নাগরিক সমাজ এগিয়ে আসুন-‘বিচার বিভাগ কাচের ঘরে’

সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বিচার বিভাগ নিয়ে আমাদের অব্যাহত উদ্বেগ ও বেদনাবোধকেই কিছুটা যথার্থতা দিলেন। তিনি বলেছেন, ‘জুডিশিয়ারি ইন এ গ্লাস হাউস’, অর্থাৎ বিচার বিভাগ এখন কাচের ঘরে। বিচার বিভাগ যে ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে, তা তাঁর এই মন্তব্যে স্পষ্ট।


২৪ এপ্রিল ঢাকায় একটি সেমিনারে প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগে কর্মরত ও সাবেক বিচারকেরা যোগ দেন। সেখানেই তিনি ওই মন্তব্য করেন। ওই অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরাও উপস্থিত ছিলেন।
দুজন অতিরিক্ত বিচারককে শপথপাঠ না করানো এবং বিষয়টি অনিষ্পন্ন থাকায় সব মহলে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী ও আইন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন। তাঁরা উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এটা বিরল ঘটনা। ১৯৯৪ সালে বিচারক নিয়োগের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দুজন বিচারক সম্পর্কে তাঁর আপত্তি প্রকাশ করেছিলেন। তখনো সংবিধানে প্রধান বিচারপতির পরামর্শে বিচারক নিয়োগের বিধান ছিল না, এখনো নেই। তবে এখন আর এ বিষয়ে সাংবিধানিক শূন্যতা নেই। উচ্চ আদালত তা পূরণ করেছেন। আপিল বিভাগ বিচারক নিয়োগে বিস্তারিত নীতিমালা বেঁধে দিয়েছেন এবং নির্বাহী বিভাগ তা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগে প্রত্যাশিত স্বচ্ছতা দেখা গেল না।
এ জন্য অবশ্য কেবল নির্বাহী বিভাগকে দায়ী করা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত বিচারক বাছাইয়ে আপিল বিভাগের শর্ত অনুযায়ী সত্যি সবচেয়ে যোগ্যতম ব্যক্তিকে খোঁজ করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানা যায় না। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিও এ বিষয়ে যথাভূমিকা পালন করতে পারেনি। অবসরপ্রাপ্ত বিচারকেরা সুপ্রিম কোর্টের সংস্কারসংক্রান্ত অনেক বিষয়ে নীরবতা পালনকেই শ্রেয় মনে করছেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের অদৃশ্য হস্তক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। সংসদ সদস্যদের ভূমিকা পালন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। জাতীয় সংসদ বর্তমানে যেভাবে চলছে, তা মোটেই সন্তোষজনক নয়। এমনকি মন্ত্রিসভা বা সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গের কার্যক্রমও জনতুষ্টি অর্জন থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের অন্যতম ও শেষ ভরসাস্থল সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকার দিকেও আমাদের বিশেষ নজর ও মনোযোগ দিতে হয়। বিচার বিভাগ কাচের ঘরে থাকলে তা গণতন্ত্রের জন্য নিশ্চয় সুখের নয়। প্রধান বিচারপতি দুই দলকে একসঙ্গে কাজ করার ও বিচারকদের প্রতি ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সচেতন মহল সাধারণভাবে নিশ্চয় চিন্তার ঐক্য খুঁজে পাবেন। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা বিচার বিভাগের ভূমিকা পালনে শিথিলতার বিষয় এড়াতে পারি না। রাষ্ট্রের দুই অঙ্গের মতো বিচার বিভাগ নিয়েও আমাদের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
বিচারক বাছাইয়ে আপিল বিভাগের নীতিমালা অনুসরণে খোদ আপিল বিভাগের সক্রিয়তার কোনো বিকল্প নেই। বিচার বিভাগ আজ সত্যি কাচের ঘরে। তবে তাকে বাঁচাতে আজ বিভিন্ন পেশার সচেতন নাগরিকদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু পেশাদার রাজনীতিক ও আইনজীবীদের ভরসায় থাকলে পরে বড় অনুশোচনা করতে হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.