মনের কোণে হীরে-মুক্তো-নগরীতে উচ্চবিত্তের উত্তরমুখী যাত্রা by ড. সা'দত হুসাইন
চল্লিশ বছর আগের ঢাকা শহর এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। উপাধিও বদলেছে। এখন তার নাম হয়েছে ঢাকা মহানগর। বাংলাদেশের রাজধানী। পৃথিবীর অন্যতম প্রধান জনবহুল নগরী। এর বৈশিষ্ট্যও বদলেছে লক্ষণীয়ভাবে। ঢাকা এখন একটি একক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত জনপদ নয়। এর বিভিন্ন অংশের স্বাতন্ত্র্য দৃশ্যমান।
মোটা দাগে ঢাকাকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা যায় : দক্ষিণ ঢাকা, মধ্য ঢাকা ও উত্তর ঢাকা। তবে অবস্থান, ভৌত অবকাঠামো, বাসিন্দাদের বিত্তবৈভব এবং সাংস্কৃতিক প্রকাশের বিবেচনায় প্রতিটি ভাগকে আবার পূর্ব এবং পশ্চিম অঞ্চলে বিভক্ত করা যেতে পারে। সে হিসেবে ঢাকা মহানগরে মোট ছয়টি অঞ্চল চিহ্নিত করা যেতে পারে। এ সংখ্যা আরো দু-একটি বাড়ানো অসম্ভব হবে না। গুলিস্তানের দক্ষিণ অংশকে দক্ষিণ ঢাকা, গুলিস্তান থেকে মহাখালীর দক্ষিণ পর্যন্ত অংশকে মধ্য ঢাকা এবং মহাখালী ও তার উত্তর অংশকে উত্তর ঢাকা হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। উত্তর-দক্ষিণে টানা বড় রাস্তাকে সীমানা ধরে প্রত্যেক ভাগের পূর্ব এবং পশ্চিম অঞ্চল নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে জাতীয় স্বার্থে মহানগরীর সংহতি অটুট রাখতে হবে।
ষাটের দশকে আমরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন পুরো ঢাকা মূলত একটি শহর ছিল। পুরান ঢাকা এবং 'ঢাকা' শব্দদ্বয় বন্ধুবান্ধবদের কথাবার্তার মধ্যে সীমিত ছিল। এ বিভাজন বড়জোর জায়গা চেনানোর জন্য ব্যবহার করা হতো। পুরান ঢাকার মূল রাস্তা অপ্রশস্ত ছিল, অলিগলি অনেক সরু ছিল, কিন্তু তা আমাদের পুরান ঢাকায় যাওয়া থেকে কোনো দিন বিরত করেনি। খাওয়ার দোকান, সিনেমা হল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের অনেকের বাড়ি পুরান ঢাকায় ছিল। আমরা নির্দ্বিধায় রিকশা করে পুরান ঢাকার বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়াতাম। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশের বাসিন্দাদের মধ্যে শ্রেণীগত বা সাংস্কৃতিক পার্থক্য অন্তত আমরা অনুভব করিনি। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, গুলশান তখনো ছিল, তবে এগুলো ছিল অনেকটা আমাদের হিসাবের বাইরে। ঢাকা শহরের অবিচ্ছেদ্য ও অঙ্গীভূত অংশ হিসেবে এদের ধরা হতো না। উত্তরা, বনশ্রী, বসুন্ধরা, নিকেতন, নিকুঞ্জ ও বারিধারা তখন ছিলই না। মিন্টো রোড, হেয়ার রোড ও ইস্কাটন ছিল শহরের অভিজাত এলাকা। পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা এবং গণ্যমান্য কিছু বেসরকারি ব্যক্তিরাও এলাকায় বসবাস করতেন। রাজউকের (তৎকালীন ডিআইটি) হাতে গড়ে তোলা ধানমণ্ডি ছিল একমাত্র পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। বেসরকারি খাতের প্রভাবশালী গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই এখানে বসবাস করতেন। ওয়ারী, র্যাংকিন স্ট্রিট, হাটখোলা, পুরানা পল্টন এবং বকশীবাজারও ছিল শহরের অভিজাত এলাকা। শহরের অনেক প্রখ্যাত এবং সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি এসব এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।
তখন ঢাকা শহরের প্রতিটি অংশ ছিল একই সূত্রে গাঁথা। এক অংশের বাসিন্দাদের অন্য অংশে আসা-যাওয়া ছিল অতি সাধারণ দৈনন্দিন ব্যাপার। বাজার করার জন্য আজিমপুরের লোক ঠাঁটারিবাজার, কাপ্তানবাজার যাচ্ছে কিংবা মালিবাগের বাসিন্দা নিউ মার্কেট যাচ্ছে, আবার বই কেনার জন্য পুরানা পল্টনের লোক বাংলাবাজার বা নর্থ ব্রুক হল রোডে যাচ্ছে; এটাই ছিল স্বাভাবিক। আবাসস্থল দিয়ে কোনো মানুষের মূল্যায়ন করা হতো না। এলাকার অবস্থান দিয়ে কোনো কর্মসূচির মূল্যায়ন করা হতো না। সব এলাকার মর্যাদা ছিল সাধারণভাবে মোটামুটি সমান। মানুষ এবং কর্মসূচিকে তাদের গুণাগুণ দিয়েই বিচার করা হতো।
স্বাধীনতার পর কয়েক বছর শহরের আয়তন সীমিত থাকলেও পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। তেজগাঁও বিমানবন্দর কুর্মিটোলাতে স্থানান্তর এবং রাজউক কর্তৃক উত্তরা মডেল টাউন নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পর নাগরিকদের মধ্যে নগরের উত্তরাংশে বসবাসের ভীতি তিরোহিত হয়। গুলশান ও বনানী আবাসিক এলাকাকে ক্ষেত্রবিশেষে সম্প্রসারিত করা হয়, বারিধারা নামে একটি উচ্চমানের আবাসিক এলাকা গড়ে তুলে তাকে কূটনৈতিক জোন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
আশির দশক থেকে উত্তরাসহ নবসৃষ্টি আবাসিক এলাকাগুলোয় সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে এ তৎপরতা বহুগুণ বেড়ে যায়। এ সময় নির্মাণ এলাকায় ডেভেলপারদের কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হতে শুরু করে। তারা জমির মালিকদের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় বিশাল সুউচ্চ ভবন নির্মাণ শুরু করে। আবাসিক ভবনগুলো কমপক্ষে ছয়তলা উচ্চতাবিশিষ্ট হয়ে পড়ে। একটি ভবনে পাঁচটি বড় কিংবা ১০টি ছোট ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়, যার অর্ধেক পায় জমির মালিক, অর্ধেক পায় ডেভেলপার। যে স্থানে আগে একটি পরিবার বসবাস করত, একই স্থানে সাধারণ হিসাবে ১০টি পরিবার বসবাস করতে শুরু করে। এলাকার লোকসংখ্যা মোটামুটি হিসাবে দশ গুণ বেড়ে যায়। একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে জমির মালিক বা উত্তরাধিকারীরা রাতারাতি ধনকুবেরে পরিণত হয়। বাইরের লোক ফ্ল্যাট কিনে এসব এলাকার বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ পায়। জমির ক্রেতা হিসেবে ডেভেলপাররাই মাঠে থাকে। ফ্ল্যাট নির্মাণ এবং বিক্রি একটি অত্যন্ত লোভনীয় ব্যবসা হিসেবে আবির্ভূত হয়। বহু ডেভেলপারের সমাগমে জমির দাম হু হু করে বেড়ে যায়। কিছু এলাকা প্রভাবশালী বিত্তবানদের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়ে। আবাসিক ভবন নির্মাণের এ ধারা নগরীর রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে লক্ষণীয়ভাবে প্রভাবিত করে।
ঢাকায় বর্তমানে যে কয়টি অভিজাত আবাসিক এলাকা রয়েছে তার সব কয়টি হয় রাজউক অথবা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড কর্তৃক নির্মিত। এর মধ্যে একমাত্র ধানমণ্ডি ছাড়া অন্য সব কয়টি আবাসিক এলাকা উত্তর ঢাকায় অবস্থিত। এ আবাসিক এলাকাগুলো হচ্ছে গুলশান, বারিধারা, বনানী, উত্তরা, নিকুঞ্জ (দক্ষিণ) এবং ডিওএইচএস (মহাখালী, বনানী এবং বারিধারা)। বেসরকারি পর্যায়ে সৃষ্ট বসুন্ধরা এখনো পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠেনি, তবে এখানেও সমাজের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি অবস্থান করছেন। ধানমণ্ডির পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে ফেলে প্রায় সব কয়টি বাড়িকেই কমপক্ষে ছয়তলাবিশিষ্ট ফ্ল্যাটে রূপান্তরিত করা হয়েছে। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, রেস্টুরেন্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাধিক্যের কারণে ধানমণ্ডি বস্তুত একটি বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হলেও এখানে অভিজাত শ্রেণীর অনেক প্রভাবশালী পরিবার এখনো বসবাস করে। সেদিক থেকে বলা যায়, এটিই মধ্য ঢাকার একমাত্র আবাসিক এলাকা, যাকে প্রভাবশালীদের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
ধানমণ্ডি ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এলাকার সব কয়টির অবস্থান মহাখালী থেকে উত্তরে। এর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং চমকপ্রদ। বাংলাদেশের প্রভাবশালীদের একটি বিরাট অংশ এ কয়টি আবাসিক এলাকায় বসবাস করে। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের অধিকাংশই মনে হয়- এসব এলাকার অধিবাসী। মন্ত্রী, সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, পেশাজীবী ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থীর সিংহভাগই এসব এলাকার অধিবাসী। সমাজের উচ্চবিত্তের এরূপ কেন্দ্রীভূত হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা নয়। পৃথিবীর অনেক শহরেই এরূপ দেখা যায় না। অর্থ ও প্রভাব একযোগ হয়ে সহায়-সম্পত্তি কিভাবে ধনিকশ্রেণীর করায়ত্ত হয়, ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার বাসিন্দাদের চিত্ররূপ তার একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অভ্যন্তরীণ আবাসন স্থানান্তর প্রক্রিয়া। উত্তর ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোর এমন একটি মোহনীয় আর্কষণ রয়েছে যে দক্ষিণ এবং মধ্য ঢাকার সংগতিসম্পন্ন বাসিন্দারা ধীরে ধীরে আবাসন স্থানান্তর করে উত্তর ঢাকায় চলে আসছেন। উত্তর ঢাকা বিশেষ করে, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় বাস করা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভাবশালী উচ্চবিত্তরা দক্ষিণ ঢাকায় থাকছে না বললেই চলে। পূর্ব পুরুষদের ভিটেমাটি বিক্রি করে অথবা বাড়িভাড়া দিয়ে তারা প্লট বা ফ্ল্যাট কিনে উত্তরাঞ্চলে চলে আসছেন। ফলে দক্ষিণ অঞ্চলে স্বনামধন্য প্রভাবশালী বাসিন্দার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থীর চিত্র থেকে এ ধারণা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। মধ্য ঢাকা এখন অফিসপাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ এলাকার বাড়ির মালিকরা তাঁদের বাড়িভাড়া দিয়ে উত্তর ঢাকায় বাসস্থান স্থান্তান্তর করেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, দক্ষিণ ও মধ্য ঢাকার উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধব বা পড়শিদের খোঁজ করতে হলে এখন উত্তর ঢাকায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। উত্তর ঢাকার এ অংশই হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সব সেক্টরের নিয়ন্ত্রকদের আবাসস্থল।
নগরীরের বাসস্থান স্থানান্তরের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের যে ধারার সূচনা করেছে, তার তাৎপর্য গবেষণার দাবি রাখে। বাংলাদেশের রাজনীতিকেও এ ধারা প্রভাবিত করেছে বলে ধারণা করা যায়। এ গবেষণা বা সমীক্ষায় অনেক চমকপ্রদ এবং সুদূরপ্রসারী ফল বেরিয়ে আসবে সন্দেহ নেই। আমরা এরূপ একটি গবেষণার প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
ষাটের দশকে আমরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন পুরো ঢাকা মূলত একটি শহর ছিল। পুরান ঢাকা এবং 'ঢাকা' শব্দদ্বয় বন্ধুবান্ধবদের কথাবার্তার মধ্যে সীমিত ছিল। এ বিভাজন বড়জোর জায়গা চেনানোর জন্য ব্যবহার করা হতো। পুরান ঢাকার মূল রাস্তা অপ্রশস্ত ছিল, অলিগলি অনেক সরু ছিল, কিন্তু তা আমাদের পুরান ঢাকায় যাওয়া থেকে কোনো দিন বিরত করেনি। খাওয়ার দোকান, সিনেমা হল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের অনেকের বাড়ি পুরান ঢাকায় ছিল। আমরা নির্দ্বিধায় রিকশা করে পুরান ঢাকার বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়াতাম। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশের বাসিন্দাদের মধ্যে শ্রেণীগত বা সাংস্কৃতিক পার্থক্য অন্তত আমরা অনুভব করিনি। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, গুলশান তখনো ছিল, তবে এগুলো ছিল অনেকটা আমাদের হিসাবের বাইরে। ঢাকা শহরের অবিচ্ছেদ্য ও অঙ্গীভূত অংশ হিসেবে এদের ধরা হতো না। উত্তরা, বনশ্রী, বসুন্ধরা, নিকেতন, নিকুঞ্জ ও বারিধারা তখন ছিলই না। মিন্টো রোড, হেয়ার রোড ও ইস্কাটন ছিল শহরের অভিজাত এলাকা। পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা এবং গণ্যমান্য কিছু বেসরকারি ব্যক্তিরাও এলাকায় বসবাস করতেন। রাজউকের (তৎকালীন ডিআইটি) হাতে গড়ে তোলা ধানমণ্ডি ছিল একমাত্র পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। বেসরকারি খাতের প্রভাবশালী গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই এখানে বসবাস করতেন। ওয়ারী, র্যাংকিন স্ট্রিট, হাটখোলা, পুরানা পল্টন এবং বকশীবাজারও ছিল শহরের অভিজাত এলাকা। শহরের অনেক প্রখ্যাত এবং সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি এসব এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।
তখন ঢাকা শহরের প্রতিটি অংশ ছিল একই সূত্রে গাঁথা। এক অংশের বাসিন্দাদের অন্য অংশে আসা-যাওয়া ছিল অতি সাধারণ দৈনন্দিন ব্যাপার। বাজার করার জন্য আজিমপুরের লোক ঠাঁটারিবাজার, কাপ্তানবাজার যাচ্ছে কিংবা মালিবাগের বাসিন্দা নিউ মার্কেট যাচ্ছে, আবার বই কেনার জন্য পুরানা পল্টনের লোক বাংলাবাজার বা নর্থ ব্রুক হল রোডে যাচ্ছে; এটাই ছিল স্বাভাবিক। আবাসস্থল দিয়ে কোনো মানুষের মূল্যায়ন করা হতো না। এলাকার অবস্থান দিয়ে কোনো কর্মসূচির মূল্যায়ন করা হতো না। সব এলাকার মর্যাদা ছিল সাধারণভাবে মোটামুটি সমান। মানুষ এবং কর্মসূচিকে তাদের গুণাগুণ দিয়েই বিচার করা হতো।
স্বাধীনতার পর কয়েক বছর শহরের আয়তন সীমিত থাকলেও পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। তেজগাঁও বিমানবন্দর কুর্মিটোলাতে স্থানান্তর এবং রাজউক কর্তৃক উত্তরা মডেল টাউন নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পর নাগরিকদের মধ্যে নগরের উত্তরাংশে বসবাসের ভীতি তিরোহিত হয়। গুলশান ও বনানী আবাসিক এলাকাকে ক্ষেত্রবিশেষে সম্প্রসারিত করা হয়, বারিধারা নামে একটি উচ্চমানের আবাসিক এলাকা গড়ে তুলে তাকে কূটনৈতিক জোন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
আশির দশক থেকে উত্তরাসহ নবসৃষ্টি আবাসিক এলাকাগুলোয় সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে এ তৎপরতা বহুগুণ বেড়ে যায়। এ সময় নির্মাণ এলাকায় ডেভেলপারদের কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হতে শুরু করে। তারা জমির মালিকদের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় বিশাল সুউচ্চ ভবন নির্মাণ শুরু করে। আবাসিক ভবনগুলো কমপক্ষে ছয়তলা উচ্চতাবিশিষ্ট হয়ে পড়ে। একটি ভবনে পাঁচটি বড় কিংবা ১০টি ছোট ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়, যার অর্ধেক পায় জমির মালিক, অর্ধেক পায় ডেভেলপার। যে স্থানে আগে একটি পরিবার বসবাস করত, একই স্থানে সাধারণ হিসাবে ১০টি পরিবার বসবাস করতে শুরু করে। এলাকার লোকসংখ্যা মোটামুটি হিসাবে দশ গুণ বেড়ে যায়। একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে জমির মালিক বা উত্তরাধিকারীরা রাতারাতি ধনকুবেরে পরিণত হয়। বাইরের লোক ফ্ল্যাট কিনে এসব এলাকার বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ পায়। জমির ক্রেতা হিসেবে ডেভেলপাররাই মাঠে থাকে। ফ্ল্যাট নির্মাণ এবং বিক্রি একটি অত্যন্ত লোভনীয় ব্যবসা হিসেবে আবির্ভূত হয়। বহু ডেভেলপারের সমাগমে জমির দাম হু হু করে বেড়ে যায়। কিছু এলাকা প্রভাবশালী বিত্তবানদের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়ে। আবাসিক ভবন নির্মাণের এ ধারা নগরীর রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে লক্ষণীয়ভাবে প্রভাবিত করে।
ঢাকায় বর্তমানে যে কয়টি অভিজাত আবাসিক এলাকা রয়েছে তার সব কয়টি হয় রাজউক অথবা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড কর্তৃক নির্মিত। এর মধ্যে একমাত্র ধানমণ্ডি ছাড়া অন্য সব কয়টি আবাসিক এলাকা উত্তর ঢাকায় অবস্থিত। এ আবাসিক এলাকাগুলো হচ্ছে গুলশান, বারিধারা, বনানী, উত্তরা, নিকুঞ্জ (দক্ষিণ) এবং ডিওএইচএস (মহাখালী, বনানী এবং বারিধারা)। বেসরকারি পর্যায়ে সৃষ্ট বসুন্ধরা এখনো পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠেনি, তবে এখানেও সমাজের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি অবস্থান করছেন। ধানমণ্ডির পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে ফেলে প্রায় সব কয়টি বাড়িকেই কমপক্ষে ছয়তলাবিশিষ্ট ফ্ল্যাটে রূপান্তরিত করা হয়েছে। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, রেস্টুরেন্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাধিক্যের কারণে ধানমণ্ডি বস্তুত একটি বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হলেও এখানে অভিজাত শ্রেণীর অনেক প্রভাবশালী পরিবার এখনো বসবাস করে। সেদিক থেকে বলা যায়, এটিই মধ্য ঢাকার একমাত্র আবাসিক এলাকা, যাকে প্রভাবশালীদের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
ধানমণ্ডি ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এলাকার সব কয়টির অবস্থান মহাখালী থেকে উত্তরে। এর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং চমকপ্রদ। বাংলাদেশের প্রভাবশালীদের একটি বিরাট অংশ এ কয়টি আবাসিক এলাকায় বসবাস করে। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের অধিকাংশই মনে হয়- এসব এলাকার অধিবাসী। মন্ত্রী, সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, পেশাজীবী ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থীর সিংহভাগই এসব এলাকার অধিবাসী। সমাজের উচ্চবিত্তের এরূপ কেন্দ্রীভূত হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা নয়। পৃথিবীর অনেক শহরেই এরূপ দেখা যায় না। অর্থ ও প্রভাব একযোগ হয়ে সহায়-সম্পত্তি কিভাবে ধনিকশ্রেণীর করায়ত্ত হয়, ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার বাসিন্দাদের চিত্ররূপ তার একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অভ্যন্তরীণ আবাসন স্থানান্তর প্রক্রিয়া। উত্তর ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোর এমন একটি মোহনীয় আর্কষণ রয়েছে যে দক্ষিণ এবং মধ্য ঢাকার সংগতিসম্পন্ন বাসিন্দারা ধীরে ধীরে আবাসন স্থানান্তর করে উত্তর ঢাকায় চলে আসছেন। উত্তর ঢাকা বিশেষ করে, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় বাস করা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভাবশালী উচ্চবিত্তরা দক্ষিণ ঢাকায় থাকছে না বললেই চলে। পূর্ব পুরুষদের ভিটেমাটি বিক্রি করে অথবা বাড়িভাড়া দিয়ে তারা প্লট বা ফ্ল্যাট কিনে উত্তরাঞ্চলে চলে আসছেন। ফলে দক্ষিণ অঞ্চলে স্বনামধন্য প্রভাবশালী বাসিন্দার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থীর চিত্র থেকে এ ধারণা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। মধ্য ঢাকা এখন অফিসপাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ এলাকার বাড়ির মালিকরা তাঁদের বাড়িভাড়া দিয়ে উত্তর ঢাকায় বাসস্থান স্থান্তান্তর করেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, দক্ষিণ ও মধ্য ঢাকার উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধব বা পড়শিদের খোঁজ করতে হলে এখন উত্তর ঢাকায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। উত্তর ঢাকার এ অংশই হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সব সেক্টরের নিয়ন্ত্রকদের আবাসস্থল।
নগরীরের বাসস্থান স্থানান্তরের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের যে ধারার সূচনা করেছে, তার তাৎপর্য গবেষণার দাবি রাখে। বাংলাদেশের রাজনীতিকেও এ ধারা প্রভাবিত করেছে বলে ধারণা করা যায়। এ গবেষণা বা সমীক্ষায় অনেক চমকপ্রদ এবং সুদূরপ্রসারী ফল বেরিয়ে আসবে সন্দেহ নেই। আমরা এরূপ একটি গবেষণার প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
No comments