নদীশাসন-‘ও নদী রে, তোর বুঝি কোনো ব্যথার দোসর নাই’ by ফারুক ওয়াসিফ
ফরিদা পারভীনের গাওয়া একটা গান শুনতাম একসময়, ‘ও নদী রে, তোর বুঝি কোনো ব্যথার দোসর নাই’। আজ বাংলাদেশে নদীর ব্যথা আর জাতীয় ব্যথা একাকার। ক্রমেই জান শুকিয়ে আসা নদীগুলোকে সচল ও সপ্রাণ রাখার মানুষের সত্যি বড় অভাব বাংলাদেশে। কথাটা পড়ামাত্র রে রে করে অনেকেই বলবেন,
কেন, আমাদের কত কত দপ্তর আছে না, হাজার হাজার কোটি টাকা কি পানিতে ঢালা হয়নি? কথা সত্য। আমাদের সব আছে এবং সত্যি অঢেল টাকা পানিতে ঢালাও হয়েছে। কিন্তু ফলটা এই যে, অনেক নদী মরতে বসেছে, খাল-বিল-জলাশয়গুলো শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়েছে। অস্বাভাবিক বন্যা ও খরা, ভাঙন, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, নদী-খাল-জলাশয়ের অপমৃত্যু আমাদের পানি-বিপন্নতার প্রমাণ। এরই মধ্যে ২৩ এপ্রিলের প্রথম আলোয় প্রকাশিত হলো একটি সুসংবাদ। সেখানে বাংলাদেশের পানিবিজ্ঞানীদের (সিইজিআইএস) বরাত দিয়ে বলা হয়, সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মোহনায় পলি জমে জমে ভূমিও উঁচু হতে থাকবে। এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
এই সংবাদে পুরোনো সত্য নতুন করে প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশের পুরো ভূ-ভাগই কিন্তু একসময় সমুদ্রের তলায় ছিল। লাখ লাখ বছর ধরে গঙ্গা-পদ্মাবাহিত পলিই এ দেশকে সৃষ্টি করেছে। নদীর স্রোত আর পলিই আমাদের সত্যিকার দেশমাতৃকা। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র আর মেঘনা দিয়ে বয়ে যাওয়া এক বছরের পানি পুরো দেশের ওপর নির্মিত দুই তলা উচ্চতার স্তম্ভের সমান। এই পানির সঙ্গে বছরে আসে ৩০০ বিলিয়ন টন পলি। এ দিয়ে বাংলাদেশকে আধা সেন্টিমিটার পলিতে ঢেকে দেওয়া যায়। এই পলির তিন ভাগের এক ভাগ বন্যার মাধ্যমে ভূমিতে জমা হয়, এক ভাগ মোহনায় নতুন ভূ-ভাগ জাগায় এবং আরেক ভাগ গভীর সমুদ্রে চলে যায়।
বাংলাদেশকে সজীব রাখতে হলে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মের এই বন্যা, পলি জমা ও স্রোতের সমুদ্রমুখী গতি ঠিক রাখার কোনো বিকল্প নেই। লাখ লাখ বছর ধরে এটাই ঘটে এসেছে বলে বাংলার মাটি ও জলবায়ু পশ্চিম বাংলার মতো রুক্ষ হয়ে যায়নি। কিন্তু প্রধানত বন্যানিয়ন্ত্রণের বাঁধ আর আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের পানি সরানোর ব্যারাজের জন্য সেই প্রক্রিয়া আজ বাধাগ্রস্ত। একটির জন্য আমরা দায়ী, অন্যটির জন্য দায়ী ভারত। জলবায়ু পরিবর্তন হোক বা না হোক, এ দুটি কারণের দিকে নজর না দিলে আমাদের বিপদ অনিবার্য।
প্রথমত, ইংরেজ আমলে নদীশাসনের নামে নদীর গতি নষ্ট করে সৌভাগ্যের জননীকে পরিণত করা হয় দুর্যোগের ডাকিনীতে। ব্রিটিশ নদী-প্রকৌশলী স্যার উইলিয়াম উইলকক্স ১৯২৮ সালে দেওয়া তাঁর এক বক্তৃতায় অভিযোগ করেন, ‘ইংরেজ আমলের গোড়াতেই সনাতন খাল-ব্যবস্থাগুলোকে কাজে লাগানো ও সংস্কার তো করাই হয়নি, বরং রেলপথের জন্য তৈরি বাঁধের মাধ্যমে এগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।’ ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জি থমসনও হিন্দু ও মুসলিম যুগের নদী-ব্যবস্থাপনার ধ্বংসের মাধ্যমে বাংলার কৃষি ও জলদেহকে বিপর্যস্ত করার অভিযোগ তুলেছেন। উইলকক্স বলেছেন, ‘বাংলার প্রাচীন রাজাদের সামনে সমস্যা ছিল মাটিকে উর্বর করা, ম্যালেরিয়া ঠেকানো ও নদীর স্ফীতিজনিত চাপে ভাঙন মোকাবিলার উপায় বের করা।...বাংলার আদিযুগের কতিপয় রাজা তখন প্লাবন-সেচ পদ্ধতির উদ্ভাবন ও প্রচলন ঘটান। এটাই শত শত বছরের জন্য বাংলার সম্পদ ও সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা এনে দিয়েছিল। অববাহিকা-সেচ যেমন মিসরের জন্য, স্থায়ী-সেচ যেমন ব্যাবিলনের জন্য, তেমনি বাংলার জন্য উপযুক্ত ছিল এই প্লাবন-সেচব্যবস্থা।’ উইলকক্স মনে করেন, ‘বাংলার প্রাচীন সেচব্যবস্থাই কেবল পারে সেই সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে। অথচ প্রাচীন সেচব্যবস্থা প্রবর্তন ছাড়া তৎকালীন সেচ বিভাগ আর সব পথেই চেষ্টা করেছে। তাতে মাটি আরও অনুর্বর হয়েছে, মাছের আধার ধ্বংস হয়েছে, ম্যালেরিয়া মহামারি আকার পেয়েছে এবং নদীস্ফীতিজনিত চাপে নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশ ভরে গেছে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় পৌর্তিক কাজ দিয়ে। একবার সেই প্রাচীন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া গেলেই দেশটা যেন জাদুকরের জীয়নকাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠবে, আপনাদের সাবেক সমৃদ্ধি আবার আপনাদের দোরগোড়ায় উঁকি দেবে।’ কিন্তু তাঁর কথায় কান দেননি তখনকার শাসকেরা।
ভারতীয় নদীবিশেষজ্ঞ প্রশান্ত মহলানবীশ সেই ১৯২৭ সালেই বলেছিলেন, বাঁধের ফলাফল হিসেবে তলানি জমে নদীতল ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসবে। পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে। একদিকে নদী মরছে, অন্যদিকে পলি দুই পাশের প্লাবনভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে না পারায় মাটি অনুর্বর হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক হিসাবে নদীবক্ষে পলি জমে ১৭টি নদী মরে গেছে, আরও আটটি মারা যাওয়ার পথে। অন্যদিকে দেশের প্রধান তিনটি নদী জায়গায় জায়গায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
ব্রিটিশদের মতো পাকিস্তান আমলের নীতিনির্ধারকদেরও এ দেশের নদ-নদীর চালচলন-সম্পর্কিত ধারণা এবং কিসে এ দেশের মঙ্গল, সে বিষয়ে ততটা নিষ্ঠা ছিল না। ১৯৬৪ সালের ক্রুগ মিশনের প্রস্তাবিত মাস্টারপ্ল্যানে ইউএসএইডের দেওয়া ২০০ কোটি ডলারের প্রকল্পে দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় তৈরি হয় ৫৮টি বড় বাঁধ। ১৯৮০ সালের শেষাশেষি মোট সাত হাজার ৫৫৫ কিলোমিটার বাঁধ, শখানেক পোল্ডার এবং আট হাজারের মতো জলনিয়ন্ত্রক কাঠামো বানানো হয়। কিন্তু ‘সকলই গরল ভেল’ হয়ে যায়। ২৯ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বুয়েটের পানি ও বন্যা-ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক জহির উদ্দীন চৌধুরী লিখেছেন, ‘এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের সাহায্যে প্লাবনভূমিকে বন্যামুক্ত করে আমন ধানের উৎপাদন বাড়ানো।...কিন্তু বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্প ও আমন ধান উৎপাদনের ৩০ বছরের উপাত্ত নিয়ে গবেষণার ফল দেখায় যে সার্বিকভাবে আমন ধানের উৎপাদন বাড়েনি। তবে মোট ধান উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়লেও তার কৃতিত্ব মূলত শুষ্ক মৌসুমে সেচব্যবস্থার।...বাঁধের সাহায্যে প্লাবনভূমিকে বন্যামুক্ত করার কারণে বন্যার পানি জমার জায়গা কমে গেছে। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে অন্য এলাকায় বন্যার উচ্চতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাবের শিকার হয়েছে দরিদ্র জনপদ। এভাবে বন্যার ঝুঁকি এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় কেবল স্থানান্তর হচ্ছে, আসলে বন্যা কমছে না। বরং বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের কারণে বহু জলাভূমি সংকুচিত বা ধ্বংস হয়েছে।’
এরপর ১৯৮৭-৮৮ সালের বন্যার পর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় নেওয়া হয় ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান। অনেকেই তখন এর বিরোধিতা করেন, কিন্তু সরকার শোনেনি। অতিউৎসাহী একদল আমলা ও পানিবিশেষজ্ঞ হই হই করে এর পক্ষে দাঁড়ান। যাঁরা বিরোধিতা করেন, তাঁদের কোণঠাসা হতে হয়। কিন্তু ক্ষতিকর প্রমাণিত হওয়ায় জনদাবির মুখে প্রকল্পটি বাতিল হয়। জনমতের চাপে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকার গঠিত টাস্কফোর্স দেখায়, এরশাদ সরকার জনমতের তোয়াক্কা না করে কিছু দাতা দেশের মদদে দিনের পর দিন এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গেছে। কারণ, তাদের হাতে তখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প।
অবশেষে পরিবর্তন আসে ২০০০ সালের জাতীয় পানি-ব্যবস্থাপনা নীতিমালায়। এর খসড়ায় স্পষ্ট করে বলা হয়, শহর ও উপকূলীয় এলাকা ছাড়া গ্রামাঞ্চলে নতুন করে বাঁধ নির্মিত হবে না। পুরোনো বাঁধ-পোল্ডারগুলোও মূল্যায়নের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে বাতিল করার কথাও বলা হয়। বন্যানিয়ন্ত্রণের নির্মাণকাজে শত শত কোটি টাকার খেলা ও কারচুপির সুযোগ আছে, তার প্রলোভন মহা শক্তিশালী। এই নতুন নীতিমালা কার্যকর হওয়ার ভরসা তাই কম।
দ্বিতীয়ত, যে গঙ্গা থেকেই দেশের সব প্রধান নদীর জন্ম, ফারাক্কায় সেই গঙ্গায় বাঁধ বসিয়ে বাংলাদেশকে পানিবঞ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যে ৫৪টি যৌথনদীর মাধ্যমে ভারতের মিতালি, তার ৪৭টিতেই বাঁধ দিয়ে মিতালিকে বিবাদে পরিণত করা হয়েছে। ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প দিয়ে বঙ্গোপসাগরগামী প্রায় সব নদী থেকে জল সরিয়ে নেওয়ার প্রকল্প চলছে। কেবল উত্তর-পূর্ব ভারতেই নির্মিত হচ্ছে ১৬০টি বাঁধ ও ব্যারেজ। দীর্ঘ মেয়াদে এর ফল হচ্ছে ভয়াবহ। এখন খবর বেরিয়েছে, চীন ব্রহ্মপুত্রের উেস ইয়ারলু সাংপু নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ বানানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আমাদের এবং প্রতিবেশীদের এসব কার্যকলাপেরই ফল হলো বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নদী-বিপর্যয়।
এ ধরনের বহু ক্ষতিকর বন্যানিয়ন্ত্রণ, নদীশাসন ও উপকূল রক্ষা প্রকল্পে কল্পনাতীত পরিমাণ অর্থ নষ্ট করা হয়েছে। আইয়ুব খানের উন্নয়নের দশক থেকে শুরু করে এরশাদের স্বৈরশাহির সময় হয়ে বর্তমান পর্যন্ত এমন অনেক প্রকল্পে ঠিকাদার-আমলা-মন্ত্রী-বিশেষজ্ঞদের বিপুল লাভ হয়েছে সত্যি, কিন্তু দারিদ্র্য বেড়েছে, কৃষিজীবী ও জলজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ হয়েছে বিপন্ন। প্রাচীন আমলে নদী ও পানি-ব্যবস্থাপনার কাজে সমাজ তথা কৃষিজীবীদের অংশীদারি ছিল। দিনে দিনে তা এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে গেছে, যা লোকায়ত জ্ঞান ও লোকের স্বার্থ দেখার দায় ততটা বোধ করে না। প্রকৃতি বিপন্ন হলে জনসমাজও যে দুর্বল ও দরিদ্র হয়ে যায়, এই বুঝ আজ বড় প্রয়োজন।
কে না জানে, নদীগুলোকে না বাঁচালে এবং তার সঠিক ব্যবস্থাপনা না করলে এ ভূখণ্ড বাসযোগ্য থাকবে না। জীবন একটা, দেশও কিন্তু একটাই আমাদের। ক্ষমতাবান কিছু মানুষের হয়তো যাওয়ার জায়গা আছে। মুশকিল হলো, এঁদের অনেকেই আবার মানুষ এবং প্রকৃতির শাসক ও নীতিনির্ধারক। কিন্তু ১৫ কোটি মানুষের নিয়তি তো নদী-মাটি-জলবায়ুর সঙ্গে নাড়ির বাঁধনে বাঁধা। আমাদের তো আর উপায়নেই। উইলকক্স বাঙালিদের বলেছিলেন, ‘আপনাদের নদীগুলোই আপনাদের তৎপর হতে ডাক দিচ্ছে।’ যদি সেই ডাক না শুনি, তাহলে সত্য হবে গানের সেই কথাটাই, ‘ও নদী রে, তোর বুঝি কোনো ব্যথার দোসর নাই।’
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
এই সংবাদে পুরোনো সত্য নতুন করে প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশের পুরো ভূ-ভাগই কিন্তু একসময় সমুদ্রের তলায় ছিল। লাখ লাখ বছর ধরে গঙ্গা-পদ্মাবাহিত পলিই এ দেশকে সৃষ্টি করেছে। নদীর স্রোত আর পলিই আমাদের সত্যিকার দেশমাতৃকা। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র আর মেঘনা দিয়ে বয়ে যাওয়া এক বছরের পানি পুরো দেশের ওপর নির্মিত দুই তলা উচ্চতার স্তম্ভের সমান। এই পানির সঙ্গে বছরে আসে ৩০০ বিলিয়ন টন পলি। এ দিয়ে বাংলাদেশকে আধা সেন্টিমিটার পলিতে ঢেকে দেওয়া যায়। এই পলির তিন ভাগের এক ভাগ বন্যার মাধ্যমে ভূমিতে জমা হয়, এক ভাগ মোহনায় নতুন ভূ-ভাগ জাগায় এবং আরেক ভাগ গভীর সমুদ্রে চলে যায়।
বাংলাদেশকে সজীব রাখতে হলে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মের এই বন্যা, পলি জমা ও স্রোতের সমুদ্রমুখী গতি ঠিক রাখার কোনো বিকল্প নেই। লাখ লাখ বছর ধরে এটাই ঘটে এসেছে বলে বাংলার মাটি ও জলবায়ু পশ্চিম বাংলার মতো রুক্ষ হয়ে যায়নি। কিন্তু প্রধানত বন্যানিয়ন্ত্রণের বাঁধ আর আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহের পানি সরানোর ব্যারাজের জন্য সেই প্রক্রিয়া আজ বাধাগ্রস্ত। একটির জন্য আমরা দায়ী, অন্যটির জন্য দায়ী ভারত। জলবায়ু পরিবর্তন হোক বা না হোক, এ দুটি কারণের দিকে নজর না দিলে আমাদের বিপদ অনিবার্য।
প্রথমত, ইংরেজ আমলে নদীশাসনের নামে নদীর গতি নষ্ট করে সৌভাগ্যের জননীকে পরিণত করা হয় দুর্যোগের ডাকিনীতে। ব্রিটিশ নদী-প্রকৌশলী স্যার উইলিয়াম উইলকক্স ১৯২৮ সালে দেওয়া তাঁর এক বক্তৃতায় অভিযোগ করেন, ‘ইংরেজ আমলের গোড়াতেই সনাতন খাল-ব্যবস্থাগুলোকে কাজে লাগানো ও সংস্কার তো করাই হয়নি, বরং রেলপথের জন্য তৈরি বাঁধের মাধ্যমে এগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।’ ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জি থমসনও হিন্দু ও মুসলিম যুগের নদী-ব্যবস্থাপনার ধ্বংসের মাধ্যমে বাংলার কৃষি ও জলদেহকে বিপর্যস্ত করার অভিযোগ তুলেছেন। উইলকক্স বলেছেন, ‘বাংলার প্রাচীন রাজাদের সামনে সমস্যা ছিল মাটিকে উর্বর করা, ম্যালেরিয়া ঠেকানো ও নদীর স্ফীতিজনিত চাপে ভাঙন মোকাবিলার উপায় বের করা।...বাংলার আদিযুগের কতিপয় রাজা তখন প্লাবন-সেচ পদ্ধতির উদ্ভাবন ও প্রচলন ঘটান। এটাই শত শত বছরের জন্য বাংলার সম্পদ ও সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা এনে দিয়েছিল। অববাহিকা-সেচ যেমন মিসরের জন্য, স্থায়ী-সেচ যেমন ব্যাবিলনের জন্য, তেমনি বাংলার জন্য উপযুক্ত ছিল এই প্লাবন-সেচব্যবস্থা।’ উইলকক্স মনে করেন, ‘বাংলার প্রাচীন সেচব্যবস্থাই কেবল পারে সেই সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে। অথচ প্রাচীন সেচব্যবস্থা প্রবর্তন ছাড়া তৎকালীন সেচ বিভাগ আর সব পথেই চেষ্টা করেছে। তাতে মাটি আরও অনুর্বর হয়েছে, মাছের আধার ধ্বংস হয়েছে, ম্যালেরিয়া মহামারি আকার পেয়েছে এবং নদীস্ফীতিজনিত চাপে নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশ ভরে গেছে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় পৌর্তিক কাজ দিয়ে। একবার সেই প্রাচীন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া গেলেই দেশটা যেন জাদুকরের জীয়নকাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠবে, আপনাদের সাবেক সমৃদ্ধি আবার আপনাদের দোরগোড়ায় উঁকি দেবে।’ কিন্তু তাঁর কথায় কান দেননি তখনকার শাসকেরা।
ভারতীয় নদীবিশেষজ্ঞ প্রশান্ত মহলানবীশ সেই ১৯২৭ সালেই বলেছিলেন, বাঁধের ফলাফল হিসেবে তলানি জমে নদীতল ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসবে। পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে। একদিকে নদী মরছে, অন্যদিকে পলি দুই পাশের প্লাবনভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে না পারায় মাটি অনুর্বর হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক হিসাবে নদীবক্ষে পলি জমে ১৭টি নদী মরে গেছে, আরও আটটি মারা যাওয়ার পথে। অন্যদিকে দেশের প্রধান তিনটি নদী জায়গায় জায়গায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
ব্রিটিশদের মতো পাকিস্তান আমলের নীতিনির্ধারকদেরও এ দেশের নদ-নদীর চালচলন-সম্পর্কিত ধারণা এবং কিসে এ দেশের মঙ্গল, সে বিষয়ে ততটা নিষ্ঠা ছিল না। ১৯৬৪ সালের ক্রুগ মিশনের প্রস্তাবিত মাস্টারপ্ল্যানে ইউএসএইডের দেওয়া ২০০ কোটি ডলারের প্রকল্পে দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় তৈরি হয় ৫৮টি বড় বাঁধ। ১৯৮০ সালের শেষাশেষি মোট সাত হাজার ৫৫৫ কিলোমিটার বাঁধ, শখানেক পোল্ডার এবং আট হাজারের মতো জলনিয়ন্ত্রক কাঠামো বানানো হয়। কিন্তু ‘সকলই গরল ভেল’ হয়ে যায়। ২৯ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বুয়েটের পানি ও বন্যা-ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক জহির উদ্দীন চৌধুরী লিখেছেন, ‘এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের সাহায্যে প্লাবনভূমিকে বন্যামুক্ত করে আমন ধানের উৎপাদন বাড়ানো।...কিন্তু বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্প ও আমন ধান উৎপাদনের ৩০ বছরের উপাত্ত নিয়ে গবেষণার ফল দেখায় যে সার্বিকভাবে আমন ধানের উৎপাদন বাড়েনি। তবে মোট ধান উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়লেও তার কৃতিত্ব মূলত শুষ্ক মৌসুমে সেচব্যবস্থার।...বাঁধের সাহায্যে প্লাবনভূমিকে বন্যামুক্ত করার কারণে বন্যার পানি জমার জায়গা কমে গেছে। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে অন্য এলাকায় বন্যার উচ্চতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাবের শিকার হয়েছে দরিদ্র জনপদ। এভাবে বন্যার ঝুঁকি এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় কেবল স্থানান্তর হচ্ছে, আসলে বন্যা কমছে না। বরং বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের কারণে বহু জলাভূমি সংকুচিত বা ধ্বংস হয়েছে।’
এরপর ১৯৮৭-৮৮ সালের বন্যার পর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় নেওয়া হয় ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান। অনেকেই তখন এর বিরোধিতা করেন, কিন্তু সরকার শোনেনি। অতিউৎসাহী একদল আমলা ও পানিবিশেষজ্ঞ হই হই করে এর পক্ষে দাঁড়ান। যাঁরা বিরোধিতা করেন, তাঁদের কোণঠাসা হতে হয়। কিন্তু ক্ষতিকর প্রমাণিত হওয়ায় জনদাবির মুখে প্রকল্পটি বাতিল হয়। জনমতের চাপে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকার গঠিত টাস্কফোর্স দেখায়, এরশাদ সরকার জনমতের তোয়াক্কা না করে কিছু দাতা দেশের মদদে দিনের পর দিন এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গেছে। কারণ, তাদের হাতে তখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প।
অবশেষে পরিবর্তন আসে ২০০০ সালের জাতীয় পানি-ব্যবস্থাপনা নীতিমালায়। এর খসড়ায় স্পষ্ট করে বলা হয়, শহর ও উপকূলীয় এলাকা ছাড়া গ্রামাঞ্চলে নতুন করে বাঁধ নির্মিত হবে না। পুরোনো বাঁধ-পোল্ডারগুলোও মূল্যায়নের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে বাতিল করার কথাও বলা হয়। বন্যানিয়ন্ত্রণের নির্মাণকাজে শত শত কোটি টাকার খেলা ও কারচুপির সুযোগ আছে, তার প্রলোভন মহা শক্তিশালী। এই নতুন নীতিমালা কার্যকর হওয়ার ভরসা তাই কম।
দ্বিতীয়ত, যে গঙ্গা থেকেই দেশের সব প্রধান নদীর জন্ম, ফারাক্কায় সেই গঙ্গায় বাঁধ বসিয়ে বাংলাদেশকে পানিবঞ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যে ৫৪টি যৌথনদীর মাধ্যমে ভারতের মিতালি, তার ৪৭টিতেই বাঁধ দিয়ে মিতালিকে বিবাদে পরিণত করা হয়েছে। ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প দিয়ে বঙ্গোপসাগরগামী প্রায় সব নদী থেকে জল সরিয়ে নেওয়ার প্রকল্প চলছে। কেবল উত্তর-পূর্ব ভারতেই নির্মিত হচ্ছে ১৬০টি বাঁধ ও ব্যারেজ। দীর্ঘ মেয়াদে এর ফল হচ্ছে ভয়াবহ। এখন খবর বেরিয়েছে, চীন ব্রহ্মপুত্রের উেস ইয়ারলু সাংপু নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ বানানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আমাদের এবং প্রতিবেশীদের এসব কার্যকলাপেরই ফল হলো বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নদী-বিপর্যয়।
এ ধরনের বহু ক্ষতিকর বন্যানিয়ন্ত্রণ, নদীশাসন ও উপকূল রক্ষা প্রকল্পে কল্পনাতীত পরিমাণ অর্থ নষ্ট করা হয়েছে। আইয়ুব খানের উন্নয়নের দশক থেকে শুরু করে এরশাদের স্বৈরশাহির সময় হয়ে বর্তমান পর্যন্ত এমন অনেক প্রকল্পে ঠিকাদার-আমলা-মন্ত্রী-বিশেষজ্ঞদের বিপুল লাভ হয়েছে সত্যি, কিন্তু দারিদ্র্য বেড়েছে, কৃষিজীবী ও জলজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ হয়েছে বিপন্ন। প্রাচীন আমলে নদী ও পানি-ব্যবস্থাপনার কাজে সমাজ তথা কৃষিজীবীদের অংশীদারি ছিল। দিনে দিনে তা এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে গেছে, যা লোকায়ত জ্ঞান ও লোকের স্বার্থ দেখার দায় ততটা বোধ করে না। প্রকৃতি বিপন্ন হলে জনসমাজও যে দুর্বল ও দরিদ্র হয়ে যায়, এই বুঝ আজ বড় প্রয়োজন।
কে না জানে, নদীগুলোকে না বাঁচালে এবং তার সঠিক ব্যবস্থাপনা না করলে এ ভূখণ্ড বাসযোগ্য থাকবে না। জীবন একটা, দেশও কিন্তু একটাই আমাদের। ক্ষমতাবান কিছু মানুষের হয়তো যাওয়ার জায়গা আছে। মুশকিল হলো, এঁদের অনেকেই আবার মানুষ এবং প্রকৃতির শাসক ও নীতিনির্ধারক। কিন্তু ১৫ কোটি মানুষের নিয়তি তো নদী-মাটি-জলবায়ুর সঙ্গে নাড়ির বাঁধনে বাঁধা। আমাদের তো আর উপায়নেই। উইলকক্স বাঙালিদের বলেছিলেন, ‘আপনাদের নদীগুলোই আপনাদের তৎপর হতে ডাক দিচ্ছে।’ যদি সেই ডাক না শুনি, তাহলে সত্য হবে গানের সেই কথাটাই, ‘ও নদী রে, তোর বুঝি কোনো ব্যথার দোসর নাই।’
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments