চরাচর-বাঙালির চন্দ্রাবতী বিশ্বজনের হোক by মো. আবুল কাসেম

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবির নাম চন্দ্রাবতী। কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের মাইজখাপন ইউনিয়নের অন্তর্গত পাতুয়াইর গ্রামে এই কিংবদন্তি কবির ঠিকানা। ঠিকানাটি শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও সুপরিচিত। দুটি মন্দির ও একটি বাড়ির জীর্ণশীর্ণ দুর্দশা নিয়ে ষোড়শ শতকের চন্দ্রাবতী এখনো বিরহিনী এবং লজ্জাবনতা।


কিশোরগঞ্জ সদর থেকে গ্রামের মেঠোপথ ধরে এই স্থানটিতে প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী চন্দ্রাবতীকে দেখতে যায়। এ পর্যন্ত যাঁরা কবির ঠিকানায় গেছেন, চন্দ্রাবতীর ভাগ্যে তাঁদের করুণাই জুটেছে। অযত্ন-অবহেলায় চন্দ্রাবতীর দুর্দশা নিয়ে কিশোরগঞ্জবাসীও হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। কয়েক বছর আগে নাটোর থেকে এসেছিলেন অধ্যক্ষ গোলাম রসুল। গত বছর এসেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফসার আহমেদ। সম্প্রতি এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. খালেদ হোসাইন। তা ছাড়া কলকাতাসহ অন্যান্য দেশ থেকেও এসেছিলেন নামকরা ঐতিহাসিক, ইতিহাসবেত্তা ও চলচ্চিত্র নির্মাতারা। সৌভাগ্য যে তাঁদের অনেকের সঙ্গেই এই লেখকের কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তাঁদের অনেকেই চন্দ্রাবতীর ইতিহাস ও সাহিত্যধন্য স্থানটির অযত্ন-অবহেলা দেখে কিশোরগঞ্জকেই নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন। এরই মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, কিশোরগঞ্জের প্রথিতযশা অনেকেই অতীত-বর্তমান মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন এবং আছেন। সর্বজনীন কিংবা ঐহিত্য বিবেচনায়ও কিশোরগঞ্জের উন্নয়ন, উন্নতি কিংবা সমৃদ্ধি তেমনটা দৃশ্যমান নয়। এ রকম কথা শুনতে শুনতে আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তাই স্বীকার করি এ লজ্জা কিশোরগঞ্জের। একই সঙ্গে এ লজ্জা বাংলাদেশের, এ লজ্জা প্রগতিশীল ক্ষমতাসীনদের, এ লজ্জা আমাদের কীর্তিমানদের। দিনবদলের অঙ্গীকারে এই লজ্জার অবসান চাই। সর্বশেষ জানলাম, রাস্তা পাকাকরণ, নাট্যমঞ্চ, লোকশিল্পের জাদুঘর, সারা দেশের লেখিকাদের রচনার সংগ্রহশালা, মেলা উদ্‌যাপন ও বাড়ি সংস্কারসহ নানা দর্শনীয় বিষয়ের সমারোহে চন্দ্রাবতী কমপ্লেঙ্টির বাজেট পেশসহ ইতিমধ্যে সবই সম্পন্ন হয়েছে। এখন সম্ভবত প্রক্রিয়াধীন ফাইলটি মন্ত্রণালয়ের শক্ত কাগজে জড়ানো লাল ফিতার বন্ধনে আটকে আছে। প্রেমিকা চন্দ্রাকে প্রেমিক জয়ানন্দ একসময় আটকে দিয়ে বিরহিনী করেছে। একুশ শতকের বিশ্বায়নী যুগে চন্দ্রার বিরহ আর দেখতে চাই না। মন্ত্রণালয়ের সুন্দর মনের মানুষদের বলব, চন্দ্রাবতীকে পর্যটন ভাবনায় সাজঘর থেকে বের করে দর্শক উপযোগী দর্শনীয় করে তুলুন। গ্রিক ভাষায় পৃথিবীর প্রথম মহিলা কবি স্যাফো যেমন গ্রিক জাতির অহংকার, তেমনি বাংলা ভাষার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীও কিশোরগঞ্জবাসী তথা বাঙালি জাতির অহংকার। এই অহংকারের জায়গাটায় সুশীল সমাজ, সংস্কৃতিপ্রিয় বোদ্ধামহল, সাহিত্যপ্রেমিক, প্রগতিশীল রাজনীতিক, গণমাধ্যমকর্মী, ইতিহাস-ঐতিহ্যপ্রিয় প্রত্নতাত্তি্বকরা সময়ের দাবি নিয়ে এখন আলো জ্বালিয়ে সমস্বরে নান্দীপাঠ করছেন।

No comments

Powered by Blogger.