কুমড়ার পেটে গঞ্জিকা by হাসান হাফিজ
দিন আসলেই বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় জিনিসের কলাকৌশল, টেকনিকও পাল্টায়। রাজনীতির কবলে পড়লে তো আরও দ্রুত বদলে যায়। ছাত্রনীতি, ব্যবসা, প্রতারণা, লোভনীয় আশ্বাস, গালভরা প্রতিশ্রুতি, জোচ্চুরি, এমনকি চোরাচালান—সব কাজকর্মেই দিনবদলের বেমক্কা ঢেউ আছড়ে পড়ছে। মহা ঢেউ বলে চোটপাটই আলাদা।
ঘটনাস্থল খোদ রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশন। সেখানে পুলিশ পাকড়াও করেছে কুলসুমকে। তার সঙ্গে ছিল ঢাউস একটা মিষ্টি কুমড়া। কুমড়োর পেটে ভর্তি দুই কেজি ওজনের বিশেষ একটি বস্তু। দু-চার ছটাক হলেও কথা ছিল! দুই কেজি, বাউ রে! উদ্ধারকারী পুলিশেরও ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। আপন মনের মাধুরী মিশায়ে ইতিহাস লিখতে নাকি ওই ধূম্র উদ্রেককারী বিষয়টির খুব প্রয়োজন হয়।
এক ছিলিমে যেমন-তেমন দুই ছিলিমে তাজা। ওই গাঁজা নিয়ে কত কাণ্ড। কুলসুম শুধু গঞ্জিকাই বহন করছিল না। সঙ্গে ছিল ভারতীয় টোটকা ফেনসিডিল, ৫০ বোতল। বলিহারি পুতলা তুমি কুলসুম। নেপথ্যে কে যে তোমাকে নাচায়, তার পরিচয় উদ্ঘাটন করে বঙ্গীয় পুলিশের এমন সাধ্য নেই। তোমার গডফাদার বা গডমাদার কে, আমরা জানি না। অজ্ঞাতপরিচয় সেই এলেমদারকে স্যালুট। গাঁজায় গর্ভিণী কুমড়োসমেত কুলসুম ধরা খেয়েছে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি।
গাঁজা-সংক্রান্ত তরতাজা এ খবরটা চিন্তার খোরাক জোগায়। হঠাত্ই গাঁজার এত বড় বড় চালান আসছে কেন? কী এর মাজেজা? নিশ্চয়ই চাহিদা বহুগুণে বর্ধিত হয়েছে। অর্থনীতির নিয়ম, ডিমান্ড বাড়লেই সাপ্লাই বাড়ে। আমরা এ রহস্যের একটু গোবেচারা তদন্ত করে দেখতে পারি। এই মহতী কাজে বিডিআর বিদ্রোহের মতো এক বছর সময়ক্ষেপণ পোষাবে না। চকিত তদন্তে দেখছি, নাম বদলকারী এবং নতুন গজানো ইতিহাসবিদদের খাঁই মেটাতেই এত বিপুল পরিমাণ গাঁজা ফেনসিডিলের অবাধ আমদানি। পিলখানা ট্র্যাজেডির পর থেকে সীমান্ত তো নামকাওয়াস্তে পাহারা দেয় বিডিআর। দেশি-বিদেশি বড় বড় কুতুবরা কলকাঠি নাড়ে। যেমনে নাচাও তেমনি নাচে পুতলার কিবা দোষ! রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে চিরকাল। মাঝখানে কুলসুমের মতো চুনোপুঁটিদের হেনস্তা এবং দফারফা। উন্মত্ত নেশার ঘোরে বেধড়ক নাম পাল্টাপাল্টি চলছে। কোনো যুক্তিবুদ্ধি বাছবিচার নেই। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজেও ওই শুষ্ক সালসার ভূমিকা রয়েছে।
দেশে নাকি হালফিল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চমেত্কার। এই মর্মে মিডিয়ায় ডুগডুগি বাজানো হচ্ছে তারস্বরে। গোয়েবলসীয় প্রচারে কান পাতা দায়। কয় পুরিয়া গাঁজা খেলে এমন উদ্ভট দাবি করা সম্ভব? এই মাত্রা নিরূপণের দায়িত্ব ভিনদেশী বিজ্ঞানীদের দিতে হবে। তারা নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করবে। পাহাড়ি জনপদ এখন রক্তাক্ত, অস্থিতিশীল। রিমান্ড, ক্রসফায়ারের বন্যা চলছে।
দুষ্ট লোকেরা বলে, একটা কুমড়ো কিনলে দশ পুরিয়া গাঁজা ফ্রি ফর্মুলা চলছে। ইতিহাসবিদরা তো আছেনই। দ্রব্যমূল্য ও আইন-শৃঙ্খলার শনৈ শনৈ উন্নতির দাবি যারা করেন, তাদের জন্য এই বস্তু টনিক হিসেবে কাজ করছে। হয়তো তারা জিনিসটা সরাসরি খরিদে লজ্জা পান। সামাজিক মর্যাদা বলে একটা কথা আছে না? কুমড়োর মোড়কে আসল মালের সাপ্লাই নিশ্চিত করা হচ্ছে। তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হচ্ছে। গঞ্জিকা-ফেনসিডিলের কাটতি বাড়ছে, পড়শির রফতানি আয় স্ফীত হচ্ছে। বিপরীতে সমাজপতিদের মাথাও কাটা পড়ছে না। দিনবদলও ঘটে যাচ্ছে।
বিভিন্ন কোম্পানি একটা পণ্যের সঙ্গে আরেকটা জিনিস ফাও দিচ্ছে। যেমন একটি বহুজাতিক কোম্পানির সাবান কিনলে একটা পিচ্চি রুমাল ফ্রি দেয়া হচ্ছে আজকাল। কিংবা টয়লেট পরিষ্কারক কিনলে এক পাতা শ্যাম্পু বিনি পয়সায় মিলছে। ফাও জিনিসের জন্য হাঙ্গামা-হুজ্জত কম হচ্ছে না। কোম্পানিগুলোতে ফাটাফাটি লড়াই। কে কত ফাও দিতে পারে, তা নিয়ে চলছে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। ফাও-এর উপর বেশি জোর দিলে বিপদও হতে পারে। আম-ছালা দুটোই হাপিশ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা।
সহৃদয় পাঠক, আপনাদের অনেকেই নাসিরুদ্দিন হোজ্জার বিখ্যাত সেই গল্পটা জানেন। যাদের জানা নেই, তাদের জন্য সংক্ষেপে গল্পটা বলি। হোজ্জা তার এক পড়শির কাছ থেকে একটা কড়াই ধার আনলেন। কিছু দিন পর পড়শি কড়াই ফেরত নিতে এলেন। হোজ্জা তাকে অতিরিক্ত একটা ছোট্ট কড়াই দিলেন সঙ্গে। অবাক পড়শি শুধোন, এটা কোত্থেকে এল? বিগলিত হোজ্জার জবাব, আপনার কড়াইটা একখানা বাচ্চা দিয়েছে। বাচ্চাটাও আপনারই প্রাপ্য। পড়শি খুশিমনে দুটো কড়াই বগলদাবা করে ফিরে গেলেন।
আবার কড়াই ধার আনলেন হোজ্জা। ফেরত দেয়ার নামটি নেই। পড়শি বারবার তাগাদা দেন, ফেরত চান কড়াই। এক দিন কাঁদো কাঁদো হোজ্জা বললেন, কড়াইটা তো ইন্তেকাল করেছে জনাব। পড়শি হতভম্ব— আপনার কি মাথাটাথা খারাপ হয়েছে নাকি? কড়াই কখনো মরে? নির্বিকার হোজ্জা জবাব দেন, আমার না আপনার মাথাই গড়বড় করছে। পড়শি বলেন, কেন? হোজ্জার সোজা সাপটা উত্তর : যে কড়াই বাচ্চা দিতে পারে, সে মারাও যেতে পারে। সেটাই কী স্বাভাবিক নয়?
hasanhafiz51@gmail.com
এক ছিলিমে যেমন-তেমন দুই ছিলিমে তাজা। ওই গাঁজা নিয়ে কত কাণ্ড। কুলসুম শুধু গঞ্জিকাই বহন করছিল না। সঙ্গে ছিল ভারতীয় টোটকা ফেনসিডিল, ৫০ বোতল। বলিহারি পুতলা তুমি কুলসুম। নেপথ্যে কে যে তোমাকে নাচায়, তার পরিচয় উদ্ঘাটন করে বঙ্গীয় পুলিশের এমন সাধ্য নেই। তোমার গডফাদার বা গডমাদার কে, আমরা জানি না। অজ্ঞাতপরিচয় সেই এলেমদারকে স্যালুট। গাঁজায় গর্ভিণী কুমড়োসমেত কুলসুম ধরা খেয়েছে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি।
গাঁজা-সংক্রান্ত তরতাজা এ খবরটা চিন্তার খোরাক জোগায়। হঠাত্ই গাঁজার এত বড় বড় চালান আসছে কেন? কী এর মাজেজা? নিশ্চয়ই চাহিদা বহুগুণে বর্ধিত হয়েছে। অর্থনীতির নিয়ম, ডিমান্ড বাড়লেই সাপ্লাই বাড়ে। আমরা এ রহস্যের একটু গোবেচারা তদন্ত করে দেখতে পারি। এই মহতী কাজে বিডিআর বিদ্রোহের মতো এক বছর সময়ক্ষেপণ পোষাবে না। চকিত তদন্তে দেখছি, নাম বদলকারী এবং নতুন গজানো ইতিহাসবিদদের খাঁই মেটাতেই এত বিপুল পরিমাণ গাঁজা ফেনসিডিলের অবাধ আমদানি। পিলখানা ট্র্যাজেডির পর থেকে সীমান্ত তো নামকাওয়াস্তে পাহারা দেয় বিডিআর। দেশি-বিদেশি বড় বড় কুতুবরা কলকাঠি নাড়ে। যেমনে নাচাও তেমনি নাচে পুতলার কিবা দোষ! রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে চিরকাল। মাঝখানে কুলসুমের মতো চুনোপুঁটিদের হেনস্তা এবং দফারফা। উন্মত্ত নেশার ঘোরে বেধড়ক নাম পাল্টাপাল্টি চলছে। কোনো যুক্তিবুদ্ধি বাছবিচার নেই। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজেও ওই শুষ্ক সালসার ভূমিকা রয়েছে।
দেশে নাকি হালফিল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চমেত্কার। এই মর্মে মিডিয়ায় ডুগডুগি বাজানো হচ্ছে তারস্বরে। গোয়েবলসীয় প্রচারে কান পাতা দায়। কয় পুরিয়া গাঁজা খেলে এমন উদ্ভট দাবি করা সম্ভব? এই মাত্রা নিরূপণের দায়িত্ব ভিনদেশী বিজ্ঞানীদের দিতে হবে। তারা নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করবে। পাহাড়ি জনপদ এখন রক্তাক্ত, অস্থিতিশীল। রিমান্ড, ক্রসফায়ারের বন্যা চলছে।
দুষ্ট লোকেরা বলে, একটা কুমড়ো কিনলে দশ পুরিয়া গাঁজা ফ্রি ফর্মুলা চলছে। ইতিহাসবিদরা তো আছেনই। দ্রব্যমূল্য ও আইন-শৃঙ্খলার শনৈ শনৈ উন্নতির দাবি যারা করেন, তাদের জন্য এই বস্তু টনিক হিসেবে কাজ করছে। হয়তো তারা জিনিসটা সরাসরি খরিদে লজ্জা পান। সামাজিক মর্যাদা বলে একটা কথা আছে না? কুমড়োর মোড়কে আসল মালের সাপ্লাই নিশ্চিত করা হচ্ছে। তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হচ্ছে। গঞ্জিকা-ফেনসিডিলের কাটতি বাড়ছে, পড়শির রফতানি আয় স্ফীত হচ্ছে। বিপরীতে সমাজপতিদের মাথাও কাটা পড়ছে না। দিনবদলও ঘটে যাচ্ছে।
বিভিন্ন কোম্পানি একটা পণ্যের সঙ্গে আরেকটা জিনিস ফাও দিচ্ছে। যেমন একটি বহুজাতিক কোম্পানির সাবান কিনলে একটা পিচ্চি রুমাল ফ্রি দেয়া হচ্ছে আজকাল। কিংবা টয়লেট পরিষ্কারক কিনলে এক পাতা শ্যাম্পু বিনি পয়সায় মিলছে। ফাও জিনিসের জন্য হাঙ্গামা-হুজ্জত কম হচ্ছে না। কোম্পানিগুলোতে ফাটাফাটি লড়াই। কে কত ফাও দিতে পারে, তা নিয়ে চলছে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। ফাও-এর উপর বেশি জোর দিলে বিপদও হতে পারে। আম-ছালা দুটোই হাপিশ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা।
সহৃদয় পাঠক, আপনাদের অনেকেই নাসিরুদ্দিন হোজ্জার বিখ্যাত সেই গল্পটা জানেন। যাদের জানা নেই, তাদের জন্য সংক্ষেপে গল্পটা বলি। হোজ্জা তার এক পড়শির কাছ থেকে একটা কড়াই ধার আনলেন। কিছু দিন পর পড়শি কড়াই ফেরত নিতে এলেন। হোজ্জা তাকে অতিরিক্ত একটা ছোট্ট কড়াই দিলেন সঙ্গে। অবাক পড়শি শুধোন, এটা কোত্থেকে এল? বিগলিত হোজ্জার জবাব, আপনার কড়াইটা একখানা বাচ্চা দিয়েছে। বাচ্চাটাও আপনারই প্রাপ্য। পড়শি খুশিমনে দুটো কড়াই বগলদাবা করে ফিরে গেলেন।
আবার কড়াই ধার আনলেন হোজ্জা। ফেরত দেয়ার নামটি নেই। পড়শি বারবার তাগাদা দেন, ফেরত চান কড়াই। এক দিন কাঁদো কাঁদো হোজ্জা বললেন, কড়াইটা তো ইন্তেকাল করেছে জনাব। পড়শি হতভম্ব— আপনার কি মাথাটাথা খারাপ হয়েছে নাকি? কড়াই কখনো মরে? নির্বিকার হোজ্জা জবাব দেন, আমার না আপনার মাথাই গড়বড় করছে। পড়শি বলেন, কেন? হোজ্জার সোজা সাপটা উত্তর : যে কড়াই বাচ্চা দিতে পারে, সে মারাও যেতে পারে। সেটাই কী স্বাভাবিক নয়?
hasanhafiz51@gmail.com
No comments