বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-জনশক্তি রপ্তানি : মালয়েশিয়ায় পুনর্বার আশার আলো by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়া উর্বরভূমিতে রূপান্তরিত হলেও কিছু অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির কারণে একপর্যায়ে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি বন্ধ করে দেয়। ১৯৯৯ ও ২০০৭ সালে দুই দফায় তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছিল।


১৯৭৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের প্রায় সাত লাখ দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক কাজের সন্ধানে গেলেও তাঁদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত সেখানে বিপাকে পড়েন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে মালয়েশিয়ায় বন্ধ শ্রমবাজার আবার বাংলাদেশের জন্য অবারিত করতে নানা রকম পদক্ষেপ নেয়। এরই অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশিয়া সফরেও গিয়েছিলেন। বিলম্বে হলেও এর সুফল মিলছে, আশার আলো দেখা দিয়েছে। ১৬ মে ২০১২, প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানির ব্যাপারে সবকিছু খতিয়ে দেখতে সে দেশের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসছে। তাদের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সে দেশের সরকার এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা আশবাদী, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্তই নেবে। বাংলাদেশ সরকার জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন করে কৌশল অবলম্বন করছে একটি নীতিমালার ভিত্তিতে, এও আশাপ্রদ খরব। অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনার পাশাপাশি সরকারি মাধ্যমে সে দেশে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি সরকার ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করেছে, তাও জানা গেছে।
বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচতে এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু ভালোভাবে জীবনযাপনের প্রত্যাশায় কর্মহীন মানুষ সংগত কারণেই বিদেশে পাড়ি জমাতে চান। কিন্তু জমিজমা, সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে প্রতিনিয়তই অনেক মানুষ প্রতারকদের খপ্পরে পড়ছেন, এমন সংবাদ পত্রপত্রিকা কিংবা টেলিভিশনে প্রায়ই চোখে পড়ে। জাল ভিসা, ভ্রমণ ভিসা ইত্যাদি নানা রকম পথ অবলম্বন করে যাঁদের বিদেশ পাঠানো হয় তাঁরা বিভিন্ন দেশে গিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও দুঃখ-কষ্টের শিকার হন। অসংখ্য পরিবার ইতিমধ্যে সর্বস্বান্ত হয়ে পথেও বসে গেছে। এই চিত্র নতুন কিছু না হলেও এর প্রতিকার চিত্র খুবই বিবর্ণ। এমন ঘটনাও ইতিমধ্যে ঘটেছে যে, অনেককে জিম্মি করে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়ে তাঁদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছে। সাধারণত প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কিংবা তাদের দালাল চক্র বিদেশে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে গ্রামের নিরীহ সাধারণ লোকজনকে বোকা বানিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি অতি পুরনো হলেও এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আইন-প্রশাসন কোনো কিছুই প্রতারিতদের সহযোগিতা করে না- এমন অভিযোগও আছে বিস্তর।
কখনো কখনো এই অপক্রিয়ার গতি কিছুটা মন্থর হলেও সুযোগ বুঝে প্রতারকরা তা আবার পরিস্থিতি বুঝে বেগবান করে। একপর্যায়ে আদম বেপারি হিসেবে খ্যাত দালালরা লাপাত্তা হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো দালাল জাল ভিসা, ভ্রমণ ভিসা ইত্যাদির মাধ্যমে লোক পাঠিয়ে আরো নতুন নতুন অপক্রিয়ায় যুক্ত হয়। প্রতারিতরা বাধ্য হয়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে শুধু কম বেতনেই নয়, অত্যন্ত আমানবিক জীবনযাপনের পথটা বেছে নেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের পাসপোর্টও কেড়ে নেওয়া হয়। মালয়েশিয়ায় এ ধরনের প্রতারণার শিকার শত শত বাংলাদেশি রয়েছেন এই সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ঘটছে আরো ভয়াবহ ঘটনা। এসব কারণেই বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি হ্রাস পাচ্ছে এবং এর বিরূপ ধাক্কা লাগছে জাতীয় অর্থনীতিতে।
এসব কুকর্মের কারণে শুধু যে অসংখ্য মানুষের জীবনই ধ্বংস হয়ে গেছে তাই নয়, দেশের সুনামও বিনষ্ট হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। ভুয়া রিক্রুটের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগের ব্যাপারে আগেই অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিল। এরপর এ তালিকায় যুক্ত হয় মালয়েশিয়া। শ্রমবাজারে যখন এই দুরবস্থার চিত্র বিদ্যমান তখন মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনর্বার উন্মুক্তের প্রক্রিয়ার খবরটি নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যাতে আর কোনো রকম তুঘলকি কাণ্ড না ঘটে তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের। সরকারি মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক হলেও এ ক্ষেত্রে যে অসাধুরা সক্রিয় হয়ে উঠবে না এর নিশ্চয়তা নেই। কাজেই বিষয়টি সতর্ক পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বিদেশ যেতে আগ্রহীদের সচেতনতার বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে জরুরি যেসব অসাধু এজেন্টের কারণে ইতিমধ্যে আমাদের ব্যাপক সর্বনাশ হয়ে গেছে তাদের শনাক্ত করে কঠোর প্রতিকারের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই 'হবে', 'হচ্ছে'র মতো শব্দগুলো অদ্ভুত এক সংস্কৃতির জটাজাল বিস্তৃত করে আছে। এই জাল ছিন্ন করা খুবই দরকার। ইতিপূর্বে কয়েকজন প্রতারককে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তাদের দণ্ড কতটা কী নিশ্চিত হয়েছে তা অজানা। এখানে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সংশয়ের বৃত্তবন্দি হয়ে পড়ে অনেক কিছু আর এরই সুযোগ নেয় অপশক্তি। শুধু আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি না দিয়ে সরকারের উচিত যেসব দেশে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ রয়েছে কিংবা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে সেসব দেশের সঙ্গে কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা। বিস্তর অভিযোগ আছে, বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে কর্তব্যরত দায়িত্বশীল অনেকের বিরুদ্ধেও। তাঁরা বিপন্ন বিপর্যস্ত বাংলাদেশিদের পাশে সময়মতো তো দাঁড়ানই না, নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধানে কিংবা পুরনো বাজারগুলো চাঙ্গা করতেও তাঁদের ব্যর্থতার দাগটি খুব মোটা। বাংলাদেশের শ্রমিকদের সম্পর্কে যেসব দেশে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে তা নিরসনেও তাঁদের উদ্যোগ-আয়োজন প্রশ্নবোধক। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে গিয়ে নানা রকম অপকর্ম করার কারণে আমাদের শ্রমবাজারের দরজায় খিল পড়ছে- এই অভিযোগটিও পুরনো বটে। কিন্তু এ সম্পর্কে সরকারের তরফে কতটা কী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাও অজানা। দরকার হলে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করে তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিক। তাদের কারণে বাংলাদেশের শ্রমবাজার প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে না।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের ইমেজ সংকট কাটানোর উদ্যোগ নিতে হবে বিদেশের মিশনগুলোতে কর্মরত দায়িত্বশীলদের। রপ্তানি প্রতারণা ছাড়াও বিদেশে কর্মরত কিছু বাংলাদেশির বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে। এমন অনিয়ম কিংবা অপতৎপরতা রোধ করতে না পারলে সব সুযোগই যে হাতছাড়া হবে নতুন করে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্র্রয়োজন। মালয়েশিয়ায় পুনর্বার জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ লাভের প্রচেষ্টার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত বাংলাদেশের কোনো সুযোগই যাতে কীটদংশ না হয়, তা নিশ্চিত করার দায় সরকারের। জনশক্তি রপ্তানি খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে সব অর্জনেরই বিসর্জন ঘটবে, যা শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন কারোরই কাম্য নয়।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.