মানুষের মুখ-চান মিয়া বদলে দিতে চান by রমেশ কুমার
জীবিকার প্রয়োজনে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ যা করে, তা করতে কারোরই ভালো লাগে না। তবু করতে হয়। সকাল থেকে রাত-দিন, মাস-বছর, যৌবন থেকে মৃত্যু অবধি। তা থেকেই মানুষ খুঁজে পায় সুখ বা দুঃখ।চান মিয়াও সেই রকম একজন মানুষ। অনেক কষ্ট নিয়ে জীবনটা বয়ে চলেছেন। সুখ খুঁজে ফেরেন কবিতার মধ্যে। জীবনের সুখ-দুঃখগুলোকে যেন কবিতার সুতোয় বাঁধতে চান তিনি। বদলে দিতে চান চারপাশের অসংগতিগুলো।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলা সদরের কোলাহলপূর্ণ বাসস্টপেজ থেকে নরসুন্দা নদীর পাড় দিয়ে বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের গা ঘেঁষে যে এক চিলতে রাস্তা নান্দাইল পুরান বাজারের দিকে চলে গেছে, সেই ধূলি-ধূসর রাস্তার এক কোণে জীবিকার পসরা সাজিয়ে বসেন চান মিয়া। তিনি মূলত একজন সূচিশিল্পী। এই মফস্বল শহরে গর্ব করার মতো পেশা নয় সেটি। নানা রঙের সুতো দিয়ে সুচের সাহায্যে সাদা কাপড়ের জমিনে নিজের অন্তরের ভেতর থেকে আসা কষ্টকথার কয়েক ছত্র তুলে ধরেন। সেই কষ্টকথার ছত্রে কারও চোখ পড়লে কিনে নেন সেই ক্যানভাস। ক্রেতার বাড়ির কোনো অংশে টাঙানো চান মিয়ার কষ্টকথার ছত্রে হয়তো কেউ খুঁজে ফেরেন হারানো কোনো কিছু। অবসর সময়ে চান মিয়া কলম নিয়ে ডায়েরিতে মনোনিবেশ করেন। কষ্টের মধ্যে খুঁজে ফেরেন সুখ, নাকি কবিতা! চান মিয়া বলেন, ‘কবিতা লেখেন বড় কবিরা। তিনারা নমস্য ব্যক্তি। আমার লেখাগুলো কবিতা হয় কি না জানি না। তবে লিখলে মনটা হালকা লাগে। লেখাগুলোকে সন্তানের মতো মনে হয়।’ তাঁর কিছু লেখা আবার পরামর্শমূলক।
যেমন—‘শিক্ষা জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ শিক্ষা প্রয়োজন/ ছেলে মেয়ে সবাই পড়ো সুযোগ পেয়েছ এখন; শিক্ষা নাই যার চক্ষু থাকতে অন্ধ জীবন তার/ শিক্ষার জন্য সহায়তা করতেছেন সরকার।’ ডায়েরির আরেক পাতায় লিখেছেন, ‘আমি আম্মার একটি ছেলে এ ধরায় আসি/ মা যে আমার প্রাণের প্রিয় মাকে ভালোবাসি; আমার মায়ের চরণতলে আছে আমার জান্নাত/ মায়ের যতনে আমার হয় সোনার অঙ্গ হাত।’
এ রকম অনেক লেখা ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন তিনি। সমাজ, সংসার, পরিবার ও রাজনীতির শাশ্বত রূপ ফুটে উঠেছে তাঁর লেখাগুলোয়।
চান মিয়ার আসল নাম আবুল কালাম আকন্দ। বয়স ৫৫। বাবা আদর করে ডাকতেন চান মিয়া। সেই নামটাই এখন স্থায়ী হয়েছে। এমব্রয়ডারি সূচিশিল্পী চান মিয়ার বাড়ি নান্দাইল উপজেলার সীমান্তবর্তী ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বেহত্তরী গ্রামে। ছয় বোনের একমাত্র ভাই, তাই আদরে আদরে বড় হয়ে উঠছিলেন। বাড়ির কাছের বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হয়েছিলেন কুমারুলি উচ্চবিদ্যালয়ে। লেখাপড়ায় প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কশাঘাতে তা আর হয়ে ওঠেনি। সহায়সম্বল বলতে বাড়ির ভিটেটুকুই।
কষ্টের কথা জিজ্ঞেস করলে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে চান মিয়া বললেন, ‘লেখাপড়া করতে পারি নাই। দরিদ্রতার সাথে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে এক ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সামনে দিয়ে বই হাতে যখন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যায়, মনটা তখন মোচড় দিয়ে ওঠে। সান্ত্বনা খুঁজি ডায়েরিতে এটা-সেটা লিখে। সেই লেখাগুলো কবিতা কি না জানি না। তবে সেগুলো পড়লে মনটা হালকা হয়ে যায়।’ জীবিকার তাগিদে প্রথম দিকে তিনি মুরগির ব্যবসা করতেন। প্রতারণার কারণে ব্যবসায় মার খান। চান মিয়া বলেন, সেই প্রতারক এখন ঢাকায় মুরগির বড় ব্যবসায়ী। আর আমি রাস্তায় সূচিকর্ম বিক্রি করছি।
বছর দশেক আগে জামালপুরের এক ব্যক্তির কাছ থেকে এই বিশেষ ধরনের সুঁই বানানো ও ডিজাইন করা শেখেন। ২০ থেকে ২৫ রকমের নকশা বিভিন্ন কাপড়ে বর্ণিল সুতোয় ফুটিয়ে তোলেন। পাশাপাশি তাঁর নিজের লেখা কবিতার কয়েকটি লাইন কাপড়ের জমিনে ফুটিয়ে দেন। শৌখিন মানুষের ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ঝোলানো থাকে। রঙিন লাছি সুতাও বিক্রি করেন। স্কুল-কলেজের মেয়েরা এর প্রধান ক্রেতা। এগুলো বিক্রি করে মাসে তাঁর আয় হয় তিন-চার হাজার টাকা। তাঁর চার ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে শ্রমজীবী। আর মেজো ছেলে দরিদ্রতার জন্যই তাঁকে ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে বলে চোখ মোছেন। তৃতীয়জন রাজমিস্ত্রি। চান মিয়া বলেন, নিজে লেখাপড়া করতে পারিনি, কিন্তু ছোট ছেলে এবং একমাত্র মেয়েটিকে তিনি লেখাপড়া শেখাবেন। সময় পেলেই তিনি বিভিন্ন লেখকের প্রচুর বই পড়েন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়েন। আলাপচারিতার সময় তাঁর নিজের লেখা কয়েকটি কবিতা পড়ে শোনান। এ সময় তাঁর দুচোখে জলের ধারা। চোখ মুছে বলেন, ‘জানেন, বৃষ্টির পানিতে ভিজে আমার অনেক লেখা নষ্ট হয়ে গেছে। দুঃখ একটাই—আমি যখন থাকব না, তখন এসব লেখার কী হবে। কারও কাছে এসবের দাম হয়তো নেই। কিন্তু এসব লেখায় কেউ যখন সুখ খুঁজে পায়, তখন আমার কিছু না কিছু মূল্য তো অবশ্যই আছে। যত দিন বাঁচব, লিখে যাব।’
যেমন—‘শিক্ষা জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ শিক্ষা প্রয়োজন/ ছেলে মেয়ে সবাই পড়ো সুযোগ পেয়েছ এখন; শিক্ষা নাই যার চক্ষু থাকতে অন্ধ জীবন তার/ শিক্ষার জন্য সহায়তা করতেছেন সরকার।’ ডায়েরির আরেক পাতায় লিখেছেন, ‘আমি আম্মার একটি ছেলে এ ধরায় আসি/ মা যে আমার প্রাণের প্রিয় মাকে ভালোবাসি; আমার মায়ের চরণতলে আছে আমার জান্নাত/ মায়ের যতনে আমার হয় সোনার অঙ্গ হাত।’
এ রকম অনেক লেখা ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন তিনি। সমাজ, সংসার, পরিবার ও রাজনীতির শাশ্বত রূপ ফুটে উঠেছে তাঁর লেখাগুলোয়।
চান মিয়ার আসল নাম আবুল কালাম আকন্দ। বয়স ৫৫। বাবা আদর করে ডাকতেন চান মিয়া। সেই নামটাই এখন স্থায়ী হয়েছে। এমব্রয়ডারি সূচিশিল্পী চান মিয়ার বাড়ি নান্দাইল উপজেলার সীমান্তবর্তী ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বেহত্তরী গ্রামে। ছয় বোনের একমাত্র ভাই, তাই আদরে আদরে বড় হয়ে উঠছিলেন। বাড়ির কাছের বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হয়েছিলেন কুমারুলি উচ্চবিদ্যালয়ে। লেখাপড়ায় প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কশাঘাতে তা আর হয়ে ওঠেনি। সহায়সম্বল বলতে বাড়ির ভিটেটুকুই।
কষ্টের কথা জিজ্ঞেস করলে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে চান মিয়া বললেন, ‘লেখাপড়া করতে পারি নাই। দরিদ্রতার সাথে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে এক ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সামনে দিয়ে বই হাতে যখন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যায়, মনটা তখন মোচড় দিয়ে ওঠে। সান্ত্বনা খুঁজি ডায়েরিতে এটা-সেটা লিখে। সেই লেখাগুলো কবিতা কি না জানি না। তবে সেগুলো পড়লে মনটা হালকা হয়ে যায়।’ জীবিকার তাগিদে প্রথম দিকে তিনি মুরগির ব্যবসা করতেন। প্রতারণার কারণে ব্যবসায় মার খান। চান মিয়া বলেন, সেই প্রতারক এখন ঢাকায় মুরগির বড় ব্যবসায়ী। আর আমি রাস্তায় সূচিকর্ম বিক্রি করছি।
বছর দশেক আগে জামালপুরের এক ব্যক্তির কাছ থেকে এই বিশেষ ধরনের সুঁই বানানো ও ডিজাইন করা শেখেন। ২০ থেকে ২৫ রকমের নকশা বিভিন্ন কাপড়ে বর্ণিল সুতোয় ফুটিয়ে তোলেন। পাশাপাশি তাঁর নিজের লেখা কবিতার কয়েকটি লাইন কাপড়ের জমিনে ফুটিয়ে দেন। শৌখিন মানুষের ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ঝোলানো থাকে। রঙিন লাছি সুতাও বিক্রি করেন। স্কুল-কলেজের মেয়েরা এর প্রধান ক্রেতা। এগুলো বিক্রি করে মাসে তাঁর আয় হয় তিন-চার হাজার টাকা। তাঁর চার ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে শ্রমজীবী। আর মেজো ছেলে দরিদ্রতার জন্যই তাঁকে ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে বলে চোখ মোছেন। তৃতীয়জন রাজমিস্ত্রি। চান মিয়া বলেন, নিজে লেখাপড়া করতে পারিনি, কিন্তু ছোট ছেলে এবং একমাত্র মেয়েটিকে তিনি লেখাপড়া শেখাবেন। সময় পেলেই তিনি বিভিন্ন লেখকের প্রচুর বই পড়েন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়েন। আলাপচারিতার সময় তাঁর নিজের লেখা কয়েকটি কবিতা পড়ে শোনান। এ সময় তাঁর দুচোখে জলের ধারা। চোখ মুছে বলেন, ‘জানেন, বৃষ্টির পানিতে ভিজে আমার অনেক লেখা নষ্ট হয়ে গেছে। দুঃখ একটাই—আমি যখন থাকব না, তখন এসব লেখার কী হবে। কারও কাছে এসবের দাম হয়তো নেই। কিন্তু এসব লেখায় কেউ যখন সুখ খুঁজে পায়, তখন আমার কিছু না কিছু মূল্য তো অবশ্যই আছে। যত দিন বাঁচব, লিখে যাব।’
No comments