সময়চিত্র-পীর: বাহিনী ও কাহিনি by আসিফ নজরুল
বিশ-পঁচিশ বছর আগেও পীরদের মহা প্রতাপ ছিল দেশে। অনেক রাজনীতিবিদ, জেনারেল ও ক্ষমতাশালী লোক যেতেন পীরদের কাছে। বাংলাদেশে এসে এমনকি বেনজির ভুট্টোও অখ্যাত এক পীর মজিবর রহমান চিশতির কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। সারা দেশে তুমুল আলোচিত ছিল এ ঘটনা।
প্রথম আলোর সাংবাদিক কবির হোসেন পীরের ছবি তুলে আরেক ধরনের আলোড়ন তুলেছেন এখন দেশে। এই ছবি মুন্সিগঞ্জের পীর ও তাঁর বাহিনীর ভণ্ডামি এবং নিষ্ঠুরতাকে উন্মোচন করেছে। বহু মানুষ সোচ্চার হয়েছে ভণ্ড পীরের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে। কেউ কেউ বিস্ময়ে হতবাকও হয়েছে। কিন্তু পীর-সংস্কৃতি নিয়ে আসলে বিস্ময়ের কিছু নেই। যুগ যুগ ধরে মানুষের অশিক্ষা, অসহায়ত্ব আর অন্ধবিশ্বাসকে পুঁজি করে বাংলাদেশে চলছে ভণ্ড পীরদের দৌরাত্ম্য। কবিরের সচিত্র প্রতিবেদন দেখে মনে পড়ে এ রকম বহু ঘটনা।
২.
আমাদের তরুণ বয়সে পীরেরা ছিলেন দুই ধরনের। রাজনৈতিক পীর আর ব্যবসায়ী পীর। রাজনৈতিক পীরেরাও ধর্মব্যবসা করতেন, কিন্তু তাঁদের মূল ক্ষমতার উৎস ছিল রাজনীতিবিদ আর ক্ষমতাধর মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তখনকার দিনে রাজনৈতিক পীরদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ছিলেন ফরিদপুর নিবাসী আটরশির পীর। এরশাদের কল্যাণে তিনি তখন তারকাখ্যাতি পেয়েছেন বাংলাদেশে। কিন্তু আটরশির পীর জনসমক্ষে আসতেন না। তিনি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতেন না। এমনকি তখন এমন গুজবও ছিল যে তাঁর ছবি নাকি ক্যামেরার রিলেতে তোলাও যায় না।
আটরশির পীরের কাছে যাওয়ার ‘সৌভাগ্য’ হয়েছিল আমারও। সাংবাদিক পরিচয় লুকিয়ে রেখে রওনা দিয়েছিলাম একবার আটরশিতে। সেখানে সবাইকে জুতো খুলে খালি পায়ে থাকতে হয়। আমরাও তা-ই করি। রাতে দেখা হলো তাঁর ফিটফাট ছেলের সঙ্গে। তিনি জুতো পরেই দিব্যি ঘুরছেন সবখানে। বাম রাজনীতির সোনালি দিন তখন দেশে, শ্রেণীচেতনা ছিল আমাদের অনেকের মধ্যেও। আটরশির পীরের ছেলের চকচকে জুতোর দিকে চেয়ে তাই রাগে গা জ্বলতে থাকে। গোপনে আটরশির ছবি তোলার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ফিরে আসি ঢাকায়।
পীরদের সঙ্গে আমার মোলাকাত শেষ হয়ে যায়নি তাই বলে। ১৯৮৯ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যোগ দিয়ে বহু রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ঘটে জীবনে। পীরদের সামনাসামনি হওয়া ছিল সে রকমই কিছু। বিচিত্রায় একবার সিদ্ধান্ত হলো, পরের প্রচ্ছদকাহিনি হবে ঢাকার পীরদের নিয়ে। লিখব আমি।
সেটি ১৯৯২ সালের কথা। দেশে কিছুদিন আগে গণতন্ত্র এসেছে। গণতন্ত্র এসেছে পীর-ব্যবসাতেও। সারা ঢাকা তাই ছেয়ে গেছে পীরদের আস্তানায়। এঁদের অনেকের বিজ্ঞাপন ছাপা হতো তখন বহুল প্রচারিত দৈনিক আর সাপ্তাহিকগুলোতে। অনেক বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত ‘চেহারা দেখে সমস্যার সমাধান দেয়া হয়’। কেউ করতেন সাপ দিয়ে চিকিৎসা, কেউ পাথর দিয়ে। কিন্তু সবারই দাবি, তাঁদের ক্ষমতা অলৌকিক কিংবা কুদরতি। আসলে তা কী, সেই বর্ণনা দেওয়ার জন্য একটু নিজের প্রতিবেদনের কথা বলে নিই।
৩.
ঢাকার অধিকাংশ পীর তখন একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে লোক ঠকাতেন। অতিথিকক্ষে তাঁদেরই বেতনভোগী কর্মচারীরা পীরের দর্শনার্থী সেজে থাকতেন। সমস্যায় আক্রান্ত কোনো মানুষ পীরের কাছে গেলে এই কর্মচারী বাহিনীর কেউ তাঁর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিতেন। ওই ব্যক্তি হয়তো বলেন, তাঁর ব্যবসায় খুব দুর্দিন যাচ্ছে, পীরের কাছে এসেছেন তদবির করতে। পীরের কাছে তাঁর ডাক পড়ে হয়তো ঘণ্টাখানেক পর। পীর তাঁকে দেখে বলে দেন ‘তোমার তো ব্যবসার অবস্থা খারাপ, তাই না।’ ওই ব্যক্তি তখন চমকে উঠে ভাবেন, এই পীর আমাকে দেখেই বলে দিলেন সমস্যার কথা। এত মহা আল্লাহওয়ালা লোক! এ সুযোগে পীর তাঁকে নানা কথা বলে আরও ভড়কে দেন, দোয়া-তদবির-সদকা বিভিন্ন নামে তাঁর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। প্রবীর মিত্রের অলৌকিক নয়, লৌকিক নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ভণ্ড পীরদের এ রকম বহু টেকনিকের বর্ণনা আছে।
১৯৯২ সালে ঢাকার কয়েকজন বিখ্যাত পীরের ওপর প্রতিবেদন রচনার সময় প্রবীর মিত্রের বই আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। এই পীরদের একজন ছিলেন ‘হুজুর হজরত ফকির আবদুর রব চিশতী ছুম্মায়ে আজমিরী’। ছুম্মায়ে আজমিরীর চেম্বারে দর্শনার্থীদের ঘরে বসামাত্র মলিন চেহারার এক লোক এসে আলাপ জুড়ে দেন আমার সঙ্গে। তাঁর নাকি দুই বউ ছিল, দুজনই ‘মইরা শেষ’। তৃতীয় বিয়ের আগে তদবির করতে চান। আমার সমস্যা কী তা তিনি জানতে চান। আমি বানিয়ে বলি সমস্যার কথা। আমার বউ বড়ই বদ, তার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি, মামলা-মোকদ্দমা চলছে (আসলে আমি তখনো অবিবাহিত, মামলার কোনো ঝামেলাও ছিল না তখন)।
একটু পরেই হুজুরের দরবারে ডাক। তিনি উঁচু তাকিয়ার পাগড়ি মাথায় বসে। আতর, গোলাপজল, আগরবাতিতে আচ্ছন্ন ঘরের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসি আমি। কালো ব্যাগে গোপনে রেকর্ড হয় হুজুরের সঙ্গে আমার সংলাপ। সেখানকার কিছু অংশ ছিল হুবহু এ রকম:
‘হুজুর বলেন...তুমি এখন বড় টেনশনে আছো নিজেকে নিয়ে...তুমি বড়...অহেতুক মামলা-মোকাদ্দমা তোমার পেছনে লেগে থাকবেই, কিছু করতে পারুক আর না পারুক...তোমার বুকে একটা তিল আছে, আছে না?
জি না হুজুর (আসলেই আমার বুকে কোনো তিল নেই)।
আছে, অবশ্যই আছে, দেখি শার্ট খোলো...হুজুর আমার বুকের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, কি নাই?
জি না হুজুর।
আছেই, ভালো করে খেয়াল করে দেখো, গোসলের সময় কাঁচা হলুদ দিয়া ডইলা উঠায় ফেলবা।
হুজুর আমার সমস্যার কথা বলেন...
তোমার প্রথম জীবনে চাকরি হবে, তারপর ব্যবসা, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণ আছে, অস্ট্রেলিয়া-জাপান-সৌদি আরব...“ইয়ার লাইন” বোঝো?
জি হুজুর!
ইয়ার লাইনে তোমার বিমান দুর্ঘটনা শতকরা ৮৮ ভাগ, মাত্র ৮ ভাগ ভালো আছে...
বাকি ৪ ভাগ কী হুজুর?
যা বলি শোনো, তুমি বড় বেশি কথা বলো।’
(তথ্যসূত্র: আসিফ নজরুলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, বিদ্যাপ্রকাশ, ১৯৯৭)
ছুম্মায়ে আজমিরী ও অন্য পীরদের কাছে আমি কিছুদিন পর যাই প্রতিবেদক হিসেবে। এই পর্যায়ে তাঁদের কথাবার্তা একদম বদলে যায়। স্বীকার করেন যে আসলে সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেন না তাঁরা। সমাধান আল্লাহর হাতে, তাঁরা শুধু দোয়া করে দেন। তাঁদের কাছে না এসে লোকজন নিজেরা দোয়া করলেই পারে।
বিজ্ঞাপনে তাঁদের দাবি আবার একবারে ভিন্ন। বিচিত্রায় আমার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে এসব অসংগতি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন বের হওয়ার আগেই আল-জহুরী সর্পরাজ এ আর গনি তাঁর বিরুদ্ধে কিছু লেখা হলে সর্প দংশন করিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেন, প্রতিবেদন বের হওয়ার পর ছুম্মায়ে আজমিরী খোদার গজবের ভয় দেখিয়ে চিঠি পাঠান। মওলানা এম ইউ আজাদী কুদরতী বিচিত্রায় ফোন করে আমাকে বলেন, ‘আপনি একটা “ইসটুপিড” লোক।’
বিচিত্রায় প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার দুই বছর পর আমি বিদেশে যাই গবেষণার কাজে। ফিরে আসি পাঁচ বছর পর। তখনো দেশের নামকরা দৈনিকগুলোতে ছুম্মায়ে আজমিরীর বিজ্ঞাপন, আরও বহু নারী-পুরুষ পীরের বিজ্ঞাপন। আমাদের লেখালেখিতে কিছুই হয়নি তাঁদের।
কবির হোসেনের প্রতিবেদনের পর মুন্সিগঞ্জের পীর আমজাদ ধরা পড়েছেন, তাঁর সিন্ডিকেটের সদস্যরা ধরা পড়েছেন। কিন্তু তাঁদের কি শাস্তি হবে শেষ পর্যন্ত? পুলিশ কি ঠিকমতো তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবে? সরকারের উকিল কি লড়বেন ঠিকমতো? আদালত কি জামিন না দিয়ে বিচার করবেন দ্রুত?
সব যদি ঠিকমতো হয়, একজন ভণ্ড পীর ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা হয়তো সাজা পাবে। কিন্তু বাংলাদেশ কি রেহাই পাবে এই পীরদের দৌরাত্ম্য থেকে? সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য আমজাদের হাত থেকে কি রক্ষা পাবে অগণিত অসহায় মানুষ? আমার তা মনে হয় না।
৪.
ভণ্ড পীর আসলে শুধু মুন্সিগঞ্জের আমজাদেরা নন। মূল সমস্যা হলো, সমাজে এ রকম ভণ্ড পীর ছড়িয়ে আছেন সর্বত্র। মানুষের বিশ্বাস ও আনুগত্যকে পুঁজি করে এঁরা তাদের ঠকান নানাভাবে। নিজেরা হন অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার মালিক। সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী—সবার নেতৃত্বে আছেন এ রকম নেতাবেশী পীর। সবাই এমন নন, তবে অন্তত কেউ কেউ এমন। পীরদের মতো তাঁদেরও আছে উচ্ছিষ্টভোগী বাহিনী।
ভণ্ড পীরের মতো আচরণ করেন এমনকি আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারাও। দেশের সমস্যা, সমাজের সমস্যা ক্ষমতায় এসে অলৌকিক সমাধানের বাণী দেন। আমরা চরম ভক্তিবাদ দেখিয়ে, তাঁদের অন্ধভাবে বিশ্বাস করে ক্ষমতায় বসাই। পীরেরা ঝাড়ফুঁক দিয়ে, পানি পড়া খাইয়ে সমস্যার সমাধান করেন। সেই সমাধানে সমস্যা আরও বাড়তে থাকে। আমাদের রাজনীতিবিদেরাও গলাবাজি করে ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশের পানি পড়া খাইয়ে দেন আমাদের। তাঁদের ধোঁকা আর দুঃশাসনে শুধু বাড়তে থাকে দেশের সমস্যা। আরও মানুষ দরিদ্র হয়, আরও মানুষের ঘরের বাতি নিভে যায়, আরও মানুষ বস্তি কিংবা ফুটপাতে নেমে আসে।
পীরেরা পিটিয়ে অসুখ সারান। নেতারা পিটিয়ে প্রতিবাদের অসুখ সারান। পীরেরা কলা-মুলো ভ্যাট পান, নগদ টাকায় গড়ে তোলেন পাকা দালানকোঠা। নেতারা পান লাইসেন্স-পারমিট-কমিশন, বারিধারার প্লট। কোনো পীর দরিদ্র নন, কোনো নেতাও নন। পীরের আশপাশে গড়ে ওঠে মধুলোভী সঙ্গীদের বাহিনী। নেতাদের চারপাশেও তাই। পীরেরা কখনো কখনো গ্রেপ্তার হন, কালেভদ্রে শাস্তি পান। আমাদের নেতারাও তাই।
পীরের সঙ্গে নেতার মিল সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। এই মিল ঘোচানোই সবচেয়ে জরুরি।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২.
আমাদের তরুণ বয়সে পীরেরা ছিলেন দুই ধরনের। রাজনৈতিক পীর আর ব্যবসায়ী পীর। রাজনৈতিক পীরেরাও ধর্মব্যবসা করতেন, কিন্তু তাঁদের মূল ক্ষমতার উৎস ছিল রাজনীতিবিদ আর ক্ষমতাধর মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তখনকার দিনে রাজনৈতিক পীরদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ছিলেন ফরিদপুর নিবাসী আটরশির পীর। এরশাদের কল্যাণে তিনি তখন তারকাখ্যাতি পেয়েছেন বাংলাদেশে। কিন্তু আটরশির পীর জনসমক্ষে আসতেন না। তিনি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতেন না। এমনকি তখন এমন গুজবও ছিল যে তাঁর ছবি নাকি ক্যামেরার রিলেতে তোলাও যায় না।
আটরশির পীরের কাছে যাওয়ার ‘সৌভাগ্য’ হয়েছিল আমারও। সাংবাদিক পরিচয় লুকিয়ে রেখে রওনা দিয়েছিলাম একবার আটরশিতে। সেখানে সবাইকে জুতো খুলে খালি পায়ে থাকতে হয়। আমরাও তা-ই করি। রাতে দেখা হলো তাঁর ফিটফাট ছেলের সঙ্গে। তিনি জুতো পরেই দিব্যি ঘুরছেন সবখানে। বাম রাজনীতির সোনালি দিন তখন দেশে, শ্রেণীচেতনা ছিল আমাদের অনেকের মধ্যেও। আটরশির পীরের ছেলের চকচকে জুতোর দিকে চেয়ে তাই রাগে গা জ্বলতে থাকে। গোপনে আটরশির ছবি তোলার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ফিরে আসি ঢাকায়।
পীরদের সঙ্গে আমার মোলাকাত শেষ হয়ে যায়নি তাই বলে। ১৯৮৯ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যোগ দিয়ে বহু রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ঘটে জীবনে। পীরদের সামনাসামনি হওয়া ছিল সে রকমই কিছু। বিচিত্রায় একবার সিদ্ধান্ত হলো, পরের প্রচ্ছদকাহিনি হবে ঢাকার পীরদের নিয়ে। লিখব আমি।
সেটি ১৯৯২ সালের কথা। দেশে কিছুদিন আগে গণতন্ত্র এসেছে। গণতন্ত্র এসেছে পীর-ব্যবসাতেও। সারা ঢাকা তাই ছেয়ে গেছে পীরদের আস্তানায়। এঁদের অনেকের বিজ্ঞাপন ছাপা হতো তখন বহুল প্রচারিত দৈনিক আর সাপ্তাহিকগুলোতে। অনেক বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত ‘চেহারা দেখে সমস্যার সমাধান দেয়া হয়’। কেউ করতেন সাপ দিয়ে চিকিৎসা, কেউ পাথর দিয়ে। কিন্তু সবারই দাবি, তাঁদের ক্ষমতা অলৌকিক কিংবা কুদরতি। আসলে তা কী, সেই বর্ণনা দেওয়ার জন্য একটু নিজের প্রতিবেদনের কথা বলে নিই।
৩.
ঢাকার অধিকাংশ পীর তখন একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে লোক ঠকাতেন। অতিথিকক্ষে তাঁদেরই বেতনভোগী কর্মচারীরা পীরের দর্শনার্থী সেজে থাকতেন। সমস্যায় আক্রান্ত কোনো মানুষ পীরের কাছে গেলে এই কর্মচারী বাহিনীর কেউ তাঁর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিতেন। ওই ব্যক্তি হয়তো বলেন, তাঁর ব্যবসায় খুব দুর্দিন যাচ্ছে, পীরের কাছে এসেছেন তদবির করতে। পীরের কাছে তাঁর ডাক পড়ে হয়তো ঘণ্টাখানেক পর। পীর তাঁকে দেখে বলে দেন ‘তোমার তো ব্যবসার অবস্থা খারাপ, তাই না।’ ওই ব্যক্তি তখন চমকে উঠে ভাবেন, এই পীর আমাকে দেখেই বলে দিলেন সমস্যার কথা। এত মহা আল্লাহওয়ালা লোক! এ সুযোগে পীর তাঁকে নানা কথা বলে আরও ভড়কে দেন, দোয়া-তদবির-সদকা বিভিন্ন নামে তাঁর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। প্রবীর মিত্রের অলৌকিক নয়, লৌকিক নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ভণ্ড পীরদের এ রকম বহু টেকনিকের বর্ণনা আছে।
১৯৯২ সালে ঢাকার কয়েকজন বিখ্যাত পীরের ওপর প্রতিবেদন রচনার সময় প্রবীর মিত্রের বই আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। এই পীরদের একজন ছিলেন ‘হুজুর হজরত ফকির আবদুর রব চিশতী ছুম্মায়ে আজমিরী’। ছুম্মায়ে আজমিরীর চেম্বারে দর্শনার্থীদের ঘরে বসামাত্র মলিন চেহারার এক লোক এসে আলাপ জুড়ে দেন আমার সঙ্গে। তাঁর নাকি দুই বউ ছিল, দুজনই ‘মইরা শেষ’। তৃতীয় বিয়ের আগে তদবির করতে চান। আমার সমস্যা কী তা তিনি জানতে চান। আমি বানিয়ে বলি সমস্যার কথা। আমার বউ বড়ই বদ, তার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি, মামলা-মোকদ্দমা চলছে (আসলে আমি তখনো অবিবাহিত, মামলার কোনো ঝামেলাও ছিল না তখন)।
একটু পরেই হুজুরের দরবারে ডাক। তিনি উঁচু তাকিয়ার পাগড়ি মাথায় বসে। আতর, গোলাপজল, আগরবাতিতে আচ্ছন্ন ঘরের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসি আমি। কালো ব্যাগে গোপনে রেকর্ড হয় হুজুরের সঙ্গে আমার সংলাপ। সেখানকার কিছু অংশ ছিল হুবহু এ রকম:
‘হুজুর বলেন...তুমি এখন বড় টেনশনে আছো নিজেকে নিয়ে...তুমি বড়...অহেতুক মামলা-মোকাদ্দমা তোমার পেছনে লেগে থাকবেই, কিছু করতে পারুক আর না পারুক...তোমার বুকে একটা তিল আছে, আছে না?
জি না হুজুর (আসলেই আমার বুকে কোনো তিল নেই)।
আছে, অবশ্যই আছে, দেখি শার্ট খোলো...হুজুর আমার বুকের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, কি নাই?
জি না হুজুর।
আছেই, ভালো করে খেয়াল করে দেখো, গোসলের সময় কাঁচা হলুদ দিয়া ডইলা উঠায় ফেলবা।
হুজুর আমার সমস্যার কথা বলেন...
তোমার প্রথম জীবনে চাকরি হবে, তারপর ব্যবসা, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণ আছে, অস্ট্রেলিয়া-জাপান-সৌদি আরব...“ইয়ার লাইন” বোঝো?
জি হুজুর!
ইয়ার লাইনে তোমার বিমান দুর্ঘটনা শতকরা ৮৮ ভাগ, মাত্র ৮ ভাগ ভালো আছে...
বাকি ৪ ভাগ কী হুজুর?
যা বলি শোনো, তুমি বড় বেশি কথা বলো।’
(তথ্যসূত্র: আসিফ নজরুলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, বিদ্যাপ্রকাশ, ১৯৯৭)
ছুম্মায়ে আজমিরী ও অন্য পীরদের কাছে আমি কিছুদিন পর যাই প্রতিবেদক হিসেবে। এই পর্যায়ে তাঁদের কথাবার্তা একদম বদলে যায়। স্বীকার করেন যে আসলে সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেন না তাঁরা। সমাধান আল্লাহর হাতে, তাঁরা শুধু দোয়া করে দেন। তাঁদের কাছে না এসে লোকজন নিজেরা দোয়া করলেই পারে।
বিজ্ঞাপনে তাঁদের দাবি আবার একবারে ভিন্ন। বিচিত্রায় আমার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে এসব অসংগতি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন বের হওয়ার আগেই আল-জহুরী সর্পরাজ এ আর গনি তাঁর বিরুদ্ধে কিছু লেখা হলে সর্প দংশন করিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেন, প্রতিবেদন বের হওয়ার পর ছুম্মায়ে আজমিরী খোদার গজবের ভয় দেখিয়ে চিঠি পাঠান। মওলানা এম ইউ আজাদী কুদরতী বিচিত্রায় ফোন করে আমাকে বলেন, ‘আপনি একটা “ইসটুপিড” লোক।’
বিচিত্রায় প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার দুই বছর পর আমি বিদেশে যাই গবেষণার কাজে। ফিরে আসি পাঁচ বছর পর। তখনো দেশের নামকরা দৈনিকগুলোতে ছুম্মায়ে আজমিরীর বিজ্ঞাপন, আরও বহু নারী-পুরুষ পীরের বিজ্ঞাপন। আমাদের লেখালেখিতে কিছুই হয়নি তাঁদের।
কবির হোসেনের প্রতিবেদনের পর মুন্সিগঞ্জের পীর আমজাদ ধরা পড়েছেন, তাঁর সিন্ডিকেটের সদস্যরা ধরা পড়েছেন। কিন্তু তাঁদের কি শাস্তি হবে শেষ পর্যন্ত? পুলিশ কি ঠিকমতো তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবে? সরকারের উকিল কি লড়বেন ঠিকমতো? আদালত কি জামিন না দিয়ে বিচার করবেন দ্রুত?
সব যদি ঠিকমতো হয়, একজন ভণ্ড পীর ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা হয়তো সাজা পাবে। কিন্তু বাংলাদেশ কি রেহাই পাবে এই পীরদের দৌরাত্ম্য থেকে? সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য আমজাদের হাত থেকে কি রক্ষা পাবে অগণিত অসহায় মানুষ? আমার তা মনে হয় না।
৪.
ভণ্ড পীর আসলে শুধু মুন্সিগঞ্জের আমজাদেরা নন। মূল সমস্যা হলো, সমাজে এ রকম ভণ্ড পীর ছড়িয়ে আছেন সর্বত্র। মানুষের বিশ্বাস ও আনুগত্যকে পুঁজি করে এঁরা তাদের ঠকান নানাভাবে। নিজেরা হন অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার মালিক। সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী—সবার নেতৃত্বে আছেন এ রকম নেতাবেশী পীর। সবাই এমন নন, তবে অন্তত কেউ কেউ এমন। পীরদের মতো তাঁদেরও আছে উচ্ছিষ্টভোগী বাহিনী।
ভণ্ড পীরের মতো আচরণ করেন এমনকি আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারাও। দেশের সমস্যা, সমাজের সমস্যা ক্ষমতায় এসে অলৌকিক সমাধানের বাণী দেন। আমরা চরম ভক্তিবাদ দেখিয়ে, তাঁদের অন্ধভাবে বিশ্বাস করে ক্ষমতায় বসাই। পীরেরা ঝাড়ফুঁক দিয়ে, পানি পড়া খাইয়ে সমস্যার সমাধান করেন। সেই সমাধানে সমস্যা আরও বাড়তে থাকে। আমাদের রাজনীতিবিদেরাও গলাবাজি করে ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশের পানি পড়া খাইয়ে দেন আমাদের। তাঁদের ধোঁকা আর দুঃশাসনে শুধু বাড়তে থাকে দেশের সমস্যা। আরও মানুষ দরিদ্র হয়, আরও মানুষের ঘরের বাতি নিভে যায়, আরও মানুষ বস্তি কিংবা ফুটপাতে নেমে আসে।
পীরেরা পিটিয়ে অসুখ সারান। নেতারা পিটিয়ে প্রতিবাদের অসুখ সারান। পীরেরা কলা-মুলো ভ্যাট পান, নগদ টাকায় গড়ে তোলেন পাকা দালানকোঠা। নেতারা পান লাইসেন্স-পারমিট-কমিশন, বারিধারার প্লট। কোনো পীর দরিদ্র নন, কোনো নেতাও নন। পীরের আশপাশে গড়ে ওঠে মধুলোভী সঙ্গীদের বাহিনী। নেতাদের চারপাশেও তাই। পীরেরা কখনো কখনো গ্রেপ্তার হন, কালেভদ্রে শাস্তি পান। আমাদের নেতারাও তাই।
পীরের সঙ্গে নেতার মিল সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। এই মিল ঘোচানোই সবচেয়ে জরুরি।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments