১৬তম সার্ক সম্মেলন-সার্কের কাঠামোগত সংস্কার দরকার by ইমতিয়াজ আহমেদ
ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে শুরু হয়েছে ষোড়শ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। গণমাধ্যম ও বেসরকারি সূত্রে যত দূর জানা যাচ্ছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতা এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের মতো বিষয়ই এবারের সম্মেলনের মূল আলোচ্যসূচি। কিছুদিন আগে সার্ক চেম্বারগুলোর বৈঠক হলো কাঠমান্ডুতে।
বিশেষত, সাফটা চুক্তির পরও নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার (এনটিবি) শিথিল না হওয়ার বিষয়টি নিয়েই ব্যবসায়ীদের আগ্রহ। ছোট দেশের সঙ্গে বড় দেশের বাণিজ্য-ঘাটতি কমছে না। এই বাধা দূর করায় এনটিবি সরানো দরকার। পণ্যের মান যাচাই, যোগাযোগের সুগমতা, দুই দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বর্তমান ব্যবস্থা, স্টোর হাউস না থাকা ইত্যাদি বিষয় বাধা হয়ে আছে। ব্যবসায়ীদের ভিসাপ্রাপ্তিও সহজ করতে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি হয়নি। নিরাপত্তার প্রশ্নও জটিলতা তৈরি করে রেখেছে। অনেক সময় ভিসা না পাওয়ার জন্যও বাণিজ্যিক লেনদেনে সমস্যা হয়। এতে বরং চোরাকারবারিদেরই লাভ হয়। এর সঙ্গে জড়িত হয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিস্তার, ক্ষুদ্র অস্ত্র পাচার ইত্যাদি।
দিল্লি সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মনমোহন সিংয়ের মধ্যে সড়ক ও সমুদ্রে কানেকটিভিটির বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। এ ছাড়া দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও ঘোষণা এসেছিল। এর মূল ক্যাম্পাস হওয়ার কথা দিল্লিতে। এ ছাড়া আরও ক্যাম্পাস হওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তান বলছে, ভারতের পক্ষ থেকে ভিসার নিশ্চয়তা এবং শিক্ষার্থীদের অবাধ বিচরণের নিশ্চয়তা না পেলে তারা এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়। উদ্যোগটি এ পর্যায়ে থেমে আছে সচিবদের সমন্বয়ে গঠিত স্ট্যান্ডিং কমিটিতে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। উপমহাদেশের প্রতিটি দেশই জ্বালানি-ঘাটতির মধ্যে আছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুত্ আনার কথা হলেও ভারতের নিজেরই ঘাটতি রয়েছে। সার্ক সম্মেলনে সার্বিকভাবে আলোচনার সুযোগ হবে যে কীভাবে দক্ষিণ এশীয় পর্যায়ে এর সমাধান করা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে মালদ্বীপ সমুদ্রের গর্ভে আর নেপাল হিমালয়ের চূড়ায় মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক করে প্রতীকীভাবে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রশ্নটা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এ দেশে যে জলবায়ু উদ্বাস্তু সৃষ্টি হবে, তার চাপ কিন্তু ভারতের ওপরই পড়বে। ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বানিয়ে এই চাপ সামলানোর চিন্তা করেছে। কার্যত, এ ধরনের সমস্যা কাঁটাতার দিয়ে সামলানো যায় না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ব্যাপারে ভারতের যে অবস্থান, তার সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব রয়েছে। ভারত তার উন্নয়নের স্বার্থে এ বিষয়ে বেশি ছাড় দিতে রাজি নয়। এ বিষয়ে কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলনে ভারত ও চীনের মধ্যে সমঝোতা দেখা গেছে। এতে জলবায়ুর আরও ক্ষতি হবে সন্দেহ নেই। ছোট দেশগুলোর জন্য অল্প ক্ষতিও কিন্তু বড় ক্ষতি। নেপাল-বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের পক্ষে এ ক্ষতি সামলানো কঠিন। তাই এ বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যায়ে সমঝোতা প্রয়োজন। ক্লাইমেট তহবিল তৈরির সম্ভাবনাও রয়েছে।
ভারতের আরও জলবায়ুবান্ধব অবস্থান নেওয়ার জন্য সার্কভুক্ত ছোট দেশগুলোর চাপ থাকবে। কিন্তু সার্কের মূল সমস্যা হলো, সার্ক মতৈক্যের ভিত্তিতে চলে। মতৈক্য না হলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। সে বিচারে বাংলাদেশ মনে হয় না এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে, যাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়। সম্পর্ক ভালো করার মাধ্যমেই যতটা পাওয়া যায়, সেই দিকেই যাবে বাংলাদেশ। আমরা ভারতকে কতটা প্রভাবিত করতে পারব, সেটাই দেখার বিষয়। বাংলাদেশ চাইবে না কোনোভাবে ভারত ও চীনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একলা হয়ে যেতে।
টিপাইমুখে বাঁধ হলে বা বাংলাদেশ বিপর্যস্ত হলে ভারতের ওপরই জলবায়ু-উদ্বাস্তুদের চাপ বাড়বে। ফারাক্কার কারণেও কিন্তু পরিবেশ-উদ্বাস্তু তৈরি হয়েছে। ভারতের অনেকেই বলেন, ফারাক্কার কারণে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষদের একটা অংশ ভারতে চলে গেছে। সুতরাং ভারতের নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে হবে। বাংলাদেশের হাতে বেশ কিছু কার্ড রয়েছে। আমরা আশা করব, যে ধরনের কূটনৈতিক কৌশল নেওয়া প্রয়োজন, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার বাংলাদেশ করবে।
সন্ত্রাস দমনের ব্যাপারে বাংলাদেশের একটা উদ্যোগ থাকবেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন, রাষ্ট্রপতির স্ত্রীও মারা গেছেন সন্ত্রাসী হামলায়। সুতরাং এ বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ থাকবে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতা না হলে বাংলাদেশের বিশেষ কিছু করার নেই। ভারত মনে করছে, পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসী আসে। আর পাকিস্তান মনে করে, সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো ভারতেরই কাজ। বাংলাদেশকে দেখতে হবে প্রভাবশালী দেশ দুটোকে যাতে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যায়, যাতে সন্ত্রাস দমনে দক্ষিণ এশীয় টাস্কফোর্স গঠন, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, সন্ত্রাসীদের আদান-প্রদান বিষয়ে কার্যকর সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়। কার্যত, সন্ত্রাসের দ্বারা সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্বের কারণে সার্ক কাঠামোর মধ্যে এ রকম কিছু হতে আরও সময় লাগবে। তাই হয়তো দ্বিপক্ষীয় কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এ ব্যাপারে কিছু সমঝোতা আছে, ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কারও কিছু চুক্তি রয়েছে। কিন্তু এটা আসলে দ্বিপক্ষীয় নয়, বহুপক্ষীয় বিষয়। এক রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী আরেক রাষ্ট্রে কাজ করছে, এটা তিনটি দেশের মধ্যেই ঘটছে।
সার্কের বড় বিষয় হলো ব্যবসার বিষয়টা। আমাদের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনেক সময় আমলাতন্ত্র এমনকি রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে একটা ব্যবধান কাজ করে। বিষয়টা অনেকটা আমলাতান্ত্রিক হয়ে গেছে। এই ব্যবধান দূর করা দরকার। যেমন সম্মেলনের আগে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠক হওয়া দরকার ছিল। জাতীয় চেম্বার সভাপতিকে পদাধিকারবলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। চীনে কিন্তু তাই-ই হয়েছে। সার্কেরও একটা পরিকল্পনা কমিশন ও সার্ক চেম্বার থাকা দরকার। এর প্রধানদের মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মান দিতে হবে। তাহলে হয়তো সার্ক পর্যায়ে বাণিজ্যিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে। সার্ক চেম্বারের সভাপতির মর্যাদা ও গুরুত্ব না বাড়ানো হলে ব্যবসায়িক সহযোগিতা বাড়বে না।
আশির দশকে যে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় সার্ক চার্টার গৃহীত হয়েছিল, তার পর থেকে পরিস্থিতি এখন অনেক বদলেছে। সে সময় বিশ্বায়ন অনেক প্রাথমিক অবস্থায় ছিল। এখন প্রয়োজন বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সার্ক কাঠামোর সংস্কার করা। তাতে করে সবার সাধারণ সমস্যাগুলো আমরা একত্রে মোকাবিলা করতে পারব। পাশাপাশি সার্কের কার্যক্রম গুরুত্ববহ করে তুলতে হলে সার্কের সেক্রেটারি জেনারেলের মর্যাদা প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে অবসর নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের মধ্য থেকেও জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচন করা যায়। এ আলোচনাগুলো এখন থেকেই তুলতে হবে। এসব বাস্তবতায় সার্কের কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।
আমি মনে করি না, বড় রাষ্ট্র ছোট রাষ্ট্র সমস্যার কারণে সার্ক কার্যকর হচ্ছে না, তা নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আসিয়ানেও তো বড় রাষ্ট্র ছোট রাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করছে। আমাদের এখানে সমস্যা হলো পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দূরত্ব। এখানে দেখা দরকার, একটা বড় দেশ ভাগ হয়ে তিনটা দেশ হয়েছে। সেই পথে ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় বিপুল প্রাণহানি হয়েছে। এক দেশের মানুষ আরেক দেশে দেশান্তরিত হয়েছে। এসব ঐতিহাসিক কারণে আমার মনে হয়, সার্ক দেশগুলোর মধ্যে কার্যকর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে। আরেকটি বাধা হলো সবাই যার যার রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশ্বায়নের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চেয়ে বহুপক্ষীয় সম্পর্কই বেশি ফলদায়ক। আজকের বাস্তবতায় এই মনোভঙ্গি বদলাতে হবে। এ রকম একটা চিন্তা থেকেই পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়ানোর প্রয়োজনে সার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব এসেছিল। যত দিন এই মনোভাব না বদলাবে, তত দিন দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের ব্যাপারে সার্ক অর্থবহ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হবে। এই কাজে সরকার, গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী সমাজ—সবারই সচেষ্ট হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দিল্লি সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মনমোহন সিংয়ের মধ্যে সড়ক ও সমুদ্রে কানেকটিভিটির বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। এ ছাড়া দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও ঘোষণা এসেছিল। এর মূল ক্যাম্পাস হওয়ার কথা দিল্লিতে। এ ছাড়া আরও ক্যাম্পাস হওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তান বলছে, ভারতের পক্ষ থেকে ভিসার নিশ্চয়তা এবং শিক্ষার্থীদের অবাধ বিচরণের নিশ্চয়তা না পেলে তারা এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়। উদ্যোগটি এ পর্যায়ে থেমে আছে সচিবদের সমন্বয়ে গঠিত স্ট্যান্ডিং কমিটিতে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। উপমহাদেশের প্রতিটি দেশই জ্বালানি-ঘাটতির মধ্যে আছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুত্ আনার কথা হলেও ভারতের নিজেরই ঘাটতি রয়েছে। সার্ক সম্মেলনে সার্বিকভাবে আলোচনার সুযোগ হবে যে কীভাবে দক্ষিণ এশীয় পর্যায়ে এর সমাধান করা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে মালদ্বীপ সমুদ্রের গর্ভে আর নেপাল হিমালয়ের চূড়ায় মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক করে প্রতীকীভাবে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রশ্নটা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এ দেশে যে জলবায়ু উদ্বাস্তু সৃষ্টি হবে, তার চাপ কিন্তু ভারতের ওপরই পড়বে। ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বানিয়ে এই চাপ সামলানোর চিন্তা করেছে। কার্যত, এ ধরনের সমস্যা কাঁটাতার দিয়ে সামলানো যায় না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ব্যাপারে ভারতের যে অবস্থান, তার সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব রয়েছে। ভারত তার উন্নয়নের স্বার্থে এ বিষয়ে বেশি ছাড় দিতে রাজি নয়। এ বিষয়ে কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলনে ভারত ও চীনের মধ্যে সমঝোতা দেখা গেছে। এতে জলবায়ুর আরও ক্ষতি হবে সন্দেহ নেই। ছোট দেশগুলোর জন্য অল্প ক্ষতিও কিন্তু বড় ক্ষতি। নেপাল-বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের পক্ষে এ ক্ষতি সামলানো কঠিন। তাই এ বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যায়ে সমঝোতা প্রয়োজন। ক্লাইমেট তহবিল তৈরির সম্ভাবনাও রয়েছে।
ভারতের আরও জলবায়ুবান্ধব অবস্থান নেওয়ার জন্য সার্কভুক্ত ছোট দেশগুলোর চাপ থাকবে। কিন্তু সার্কের মূল সমস্যা হলো, সার্ক মতৈক্যের ভিত্তিতে চলে। মতৈক্য না হলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। সে বিচারে বাংলাদেশ মনে হয় না এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে, যাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়। সম্পর্ক ভালো করার মাধ্যমেই যতটা পাওয়া যায়, সেই দিকেই যাবে বাংলাদেশ। আমরা ভারতকে কতটা প্রভাবিত করতে পারব, সেটাই দেখার বিষয়। বাংলাদেশ চাইবে না কোনোভাবে ভারত ও চীনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একলা হয়ে যেতে।
টিপাইমুখে বাঁধ হলে বা বাংলাদেশ বিপর্যস্ত হলে ভারতের ওপরই জলবায়ু-উদ্বাস্তুদের চাপ বাড়বে। ফারাক্কার কারণেও কিন্তু পরিবেশ-উদ্বাস্তু তৈরি হয়েছে। ভারতের অনেকেই বলেন, ফারাক্কার কারণে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষদের একটা অংশ ভারতে চলে গেছে। সুতরাং ভারতের নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে হবে। বাংলাদেশের হাতে বেশ কিছু কার্ড রয়েছে। আমরা আশা করব, যে ধরনের কূটনৈতিক কৌশল নেওয়া প্রয়োজন, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার বাংলাদেশ করবে।
সন্ত্রাস দমনের ব্যাপারে বাংলাদেশের একটা উদ্যোগ থাকবেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন, রাষ্ট্রপতির স্ত্রীও মারা গেছেন সন্ত্রাসী হামলায়। সুতরাং এ বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ থাকবে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতা না হলে বাংলাদেশের বিশেষ কিছু করার নেই। ভারত মনে করছে, পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসী আসে। আর পাকিস্তান মনে করে, সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো ভারতেরই কাজ। বাংলাদেশকে দেখতে হবে প্রভাবশালী দেশ দুটোকে যাতে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যায়, যাতে সন্ত্রাস দমনে দক্ষিণ এশীয় টাস্কফোর্স গঠন, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, সন্ত্রাসীদের আদান-প্রদান বিষয়ে কার্যকর সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়। কার্যত, সন্ত্রাসের দ্বারা সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্বের কারণে সার্ক কাঠামোর মধ্যে এ রকম কিছু হতে আরও সময় লাগবে। তাই হয়তো দ্বিপক্ষীয় কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এ ব্যাপারে কিছু সমঝোতা আছে, ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কারও কিছু চুক্তি রয়েছে। কিন্তু এটা আসলে দ্বিপক্ষীয় নয়, বহুপক্ষীয় বিষয়। এক রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী আরেক রাষ্ট্রে কাজ করছে, এটা তিনটি দেশের মধ্যেই ঘটছে।
সার্কের বড় বিষয় হলো ব্যবসার বিষয়টা। আমাদের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনেক সময় আমলাতন্ত্র এমনকি রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে একটা ব্যবধান কাজ করে। বিষয়টা অনেকটা আমলাতান্ত্রিক হয়ে গেছে। এই ব্যবধান দূর করা দরকার। যেমন সম্মেলনের আগে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠক হওয়া দরকার ছিল। জাতীয় চেম্বার সভাপতিকে পদাধিকারবলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। চীনে কিন্তু তাই-ই হয়েছে। সার্কেরও একটা পরিকল্পনা কমিশন ও সার্ক চেম্বার থাকা দরকার। এর প্রধানদের মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মান দিতে হবে। তাহলে হয়তো সার্ক পর্যায়ে বাণিজ্যিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে। সার্ক চেম্বারের সভাপতির মর্যাদা ও গুরুত্ব না বাড়ানো হলে ব্যবসায়িক সহযোগিতা বাড়বে না।
আশির দশকে যে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় সার্ক চার্টার গৃহীত হয়েছিল, তার পর থেকে পরিস্থিতি এখন অনেক বদলেছে। সে সময় বিশ্বায়ন অনেক প্রাথমিক অবস্থায় ছিল। এখন প্রয়োজন বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সার্ক কাঠামোর সংস্কার করা। তাতে করে সবার সাধারণ সমস্যাগুলো আমরা একত্রে মোকাবিলা করতে পারব। পাশাপাশি সার্কের কার্যক্রম গুরুত্ববহ করে তুলতে হলে সার্কের সেক্রেটারি জেনারেলের মর্যাদা প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে অবসর নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের মধ্য থেকেও জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচন করা যায়। এ আলোচনাগুলো এখন থেকেই তুলতে হবে। এসব বাস্তবতায় সার্কের কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।
আমি মনে করি না, বড় রাষ্ট্র ছোট রাষ্ট্র সমস্যার কারণে সার্ক কার্যকর হচ্ছে না, তা নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আসিয়ানেও তো বড় রাষ্ট্র ছোট রাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করছে। আমাদের এখানে সমস্যা হলো পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দূরত্ব। এখানে দেখা দরকার, একটা বড় দেশ ভাগ হয়ে তিনটা দেশ হয়েছে। সেই পথে ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় বিপুল প্রাণহানি হয়েছে। এক দেশের মানুষ আরেক দেশে দেশান্তরিত হয়েছে। এসব ঐতিহাসিক কারণে আমার মনে হয়, সার্ক দেশগুলোর মধ্যে কার্যকর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে। আরেকটি বাধা হলো সবাই যার যার রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশ্বায়নের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চেয়ে বহুপক্ষীয় সম্পর্কই বেশি ফলদায়ক। আজকের বাস্তবতায় এই মনোভঙ্গি বদলাতে হবে। এ রকম একটা চিন্তা থেকেই পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়ানোর প্রয়োজনে সার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব এসেছিল। যত দিন এই মনোভাব না বদলাবে, তত দিন দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের ব্যাপারে সার্ক অর্থবহ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হবে। এই কাজে সরকার, গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী সমাজ—সবারই সচেষ্ট হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments