ফিদা হুসেনের অশেষ জীবন by সুভাষ সাহা

তার বড় সাধ ছিল স্বদেশের মাটিতে দৃপ্ত নাঙা পায়ে আবার ছড়ির মতো লম্বা তুলি ঘুরিয়ে পথচলার। কেউই জানেন না, জানতেও পারবেন না আর কোনো দিন যে, এই আগ্রহের কথা যখন বলছিলেন তখন তার চোখের সামনে জন্মস্থান মহারাষ্ট্রের সেই পান্দারপুরের স্মৃতি খেলা করছিল কি-না।


গত বছর এ কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন কাতারে তার সর্বশেষ কর্মঅবস্থান সম্পর্কে। ভারতবর্ষ এবং আরব ইতিহাসকে রঙ-তুলিতে মূর্ত করার দুরূহ প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছিলেন তিনি। এরপর কমেডি ছবি বানানোর ইচ্ছার কথাও জানাতে ভুললেন না। কী আশাবাদী মানুষ ছিলেন তিনি। তা না হলে শতকের ঘাড়ে এসে পড়া মানুষটি বিশ বছরের তারুণ্যে নিজেকে দুরন্ত কর্মের আবহে বাঁধতে চাইবার সাহস দেখাতে পারেন কী করে! একাধারে কবি, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক, কাহিনী ও চিত্রনাট্য রচয়িতার গুণ মিশেছিল যে মানুষটির মধ্যে সেই 'ভারতের পিকাসো' খ্যাত মকবুল ফিদা হুসেন ৯৫ বছর বয়সে লন্ডনের হাসপাতালে গতকাল বৃহস্পতিবার চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন।
শিল্পী জীবনের বৈচিত্র্যের সঙ্গে বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। তবে রঙ-তুলিতে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মূর্ত করে তোলায় তার জুড়ি মেলা ভার। এ জন্য তার সমালোচক থেকে সমর্থক পর্যন্ত সবাই তার চিত্রকর্মের সমঝদারে পরিণত হয়েছিলেন। তার জনপ্রিয়তা কতটা তুঙ্গে উঠেছিল তার প্রমাণ একটা সময়ে মাত্র কয়েক পয়সার বিনিময়ে তাকে তার আঁকা চিত্রকর্ম বিক্রি করতে হলেও কালক্রমে তার আঁকা এক একটি চিত্রকর্মই লাখ লাখ রুপিতে কেনার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণকারী মানুষটি কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিরকালের জন্য মাতৃস্নেহবঞ্চিত হয়েছিলেন। তারপর মায়ের রূপকল্প খাড়া করতে তার আপ্রাণ চেষ্টার শুরু। সেই থেকে তার অসংখ্য নারীর চিত্রকর্মের মধ্যে মায়ের কল্পিত মুখখানি হয়তো অবয়ব খুঁজে পেত। কিন্তু তাতে শিল্পীর মানসলোকের অতৃপ্তি ঘুচত না। এই অতৃপ্তি তার জীবনের শেষ মুহূর্তেও ছিল। তার বাবারও ছিল চিত্রশিল্পের প্রতি ভালোবাসা। তারই প্রত্যক্ষ উৎসাহে ছবি আঁকা সেই ছোট বয়সেই নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, 'আমি সবসময় ছবি আঁকতাম। খেলার কোনো সময়ই ছিল না। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০-১২ ঘণ্টা ছবি এঁকেছি কোনো বিরতি ছাড়াই।' মায়ের মৃত্যু ছাড়াও শিল্পী জীবনে দীর্ঘ এক দুরূহ সময়ের হাত ধরেই তাকে বেয়াড়া তরুণীর মতো অনেকের তির্যক-বক্র দৃষ্টিকে ভ্রূকুটি হেনে তাকে আজকের নিজেই নিজের উপমা হওয়ার মতো বিশিষ্ট স্থানে আসীন হতে হয়েছে। তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'তখনও বিয়ে করিনি। ... হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য পোস্টার করতাম। দৈনিক পেতাম ছয় পয়সা। পাঁচ পয়সা যেত খাবারে।'
টাইমসকে বলা তার নিজের সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন হলো এ রকম : 'আমি বছরের পর বছর ধরে অনেক কিছুই করেছি; কবিতা, চলচ্চিত্র, চিত্রকর্ম। এর একটা না একটা ক্লিক করবেই, এ বিশ্বাসটা আমার ছিল।'
কিন্তু প্রখ্যাত চিত্রকর ছাড়াও যে বিষয়টির জন্য তিনি বিতর্কিত চরিত্র হিসেবে ঠাঁই পেলেন তাহলো হিন্দু দেব-দেবীর উলঙ্গ ছবি এঁকে তিনি হিন্দু উগ্রবাদীদের কোপানলে পড়েছিলেন। উগ্রবাদীরা সে সময় তার ছবি প্রদর্শনী ভারতে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। তার প্রাণনাশের হুমকিও জারি করেছিল উগ্রবাদীরা। তার বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন আদালতে ১৯৯৬ সাল থেকে ৯ শতাধিক মামলা হয়েছিল। বিপুল অঙ্কের অর্থ তার মাথার দাম হাঁকা হয়েছিল। এভাবে ভারতে তার শিল্পী জীবন ও ব্যক্তিগত জীবন ভরে গেল নরক যন্ত্রণায়। সরকারি নিরাপত্তায় তার আস্থা ছিল না। পরে তিনি এ ব্যাপারে বলেছেন, ইন্দিরা গান্ধী ও তার পুত্র রাজীব গান্ধীকে সরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা যখন বাঁচিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয় তখন তার জীবন তারা রক্ষা করতে পারবেন কি-না সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান। এরপর ভারত ছেড়ে জীবন ও কর্মের নিরাপত্তার জন্য তিনি দুবাই-লল্ডন করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত কাতার সরকারের অনুরোধে সে দেশের নাগরিকত্ব নিলেন। যেহেতু ভারতীয় আইনে দ্বৈত নাগরিকত্ব বেআইনি, তাই তাকে ভারতের পাসপোর্টটি সমর্পণ করতেই হলো গত বছর। তবে তিনি যে শেষ পর্যন্ত একজন ভারতীয়ই থেকে যাবেন সে কথা জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে প্রকাশ করতে ভুলেননি।
হুসেনের রাজনীতিতে তেমন আগ্রহ ছিল না। তারপরও তাকে যখন ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের জন্য মনোনীত করা হয় তখন তিনি সানন্দে সে পদ গ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘ ছয় বছরের পার্লামেন্টারি জীবনে অধিবেশন চলার সময় সদস্যদের বাহাসসহ বিভিন্ন তৎপরতা তার রঙ-তুলিতে উঠে এসেছে তির্যকভাবে। তার নির্মিত গজগামিনী কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বিয়ার লাভ করেছিল।
তার হিন্দু দেব-দেবীকে নিয়ে চিত্রকর্ম সম্পর্কে একশ্রেণীর লোকের মধ্যে বিরূপ মনোভাবে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল, এটা কোনো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থেকেই করা হয়ে থাকবে। আর শিল্প নিয়ে রাজনীতি চললে বিষয়টি দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে চার্লি চ্যাপলিনকে ম্যাকার্থিজমের সময় আমেরিকা থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি। যারা প্রথাগত ও চিরাচরিত নিয়মকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন মকবুল ফিদা হুসেন তাদের বিরুদ্ধে। তিনি চিত্রশিল্পে নতুন ভাষা জোগান দানের অফুরন্ত উৎস হয়েই থাকবেন। আর সে ভাষার মর্মকথাই হলো পুরনো জীর্ণকে চুলোয় ঢুকিয়ে নতুনের কেতন উড়ানোর বাহন হলো শিল্প। আর শিল্প মননের বিষয় বলে সময়ের আগে চলে।
ভারতের পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত এই প্রখ্যাত শিল্পীর জীবন ও কর্ম সত্যিই পৃথিবীর ক্যানভাস ছাড়া অন্য কিছুতে ধারণা করা যাবে না। ফিদা হুসেনরা মরেন না, মরতে পারেন না। কারণ, তাহলে যে সভ্যতার চাকা থেমে যাবে!

সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.