচারীর সংখ্যা ২০ জনের কম। তাদের অ্যাকাউন্টিং দরকার। আপনি যদি সংস্থায় সুদক্ষ অ্যাকাউন্ট্যান্ট দিতে পারেন তারা এ কাজ পেয়ে যাবে। বাজার বিশ্বব্যাপী, কিন্তু কাজটা করতে হয় কম্পিউটারে, সফটওয়্যার ব্যবহার করে। সেটা দেশে বসেই করা যায়। তাতেই সুবিধা, কারণ তাহলেই আপনি সস্তায় কাজটা করতে পারছেন। এখানেও দরকার হবে বিশ্বমানের ট্রেনিং। এছাড়া আছে বিশ্ব বাজার সংক্রান্ত নানা রকমের রিসার্চের কাজ, যেটা দেশে বসেও করা যায়। দরকার হলে অল্পদিনের জন্য আপনি লোক পাঠিয়ে দিতে পারেন।
একেবারে অন্য ধরনের কর্মক্ষেত্র স্বাস্থ্য সেক্টর। উন্নত দেশগুলোতে মানুষ এখন গড়ে আশি বছর বাঁচে, বুড়ো মানুষের সংখ্যা বেশি। তাদের দেখাশোনার জন্য বিশ্বমানের ট্রেনিংপ্রাপ্ত নার্সের (শুধু নারী নয়) অভাব। বাংলাদেশেই কি সুদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর চাহিদা কম? আজ বাংলাদেশিরা চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায় কেন দলে দলে? আর যেসব মধ্যবিত্ত বিদেশে যেতে পারছে না, তাদের মধ্যেও ভালো চিকিৎসার একটা প্রচণ্ড চাহিদা আছে। কিন্তু অনেক টাকাপয়সা খরচ করেও তারা উন্নতমানের চিকিৎসা পাচ্ছে না। যতই লোকের টাকাপয়সা বাড়ছে ততই এর চাহিদা বাড়ছে। অর্থাৎ উন্নতমানের ট্রেনিং দিতে পারলে দেশের ভেতরেই স্বাস্থ্যভিত্তিক একটা বড় অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ঘটবে। কারণ মানুষ মরতে চায় না। তাছাড়া আপনি যদি সস্তায় উন্নতমানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে বিদেশ থেকেও লোক আসবে, কারণ সেখানে খরচ আকাশচুম্বী। যেমন আজকাল পশ্চিমা দেশ থেকে ভারতে রোগী আসছে।
মোট কথা, বাংলাদেশের দ্রুত উন্নতি লাভের একটি মাত্র উপায় আছে, উন্নত দেশের সমমানের ট্রেনিং পাওয়া জনসম্পদ তৈরি করা। সে জন্য দরকার উচ্চশিক্ষার দ্রুত প্রসার। সেটা সম্ভব, কারণ তার জন্য যে প্রাকৃতিক সম্পদ দরকার সেটা হলো মেধা। চিন্তাশীল পাঠক মাত্রই বুঝতে পারছেন, এই পথে গেলে বাংলাদেশের ভালো ছাড়া খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, সর্বজনীন উচ্চশিক্ষা সমাজকেও উন্নত করবে সবদিক থেকে। এটা করতে হবে সরকারকেই। আসলে একটা ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর তৈরি করার চেয়ে উচ্চমানের শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা সহজ এবং খরচ অনেক কম। কী করে তা করা যায়, সে প্রসঙ্গ আর একদিন হবে।

সঞ্জয় সরকার : অধ্যাপক, পদার্থবিদ্যা আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র
 

No comments

Powered by Blogger.