এই দিনে-রক্তে ভিজেছিল খাপড়া ওয়ার্ড by অনিরুদ্ধ দাশ
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দী অবস্থায় এদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন কমিউনিস্ট কর্মী সুধীন ধর, বিজন সেন, হানিফ শেখ, সুখেন্দু ভট্টাচার্য, দেলোয়ার হোসেন, কম্পরাম সিং ও আনোয়ার হোসেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন দাবিতে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ও ভূমি সংস্কারের মতো গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে জনগণ সোচ্চার হতে থাকে। ভাষা আন্দোলন, তেভাগা-হাজং-টঙ্ক আন্দোলন, শ্রমিকদের আন্দোলনে কমিউনিস্ট কর্মীরা ছিলেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকায়। ফলে তাঁদের ওপর বাড়তে থাকে নির্যাতন, ধরে ধরে তাদের জেলে ভরা হয়। সেই সময়টাতে মুসলিম লীগ সরকার রাজবন্দীদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে বিবেচনা করত। তাঁদের দিয়ে জেলের ঘানি টানানো হতো। সরকারের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এনে, অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে, কারা আইনের আমূল সংস্কার এবং বিচারাধীন মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন বন্দী প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীরা। জেলের অভ্যন্তরে এসব দাবি উত্থাপন ও আন্দোলন গড়ে ওঠায় বেসামাল সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
লড়াইয়ের অন্যতম পন্থা হিসেবে রাজবন্দীরা অনশনকে বেছে নেন। ১৯৪৯ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর ঢাকা ও রাজশাহী জেলের কমিউনিস্ট বন্দীরা চার দফায় মোট ১৫০ দিন অনশন করেন। খুলনা জেলে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কমিউনিস্ট কর্মী বিষ্ণু বৈরাগীকে। নাদেরা বেগমের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকা জেলে অনশন শুরু হয়। এই খবর পেয়ে রাজশাহী জেলেও রাজনৈতিক বন্দীরা অনশন শুরু করেন। ঢাকা জেলে অনশনকারীদের জোর করে ফিডিং করাতে গেলে ৮ ডিসেম্বর শিবেন রায়ের মৃত্যু হয়।
কমিউনিস্ট বন্দীরা নিয়মিত সভা করতেন। জেলের মধ্যে পার্টির কমিটিও ছিল। ‘জেল বিপ্লব’তত্ত্ব, জেলে লাল পতাকা ওড়ানো, জেল ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া, আইন অমান্য করা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁদের আলোচনা চলত।
রাজশাহী জেলে ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে সাধারণ কয়েদিদের অনশনে কমিউনিস্ট বন্দীরাও যোগ দেন। ঘানি টানানো হবে না, ভালো খাবার দেওয়া হবে—এই আশ্বাসের ভিত্তিতে ১৪ এপ্রিল অনশন প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু কমিউনিস্ট বন্দীদের ওপর জুলুম বাড়তে থাকে। ২১ এপ্রিল আব্দুল হক আর বিজন সেনকে ধমক দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, শাস্তি হিসেবে খাপড়া ওয়ার্ডের ১০ জন বন্দীকে কনডেমন্ড্ সেলে স্থানান্তর করা হবে। কমিউনিস্ট বন্দীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির এই আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন রাজবন্দীরা। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন কয়েক দফা। সারা রাত আলোচনার পর ২৪ এপ্রিল সকালে কম্পরাম সিং তেজোদীপ্তভাবে বলেন, ‘শাস্তি আমরা মানব না, সেলে যাব না, নিতে এলে বাধা দেব।’ তাঁর এই বক্তব্য সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়।
রাজশাহী জেল সুপারিনটেনডেন্ট এডওয়ার্ড বিল সেদিন সকাল নয়টা ১৫ মিনিটে দলবল নিয়ে হঠাৎ করেই খাপড়া ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েন এবং আব্দুল হকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। একপর্যায়ে ‘কমিউনিস্টরা ক্রিমিনাল’ বলে গালি দিতে দিতে ওয়ার্ড থেকে বের হয়েই দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দেন এডওয়ার্ড বিল। তিনি বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই পাগলা ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। মশারি টাঙানোর মোটা তার দিয়ে দরজা আটকে জানালা ভেতর থেকে বন্ধ করা হয়। বিল এবার গুলি চালাতে নির্দেশ দেন। বাঁশ দিয়ে জানালার কাচ ভেঙে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি করতে থাকে সিপাহিরা। রক্তে ভেসে যায় খাপড়া ওয়ার্ড। রাজবন্দীরা চিৎকার করে দরজা খুলে দিতে বলেন। দরজা খুলতেই সিপাহি ও কয়েদি পাহারা-মেটরা আহত-নিহতনির্বিশেষে সবাইকে পেটাতে শুরু করে।
বেলুচ আরআইয়ের নেতৃত্বে দুই ভ্যান পুলিশ ওয়ার্ডে ঢুকে বলে, ‘আমাদের তো আর দরকার নেই।’ সেই মুহূর্তে বিলের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ওয়ার্ডে ঢুকে লাঠিপেটা শুরু করে। বিল নিজ হাতে পেটাতে থাকেন আব্দুল হককে। বেলুচ আরআই বিলকে বের করে নিয়ে যান। ঘটনাস্থলেই পাঁচজন শহীদ হন। রাতে মৃত্যু হয় কম্পরাম সিং আর বিজন সেনের। অন্যদের হয়তো বাঁচানো যেত, কিন্তু তাঁদের কোনো চিকিৎসা হয়নি।
নিরস্ত্র ৩৯ জন বন্দীর ওপর ১৮০টি গুলি বর্ষণ করা হয় সেদিন। তিন দফা লাঠিপেটাও হয়। অন্যান্য ওয়ার্ড ও সেলের রাজবন্দীরাও রেহাই পাননি। খাপড়া ওয়ার্ডের জীবিত প্রত্যেক বন্দীই গুলি ও লাঠিপেটায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। নুরন্নবী চৌধুরীর পা কেটে ফেলতে হয়েছিল। পঙ্গু হয়ে যান অনন্ত দেব। খাপড়া ওয়ার্ডের স্মৃতি হিসেবে অনেকেই শরীরের ভেতরে গুলি বহন করে বেঁচে ছিলেন।
সেদিন শহীদেরা জীবন দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেন। খাপড়া ওয়ার্ডের বন্দীরা আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেছেন, জীবন উৎসর্গ করতেও পিছপা হননি। জেল প্রশাসনের আদেশ অমান্য করার পরিণতি কী, তা জানতেন তাঁরা; কিন্তু মাথা নত করেননি। বুঝিয়ে দিয়েছেন, জেলে পুরেও গণ-আন্দোলন থেকে, আদর্শ থেকে প্রকৃত সংগ্রামীকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে; কিন্তু শহীদেরা এখনো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি। খাপড়া ওয়ার্ডের লড়াই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুগ যুগ ধরে প্রেরণা জোগাবে।
লড়াইয়ের অন্যতম পন্থা হিসেবে রাজবন্দীরা অনশনকে বেছে নেন। ১৯৪৯ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর ঢাকা ও রাজশাহী জেলের কমিউনিস্ট বন্দীরা চার দফায় মোট ১৫০ দিন অনশন করেন। খুলনা জেলে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কমিউনিস্ট কর্মী বিষ্ণু বৈরাগীকে। নাদেরা বেগমের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকা জেলে অনশন শুরু হয়। এই খবর পেয়ে রাজশাহী জেলেও রাজনৈতিক বন্দীরা অনশন শুরু করেন। ঢাকা জেলে অনশনকারীদের জোর করে ফিডিং করাতে গেলে ৮ ডিসেম্বর শিবেন রায়ের মৃত্যু হয়।
কমিউনিস্ট বন্দীরা নিয়মিত সভা করতেন। জেলের মধ্যে পার্টির কমিটিও ছিল। ‘জেল বিপ্লব’তত্ত্ব, জেলে লাল পতাকা ওড়ানো, জেল ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া, আইন অমান্য করা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁদের আলোচনা চলত।
রাজশাহী জেলে ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে সাধারণ কয়েদিদের অনশনে কমিউনিস্ট বন্দীরাও যোগ দেন। ঘানি টানানো হবে না, ভালো খাবার দেওয়া হবে—এই আশ্বাসের ভিত্তিতে ১৪ এপ্রিল অনশন প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু কমিউনিস্ট বন্দীদের ওপর জুলুম বাড়তে থাকে। ২১ এপ্রিল আব্দুল হক আর বিজন সেনকে ধমক দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, শাস্তি হিসেবে খাপড়া ওয়ার্ডের ১০ জন বন্দীকে কনডেমন্ড্ সেলে স্থানান্তর করা হবে। কমিউনিস্ট বন্দীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির এই আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন রাজবন্দীরা। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন কয়েক দফা। সারা রাত আলোচনার পর ২৪ এপ্রিল সকালে কম্পরাম সিং তেজোদীপ্তভাবে বলেন, ‘শাস্তি আমরা মানব না, সেলে যাব না, নিতে এলে বাধা দেব।’ তাঁর এই বক্তব্য সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়।
রাজশাহী জেল সুপারিনটেনডেন্ট এডওয়ার্ড বিল সেদিন সকাল নয়টা ১৫ মিনিটে দলবল নিয়ে হঠাৎ করেই খাপড়া ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েন এবং আব্দুল হকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। একপর্যায়ে ‘কমিউনিস্টরা ক্রিমিনাল’ বলে গালি দিতে দিতে ওয়ার্ড থেকে বের হয়েই দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দেন এডওয়ার্ড বিল। তিনি বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই পাগলা ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। মশারি টাঙানোর মোটা তার দিয়ে দরজা আটকে জানালা ভেতর থেকে বন্ধ করা হয়। বিল এবার গুলি চালাতে নির্দেশ দেন। বাঁশ দিয়ে জানালার কাচ ভেঙে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি করতে থাকে সিপাহিরা। রক্তে ভেসে যায় খাপড়া ওয়ার্ড। রাজবন্দীরা চিৎকার করে দরজা খুলে দিতে বলেন। দরজা খুলতেই সিপাহি ও কয়েদি পাহারা-মেটরা আহত-নিহতনির্বিশেষে সবাইকে পেটাতে শুরু করে।
বেলুচ আরআইয়ের নেতৃত্বে দুই ভ্যান পুলিশ ওয়ার্ডে ঢুকে বলে, ‘আমাদের তো আর দরকার নেই।’ সেই মুহূর্তে বিলের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ওয়ার্ডে ঢুকে লাঠিপেটা শুরু করে। বিল নিজ হাতে পেটাতে থাকেন আব্দুল হককে। বেলুচ আরআই বিলকে বের করে নিয়ে যান। ঘটনাস্থলেই পাঁচজন শহীদ হন। রাতে মৃত্যু হয় কম্পরাম সিং আর বিজন সেনের। অন্যদের হয়তো বাঁচানো যেত, কিন্তু তাঁদের কোনো চিকিৎসা হয়নি।
নিরস্ত্র ৩৯ জন বন্দীর ওপর ১৮০টি গুলি বর্ষণ করা হয় সেদিন। তিন দফা লাঠিপেটাও হয়। অন্যান্য ওয়ার্ড ও সেলের রাজবন্দীরাও রেহাই পাননি। খাপড়া ওয়ার্ডের জীবিত প্রত্যেক বন্দীই গুলি ও লাঠিপেটায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। নুরন্নবী চৌধুরীর পা কেটে ফেলতে হয়েছিল। পঙ্গু হয়ে যান অনন্ত দেব। খাপড়া ওয়ার্ডের স্মৃতি হিসেবে অনেকেই শরীরের ভেতরে গুলি বহন করে বেঁচে ছিলেন।
সেদিন শহীদেরা জীবন দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেন। খাপড়া ওয়ার্ডের বন্দীরা আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেছেন, জীবন উৎসর্গ করতেও পিছপা হননি। জেল প্রশাসনের আদেশ অমান্য করার পরিণতি কী, তা জানতেন তাঁরা; কিন্তু মাথা নত করেননি। বুঝিয়ে দিয়েছেন, জেলে পুরেও গণ-আন্দোলন থেকে, আদর্শ থেকে প্রকৃত সংগ্রামীকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে; কিন্তু শহীদেরা এখনো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি। খাপড়া ওয়ার্ডের লড়াই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুগ যুগ ধরে প্রেরণা জোগাবে।
No comments