ইসলামে পরামর্শের গুরুত্ব by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে সরকার ও বিরোধী দল। বিরোধী দল এটি নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করতে সচেষ্ট। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে আলোচনার জন্য সংসদে এসে পরামর্শের আহ্বান জানিয়েছেন।


আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দল আন্তরিকভাবে পরামর্শ করলে ইতিবাচক সমাধান হতে বাধ্য। কারণ পরামর্শের আলাদা একটি গুরুত্ব রয়েছে।
ইসলামের প্রথম যুগে মুসলমানদের নামাজে আহ্বান করার পদ্ধতি নিয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করেন। অনেকেই অনেক পরামর্শ দেন, কেউ শিঙ্গা বাজানোর, কেউ আগুন জ্বালানোর আবার কেউবা ঢোল বাজানোর। সবশেষে সাহাবাদের পরামর্শের ভিত্তিতে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যাইদ (রা.)-কে স্বপ্নে দেখানো আজানের শব্দাবলিকে নামাজের আহ্বানের নিমিত্তে নির্ধারণ করা হয়। অবশ্য আজানের এ শব্দাবলি একই সময়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)সহ প্রায় ৮০ সাহাবি স্বপ্নে শোনেন বা দেখেন। তারপর থেকে বর্তমানের প্রচলিত আজানের প্রবর্তন হয়। ইসলামের প্রথম যুগে এভাবেই সব কাজ সম্পাদিত হতো পরামর্শের ভিত্তিতে। এটি তারই এক প্রকৃষ্ট নমুনা। ইসলাম বরাবরই পরস্পরে পরামর্শকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে আসছে।
ইসলাম সব মানুষের রাজনৈতিক ও সরকারি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার উদারভাবে প্রদান করেছে। ইসলাম কোনো সমাজের মানুষকে উঁচু ও নীচু বা শাসক এবং শাসিত হিসেবে বিভক্ত করার পক্ষপাতী নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষের পরামর্শক্রমে সরকার গঠিত হবে। কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, 'তাদের অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব দান করবেন।' _সূরা নূর : ৫৫
এখানে আল্লাহতায়ালা বহু বচনের শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং বলেছেন, 'আমি কয়েকজনকে নয়, বরং গোটা জাতিকে খেলাফত দান করব।' সরকার শুধু এক ব্যক্তি, এক পরিবার কিংবা একটি শ্রেণীর হবে না। সরকার হবে পরামর্শভিত্তিক সরকার। এ সম্পর্কে কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, 'তাদের কাজকর্ম পারস্পরিক পরামর্শক্রমে স্থিরিকৃত হয়।' _সূরা শুরা : ৩৮
এ ব্যাপারে হজরত উমর (রা.)-এর সুস্পষ্ট মতামত বিদ্যমান। তিনি বলেছেন, মুসলমানদের পরামর্শ ছাড়া তাদের সরকার পরিচালনা বা তাদের ওপর শাসনকার্য পরিচালনার অধিকার কারও নেই। মুসলমানরা সম্মত হলে তাদের সরকার পরিচালনা করা যাবে। তারা সম্মত না হলে তা করা যাবে না। এ বিধানের ভিত্তিতে ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ও পরামর্শভিত্তিক সরকার গঠনের নীতি অনুমোদন করে। বর্তমান পদ্ধতিতে ভোট দেওয়া যেমন একটি পরামর্শ, তেমনি ভোট চাওয়াও একটি পরামর্শ।
এই পরামর্শ ব্যবস্থা নিজ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা ধীরে ধীরে এ পরামর্শ ব্যবস্থা থেকে সরে আসছি। ফলে পরিবারে কলহ, সমাজে অশান্তি ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। ইসলামে পরস্পরে পরামর্শের ভূমিকা ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। এমনকি আল্লাহতায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার আগে ফেরেশতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে মূলত আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে পরামর্শের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। পরামর্শের গুরুত্ব প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, 'এবং কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন তখন আল্লাহতায়ালার ওপর ভরসা করুন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন।' _সূরা আল ইমরান : ১৫৯
শেষ নবী হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে পরামর্শ করেছেন এবং পরামর্শের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। খিলাফত পরিচালনারও অন্যতম ভিত্তি ছিল পরামর্শ।
পরামর্শের মাধ্যমে কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়ের সমাধান বেরিয়ে আসে যা কারও একার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত_ তিনি বলেন, 'আমি হজরত রাসূলকে (সা.) জিজ্ঞেস করলাম, আপনার অবর্তমানে আমরা যদি এমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হই, যে ব্যাপারে কোরআনের কোনো ফয়সালা নেই এবং আপনার কাছ থেকেও কোনো ফয়সালা না পাই তখন আমরা কী করব।' হজরত রাসূল (সা.) বলেন, 'এক্ষেত্রে তোমরা আমার উম্মতের জ্ঞানীগুণী ও ইবাদতকারীদের একত্র করবে এবং পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কর্তব্য স্থির করবে। কারও একজনের মত অনুযায়ী ফয়সালা করবে না।'
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বা জাতীয় দুর্যোগে পরামর্শ করলে অনেক সহজেই তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। এমনকি এ সময় পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। হজরত ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, 'রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণ করা ওয়াজিব।'
বিখ্যাত মুফাসসির ইবনে জারির তাবারি (রহ.) বলেন, 'পরামর্শ গ্রহণের নির্দেশ এ জন্য দেওয়া হয়েছে যাতে পরবর্তীকালের ইমানদাররা তাদের ধর্মীয় ব্যাপারে হজরত রাসূল (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণ করেন এবং সে আদর্শের ওপর অবিচল থাকেন।' হজরত রাসূল (সা.)-এর জীবনে পরামর্শের এ রকম অনেক উদাহরণ দেখা যায়। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের পরামর্শ নিতেন তিনি।
বর্তমান বিশ্বের দিকেও যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাব, আধুনিক রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিরা সংসদ বা পরিষদে পরামর্শ, আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এটি ইসলামের পরীক্ষিত ও কল্যাণকর এক মহান শিক্ষা। এ শিক্ষা গ্রহণ করে কাজ করলে দেশ ও জাতির প্রভূত কল্যাণ সাধিত হতে বাধ্য। হাদিসে আছে, যে পরামর্শ নিয়ে কাজ করে তাকে লজ্জিত হতে হয় না। যে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে সে নিরাপদ থাকে।
muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.