চারদিক-লেমিনেটিং করা একটি চিঠি by সুজন হাজারী

কয়েক দিন আগে পাঁচবিবির এক শহীদপরিবারের সন্তান আমাকে তাঁর বাবার শহীদ হওয়ার কথা জানালেন। আরও জানালেন শহীদের স্ত্রী ও বড় ভাই। এই শহীদপরিবারটি ৩৭ বছর ধরে আগলে রেখেছে একটি চিঠি। চিঠি না বলে অনুদানপত্র বলা চলে।


চিঠিটি ১৯৭৩ সালে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব প্যাডে শেখ মুজিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে শহীদের স্ত্রীকে দুই হাজার টাকার অনুদান দেওয়ার কথা লেখা আছে। সেই শহীদের স্ত্রী বা পরিবার বঙ্গবন্ধুর দেওয়া অনুদান আজও পায়নি।
তখন যে অনুদান পায়নি, আজও যে পাবে না—সে ভাবনা তাদের (গোটা পরিবার) মনে এখনো ঠাঁই পায়নি। অগাধ বিশ্বাস নিয়ে আজও সে চিঠি অতি যত্নে আগলে রেখেছে তারা। কারণ, এ চিঠি স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঠানো। এই চিঠি ইতিহাসের সাক্ষী। এর মূল্যায়ন কোনো না কোনো সময় হবেই হবে—এই দৃঢ়বিশ্বাসে চিঠিটি লেমিনেটিং করে রেখেছে শহীদপরিবারটি।
শহীদের স্ত্রী রাধা রানী জানালেন, চিঠি এসেছিল তাঁর নামে। পত্র নং পত্রাক-৬/৪/৭২ সিডি/২১৩১ তাং ১৮/১২। এ চিঠির বাঁ পাশে ওপরে লেখা আছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’। ডান পাশে ‘শেখ মুজিবুর রহমান’, পত্রাংশের নিচে শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে স্বাক্ষর। এ পত্রে তাঁর নামে অনুদানকৃত চেক নং-সিএ ০২০১৮৯-তে দুই হাজার টাকা বরাদ্দ, যা মহকুমার প্রশাসকের কাছ থেকে তুলে নিতে বলা হয়েছিল। সেই সময় রাধা রানী সন্তানদের নিয়ে অভিভাবক ভাশুর (স্বামীর বড় ভাই) ভগবত্ প্রসাদ গুপ্তের একান্তবর্তী পরিবারভুক্ত ছিলেন। রাধা রানী বললেন, ‘সেই চেকের টাকা তোলার জন্য ভাশুরকে লিখিতভাবে ক্ষমতা প্রদান করে দায়িত্ব দিই। আমার নাম রাধা রানী, কিন্তু চিঠি ও চেক এসেছিল রাবো দেবী নামে। নামের ত্রুটির কারণে মহকুমার প্রশাসক আমার ভাশুরকে চেক প্রদান করেননি।’ এই চেকের ব্যাপারে ভগবত্ প্রসাদ জানান, ‘রাধা রানী আমার ভ্রাতৃবধূ ও ছোট শ্যালিকা। তার স্বামী ফিরে আসবে—এ আশায় সে তখনো সিঁথিতে সিঁদুর ব্যবহার করত। টাকা তোলার জন্য রাধা রানীকে মহকুমা প্রশাসকের সামনে উপস্থিত করতে হবে। টাকা মাত্র দুই হাজার। টাকা নিলে ভাইয়ের মৃত্যু নিশ্চিতভাবে মেনে নিতে হবে। ভ্রাতৃবধূর মাথার সিঁদুর মুছে যাবে। ভাইয়ের মৃত্যুকে স্বীকার করে নিতে মন থেকে সাড়া পাইনি। এসব ভেবেচিন্তে তখন আর টাকা তোলা হয়নি। সে সময় এসডিও ছিলেন আবদুস সাত্তার ও রিলিফ অফিসার ছিলেন খয়বর আলী নামের এক ব্যক্তি।’ স্বামীর শহীদ হওয়া সম্পর্কে রাধা রানী বলেন, ‘১৯৭১ সালে মার্চের সম্ভবত ১/২ তারিখে তাঁর স্বামী পুরুষোত্তম প্রসাদ গুপ্ত ব্যবসায়িক কাজে চট্টগ্রামে যান। চট্টগ্রামের কুরবানীগঞ্জ নর্দান ট্রেডার্সের মালিক সুখচান আগরওয়ালার আড়তঘরে তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন। সুখচান আগরওয়ালা ছিলেন মূলত আমাদের বগুড়া জেলার সান্তাহারের ব্যবসায়ী। চট্টগ্রামের কুরবানীগঞ্জে তাঁর আড়ত ছিল। আমার স্বামীর সঙ্গে ছিলেন দিনাজপুরের আরেক ব্যবসায়ী অনীল কুন্ডু। আমার বাবার বাড়ি দিনাজপুর। আমার ভাই সীতারাম প্রসাদ গুপ্তের সঙ্গে রমেন বাবুর ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। পরবর্তী সময়ে রমেন বাবুই আমার ভাইকে জানিয়েছিলেন, সুখচান আগরওয়ালার গদিঘরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘেরাও করে ২৫ জন ব্যবসায়ীকে সেদিন ধরে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেদিন তিনিও ওই দলে ছিলেন। বাথরুমে লুকিয়ে থাকায় হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে পরে পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন। হানাদাররা যাঁদের ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার মধ্যে আমার স্বামী (পুরুষোত্তম) ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি তখন মালদহে ছিলাম। সে সময় বগুড়ার ব্যবসায়ী সীতারাম আমাকে জানিয়েছিলেন আমার স্বামীর মৃত্যুর কথা। তিনি অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, আমার স্বামী পুরুষোত্তমসহ যে ২৫ জনকে সুখচান আগরওয়ালার গদিঘর থেকে হানাদাররা আটক করেছিল, সমুদ্রতীরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে নির্বিচারে তাঁদের হত্যা করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।’
স্বাধীনতার পর ভাইয়ের খোঁজখবর নেওয়া হয়েছিল কি না, এ ব্যাপারে ভগবত্ প্রসাদ গুপ্ত জানান, ‘ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানদের লালনপালন করেছি। দীর্ঘদিন এক অন্নে ছিলাম। ভাইয়ের ছেলেরা ও আমার ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে এক বাড়িতে বসবাসের সমস্যার সৃষ্টি হয়। একসময় ভাইবউ তাঁর ছেলেদের নিয়ে পৃথক হয়। রাধা রানী আরও জানান, একাত্তরে তাঁর বড় ছেলে স্বপনের বয়স ছিল চার বছর, দ্বিতীয় ছেলের বয়স দুই বছর, আর তৃতীয় সন্তানটি সে সময় ছিল গর্ভে। সন্তানেরা কেউ এসএসসি পাস করেনি। এসএসসির পর আর লেখাপড়ায় এগোতে পারেনি। এখন পরিবারে মোট ১১ জন পোষ্য। বড় ছেলে ও মেজো ছেলে হাটুরে দোকানদার, ছোট ছেলে ভাশুরের দোকানে কাজ করে। এখন চারটি নাতি-নাতনি। ছেলেদের যৎসামান্য আয় দিয়ে খাওয়াপরা, নাতি-নাতনিদের লেখাপড়ার খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে।’ রাধা রানী শহীদ স্বামীর নামে সরকারি অনুদানের সম্মানজনক সাহায্য-সহযোগিতা পেলে হয়তো বা সুখের মুখ দেখতে পেতেন—এ প্রত্যাশায় বঙ্গবন্ধুর অনুদানপত্রটি সম্পত্তি মনে করে আজও বুকে আগলে আছেন। তাঁর বড় ছেলে স্বপন কুমার গুপ্ত অনুদানপত্রটি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করছেন। অনুদান পাওয়ার আশায় তিনি ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থানে আবেদন জানিয়েছেন। তাঁর আবেদনে সাড়া মিলবে কি? এই প্রশ্নই গোটা পরিবারকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

No comments

Powered by Blogger.