অভিমত ভিন্নমত

পাঁচ শিক্ষাবিদের সঙ্গে আমরাও একমত প্রথম আলোয় দেশবরেণ্য পাঁচজন শিক্ষাবিদের যৌথ আহ্বানে সম্প্রতি বলা হয়েছে, শিক্ষার ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য, সেগুলো নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁরা মনে করেন, শিক্ষার্থী ও তরুণসমাজকে অপরাজনীতি থেকে দূরে রাখতে ছাত্রলীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত।


আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও শ্রদ্ধেয় পাঁচ শিক্ষাবিদের সঙ্গে একমত। সেই সঙ্গে প্রথম আলোর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৯ হাজার সাধারণ শিক্ষার্থীর পক্ষে কিছু প্রশ্ন ও বেদনার কথা তুলে ধরতে চাই।
গুটিকয়েক ছাত্র নামধারী সরকারদলীয় মাস্তানের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য এখন আমাদের প্রিয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস অনুষ্ঠিত হচ্ছে না, এমনকি তারা পরীক্ষা অনুষ্ঠানেও বাধা দিচ্ছে। আটকে দিচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বহনকারী যানবাহন। তারা শিক্ষকদের বহনকারী বাসে আগুন দিয়েছে, হামলা করেছে। তারা অপহরণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের মধ্যে চলাচলকারী শাটল ট্রেনের চালককে। ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছে। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা কীভাবে শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পাসে যাব?
তারা সাম্প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট বাড়িয়ে তুলছে। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা কি তাদের খামখেয়ালির বস্তু হয়েই থাকব?
ছাত্র নামধারী ওই নেতাদের কেউ কেউ ১২ থেকে ১৪ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করছে। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কৃত হয়েছে। চাঁদাবাজি, অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ নানা অভিযোগে দুই থেকে ১৪টি মামলার আসামি তাদের কেউ কেউ। তাদেরই হীন স্বার্থের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ হাজার শিক্ষার্থীকে সেশনজটের শিকার হতে হচ্ছে। এর প্রতিকার কে করবে?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, তথাকথিত ছাত্রসংগঠন আর ছাত্র নামধারী কিছু সন্ত্রাসীর দৌরাত্ম্যে তাঁদের শিক্ষাজীবন এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু সরকারগুলোর এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা দেখা যায় না। তাদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও অনেক সময় লাশ হতে হচ্ছে। এটা কেন? কে জবাব দেবে?
পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে, চট্টগ্রামের মেয়র ছাত্রলীগ নামধারী ওই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। মহানগর ছাত্রলীগ, উত্তর জেলা ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র সমিতি ও জাসদ ছাত্রলীগের নেতাসহ খোদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতিও ওই কর্মকাণ্ডের প্রবল বিরোধিতা করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তা হলে এই দুষ্কৃতকারী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের এত দাপটের উত্স কী? কেন তাদের বিরুদ্ধে আইন কাজ করছে না?
আশা করি, আমাদের এই অনুভূতিগুলো সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনুধাবন করবেন। দেশের গোটা শিক্ষার্থী সমাজেরই অনুভূতি এই। আশা করব, গণতান্ত্রিক সরকার দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেবে, শিক্ষার উপযোগী পরিবেশের পক্ষে থাকবে; বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের পক্ষে নয়। অন্যায়কারী, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইন যেভাবে প্রয়োগ করা সরকারের দায়িত্ব, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তা-ই করতে হবে। সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় আছে বলে আইন তাদের বেলায় অকার্যকর, এটা মেনে নেওয়া যায় না। গোটা শিক্ষার্থী সমাজকে গুটিকয়েক ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীর কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হবে কেন?
রেজা হক, ফারজানা হক, কায়সুল ভূঁইয়া, গৌতম দাস, মো. জহির, রায়হানুল হক, মাহি আকতার, সুব্রত ধর ও সাইদুল হাসান
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সার্ককে শক্তিশালী করতে হলে
সার্ক প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর পরও দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে এটি তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেনি। অথচ সার্ক হতে পারত বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী আঞ্চলিক সংগঠন। সার্কের ১৬তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে। সার্ক মূলত শীর্ষ সম্মেলনের সংগঠনে পরিণত হয়েছে। নেতারা আসবেন, শীর্ষ সম্মেলন করবেন, সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলবেন, পরবর্তী আয়োজনের ভেন্যু ঠিক করবেন এবং দলবল নিয়ে নিজ নিজ দেশে চলে যাবেন। অথচ ২৫ বছর বয়সী একটি আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবে সার্কের অন্যতম সাফল্য হতে পারত ভারত-পাকিস্তান সুসম্পর্ক, তৈরি পোশাক খাতের নেতৃস্থানীয় অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের সুরাহা কিংবা পৃথিবীর অন্যতম পর্যটন অঞ্চল বা দক্ষ জনশক্তির জোগানদাতা। কিন্তু সার্ক তা হতে পারেনি। কারণ সার্কের মূল নীতিতেই বলা হয়েছে, সার্ক কখনো সদস্যদেশগুলোর দ্বিপক্ষীয় বিরোধপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে না। এই যদি হয় একটি অন্যতম আঞ্চলিক সংগঠনের মূলনীতি, তাহলে সার্কের আদৌ কোনো দরকার রয়েছে কি না, তা ভেবে দেখা উচিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সদস্যদেশগুলোর চাহিদা ও সংগতিকে উপজীব্য করে সার্কের গঠনপ্রণালি, মূলনীতি সংস্কার করে যুগোপযোগী এবং স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে সার্ককে গড়ে তুলতে হবে। এই সম্মেলন থেকেই সংস্কারের আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে। নয়তো আমাদের প্রিয় দক্ষিণ এশিয়া যে তিমিরে, সে তিমিরেই রয়ে যাবে।
ফাহিম ইবনে সারওয়ার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বেগুন বনাম ব্রিঞ্জাল
২২ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত ফরিদা আখতারের ‘বেগুন রাখবেন নাকি ব্রিঞ্জাল খাবেন’ শীর্ষক লেখাটি নিয়ে কিছু কথা।
লেখকের আশঙ্কা, আমরা আমাদের কৌলিক সম্পদ হারাব কি না, বা আমাদের দেশের বেগুনের বীজ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যাবে কি না। এ আশঙ্কা যথার্থ তবে তা প্রমাণ করতে গিয়ে যে যুক্তির আশ্রয় তিনি নিয়েছেন তা প্রাসঙ্গিক নয়। কিছু ক্ষেত্রে তা বৈজ্ঞানিক সত্যকেও পাশ কাটিয়ে গেছে।
লেখকের অভিযোগ, বিটি প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধব নয়, তা বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। সত্যিই কি তাই? বিটি হচ্ছে একটি ব্যাকটেরিয়ার নামের আদ্যক্ষরের সমষ্টি। এ ব্যাকটেরিয়ার রয়েছে এমন কিছু জিন (CRY-১, ২, ৩); এটি এমন প্রোটিন তৈরি করে, যা খেলে ক্ষতিকর পোকামাকড় মারা যায়। ব্যাকটেরিয়া থেকে সেই জিন আলাদা করে বেগুনের জিনে প্রবেশ করানো হয়, যেন পোকামাকড় বেগুন খেতে না পারে। এ কাজটি এমনভাবে করা হয়, যাতে শুধু বেগুন ফলার সময়ই গাছে ওই প্রোটিনটি তৈরি হয়, সব সময় নয়। ব্যাকটেরিয়াটি আমাদের প্রকৃতিরই অংশ। এটি বাংলাদেশেও রয়েছে এবং পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য যে কৌশলটি অবলম্বন করা হয় তা প্রকৃতিরই দান। সেই প্রযুক্তি যদি বেগুনকে রক্ষায় ব্যবহূত হয়, তা প্রকৃতির বিরুদ্ধে হয় কীভাবে?
লেখিকার আরেকটি অভিযোগ, বিটি প্রোটিনটি পোকামাকড়ের জন্য যেহেতু ক্ষতিকর, সুতরা মানুষের জন্যও ক্ষতিকর। আসলে, ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও মানুষের পাকস্থলীর গঠন একেবারেই আলাদা। মানুষের পাকস্থলীর গঠন এমনই যে, তা খুব সহজেই বিটি প্রোটিনকে জীর্ণ করে হজম করে ফেলতে পারে; বিষক্রিয়ার কোনো আশঙ্কাই এখানে নেই। শুধু তাই নয়, বিটি প্রোটিন সব পোকামাকড়ের জন্য ক্ষতিকর নয়। এটি মূলত ফ্রুট অ্যান্ড সুট বোরার ধরনের (পাকস্থলীর দেয়াল ফুটো করে) পোকার জন্যই বিষ। বিটি প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে যাতে ক্ষতিকারক পোকা দমনে উচ্চহারে কীটনাশক ব্যবহার করতে না হয়। বিটি জিনের অংশ বাদ দিলে বিটি বেগুনের জেনেটিক গঠন সম্পূর্ণভাবে দেশি জাতের মতোই। তাতে আলাদাভাবে উচ্চহারে সারের ব্যবহারের দরকার নেই। সুতরাং যে প্রযুক্তি সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমাচ্ছে, সার ও কীটনাশকের অজুহাত তুলে সে প্রযুক্তিকেই দোষারোপ করা ঠিক নয়। ফরিদা আখতার প্রাণব্যবস্থাপনাকেন্দ্রিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেছেন; বিটি প্রযুক্তি এই ব্যবস্থার সহযোগী, সাংঘর্ষিক নয়।
বিটি প্রযুক্তির অসারতা প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি দুটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন। তিনি সেন্টার ফর সাসটেইনেবল এগ্রিকালচারের যে তথ্যটি উপস্থাপন করেছেন, তা প্রমাণ করে, সুট ও ফ্রুট বোরার কতটা ক্ষতিকারক। দ্বিতীয়ত, বিটি বেগুন ও সাধারণ বেগুনে এ পোকার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে যে পরিসংখ্যান তিনি দিয়েছেন, তা থেকে দেখা যায় যে সাধারণ বেগুনে ২৪ থেকে ৫৮ শতাংশ ক্ষতির বিপরীতে বিটি বেগুনে ক্ষতির পরিমাণ ২ দশমিক ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ।
লেখকের আশঙ্কা, বহুজাতিক কোম্পানির অনুপ্রবেশের সঙ্গে দেশি বেগুনের জাত বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু তাঁর পুরো লেখায় এ দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের বদলে বিটি প্রযুক্তির ত্রুটি অনুসন্ধান মুখ্য হয়ে উঠেছে। শুধু লেখার শেষে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি বিল ২০১০-এর উল্লেখ করা হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নিজেদের স্বার্থে কাজ করতে চাইবেই। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির নেওয়া উচিত। কিন্তু তারা বায়োএথিকস ও বায়োসার্ভিলেন্স এই দুটি শব্দ ব্যবহার করেই তাদের দায় সেরেছে। বিটি প্রযুক্তির দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা না করে ইনস্টিটিউটের এই দুর্বলতা নিয়ে যদি আলোচনা করতেন, তাহলে তাঁর বক্তব্য আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারত।
দিগ্বিজয় দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
bijoybmb@gmail.com

আজব মানুষের দেশে
প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ভণ্ড পীর ভয়ংকর চিকিত্সা’ শিরোনামের চিত্র দেখে আমাদের প্রাণবায়ু বের হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সোনার বাংলায় আজব মানুষ আর আজব কাণ্ডকারখানার ইয়ত্তা নেই। তবে এমন আজব মানুষ আর আজব কর্ম খুব কমই দেখা যায়। পীরালি চিকিত্সার নমুনা আমরা পত্রিকা মারফত প্রায়ই দেখি, কিন্তু এই আজব রূপ বোধহয় আগের সব কাণ্ডকেই হার মানায়। ইতিমধ্যে ভণ্ড পীরকে দলসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের ভালোমতো চিকিত্সা হওয়া দরকার। কিন্তু এমন দু-একজন পীর ও সঙ্গীসাথির চিকিত্সা হলেই এসব আজব মানুষের আবির্ভূত হওয়া এবং তাদের উত্পাত ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সমূলে বন্ধ হবে না। এ জন্য প্রয়োজন, এসব সমস্যার উেসর অনুসন্ধান ও সে নিরিখে ব্যবস্থা গ্রহণ।
পৃথিবীতে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা ফলাফল আমাদের জানা নেই, যেখানে বলা হয়েছে যে শিশুর প্রতি কঠোর আচরণ তার জন্য কল্যাণকর। প্রথম আলোয় প্রকাশিত পীরালি-কর্ম শিশু কেন, যেকোনো মানুষের জন্যই ক্ষতিকর, যেমনটি জরিনাকে করা হয়েছে। যে শিশুদের ওপর এমন কাণ্ড ঘটানো হলো, তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধিতা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শিশুরা বেঁচে থাকলেও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, ভয়, আতঙ্ক, সিজোফ্রেনিয়া প্রভৃতি সমস্যা নিয়ে বড় হবে।
এক লোক সৃষ্টিকর্তার কাছে এই বলে প্রার্থনা করছিল—হে সৃষ্টিকর্তা, তুমি আমাকে রক্ষা করো, তুমি ছাড়া আমাকে কে আর রক্ষা করবে, বলো; আমার যে আর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই! আমাদেরও এই দেশেই থাকতে হবে, কেননা আমাদের যে আর কোনো দেশ নেই!
মোহাম্মদ শামীম খান
সিলেট।
sk160674@yahoo.co.uk

মনে পড়বে সেদিন
আমার শৈশব কেটেছে গাঁয়ে। মায়ের সঙ্গে প্রতিবেশীদের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। শুভ কোনো কাজের আগে দিনক্ষণ ঠিক করতে তারা মায়ের কাছে আসতেন পরামর্শ নিতে। মা পঞ্জিকা দেখে তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন। মাঝেমধ্যে উদ্ধৃতি দিতেন খনার বচনের। কারও যাত্রাপথে কেউ যদি দেখেন, কলসিতে করে অন্য কেউ পানি নিয়ে ফিরছে অথবা আনতে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে তাঁর যাত্রাপথের কী হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে খনার বচনের উদ্ধৃতি দিয়ে মা বলতেন, ‘ভরার চেয়েও শূন্য ভালো যদি ভরতে যায়, আগের চেয়ে পিছে ভালো যদি ডাকে মায়।’ অর্থাত্ কারও যাত্রাপথে কেউ যদি দেখেন, খালি কলসি নিয়ে অন্য কেউ পানি আনতে যাচ্ছে, তাহলে বুঝতে হবে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি যাত্রা করছেন, তার ফল হবে শুভ। গাঁয়ে মাটির কলসি দিয়ে জলাধার থেকে পানি আনার এই কাজটি করে থাকে সাধারণত কোনো উচ্ছল যুবতি, নববধূ কিংবা অন্য কেউ। এ নিয়ে আমাদের অনেক কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার আমাদের সাহিত্য-ভান্ডারকে করেছেন সমৃদ্ধ।
আমি এখন নগরবাসী। পানি আনার দৃশ্যটি দেখি সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে। দেখি কোনো রুগ্ণ মেয়ে কিংবা নারীকে অ্যালুমিনিয়ামের খালি কলসি নিয়ে ওয়াসার পানির লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। খালি কলসি হাতে পানি আনার রঙিন চিত্র দেখি দৈনিক পত্রিকায়। দেখি না কোনো হাস্যোজ্জ্বল মুখ। পানি আনার ছবি দেখে আমরা যারা ঘর থেকে বের হই, প্রথমেই ঝগড়া বাধে রিকশাওয়ালার সঙ্গে। যদি যাওয়া মেলে তবে তার ইচ্ছাতেই। রিকশার সুযোগ না মিললে বাসে। সেও আর এক বিড়ম্বনা। বাসে ঝোলার ভাগ্যও যদি না জোটে, তবে শেষ অবলম্বন ১১ নম্বর। অর্থাত্ পায়ে হাঁটা। তাতেও বিড়ম্বনা।
সবার আগে প্রয়োজন দ্রুত যানবাহনে ব্যবহূত গ্যাসের মূল্য অন্তত ডিজেলের মূল্যের সমপরিমাণ করা, পথযাত্রীসহ সব গাড়ির যাত্রীকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করা, গাড়িচালকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, ফুটপাতের দোকান উচ্ছেদ করা, মেইন রোডে গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধ করা এবং ডাস্টবিন দূরে রাখা; প্রতিটি শহরের রাস্তার ধারণক্ষমতা নির্ণয় করে নতুন গাড়ি চলাচলের অনুমোদন দেওয়া।
শুধু যানজটের কারণেই প্রচুর সময় নষ্ট হয়। জট তো শুধু রাস্তায় নয়। উত্পাদন, গ্যাস, বিদ্যুত্, পানি—সবখানে। সরকার নিশ্চয়ই এসব জানে। তাহলে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? তারা তো আমার আপনার মতো দুবির্ষহ জীবন যাপন করে না। সব সময় থাকে এসি গাড়িতে, বাড়িতে কিংবা অফিসে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়ায়। তাদের বাসাবাড়ি কিংবা অফিসে তো বিদ্যুত্, পানি, গ্যাসের সমস্যা হয় না। দেশের শত শত গার্মেন্টস, শিল্প কলকারখানা, সার কারখানা, সেচকাজ বন্ধ হলে তাদের তো কিছু আসে যায় না। আসে যায় শ্রমিক-মালিক, কৃষক আর আমার মতো ১১ নম্বর যাত্রীদের। জনদুর্ভোগ কী, তাঁরা বোঝেন না, বুঝতে চান না। এমনকি অতীতের কথাও মনে করতে চান না। মনে পড়বে সেদিন যে দিন কানসাটের মতো সমগ্র দেশবাসী রাস্তায় নেমে আসবে। তখন ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র বলেও কোনো লাভ হবে না।
বেনু শর্মা, ঢাকা।

বিমানের ব্যাখ্যা
১৩ এপ্রিল প্রথম আলোর সংবাদ উদ্ধৃত করে ১৬ এপ্রিলের সম্পাদকীয়তে ‘লাভজনক দুবাই রুটটি বিমান কর্তৃপক্ষ চীনা প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে’ এবং ‘এ উদ্দেশ্যে বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনসের খরচে চীন সফরেও যাচ্ছেন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি তা নয়। বাংলাদেশ বিমানের কোনো কর্মকর্তা চীন সফরে যাননি।
ওই প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় পড়ে মনে হয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে একাকার করে ফেলা হয়েছে। বস্তুত এই দুটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিমান পরিবহন ব্যবসায় নিয়োজিত। এটির রেগুলেটরি কোনো কার্যক্রম নেই। পক্ষান্তরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান, যা সরকারের পক্ষে সব রেগুলেটরি ও নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। এয়ার সার্ভিস চুক্তি ও ফ্রিকোয়েন্সি প্রদানের বিষয়টি রেগুলেটরি কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত, বাংলাদেশ বিমানের এখানে কোনো এখতিয়ার নেই।
বাংলাদেশের এয়ারলাইনস হিসেবে ‘বিমান’ আন্তসরকার চুক্তির আওতায় বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে মাত্র এবং এই ফ্লাইট পরিচালনাকালে সর্বদাই বাণিজ্যিক স্বার্থের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকারের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়।
প্রসঙ্গত, ১৩ এপ্রিলের প্রথম আলোর সংবাদের শেষাংশে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রাসঙ্গিক মন্তব্যে দুবাই রুট-সম্পর্কিত বিষয়ে বিমানের অবস্থান পরিষ্কার করা হয়েছে।
মোহাম্মদ নাসিম, উপমহাব্যবস্থাপক জনসংযোগ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।

ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা
ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন পিছিয়ে গেলে প্রথম আলো পাঠকদের কাছে এ বিষয়ে টেলিফোন মন্তব্য আহ্বান করেছিল ১৮ এপ্রিল। টেলিফোনে মন্তব্যকারীদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমার ছোট্ট মন্তব্যের উপসংহার ছিল, সরকার যদি আশঙ্কা করে যে ঘোষিত সময়ে ডিসিসি নির্বাচন করলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, তাহলে সরকার তো নির্বাচন পেছাতেই পারে।
পরদিন প্রথম আলোয় প্রকাশিত পাঠকদের টেলিফোন মন্তব্যগুলোর মধ্যে দেখলাম, আমার মন্তব্যের ধাঁচের কথা কেউ বলেননি। বরং নির্বাচন পেছানোর জন্য সরকারের একটি সুপ্ত কৌশল কাজ করছে—এমন মন্তব্য করেছেন অনেকেই। কেউ কেউ বলেছেন, দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করার লক্ষ্যেই নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমি মনে করেছিলাম, আমার মন্তব্যটি প্রথম আলো ছাপবে না। কারণ তা অন্য সব মতের পাশে একেবারেই বেখাপ্পা ছিল। তা ছাড়া জনগণ সরকারকে সব সময় সক্ষম ও সদা প্রস্তুত দেখতে চায়। কোনো সরকার যদি যথাসময়ে নির্ধারিত কাজটি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সে সরকার তার গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা হারায়। নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ মাসের পর মাস স্থগিত থাকলে জনমনে একই রকম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়। ডিসিসি নির্বাচন সময়মতো অনুষ্ঠিত না হওয়ায় জনগণ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ব্যর্থতাসহ নানা অভিযোগ অবশ্যই তুলবে এবং প্রথম আলোয় প্রকাশিত পাঠকদের টেলিফোন-মন্তব্যগুলোতে তারই প্রতিফলন দেখা গেল। কিন্তু আমার বক্তব্য ছিল, যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে দেশে যে একটি কঠিন ও জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সরকার নিজেকে ও জনগণকে খুব নিরাপদ নাও ভাবতে পারে। সে জন্যই ডিসিসি নির্বাচন সরকার পিছিয়ে দিয়েছে। আমার এই ভিন্নমতকে গুরুত্ব দিয়েছে প্রথম আলো। দেখলাম, অন্য মন্তব্যগুলোর পাশে আমারটিও ছাপা হয়েছে। এটাই বোধহয় একটি সত্যিকারের সংবাদপত্রের বৈশিষ্ট্য—সব ধরনের মতামতকে জায়গা দেওয়া। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ।
আবদুন নূর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

হাওরের কান্না
কিছুদিন ধরে পত্রপত্রিকায় চোখ রাখলেই দেখি অসহায় আর নিঃস্ব হাওরবাসীর হাহাকার।
ভৌগোলিক অবস্থান ও অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশের হাওর এলাকার মানুষের জীবিকা প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ব্যবসা-বাণিজ্য তেমন বিকশিত হয়নি, শিল্প বলতে গেলে নেই। তাই হাওর এলাকার জনগোষ্ঠী সারা বছর একটি ফসলের আশায় ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করে। নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরগুলোতে সাধারণভাবে বছরে মাত্র একটি ফসলের চাষ করা যায়।
এই হাওরগুলোর ফসলের জমি রক্ষাকারী বাঁধগুলো একের পর এক ভেঙে যাচ্ছে। অপ্রতিরোধ্য জলস্রোতে হাওরবাসীর স্বপ্নগুলো তলিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্নহারা, দিশেহারা মানুষের সামনে ঘোর অমানিশা। কেউ কেউ হয়তো এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু বারবার তারা শিকার হবে এই হতাশা, যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তার। হাওর এলাকায় এই দুর্যোগ ধারাবাহিকভাবেই কয়েক বছর পর পর ঘটে, কখনো পর পর দুই বছরেও ঘটে। হাওরের দুর্ভাগা জনগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য কেউ ভাবে না—না সরকার, না রাজনীতিবিদেরা, যাঁদের কাছে আমাদের দুর্ভাগ্যের খবর পৌঁছালে আমরা আশায় থাকি, তাঁরা একটি উদ্ধারের উপায় বাতলে দেবেন, কিছু উদ্যোগ নেবেন। সরকার আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করবে, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এ বিশ্বাস আমরা অর্জন করেছি।
হাওরবাসীর স্বপ্নভঙ্গের সময়েই এল আমাদের নববর্ষ—নানা রঙে, আনন্দে, গানে-নৃত্যে বরণ করে নিল দেশবাসী। আনন্দের বিস্ফোরণে হাওরের কান্না আমাদের কানে তো পৌঁছায়ই না, বরং দ্বিগুণ বেগে পালিয়ে যায়। সিডর, আইলা—এসব দুর্যোগের সময় সারা দেশে যেমন সহমর্মিতা বানের জলের মতো ফুলে উঠেছিল, হাওরের দুর্যোগের ক্ষেত্রে তো এর ছিটেফোঁটাও দেখি না। অথচ হাওরের ক্ষেত্রে ক্ষতি হবে ধারাবাহিক সুদূরপ্রসারী।
হাওরবাসীর অপরিমেয় দুঃখের শুরু হলো। নাগরিক সমাজের কেউ তাদের পাশে নেই। অথচ বিভিন্ন মিডিয়ার কল্যাণে তাদের দুঃখ চোখ এড়িয়ে যাবে, এমন উপায় নেই; তবু এ বিষয়ে নিশ্চুপ সবাই। হাওরাঞ্চলগুলোতে যেন এখন এক ট্র্যাজেডি ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে—আমরা সবাই দর্শ। মঞ্চে অনেক দুঃখ, অনেক কষ্ট দেখি, বেদনায়, অসহায়ত্বে অনেককে কুঁকড়ে যেতে দেখি, কাউকে দেখি সব হারিয়ে বিপর্যস্ত হতে, উদ্ভ্রান্ত হতে আর আমরা দর্শকসারিতে বসে থাকি নিশ্চুপ, মনে দুঃখ লাগলেও কারও কাছে বলি না, প্রকাশ করি না—থাকি ভাবলেশহীন, বহন করি। মঞ্চের সমস্যা শুধু দেখে যাব, যা-ই ঘটুক আমাদের তো আর কিছু করার নেই।
অন্তত প্রকৃতি অসহায় মানুষজনের প্রতি সদয় হোক—এই আশা করি।
অভীক চৌধুরী
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ।

No comments

Powered by Blogger.