ইয়াবা পাচারে এ কী কৌশল! by এস এম রানা

মিয়ানমারে উৎপাদিত মরণনেশা ইয়াবা বাংলাদেশের টেকনাফে আনার পর অদ্ভুত সব কৌশলে সারা দেশে পাচার হচ্ছে। শুরুর দিকে সহজ সব পথে এই নেশাজাত দ্রব্য বহন করা হলেও বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে ইয়াবা পাচার অত সহজ নয়।


কিন্তু পাচারকারীরা এমন সব কৌশল অবলম্বন করছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন ইয়াবা পাচার রোধে ডগ স্কোয়াড নিয়ে মাঠে নেমেছে। বিজিবি গত অক্টোবরে একটি ডগ স্কোয়াড নামিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইয়াবা পাচারকাজে ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ নেই। দামি গাড়ি হাঁকিয়ে ধনীরা ইয়াবা বহন করছে। তারা নিজেরা সেবন করার পাশাপাশি বিক্রির কাজেও জড়িত। আর দরিদ্র তরুণরা কৌশল বদলাতে সর্বশেষ বেছে নিয়েছে 'পায়ুপথ'! এমন দুটি ঘটনা চট্টগ্রামে ধরা পড়েছে। কিন্তু সব পাচারকারীর পেট পরীক্ষা করে পাচার রোধ কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে কর্মরত একাধিক পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ইয়াবা আকারে ছোট হওয়ায় শরীরে বেঁধে সহজে বহন করা যায়। কিন্তু পথে পুলিশ-বিজিবির তল্লাশির মুখে বারবার কৌশল পাল্টায় পাচারকারীরা। নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্য ও ফলের মধ্যে লুকিয়ে ইয়াবা আনা-নেওয়া করা হয়। নারিকেলের ভেতরেও ইয়াবা পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন কৌশল হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে পায়ুপথ।
কয়েকটি ইয়াবা ট্যাবলেট কনডমে ঢুকিয়ে স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে চিকন-লম্বা প্যাকেটের মতো করে পাচারকারী নিজের পায়ুপথে ঢুকিয়ে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। চট্টগ্রাম নগরে এভাবে ইয়াবা পাচারের প্রথম ঘটনা ধরা পড়ে ২০১০ সালের ৩ নভেম্বর। ওই দিন বুলু মিয়া নামের টেকনাফের এক ব্যক্তি পেটব্যথার কারণে নগরের একটি ক্লিনিকে ভর্তি হয়। পরে চিকিৎসকরা তার পেটে পান প্যাকেট করা প্রায় দেড় হাজার পিস ইয়াবা। ইয়াবা পাওয়ার পর তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল রাতে পায়ুপথে ৩০০ পিস ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম রেলস্টেশন এলাকা থেকে গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক মনিরুজ্জামানের হাতে পড়ে মোহাম্মদ আবদুল্লাহ (২২)। সে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ মিস্ত্রিপাড়ার বাসিন্দা মতিউর রহমানের ছেলে।
ধরা পড়ার পর কালের কণ্ঠের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকালে আবদুল্লাহ পায়ুপথে ইয়াবা পাচারের আদ্যোপান্ত জানায়। আবদুল্লাহকে পরে আদালতের মাধ্যমে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেপ্তারের পর আবদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে জানায়, ইয়াবা ব্যবসার মূল ব্যক্তিকে সে চেনে না। ইয়াবা বহনকে তাদের ভাষায় বলে 'মাল হাটায়' বা 'কেরিংদার'। তবে সে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে রোহিঙ্গা নাগরিক ছৈয়দ হোসেনের নাম শুনেছে। ছৈয়দ হোসেনসহ বেশ কয়েক ব্যক্তি টেকনাফে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে এবং এ দেশে ইয়াবা বিক্রি করে। আবদুল্লাহ জানায়, প্রতিটি কেরিংদারে (প্রতিবার বহন) সে পাঁচ হাজার টাকা করে পায়। তবে সব টাকা একসঙ্গে দেওয়া হয় না। ইয়াবা ব্যবসায়ীর লোকজন বিশেষ কায়দায় ইয়াবার প্যাকেট বানিয়ে তার পায়ুপথে দিয়ে জানায়, এগুলো ঢাকায় পৌঁছে দিতে হবে। ঢাকায় যাওয়ার জন্য দুই হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়। বাকি তিন হাজার কাজ শেষে পাবে। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে কোথায়, কাকে ইয়াবা দেবে, সেই ঠিকানা দেওয়া হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, ঢাকায় পৌঁছলে মোবাইল ফোনে বাকি ঠিকানা বলে দেওয়া হবে না।
আবদুল্লাহ জানায়, পাচারকারী গ্রুপের অনেক সদস্য আছে। টেকনাফ থেকে বিভিন্ন দূরপাল্লার বাসে করে তারা চট্টগ্রামে আসে। পরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাসহ অন্য জেলায় যায়। একেক জেলায় কেরিংদারকে একেক ধরনের টাকা দেওয়া হয়। তবে এসব কেরিংদারের অনেকেই কেউ কাউকে চেনে না।
এভাবে ইয়াবা পৌঁছে কারাগারেও : পাচারকারীরা পায়ুপথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছানোর পাশাপাশি ইয়াবা ঢুকে যাচ্ছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারেও। চট্টগ্রামের আদালতে মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে ফেরার পথে পায়ুপথে ইয়াবার প্যাকেট নিয়ে কারাগারে প্রবেশের পর কারা কর্তৃপক্ষ এসব ইয়াবা উদ্ধার করেছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে এ ঘটনা ঘটে। ২০১১ সালের শুরুতে কারাগারের জেলার রফিকুল কাদের একজন মাদকসেবী হাজতিকে সন্দেহের বশে তল্লাশি করেন। প্রথমে তার কাছ থেকে কিছু পাওয়া যায়নি। পরে ওই হাজতিকে বাথরুমে নিয়ে তল্লাশি চালিয়ে ৩০টি ইয়াবা বড়িসহ একটি প্যাকেট উদ্ধার করা হয়। কারাগারে মাদক নিয়ে প্রবেশের দায়ে পরে ওই হাজতিকে কারাবিধি অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে বর্তমানে নোয়াখালী কারাগারে জেলারের দায়িত্ব পালনকারী রফিকুল কাদের বলেন, 'পায়ুপথে ইয়াবা এবং জুতার ভেতর গাঁজা নিয়ে প্রবেশের দায়ে বেশ কয়েকজন হাজতিকে কারাবিধি অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তবে এখন ওই হাজতির নাম মনে নেই।'
ধনীদের বিলাসী গাড়ি : ইয়াবা সেবন ও পাচারকারীদের অনেকেই ধনাঢ্য ব্যক্তি। তারা কক্সবাজার-টেকনাফ ভ্রমণের নাম করে যায় এবং ফেরার পথে ইয়াবা নিয়ে আসে। বিলাসবহুল ওই সব প্রাইভেট গাড়ি অনেক সময় তল্লাশি করা হয় না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পর্যটনের আড়ালে ইয়াবা পাচার হয় বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ওসি মাহবুবুল হক। তিনি বলেন, 'টেকনাফ থেকে ফিরতে একাধিক সড়ক ব্যবহার করতে পারে পর্যটকরা। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া সব পর্যটকের গাড়ি গণহারে তল্লাশি করা হয় না। এই সুযোগে এক শ্রেণীর ধনী লোক পর্যটনের আড়ালে ইয়াবা বহন করে।' এ ছাড়া টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে যেসব পণ্য আসছে, সেসব পণ্যের ভেতরে করে ইয়াবা চালান আসছে।
এ বিষয়ে র‌্যাব-৭-এর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর জিয়াউল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মিয়ানমার থেকে যেসব ব্যবসায়ী পণ্য আনছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এখন আট-দশটি সিন্ডিকেটের কথা বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা বলা সহজ নয়।'
র‌্যাবের এই তথ্য নিশ্চিত করে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) সুদীপ কুমার দাশ বলেন, 'স্থলবন্দর দিয়ে আসা পণ্যের ভেতরে ইয়াবার চালান এমনভাবে লুকানো হয় যাতে ধরা না পড়ে। এ ছাড়া ইয়াবাগুলো স্কচটেপ, পলিথিনের প্যাকেটসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে বাঁধা হয়, যাতে এর ঘ্রাণ বের হতে না পারে।'
সংশোধনী : গতকাল কালের কণ্ঠে 'ফেনসিডিলকেও ছাড়িয়ে ইয়াবা' শীর্ষক সংবাদের এক স্থানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হিসেবে মোহাম্মদ আবুল কাশেমের নাম ছাপা হয়েছে। বর্তমানে তিনি বদলি হয়ে গেছেন। এখন সিএমপির কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

No comments

Powered by Blogger.