ছাত্ররাজনীতি-দুই সুপ্রিম কোর্টের রায় ও পাঁচ শিক্ষাবিদের বিবৃতি by মিজানুর রহমান খান
পাঁচজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ‘ছাত্রলীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ ছিন্ন করা প্রয়োজন’ বলে মত দিয়েছেন। এর মাধ্যমে আসলে তাঁরা অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের বিলোপেরও সুপারিশ করেছেন।
কবীর চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জামাল নজরুল ইসলাম ও আনিসুজ্জামানের এই আহ্বান সময়োপযোগী, যদিও এই শিক্ষাবিদদের বিবৃতি পড়ে মনে হয় না যে ক্যাম্পাস রাজনীতিবিষয়ক সমস্যা নিয়ে তাঁদের মুখ্য উদ্বেগ ছিল। তবে এখন এমন একটি সময়, যখন প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ও নির্বাহী বিভাগ ক্যাম্পাসে বাইরের কারও হয়ে তৎপরতা চালানোকে নিরুৎসাহিত করছেন। এই দুটি প্রতিবেশী দেশই পোড় খাওয়া। তারা ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ করেছে। আবার চালু করেছে। বিরাট সংস্কার ও শর্ত সাপেক্ষে আবার অনুমতিও দিচ্ছে। আমরাই কেবল ব্যতিক্রম। কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে আমরা নেই। কোনো ধরনের লাগাম টানার মধ্যে আমরা নেই।
ভারতের উত্তর প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষ করে লক্ষ্নৌ বিশ্ববিদ্যালয়, একসময় আমাদের সরকারি খাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো করুণ অবস্থায় পতিত হয়েছিল। ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসীরা অধ্যাপককে পর্যন্ত পিটিয়ে হত্যা করেছে। ওই অধ্যাপক একটি ছাত্র সংসদের নির্বাচন পেছাতে সুপারিশ করেছিলেন। সে অবস্থা উতরাতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাদের সাহায্য করে। আদালতের আদেশে গঠিত হয় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার জেমস মাইকেল লিংদোর নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের কমিটি ছয় দফা সুপারিশ দেয়। এর বহু উপদফা আছে। প্রতিটি সুপারিশ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করেন। কেন্দ্রীয় সরকার তা মেনে নিয়েছে।
আমাদের শিক্ষাবিদেরা কার্যত ভারতের সুপ্রিম কোর্ট-সমর্থিত একটি সুপারিশের প্রতিধ্বনি তুলেছেন। ওই সুপারিশ বলেছে, ‘রাজনৈতিক দল থেকে ছাত্র নির্বাচন ও ছাত্র প্রতিনিধিত্ব বিযুক্ত করতে হবে।’ ওই বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান লিংদো গত বছর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘রাজনৈতিক দল থেকে ছাত্রসংগঠনের বিযুক্তিকরণই ছিল তাঁদের প্রধান আকর্ষণ।’ এটা একটা নীতিগত অবস্থান। শুধু ছাত্রলীগ থেকে শেখ হাসিনা নন, ছাত্রদল থেকে বেগম খালেদা জিয়া নন, অন্য সব দলকেও এটা মানতে হবে। ছাত্ররাজনীতি পরগাছা থেকে সম্ভব নয়। দলগুলো বাধার প্রাচীর দাঁড় করিয়েছে। এ জন্য ছাত্ররাজনীতির অঙ্কুরোদ্গম সম্ভব হচ্ছে না। বহুদিন ছাত্র সংসদের নির্বাচন হচ্ছে না। এটা যাতে ছাত্রদের শর্তে ও সুবিধায় না হয়, সে বিষয়ে দুই বড় দলের বড় নেতাদের স্বার্থ অভিন্ন। তবে মনে হয়, দলের সঙ্গে সংগঠনগুলোর বিযুক্তি ছাড়া নির্বাচন না হওয়াই ভালো। কারণ ওই সংসদ নির্বাচন ছাত্রদের কাজে আসবে না। ছাত্ররাজনীতির গৌরব পুনরুদ্ধারের সুযোগ মিলবে না, বরং ওই নির্বাচন মূল দলগুলোর মানমর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠবে। মাগুরা ও ভোলার উপনির্বাচনের মতো উত্তাপ তৈরি হবে।
ছাত্ররাজনীতি উঠে আসতে হবে ছাত্রদের ভেতর থেকে। সেই রাজনীতির স্বার্থে ছাত্রসংগঠন গড়তে হবে। তখন ওই লিংদো কমিটির সুপারিশ কাজে দেবে। এর কয়েকটি এখানে বলি।
এক. ছাত্র সংসদ কীভাবে চলবে তার বিধিবিধান করে দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নির্বাচনকালে বাইরের কেউই ক্যাম্পাস-তৎপরতায় অংশ নেবে না। দুই. নির্বাচনী প্রচারাভিযান সাকল্যে ১০ দিনে করতে হবে। তিন. প্রতিটি শিক্ষাবর্ষ শুরুর ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে হবে। সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘আদু ভাই’ প্রার্থী ঠেকাতে ওষুধ আছে। স্নাতক পর্যায়ের নিচের প্রার্থীদের বয়স হবে ১৭ থেকে ২২ বছর। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পঁচিশের নিচে ও গবেষণার ছাত্র হলে তাঁর বয়স থাকবে ২৮-এর নিচে। ৭৫ ভাগ ক্লাসে উপস্থিতি লাগবে। চার. অতীত ফৌজদারি রেকর্ড থাকলে নির্বাচন করা যাবে না। পাঁচ. নির্বাচনী ব্যয় হবে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার রুপি। ফল ঘোষণার দুই সপ্তাহের মধ্যে নিরীক্ষিত হিসাব জমা দিতে হবে। ছয়. প্রার্থীরা ছাত্রদের স্বেচ্ছামূলক চাঁদা ছাড়া বাইরের উেস পাওয়া টাকা খরচ করতে পারবেন না। সাত. নির্বাচনী প্রচারণায় লাউডস্পিকার ব্যবহার করা যাবে না। আট. নির্বাচনের পর দেয়াল সাফসুতরো করার দায় সব প্রার্থীকে যৌথভাবে নিতে হবে। নয়. বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি গ্রিভান্সেস রিড্রেসাল সেল বা দুঃখ-দুর্দশা প্রশমন কমিটি গঠন করবে। এটা অনেকটা ট্রাইব্যুনালের মতো কাজ করবে। এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ছাত্র তাঁর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান/বিভাগ প্রধানের কাছে আপিল করতে পারবেন। তবে আইনশৃঙ্খলাজনিত কোনো গুরুতর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনধিক ১২ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশকে জানাবে। দশ. ভারতীয় দণ্ডবিধিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানসংক্রান্ত যেসব ধারা আছে, সেসব ছাত্রদের জন্যও প্রযোজ্য হবে। এগারো. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রনেতৃত্বের পরিবর্তন ও গুণগত মান নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণ ও কর্মশিবিরের আয়োজন করবে।
পাকিস্তানে জিয়াউল হক প্রজ্ঞাপন জারি করে ১৯৮৪ সালে ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা নিষিদ্ধ করেছিলেন। এর বিরুদ্ধে পাকিস্তানে ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দা ছিল। পিপিপি ও মুসলিম লিগের নেতারাও সরব ছিলেন। অন্যতম যুক্তি ছিল, এটা হলো আইয়ুব খানের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। মেঠো বক্তৃতায় এর বড় কদর ছিল। থাকাটাই স্বাভাবিক।
পাকিস্তানে ২০০৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ৬১.২ ভাগ ছাত্র ছাত্ররাজনীতির পক্ষে নয়। ৭২.৩ ভাগ মনে করে, ছাত্রসংগঠনের উচিত নয় রাজনৈতিক দলের লেজুড় হওয়া। ২৮.১ ভাগ অবশ্য মনে করে মূল দলের ছাত্র-অঙ্গসংগঠন থাকা উচিত। ২৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০৯ জন ছাত্রের মতামত নেওয়া হয় ওই জরিপে। রাজনৈতিক দলের লেজুড় হয়ে থাকার বিরুদ্ধে প্রথম রায় কিন্তু পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের। ১৯৯৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক অন্তর্বর্তী আদেশে ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা নিষিদ্ধ করেছিলেন। আবার পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টই পরে বলেছেন, ক্যাম্পাসে সংগঠন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা অসাংবিধানিক। এর আগে ১৯৯২ সালের ১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট একটি নির্দেশনা দেন। সে অনুযায়ী প্রত্যেক অভিভাবক তাঁদের ছেলেমেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় মুচলেকা দিতেন। তাঁরা বলতেন, তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ‘রাজনীতিতে জড়াতে আশকারা’ দেবেন না। ১৮ বছর পর এর একটা পুনরাবৃত্তি দেখলাম। আসিফ জারদারির সরকার এবার ক্ষমতায় এসে ছাত্রসংগঠন করার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দুই বছরও যায়নি। ক্যাম্পাসে ছাত্র খুনের ঘটনায় পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়েছিল। ২০ দিন পর পুনরায় খোলার সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর একটি নির্দেশনা জারি করেন। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে নতুন করে হলফনামা দিতে হবে। এর সারকথা হলো, তাঁরা ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশ নেবেন না (ডন, ১০ এপ্রিল)।
ছাত্ররাজনীতিবিষয়ক পাকিস্তানি গবেষক ইকবাল হায়দার বাট তাঁর ১৭৮ পৃষ্ঠার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘ছাত্রসংগঠনগুলো নিষেধাজ্ঞা প্রতিহত করেছিল। কিন্তু শিক্ষাবিদেরা ব্যাপকভাবে সুপ্রিম কোর্টকে সমর্থন জানান। তাঁরা যুক্তি দেন, ছাত্রদের সাংগঠনিক তৎপরতার পরিণাম ভালো হয় না। ক্যাম্পাসে তা পড়াশোনার পরিবেশে বিঘ্ন ঘটায়। সহিংসতার বিস্তার ঘটায়। আরও একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটল। পাকিস্তানের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা একটি টেলিকনফারেন্স করলেন। তাঁরা এতে ছাত্রসংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। উপাচার্যরা অবশ্য ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের সোসাইটি ও সমিতির বিকাশ সমর্থন করেন। এমনকি কতিপয় বিশিষ্ট সাবেক ছাত্রনেতা জাতীয় রাজনৈতিক দল থেকে ছাত্রসংগঠনের পৃথক্করণে এখন একমত হতে পারছেন।’
পাকিস্তান ও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি অভিন্ন অবস্থানে পৌঁছেছেন। বাংলাদেশের গন্তব্য এর থেকে আলাদা হওয়ার যুক্তি ও কারণ দেখি না। ছাত্ররা অবশ্যই রাজনীতি করবে। কিন্তু তার মতো করে। কোনো জাতীয় রাজনৈতিক দলের হয়ে নয়। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয় নয়। ছাত্রসংগঠন কথিত ‘লেজুড়’ থেকেও প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। সত্য। কিন্তু আমরা কি ওষুধ বদলাতে পারি না?
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী এক দৃষ্টান্ত। তিনি ভারতের ইতিহাসের প্রথম দলিত মুখ্যমন্ত্রী। চতুর্থবারের মতো এ পদে আছেন। জনপ্রিয় বিষয়ে অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে তিনি ভয় পান না। নিউজ উইকের শীর্ষ সাফল্য অর্জনকারী নারীর তালিকায় উঠে এসেছে তাঁর নাম। জন্মদিনে বিপুল টাকার মালায় ভূষিত হয়ে তিনি বিতর্কিত হন। আবার তিনিই অমিতাভ বচ্চনের বিরুদ্ধে ভূমি অনিয়মের দায়ে মামলা চালু করেন। গণতন্ত্র গেল গেল জিগির উপেক্ষা করে তিনি ক্যাম্পাসের ইউনিয়ন নির্বাচন নিষিদ্ধ করেন। ২০০৭ সালে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সূচনায় উল্লিখিত লিংদো কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় উত্তর প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সেই শিক্ষাবর্ষে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে পারেনি। প্রার্থীর আকাল পড়েছিল। কারণ রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট ‘আদু ভাইরা’ নির্বাচনে সব অযোগ্য হন। ২০০৭ সালের অক্টোবরে মায়াবতী এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইউনিয়ন নির্বাচন শুধু যে ক্যাম্পাসের পরিবেশ দূষিত করছে তা নয়, প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষতি করছে। সাধারণ মানুষের জন্য দুঃখ-দুর্দশা ডেকে আনছে।’ মায়াবতী অবশ্য পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ আসার পর ২০০৮ সালের মার্চে ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। উত্তর প্রদেশের ছাত্র-সহিংসতার প্রেক্ষাপটেই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালে লিংদো কমিটি গঠনে কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে অন্তত ১২ জন ছাত্র ক্যাম্পাসে নিহত হয়েছিল। ২০০৩ সালে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছিলেন। আর তারপরই ক্যাম্পাসে ব্যাপক সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লিংদো কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। আদালতের ভূমিকার সমালোচনাও আছে। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অব্যাহতভাবে লিংদো কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন তদারকি করছেন। ২০০৮ সালে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন স্থগিত করেন সুপ্রিম কোর্ট। যেটা দেখার বিষয় এবং আমাদের জন্য শিক্ষণীয়, তা হলো সরকারের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল গোপাল সুব্রামনিয়াম ওই নির্বাচন স্থগিত করার আবেদন করেন। তাঁর যুক্তি: ছাত্ররা লিংদো কমিটির সুপারিশ তামিল না করেই নির্বাচন করছে। আরও একটি ঘটনা বলি। কংগ্রেসের অঙ্গসংগঠন হলো ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া। তারা গেছে আদালতে। নালিশ করেছে লিংদো কমিটি তাদের মতামত নেয়নি। সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ বিস্ময় ও ক্ষোভ ঝরান। বলেন, ‘তোমরা কি পড়তে এসেছো, নাকি রাজনীতি করতে এসেছো? তোমাদের অগ্রাধিকার কী? অধ্যয়ন, না দলীয় বিষয়? তোমাদের বাবা-মা তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ খরচ করে শিক্ষা নিতে পাঠিয়েছেন। রাজনীতির জন্য নয়।’ (দ্য হিন্দু, ২৯ অক্টোবর, ২০০৭)
আমি একজন ব্যারিস্টার বন্ধুকে জানি। তিনি একদিন বললেন, তিনি জনস্বার্থে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রসংগঠনের নামে যা চলছে, তা চলতে পারে না। সরকার বা সংসদ কিছু করবে না। এখন যদি শেষ ভরসা আদালত মুখ তুলে তাকান। আমি তাঁকে রিট করার কিছু মসলাপাতির জোগান দেই। তারপর অনেক দিন নীরবতা। সম্প্রতি তিনি জানালেন, এ কাজে নামতে তাঁকে সবাই মানা করেছেন। ভয় দেখাচ্ছেন। সাবধান করছেন।
গতকাল আমি ওই বিবৃতি নিয়ে তিনজন শিক্ষাবিদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। আমি আসলে বোঝার চেষ্টা করি যে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ভারত ও পাকিস্তানের মতো একটি অবস্থানে যেতে পারেন কি না। সামাজিক সংবেদনশীলতার মাত্রাটা কী। এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ‘যারা এখন অন্যায় করছে তাদের শাস্তিটা সবচেয়ে জরুরি।’ তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, ওই বিবৃতি পড়ে তিনি খুবই খুশি হয়েছেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ক্ষমতাসীন দলের উচিত নয় তাদের ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক বজায় রাখা। তিনি ব্যক্তিগতভাবে তেমন দৃষ্টিকোণ থেকেই বিষয়টিকে দেখছেন।
আমরা খুব স্পষ্ট করে বলি, ক্যাম্পাসে যে মরণব্যাধি বাসা বেঁধেছে, তা থেকে পরিত্রাণ চাইলে ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের পথেই যেতে হবে। আমরা দল থেকে ছাত্ররাজনীতির পৃথক্করণ চাই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
ভারতের উত্তর প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষ করে লক্ষ্নৌ বিশ্ববিদ্যালয়, একসময় আমাদের সরকারি খাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো করুণ অবস্থায় পতিত হয়েছিল। ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসীরা অধ্যাপককে পর্যন্ত পিটিয়ে হত্যা করেছে। ওই অধ্যাপক একটি ছাত্র সংসদের নির্বাচন পেছাতে সুপারিশ করেছিলেন। সে অবস্থা উতরাতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাদের সাহায্য করে। আদালতের আদেশে গঠিত হয় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার জেমস মাইকেল লিংদোর নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের কমিটি ছয় দফা সুপারিশ দেয়। এর বহু উপদফা আছে। প্রতিটি সুপারিশ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করেন। কেন্দ্রীয় সরকার তা মেনে নিয়েছে।
আমাদের শিক্ষাবিদেরা কার্যত ভারতের সুপ্রিম কোর্ট-সমর্থিত একটি সুপারিশের প্রতিধ্বনি তুলেছেন। ওই সুপারিশ বলেছে, ‘রাজনৈতিক দল থেকে ছাত্র নির্বাচন ও ছাত্র প্রতিনিধিত্ব বিযুক্ত করতে হবে।’ ওই বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান লিংদো গত বছর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘রাজনৈতিক দল থেকে ছাত্রসংগঠনের বিযুক্তিকরণই ছিল তাঁদের প্রধান আকর্ষণ।’ এটা একটা নীতিগত অবস্থান। শুধু ছাত্রলীগ থেকে শেখ হাসিনা নন, ছাত্রদল থেকে বেগম খালেদা জিয়া নন, অন্য সব দলকেও এটা মানতে হবে। ছাত্ররাজনীতি পরগাছা থেকে সম্ভব নয়। দলগুলো বাধার প্রাচীর দাঁড় করিয়েছে। এ জন্য ছাত্ররাজনীতির অঙ্কুরোদ্গম সম্ভব হচ্ছে না। বহুদিন ছাত্র সংসদের নির্বাচন হচ্ছে না। এটা যাতে ছাত্রদের শর্তে ও সুবিধায় না হয়, সে বিষয়ে দুই বড় দলের বড় নেতাদের স্বার্থ অভিন্ন। তবে মনে হয়, দলের সঙ্গে সংগঠনগুলোর বিযুক্তি ছাড়া নির্বাচন না হওয়াই ভালো। কারণ ওই সংসদ নির্বাচন ছাত্রদের কাজে আসবে না। ছাত্ররাজনীতির গৌরব পুনরুদ্ধারের সুযোগ মিলবে না, বরং ওই নির্বাচন মূল দলগুলোর মানমর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠবে। মাগুরা ও ভোলার উপনির্বাচনের মতো উত্তাপ তৈরি হবে।
ছাত্ররাজনীতি উঠে আসতে হবে ছাত্রদের ভেতর থেকে। সেই রাজনীতির স্বার্থে ছাত্রসংগঠন গড়তে হবে। তখন ওই লিংদো কমিটির সুপারিশ কাজে দেবে। এর কয়েকটি এখানে বলি।
এক. ছাত্র সংসদ কীভাবে চলবে তার বিধিবিধান করে দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নির্বাচনকালে বাইরের কেউই ক্যাম্পাস-তৎপরতায় অংশ নেবে না। দুই. নির্বাচনী প্রচারাভিযান সাকল্যে ১০ দিনে করতে হবে। তিন. প্রতিটি শিক্ষাবর্ষ শুরুর ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন শেষ করতে হবে। সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘আদু ভাই’ প্রার্থী ঠেকাতে ওষুধ আছে। স্নাতক পর্যায়ের নিচের প্রার্থীদের বয়স হবে ১৭ থেকে ২২ বছর। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পঁচিশের নিচে ও গবেষণার ছাত্র হলে তাঁর বয়স থাকবে ২৮-এর নিচে। ৭৫ ভাগ ক্লাসে উপস্থিতি লাগবে। চার. অতীত ফৌজদারি রেকর্ড থাকলে নির্বাচন করা যাবে না। পাঁচ. নির্বাচনী ব্যয় হবে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার রুপি। ফল ঘোষণার দুই সপ্তাহের মধ্যে নিরীক্ষিত হিসাব জমা দিতে হবে। ছয়. প্রার্থীরা ছাত্রদের স্বেচ্ছামূলক চাঁদা ছাড়া বাইরের উেস পাওয়া টাকা খরচ করতে পারবেন না। সাত. নির্বাচনী প্রচারণায় লাউডস্পিকার ব্যবহার করা যাবে না। আট. নির্বাচনের পর দেয়াল সাফসুতরো করার দায় সব প্রার্থীকে যৌথভাবে নিতে হবে। নয়. বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি গ্রিভান্সেস রিড্রেসাল সেল বা দুঃখ-দুর্দশা প্রশমন কমিটি গঠন করবে। এটা অনেকটা ট্রাইব্যুনালের মতো কাজ করবে। এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ছাত্র তাঁর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান/বিভাগ প্রধানের কাছে আপিল করতে পারবেন। তবে আইনশৃঙ্খলাজনিত কোনো গুরুতর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনধিক ১২ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশকে জানাবে। দশ. ভারতীয় দণ্ডবিধিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানসংক্রান্ত যেসব ধারা আছে, সেসব ছাত্রদের জন্যও প্রযোজ্য হবে। এগারো. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রনেতৃত্বের পরিবর্তন ও গুণগত মান নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণ ও কর্মশিবিরের আয়োজন করবে।
পাকিস্তানে জিয়াউল হক প্রজ্ঞাপন জারি করে ১৯৮৪ সালে ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা নিষিদ্ধ করেছিলেন। এর বিরুদ্ধে পাকিস্তানে ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দা ছিল। পিপিপি ও মুসলিম লিগের নেতারাও সরব ছিলেন। অন্যতম যুক্তি ছিল, এটা হলো আইয়ুব খানের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। মেঠো বক্তৃতায় এর বড় কদর ছিল। থাকাটাই স্বাভাবিক।
পাকিস্তানে ২০০৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ৬১.২ ভাগ ছাত্র ছাত্ররাজনীতির পক্ষে নয়। ৭২.৩ ভাগ মনে করে, ছাত্রসংগঠনের উচিত নয় রাজনৈতিক দলের লেজুড় হওয়া। ২৮.১ ভাগ অবশ্য মনে করে মূল দলের ছাত্র-অঙ্গসংগঠন থাকা উচিত। ২৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০৯ জন ছাত্রের মতামত নেওয়া হয় ওই জরিপে। রাজনৈতিক দলের লেজুড় হয়ে থাকার বিরুদ্ধে প্রথম রায় কিন্তু পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের। ১৯৯৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক অন্তর্বর্তী আদেশে ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা নিষিদ্ধ করেছিলেন। আবার পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টই পরে বলেছেন, ক্যাম্পাসে সংগঠন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা অসাংবিধানিক। এর আগে ১৯৯২ সালের ১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট একটি নির্দেশনা দেন। সে অনুযায়ী প্রত্যেক অভিভাবক তাঁদের ছেলেমেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় মুচলেকা দিতেন। তাঁরা বলতেন, তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ‘রাজনীতিতে জড়াতে আশকারা’ দেবেন না। ১৮ বছর পর এর একটা পুনরাবৃত্তি দেখলাম। আসিফ জারদারির সরকার এবার ক্ষমতায় এসে ছাত্রসংগঠন করার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দুই বছরও যায়নি। ক্যাম্পাসে ছাত্র খুনের ঘটনায় পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়েছিল। ২০ দিন পর পুনরায় খোলার সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর একটি নির্দেশনা জারি করেন। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে নতুন করে হলফনামা দিতে হবে। এর সারকথা হলো, তাঁরা ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশ নেবেন না (ডন, ১০ এপ্রিল)।
ছাত্ররাজনীতিবিষয়ক পাকিস্তানি গবেষক ইকবাল হায়দার বাট তাঁর ১৭৮ পৃষ্ঠার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘ছাত্রসংগঠনগুলো নিষেধাজ্ঞা প্রতিহত করেছিল। কিন্তু শিক্ষাবিদেরা ব্যাপকভাবে সুপ্রিম কোর্টকে সমর্থন জানান। তাঁরা যুক্তি দেন, ছাত্রদের সাংগঠনিক তৎপরতার পরিণাম ভালো হয় না। ক্যাম্পাসে তা পড়াশোনার পরিবেশে বিঘ্ন ঘটায়। সহিংসতার বিস্তার ঘটায়। আরও একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটল। পাকিস্তানের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা একটি টেলিকনফারেন্স করলেন। তাঁরা এতে ছাত্রসংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। উপাচার্যরা অবশ্য ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের সোসাইটি ও সমিতির বিকাশ সমর্থন করেন। এমনকি কতিপয় বিশিষ্ট সাবেক ছাত্রনেতা জাতীয় রাজনৈতিক দল থেকে ছাত্রসংগঠনের পৃথক্করণে এখন একমত হতে পারছেন।’
পাকিস্তান ও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি অভিন্ন অবস্থানে পৌঁছেছেন। বাংলাদেশের গন্তব্য এর থেকে আলাদা হওয়ার যুক্তি ও কারণ দেখি না। ছাত্ররা অবশ্যই রাজনীতি করবে। কিন্তু তার মতো করে। কোনো জাতীয় রাজনৈতিক দলের হয়ে নয়। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয় নয়। ছাত্রসংগঠন কথিত ‘লেজুড়’ থেকেও প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। সত্য। কিন্তু আমরা কি ওষুধ বদলাতে পারি না?
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী এক দৃষ্টান্ত। তিনি ভারতের ইতিহাসের প্রথম দলিত মুখ্যমন্ত্রী। চতুর্থবারের মতো এ পদে আছেন। জনপ্রিয় বিষয়ে অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে তিনি ভয় পান না। নিউজ উইকের শীর্ষ সাফল্য অর্জনকারী নারীর তালিকায় উঠে এসেছে তাঁর নাম। জন্মদিনে বিপুল টাকার মালায় ভূষিত হয়ে তিনি বিতর্কিত হন। আবার তিনিই অমিতাভ বচ্চনের বিরুদ্ধে ভূমি অনিয়মের দায়ে মামলা চালু করেন। গণতন্ত্র গেল গেল জিগির উপেক্ষা করে তিনি ক্যাম্পাসের ইউনিয়ন নির্বাচন নিষিদ্ধ করেন। ২০০৭ সালে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সূচনায় উল্লিখিত লিংদো কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় উত্তর প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সেই শিক্ষাবর্ষে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে পারেনি। প্রার্থীর আকাল পড়েছিল। কারণ রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট ‘আদু ভাইরা’ নির্বাচনে সব অযোগ্য হন। ২০০৭ সালের অক্টোবরে মায়াবতী এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইউনিয়ন নির্বাচন শুধু যে ক্যাম্পাসের পরিবেশ দূষিত করছে তা নয়, প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষতি করছে। সাধারণ মানুষের জন্য দুঃখ-দুর্দশা ডেকে আনছে।’ মায়াবতী অবশ্য পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ আসার পর ২০০৮ সালের মার্চে ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। উত্তর প্রদেশের ছাত্র-সহিংসতার প্রেক্ষাপটেই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালে লিংদো কমিটি গঠনে কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে অন্তত ১২ জন ছাত্র ক্যাম্পাসে নিহত হয়েছিল। ২০০৩ সালে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছিলেন। আর তারপরই ক্যাম্পাসে ব্যাপক সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লিংদো কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। আদালতের ভূমিকার সমালোচনাও আছে। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অব্যাহতভাবে লিংদো কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন তদারকি করছেন। ২০০৮ সালে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন স্থগিত করেন সুপ্রিম কোর্ট। যেটা দেখার বিষয় এবং আমাদের জন্য শিক্ষণীয়, তা হলো সরকারের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল গোপাল সুব্রামনিয়াম ওই নির্বাচন স্থগিত করার আবেদন করেন। তাঁর যুক্তি: ছাত্ররা লিংদো কমিটির সুপারিশ তামিল না করেই নির্বাচন করছে। আরও একটি ঘটনা বলি। কংগ্রেসের অঙ্গসংগঠন হলো ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া। তারা গেছে আদালতে। নালিশ করেছে লিংদো কমিটি তাদের মতামত নেয়নি। সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ বিস্ময় ও ক্ষোভ ঝরান। বলেন, ‘তোমরা কি পড়তে এসেছো, নাকি রাজনীতি করতে এসেছো? তোমাদের অগ্রাধিকার কী? অধ্যয়ন, না দলীয় বিষয়? তোমাদের বাবা-মা তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ খরচ করে শিক্ষা নিতে পাঠিয়েছেন। রাজনীতির জন্য নয়।’ (দ্য হিন্দু, ২৯ অক্টোবর, ২০০৭)
আমি একজন ব্যারিস্টার বন্ধুকে জানি। তিনি একদিন বললেন, তিনি জনস্বার্থে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রসংগঠনের নামে যা চলছে, তা চলতে পারে না। সরকার বা সংসদ কিছু করবে না। এখন যদি শেষ ভরসা আদালত মুখ তুলে তাকান। আমি তাঁকে রিট করার কিছু মসলাপাতির জোগান দেই। তারপর অনেক দিন নীরবতা। সম্প্রতি তিনি জানালেন, এ কাজে নামতে তাঁকে সবাই মানা করেছেন। ভয় দেখাচ্ছেন। সাবধান করছেন।
গতকাল আমি ওই বিবৃতি নিয়ে তিনজন শিক্ষাবিদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। আমি আসলে বোঝার চেষ্টা করি যে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ভারত ও পাকিস্তানের মতো একটি অবস্থানে যেতে পারেন কি না। সামাজিক সংবেদনশীলতার মাত্রাটা কী। এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ‘যারা এখন অন্যায় করছে তাদের শাস্তিটা সবচেয়ে জরুরি।’ তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, ওই বিবৃতি পড়ে তিনি খুবই খুশি হয়েছেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ক্ষমতাসীন দলের উচিত নয় তাদের ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক বজায় রাখা। তিনি ব্যক্তিগতভাবে তেমন দৃষ্টিকোণ থেকেই বিষয়টিকে দেখছেন।
আমরা খুব স্পষ্ট করে বলি, ক্যাম্পাসে যে মরণব্যাধি বাসা বেঁধেছে, তা থেকে পরিত্রাণ চাইলে ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের পথেই যেতে হবে। আমরা দল থেকে ছাত্ররাজনীতির পৃথক্করণ চাই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments