হরতাল কি গণতান্ত্রিক অধিকার by এ এম এম শওকত আলী

যে দলই হরতাল করে, সে দলের কথায় একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তা হলো, হরতাল তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। এ ধরনের মিলের উৎস হলো, সব সময় বিরোধী দলই ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে হরতালকে ব্যবহার করে। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ দল বা দলগুলোর আন্দোলনের বিষয়টি অস্বাভাবিক কিছু নয়।


তবে উন্নত দেশে এ আন্দোলন সংসদের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ থাকে। খুব বেশি হলে বড় ধরনের জনসমাবেশ হয়। অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোয় আন্দোলনের চরম হাতিয়ার হিসেবে হরতাল ডাকা হয়। ভারতে এর নাম বন্ধ। অর্থাৎ সব কিছু বন্ধ থাকবে। পাকিস্তানেও মোটামুটি একই নাম। হরতালের নামে গাড়িসহ দোকানপাট ভাঙচুরের ঘটনা বাংলাদেশে যতটা বেশি হয়, ভারতে ততটা হয় না।
যে গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করে রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী হরতাল করে, মূলত তা জনস্বার্থবিরোধী। কারণ হরতাল জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। কর্মজীবী মানুষ কর্মস্থলে সহজে যেতে পারেন না। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের হরতাল অতীতসহ সাম্প্রতিককালে এক নতুন রূপ লাভ করেছে। এর নাম লাগাতার অর্থাৎ বিরামহীন হরতাল। দুই থেকে চার বা পাঁচ দিন পর্যন্ত এ ধরনের হরতালও হয়। গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে হরতাল ছাড়াও অন্যান্য মৌলিক বিষয় রয়েছে। যেমন- স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা বা ব্যবসা কার্য পরিচালনা করা। হরতাল ও সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার পরস্পরবিরোধী। এ বিরোধিতা দূর করার দায়িত্ব কার তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে তাত্তি্বকভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে এ দায়িত্ব রাষ্ট্রের। মাঝেমধ্যে শোনা যায়, হরতাল নিষিদ্ধ করার জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে বা করা প্রয়োজন। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফলে হরতাল সামাজিকভাবে স্বীকৃত না হলেও রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃত।
হরতালের ফলে দেশ বা দশের যে ক্ষতি হয় সে বিষয় নিয়ে অনেক অঙ্ক করা অতীতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। প্রথমে অর্থনীতিবিদরা এবং পরে ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এ হিসাব করেছেন। কালের কণ্ঠে ১৮ মের প্রকাশনায় বলা হয়েছে যে হরতালে প্রতিদিন ক্ষতি হয় হাজার কোটি টাকা। ব্যবসায়ী মহলের এক নেতার উদ্ধৃতি দিয়ে এ হিসাব বলা হয়। অবশ্য এ হিসাব ২০০৫ সালের ইউএনডিপি কর্তৃক প্রণীত হিসাব। এখন নিঃসন্দেহে আরো বেশি হবে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণে বিচার করলে এ হিসাব সব সময় করা হলেও সামাজিক হিসাব এখনো করা হয়নি। অন্যদিকে হরতালের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শনও করা হয় অবশ্য রাজনৈতিক মহল থেকে। এ যুক্তিতে তুলনামূলকভাবে কোন দল ক্ষমতাচ্যুত অবস্থায় কত দিন হরতাল ডেকেছে, সে কথাই সরবে উচ্চারিত হয়। জনগণকে আশ্বস্ত করার জন্যই এটা বলা হয়। অর্থাৎ বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে হরতালরত দলটি অন্য দলের তুলনায় অতটা খারাপ নয়। বরং অধিকতর সহনশীল।
এর আগে হরতাল ডাকার সময় একটি ঘোষণাও দেওয়া হতো। সে ঘোষণায় হরতালের আওতাভুক্ত কয়েকটি ক্ষেত্রও চিহ্নিত করা হতো। এর মধ্যে ছিল সাংবাদিক ও অ্যাম্বুলেন্স। এখন সে ঘোষণা দেওয়ার রীতি যেন বাতিল হয়ে গেছে। কারণ পূর্ববর্তী ঘোষণাবলে হরতালের আওতাভুক্ত ক্ষেত্রের বিষয়টি অনুসরণীয় নীতি হিসেবে গণ্য হয়। অতীতে সাধারণত রিকশা চালকদের রিকশা চালানোর জন্য কোনো বাধার সৃষ্টি করা হতো না। সাম্প্রতিককালে শুধু বাধাই নয়, বরং রিকশা ভাঙার চেষ্টাও করা হচ্ছে। রিকশা চালানোর চেষ্টা চালকরা পেটের তাগিদেই করতে বাধ্য হয়। এক দিনের পারিশ্রমিক তাদের জন্য কয়েক হাজার টাকারও বেশি। অন্যথায় না খেয়ে কাটাতে হবে। সরকারি বা বেসরকারি বাস বা ট্রাক সম্পূর্ণ ধ্বংস হলে একটি অর্থনৈতিক সম্পদই (Economic Asset) ধ্বংস- যার প্রভাব বহুমুখী।
হরতাল আহ্বানকারীরা যেসব ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দেবে তার কোনো তোয়াক্কাই করে না। সরকারি পরীক্ষার ক্ষেত্রে বলা যায় যে তাৎক্ষণিক ঘোষণার বলে এসব পরীক্ষা পিছেয়ে দেওয়া সম্ভব। বিদেশ থেকে বিশ্বব্যাপী পরিচালিত পরীক্ষার ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। যেমন- ও এবং এ লেভেলের পরীক্ষা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই প্রশ্নের ভিত্তিতে এসব পরীক্ষা পরিচালিত হয়। যেসব দেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল রয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানই এ পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট দেশে পরিচালনা করে থাকে। বাংলাদেশে হরতালের সময় এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল এক অভিনব পন্থা চালু করেছে। হরতালের সময় পরীক্ষা না পিছিয়ে একদিনে বা একাধিক সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। যেমন- আধাবেলা হরতাল হলে একই দিন পরীক্ষা হবে বেলা ১টা ৩০ মিনিটে। ওই দিন কারো দুটি পরীক্ষা থাকলে পরের বিষয়টির পরীক্ষা হবে সন্ধ্যা ৬টায়। সকাল-সন্ধ্যা হরতাল হলে পরীক্ষা হবে রাত ১২টায়। দুটি বিষয়ের জন্য দ্বিতীয় পরীক্ষা হবে রাত ৩টায়। লাগাতার হরতাল হলে পরীক্ষা সম্পূর্ণ বাতিল করা হবে। এর জন্য পরীক্ষার ফি ফেরত দেওয়া হবে না। ফি হলো পর্বপ্রতি সাত হাজার ৫০০ টাকা। সাধারণত ছয় থেকে আটটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়। কোনো কোনো বিষয়ে অন্তত দুটি পর্বও থাকে।
অনেকে যুক্তি দেখাতে পারেন যে এ পরীক্ষা যারা দেয় তারা সবাই বিত্তবান পরিবারের সদস্য। কাজেই এ খরচ তাদের জন্য এমন কিছু নয়। তা ছাড়া তাদের সংখ্যাও তেমন বেশি নয়। এ যুক্তি হয়তো আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য। তবে এর মধ্যেও কিন্তু আছে। ও এবং এ লেভেলের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েক হাজার হবে। লাগাতার হরতালের জন্য পরীক্ষার ফি ফেরত দেওয়া না হলে কত হয়। ফি বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে চলে যায় যুক্তরাজ্যে। অর্থের অপচয় হয়। এ হিসাব অর্থনৈতিক ক্ষতির অঙ্কে আছে কি না জানা নেই।
এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে অন্য একটি বিষয়, যা অনুমান করা যায়, টাকার অঙ্কে বলা সম্ভব নয়। সেটা হলো, অল্প বয়সের পরীক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ। এ চাপের কারণে পরীক্ষা যে ভালো করে দেওয়া সম্ভব নয় তা অনস্বীকার্য। অন্যদিকে বাংলা মিডিয়ামের কোমলমতি পরীক্ষার্থীদের জন্যও অতিরিক্ত মানসিক চাপের বিষয়টি সমভাবে প্রযোজ্য। গভীর রাতে পরীক্ষা না দিতে হলেও, চাপ অবশ্যই থাকে। তা ছাড়া রয়েছে পরীক্ষা একাধিকবার পেছানোর ফলে সেশনজটের আশঙ্কা। ইংরেজি মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীদের জন্য হরতালের বিষয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল একটি লিখিত বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে একটি কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কোনো পরীক্ষার্থী হরতালের পর নিজ বাড়িতে যাওয়ার কোনো ক্ষতি ব্রিটিশ কাউন্সিল বহন করবে না। এটাই হয়তো স্বাভাবিক। হরতালের সময় সরকারি পরীক্ষার সময়ও না সরকার না বিরোধী দল কোনো ক্ষতি বহনের দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
যে দলই হরতাল আহ্বান করে সে দল সর্বাত্মক চেষ্টা করে হরতাল যেন সফল হয়। ক্ষমতাসীন দল চেষ্টা করে পরিস্থিতি যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক থাকে। হরতাল আহ্বানকারী দল বলে হরতাল তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। যদিও এ কথার কোনো স্বীকৃতি সংবিধানে নেই। যা আছে তা হলো সভা-সমাবেশ করা। এ জন্য সংবিধান ও আইন অনুযায়ী সরকার সভা-সমাবেশ বা মিছিলের ওপর যুক্তিসংগত বিধিনিষেধও আরোপ করতে ক্ষমতাবান। করাও হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রা যেন একটু বেশি, যা যুক্তিসংগত বিধিনিষেধের আওতাভুক্ত নয়। প্রচলিত সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ এ বিষয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর মতামত গ্রহণ করে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা বাহিনীর মতামত সব সময়ই নেতিবাচক। অর্থাৎ তাদের পরামর্শ হলো, কোনো সভা-সমাবেশ বা মিছিলের অনুমতি দিলেই নাশকতা হবে। ফলে অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে যে ধরনের সহিংসতা হয় তার মাত্রা কি নিতান্তই নগণ্য। এ বিষয়ে কখনো বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করা হয় না।
হরতালের সময় কিছু ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে ঘটে, যা আইনসিদ্ধ নয়। যেমন- কোনো পিকেটার পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পরও তাকে লাঠিপেটা করা হয়। পেটাতে পেটাতে পুলিশের গাড়িতে ওঠানো হয়। সাম্প্রতিককালে আরেকটি ঘটনার চিত্রও সংবাদপত্রে দেখা গেছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। যশোরে এক হরতাল সমর্থকের গলা টিপে ধরেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। এসব ঘটনার জন্য পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। অতীতে ও বর্তমানেও হরতালবিষয়ক অন্য দৃশ্য হলো, এক থেকে পাঁচ হাজার নাগরিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে এ ধরনের মামলা ফলপ্রসূ হয় না। কারণ এত লোকের সুনির্দিষ্ট পরিচয় কর্তব্যরত পুলিশের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। এটা জানার পরও মামলা করা থেমে যায়নি। এখনো চলছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তোবা চলবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.