রোহিঙ্গা শরণার্থী-মিয়ানমারে আদমশুমারি ও বাংলাদেশের জন্য শঙ্কা by মোহাম্মদ আরজু

বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত দেওয়ার পথ সহজ রাখতে চায়, যদি অদূর ভবিষ্যতে আরাকান থেকে নতুন করে কক্সবাজারমুখী শরণার্থীর স্রোত দেখতে না চায়, তবে এখনই সময় তৎপর হওয়ার। বিশেষ করে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলকে জানাতে হবে যে,


আদমশুমারির আগে যাতে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং মিয়ানমারের ভেতরের রোহিঙ্গাদের 'অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী' স্ট্যাটাস পরিবর্তন করা হয়



মিয়ানমার সরকার সম্প্রতি দেশটির প্রস্তাবিত ২০১৪ সালের আদমশুমারিতে জাতিসংঘের সমর্থন ও সহযোগিতা নিশ্চিত করেছে, এ শুমারিটি যেভাবে হতে যাচ্ছে তাতে বাংলাদেশের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই মাসের শুরুতে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সফরে দেশটির সঙ্গে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের চুক্তি হয়েছে যে, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য ওই আদমশুমারি এবং খানা জরিপের কর্মপরিকল্পনা তৈরি, সব ধরনের কর্মপদ্ধতিগত-কারিগরি সহায়তা থেকে শুরু করে উদ্যোগটিতে অর্থায়নও করবে জাতিসংঘ। ১৯৮৩ সালের পর দেশটিতে এই প্রথম শুমারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মিয়ানমারে এই প্রথম একটি আদমশুমারি ও খানা জরিপ হতে যাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে। এ শুমারি এমন কিছু পরিণতি তৈরি করতে পারে (যদি না এখনই পরিস্থিতি প্রভাবিত করা হয়) যা বাংলাদেশের জন্য সমস্যা তৈরি করবে।
এ সমস্যা শুধু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত বারো হাজারের বেশি এবং শিবিরের বাইরে থাকা চার লাখের বেশি মিয়ানমারের নাগরিকদের (আরাকানি বা রোহিঙ্গা) নিয়ে নয়। চট্টগ্রাম সংলগ্ন ও বঙ্গোপসাগর উপকূলের রাখাইন প্রদেশে (সাবেক আরাকান) ১৯৭৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত বার্মিজ সামরিক বাহিনী ধারাবাহিক ও পদ্ধতিগত হত্যা-ধর্ষণ অভিযানসহ ব্যাপক হামলা ও লুটপাট চালায়। এর শিকার হয়ে জাতিগত আরাকানি ও ধর্মীয়ভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রায় ৪১ হাজার ৭শ'র বেশি মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এই বিশালসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে দুই দশক ধরে নানা ধরনের সমস্যার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ, ওই অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলার অব্যাহত অবনতি থেকে শুরু করে নানা আর্থ-সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
মিয়ানমারের আসন্ন আদমশুমারিতে এখন পর্যন্ত যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এ শরণার্থীদের দেশে ফেরার পথ বন্ধ হতে পারে আইনত। একই সঙ্গে এখনও মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিহীন অবস্থা এ শুমারির পরে আরও শক্ত ভিত্তি পাবে, যা নতুন করে তাদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন জোরালো করবে। ফলে নতুন করে শরণার্থী সমস্যা দেখা দিতে পারে। বার্মিজ সামরিক বাহিনী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্বাচননির্ভর সংসদীয় ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশ সফরে আসা কর্মকর্তারা এ শরণার্থীদের ফেরত নেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন। থমকে যাওয়া প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া আবারও শুরু করার কথা বলছেন। অথচ মিয়ানমারের ভেতরে এমন সব আইনকানুন বহাল রাখা ও নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে, যাতে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের সরকারিভাবে 'অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী' স্ট্যাটাস বহাল আছে এবং তাদের ওপর নতুন করে দমন-পীড়ন চালানোর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
দেশটিতে কার্যকর ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে রোহিঙ্গারা কার্যত 'রাষ্ট্রহীন'। এ আইনে স্পষ্টভাবে বিধান দেওয়া হয়েছে যে, দেশজুড়ে এবং বিশেষত বর্তমান রাখাইন (সাবেক আরাকান) প্রদেশে ধর্মীয়ভাবে বৌদ্ধ 'রাখাইন'রা ছাড়া অন্য কোনো 'ন্যাশনাল রেস'-এর উপস্থিতি নেই। জাতিগতভাবে আরাকানিদের মধ্যে এই 'রাখাইন'রা মূলত সংখ্যায় কম। সাবেক এই আরাকান প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আরাকানিরা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান, যাদের এখন 'রোহিঙ্গা' বলা হচ্ছে। এদের নির্মূলকরণের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আরাকানের নাম পাল্টে রাখাইন প্রদেশ রেখেছে সামরিক শাসকরা এবং রাখাইন ছাড়া এ অঞ্চলে অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতি আইনত অস্বীকার করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের জনসংখ্যা অনেকানেক নৃতাত্তি্বক ও ভৌগোলিক জাতিগোষ্ঠীর সমাহার। বর্তমান সামরিক শাসনে নৃতাত্তি্বকভাবে 'বর্মণ'রা (বিশেষণ 'বার্মিজ) কর্তৃত্বশালী হলেও তারা মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগেরও কম। 'বর্মণ'দের মতোই আরও অনেক নৃতাত্তি্বক জাতিগোষ্ঠীকে আইনগতভাবে স্বীকৃতি দেওয়া আছে স্বতন্ত্র 'ন্যাশনাল রেস' হিসেবে। নাগরিকত্বের কাগজপত্রে মিয়ানমারের নাগরিক পরিচয় ছাড়াও এ ন্যাশনাল রেস আলাদা করা থাকে। ১৪টি প্রশাসনিক প্রদেশের সাতটিতে মোটা দাগে নৃতাত্তি্বক বর্মণদের বাস, বাকি সাতটি অঞ্চলে নানা জাতির বাস। তাদের মধ্যে চিন, কাচিন, কারেন, শান ও আরাকানি জনগোষ্ঠী প্রধান। কিন্তু ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন-পরবর্তী আইনি কাঠামোতে 'আরাকানি'দের ন্যাশনাল রেসের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে (এ প্রদেশের বৌদ্ধদের 'রাখাইন' ন্যাশনাল রেস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে)। তখন থেকে আজ পর্যন্ত তাদের সরকারিভাবে 'বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী'র স্ট্যাটাস আরোপ করে উচ্ছেদ প্রচেষ্টার ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছে।
সত্যিই 'অবৈধ অভিবাসী'দের মতোই বসবাস করতে হয় তাদের নিজ দেশে। সামরিক বাহিনী কর্তৃক নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে বাস করতে হয়, স্বেচ্ছায় জীবিকার উপায় বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই, অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক শ্রম শিবিরে কাজ করতে হয়, নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে গেলে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। রোহিঙ্গাদের নিয়মিতই বলা হয় যে, তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। চাইলে বাংলাদেশ ও লন্ডনস্থ সাতটি রোহিঙ্গা অধিকার সংস্থার কাছ থেকে আরও বিস্তারিত বিবরণ পেতে পারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে থাকা এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের আইনত 'অবৈধ অভিবাসী' অবস্থায় রাখছে যে আইনি কাঠামো, সে বিষয়ে জাতিসংঘ কোনো আলোচনা করেনি আদমশুমারিতে সহযোগিতা করার চুক্তির আগে। লন্ডনভিত্তিক আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনসহ (অরনো) সাতটি সংস্থার স্থানীয় সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, এ আইনি ব্যবস্থা কার্যকর রেখে শুমারি চালানো হলে তাতে রোহিঙ্গাদের সামনে কোনো সুযোগ থাকবে না মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে শুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার, আর এখানেই বাংলাদেশের নতুন আশঙ্কার শুরু।
এ পর্যন্ত মিয়ানমারে এমন কোনো আদমশুমারি হয়নি, যা আন্তর্জাতিকভাবে নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। এখন জাতিসংঘ সেই দেশটিতে এক শুমারি চালনায় অংশীদার হচ্ছে, যেই শুমারিতে এখন পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং 'ন্যাশনাল রেস' থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। এ স্বীকৃতি রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন বাড়াতে এবং বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দিতে বার্মিজ সামরিক বাহিনীর সামনে বিশাল সুযোগ এনে দেবে। আবারও দেখা যাবে সীমান্তবর্তী নাফ নদীতে ও বঙ্গোপসাগর উপকূলে বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নৌকা ভাসছে।
বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত দেওয়ার পথ সহজ রাখতে চায়, যদি অদূর ভবিষ্যতে আরাকান থেকে নতুন করে কক্সবাজারমুখী শরণার্থীর স্রোত দেখতে না চায়, তবে এখনই সময় তৎপর হওয়ার। এ বিষয়ে দ্রুত মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। বিশেষ করে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলকে জানাতে হবে যে, আদমশুমারির আগে যাতে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং মিয়ানমারের ভেতরের রোহিঙ্গাদের 'অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী' স্ট্যাটাস পরিবর্তন করা হয়। যাতে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে তাদের নাগরিকত্বের ও ন্যাশনাল রেস হিসেবে স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা হয়। মিয়ানমার সরকার ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে যে, ২০১৪ সালের শুমারি অবশ্যই শরণার্থী বিষয়ে ১৯৫৪ সালের এবং 'রাষ্ট্রহীন' মানুষ বিষয়ে ১৯৬১ সালের জাতিসংঘ কনভেনশনের সঙ্গে মিল রেখে হতে হবে।
অরনোর সমন্বয়ে এ বিষয়ে সাতটি রোহিঙ্গা সংস্থা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের কোনোভাবে সহযোগিতা করলে বাংলাদেশের কাজ সহজ হতে পারে।

মোহাম্মদ আরজু : সাংবাদিক
mohammadarju@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.