প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী-ছাত্র ইউনিয়নের অনন্য গৌরবগাথা by মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
৫৮ বছর ধরে গড়ে উঠেছে যে ছাত্র ইউনিয়ন পরিবার, আমি সেই পরিবারের একজন সদস্য। এটা আমার আত্মপরিচয়ের অমূল্য সঞ্চয়, আমার পরম গৌরব। আর মাত্র দুই বছর পরে ছাত্র ইউনিয়নের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হবে। ভিশন-২০১২ সামনে রেখে ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারে এখন থেকেই জেগে উঠতে শুরু করেছে আবেগ-অনুভূতির গভীর স্পন্দন।
ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস হলো এক অনন্য গৌরবগাথা। এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি বছর-পরম্পরায় লাখ লাখ তরুণ ছাত্রছাত্রীকে নির্ভেজাল দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, বিশ্ব শান্তি, আন্তর্জাতিকতাবাদ, প্রগতিশীলতা, সমাজতন্ত্র, মানবমুক্তি ইত্যাদি সুমহান আদর্শ ও চেতনায় দীক্ষিত করেছে। ঐক্য-শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি—এই চারটি মূল মন্ত্রকে ভিত্তি করে ছাত্রসমাজের মধ্যে প্রজ্বলিত হয়েছে জাগরণের অগ্নি-মশাল। অজেয় ও অনির্বাণ সেই চেতনার আলোকচ্ছটায় বায়ান্ন থেকে দীপ্ত হয়েছে অগণিত ছাত্রছাত্রী। ছাত্র ইউনিয়নের শিক্ষা তাদের শ্রেষ্ঠ মানুষের গুণাবলি আত্তীকরণে ও নিজ নিজ পেশায় উত্কর্ষ অর্জনে পথ রচনা করে দিয়েছে।
ছাত্র ইউনিয়ন তার সদস্যদের শিক্ষা দিয়েছে প্রজ্ঞা, প্রগতিমুখিতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সাহসিকতা, দৃঢ়তা, নিষ্ঠা, আত্মত্যাগের মনোবৃত্তি, উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বোধ, উন্নত রুচিশীলতা, শ্রমের প্রতি মর্যাদা, শোষিত-অবহেলিত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসার বোধ ইত্যাদি। ছাত্র ইউনিয়ন শিখিয়েছে, বিদ্যমান প্রতিকূলতার কাছে মাথা নত না করে প্রতিক্রিয়াশীল স্থিতাবস্থাকে, অথবা গণশত্রুর আঘাত চ্যালেঞ্জ করতে। মাঝেমধ্যে নেমে আসা ঘোর কৃষ্ণপক্ষের মধ্যেই ছাত্র ইউনিয়ন সব সময় থেকেছে (এবং আজও আছে) আদর্শবাদের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার অনন্ত প্রবহমান উৎস হয়ে। বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যতের প্রতিনিধি হয়ে বহন করে চলেছে মুক্তির পতাকা।
ছাত্র ইউনিয়ন সব সময় ছিল এবং আজও রয়েছে ছাত্রসমাজেরই সংগঠনরূপে। ছাত্রসমাজের প্রকৃত স্বার্থ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, স্বপ্ন-সাধ অবলম্বন করেই ছাত্র ইউনিয়নের ভিত্তি রচিত। তাই শিক্ষার দাবিতে, উন্নত একাডেমিক পরিবেশের জন্য, উপযুক্ত শিক্ষানীতি রচনার জন্য, ছাত্র হিসেবে সমাজের কাছে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য ও সমাজের প্রতি ছাত্রসমাজের দায়িত্ববোধ সৃষ্টির জন্য ছাত্র ইউনিয়ন সব সময় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছে। হোস্টেলের পাতলা ডাল ঘন করতে হবে, টয়লেটের ভাঙা দরজা মেরামত করতে হবে, সিলেবাসকে জাতীয় প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে মিলিয়ে সুবিন্যস্ত করতে হবে, পরীক্ষাপদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে, নকলের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে—ছোট-বড় এসব প্রশ্ন সব সময়ই থেকেছে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু।
এসব কারণে ছাত্র ইউনিয়ন থাকতে পেরেছে ছাত্রসমাজের নিজস্ব স্বাধীন সংগঠন হয়ে। তাকে কখনোই রাজনৈতিক কোনো দলের অঙ্গসংগঠন হতে হয়নি অথবা কোনো রাজনৈতিক দল অথবা মতাদর্শের অনুষঙ্গ হয়ে থাকাটাকে তার উদ্দেশ্য করতে হয়নি।
ছাত্রসমাজের মৌলিক স্বার্থগুলো পূরণ করার পথে প্রচলিত সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বিধিব্যবস্থাগুলো যে প্রতিবন্ধক, সেই উপলব্ধি ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্মলগ্ন থেকেই ব্যক্ত করেছে। এই উপলব্ধি থেকেই জাতীয় ঘটনাপ্রবাহে, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, শোষণমুক্তির সংগ্রামে, সমাজতন্ত্র ও মেহনতি মানুষের পক্ষে অবস্থান গ্রহণে রচিত হয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা। ছাত্রসমাজের মধ্যে রক্ষণশীলতা, কূপমণ্ডূকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, সুবিধাবাদ, ক্যারিয়ারিজম প্রভৃতি প্রবণতার বিরুদ্ধে র্যাডিক্যাল বাম ধারার বিপ্লবী প্রেরণাকে সব সময় ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে ছাত্র ইউনিয়ন। এই মৌলিক বৈশিষ্ট্য অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি আকর্ষণ করেছে ছাত্রসমাজের একটি প্রধান অংশকে। ব্যতিক্রম ঘটেছে কেবল তখনই, যখন ক্ষমতাসীনদের মদদে জাতীয় ক্ষেত্রের পাশাপাশি ছাত্রসমাজের মধ্যে সুবিধাবাদ, ক্যারিয়ারিজম ইত্যাদি অবক্ষয়ের ধারা প্রবল হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে, কিংবা যখন ছাত্র ইউনিয়ন তার ঐতিহ্যমণ্ডিত র্যাডিক্যাল বিপ্লবী ধারা অগ্রসর করতে দ্বিধা-দুর্বলতা দেখিয়েছে।
শিক্ষার দাবিতে, স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতা-সন্ত্রাস-সাম্রাজ্যবাদ-লুটপাটতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, সর্বোপরি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়নের অগণিত নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন, জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মোৎসর্গের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখেছে ছাত্র ইউনিয়ন।
ছাত্র ইউনিয়ন ঐতিহ্যগতভাবেই হয়ে উঠতে পেরেছে মননশীলতা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক ফলবান ক্ষেত্র। যারা গভীর চিন্তা করে, মেধাবী, বই পড়ে, ভালো বিতর্ক করে, গান গায়, আবৃত্তি করে, নাটক করে, যারা সত্, ত্যাগী, সাহসী, গরিবের দুঃখ দেখলে যাদের মন কাঁদে, যারা দুনিয়ায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক খবর রাখে—তারা সবাই সাধারণভাবে ছাত্র ইউনিয়ন করে। ‘বিপ্লবের আবেগ’ শুধু নয়, উচ্ছ্বাসমুক্ত গভীর বাস্তব বিশ্লেষণ ও যুক্তি-চিন্তার পথ ধরেই গড়ে উঠেছে ছাত্র ইউনিয়নের বিপ্লবী ঐতিহ্যধারা।
তার বিপ্লবী ধারা সুদৃঢ়ভাবে অগ্রসর করার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন আশু সংস্কারমূলক কোনো কাজকে কখনোই অবহেলা করেনি। বরং ত্রাণের কাজ, দাঙ্গা প্রতিরোধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সব সময়ই ছাত্র ইউনিয়ন থেকেছে অগ্রবর্তী।
চেতনার যে দীপ্ত মশাল, ব্যাপক ও বহুমুখী কর্মযজ্ঞের যে ঐতিহ্য-অভিজ্ঞতা গত ৫৮ বছর গৌরবের সঙ্গে সমুজ্জ্বল রেখেছে ছাত্র ইউনিয়ন, তা চির-অম্লান, চিরঞ্জীব। প্রায় ছয় দশক ধরে গড়ে ওঠা ঐতিহ্য ও ধারাকে শুধু টিকিয়ে রাখাই নয়, তাকে আরও বিকশিত করেই এগিয়ে যাওয়ার পথ রচনা করতে হবে। আজকের দিনের ছাত্রসমাজের চাহিদা ও তাগিদ এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক বাস্তবতার চলমান বিকাশধারাকে বিবেচনায় নিয়েই সেই পথ রচনা করতে হবে।
ছাত্র ইউনিয়নের প্রগতিশীল বিপ্লবী চেতনা ঐতিহ্যের ধারাকে পরিত্যাগ নয়, কঠিন ও জটিল বাস্তবতার মুখেও তা আরও বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান প্রজন্মের সাথিদের হয়ে উঠতে হবে আরও দক্ষ। সৃজনশীলতা আর মননশীলতার ছাপ রাখতে হবে নিত্যদিনের চিন্তায় ও কর্মে। আদর্শ ও ঐতিহ্যের মশাল বহন করে এগিয়ে যেতে হবে নব নব বিজয়ের পথে। বিজয় আসবেই একদিন। ‘আমরা করব জয়, নিশ্চয়ই!’ কারণ ছাত্র ইউনিয়ন এক অজেয় চিরঞ্জীব চেতনা।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
No comments