বাংলার মেয়ের এভারেস্ট বিজয়

প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করলেন নিশাত মজুমদার। গতকাল শনিবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে পা ফেলেন তিনি, মেলে ধরেন বাংলাদেশের পতাকা। এ সময় নিশাতের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের এম এ মুহিত, যিনি গত বছরও একবার এভারেস্ট জয় করেছিলেন।


নিশাত ও মুহিত দুজনই বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের (বিএমটিসি) সদস্য। এভারেস্ট অভিযানের জন্য গত ৫ এপ্রিল তাঁরা বাংলাদেশ থেকে রওনা দেন। প্রথম বাংলাদেশি নারী নিশাত মজুমদারের এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণের খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'নিশাত মজুমদারের সাহসিকতায় দেশবাসী গর্বিত।'
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও নিশাতকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। গতকাল এক বার্তায় তিনি বলেন, 'দেশের অন্য নারীরাও তার এ সাফল্য অনুকরণের মাধ্যমে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনুপ্রাণিত হবে।'
বিএমটিসির প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক কালের কণ্ঠকে জানান, নিশাত ও মুহিতের সঙ্গে ছিলেন নেপালের পেমবা দর্জি শেরপা। তিনিই ফোনে তাঁদের এভারেস্ট জয়ের খবর জানান। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁরা এভারেস্ট অভিযান শুরু করেন।
বিবিসি রেডিওর খবরে বলা হয়েছে, দ্রুততম সময়ে এভারেস্ট শীর্ষে আরোহণের জন্য গিনেস রেকর্ডধারী পেমবা দর্জি নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডু থেকে বিবিসিকে নিশাত মজুমদারের এভারেস্ট শিখরে পা রাখার খবর নিশ্চিত করেছেন। পেমবা দর্জি বলেন, 'এভারেস্টের ক্যাম্প টু থেকে আমার ভাই আমাকে নিশাত মজুমদার ও তাঁর সঙ্গে আরেক বাংলাদেশি এম এ মুহিতের এভারেস্ট শীর্ষে আরোহণ করার খবর জানিয়েছে।'
নিশাতের বাবা আবদুল মান্নান মজুমদার বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিএমটিসি ক্লাবের কর্মকর্তারা (শনিবার) সকাল পৌনে ১০টার দিকে নিশাতের এভারেস্ট জয়ের খবর জানান। নিশাতের জন্য আমরা গর্বিত ও আনন্দিত। তারা নেপালের দিক দিয়ে এভারেস্টে উঠেছিল। আমরা এখনো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। বাংলাদেশে ফিরতে তাদের ১৫ দিনের মতো সময় লাগবে।'
নিশাতের ছোট ভাই ইফতেখার মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা খুবই টেনশনে ছিলাম। আপুর এভারেস্ট জয়ের খবর পেয়ে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি।'
বাবা আবদুল মান্নান মজুমদার ও গৃহিণী মা আশুরা মজুমদারের চার সন্তানের মধ্যে নিশাত দ্বিতীয়। তাঁর জন্ম ১৯৮১ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলায়। থাকেন ঢাকার পান্থপথে একটি ভাড়া বাসার। নিশাত মজুমদার ফার্মগেটের বটমলী হোম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। প্রতিটিতেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। বর্তমানে তিনি ঢাকা ওয়াসায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।
২০০৩ সালে এভারেস্ট বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া (৩,১৭২ ফুট) কেওক্রাডংয়ে ওঠেন। ২০০৬ সালের মার্চে বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে বিএমটিসি আয়োজিত বাংলাদেশের নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে আবারও তিনি কেওক্রাডং চূড়ায় ওঠেন। একই বছরের সেপ্টেম্বরে বিএমটিসি আয়োজিত নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে তিনি এভারেস্ট বেস ক্যাম্প (১৭ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতা) ট্র্যাকিংয়ে অংশ নেন।
এরপর নিশাত ২০০৭ সালের মে মাসে বিএমটিসির অর্থায়নে দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে হিমালয়ের মেরা পর্বতশৃঙ্গ (২১ হাজার ৮৩০ ফুট) জয় করেন।
এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে পরের বছরের মে মাসে হিমালয়ের সিংগু চুলি পর্বতশৃঙ্গে (২১ হাজার ৩২৮ ফুট) ওঠেন তিনি। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি ভারতের উত্তর কাশীর গঙ্গোত্রী হিমালয়ের গঙ্গোত্রী-১ পর্বতশৃঙ্গে (২১ হাজার ফুট) বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অভিযানে অংশ নেন। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে পৃথিবীর পঞ্চম উচ্চতম শৃঙ্গ মাকালুতে (২৭ হাজার ৮৬৫ ফুট) ভারত-বাংলাদেশ যৌথ অভিযানে অংশ নেন নিশাত। গত বছরের অক্টোবরে বিএমটিসি আয়োজিত হিমালয়ের চেকিগো শৃঙ্গ অভিযানেও নিশাত সফল হন।
পাহাড় আমাকে ডাকে : এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার আগে নিশাত ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'লাইফস্টাইল' সাময়িকীকে বলেন, হঠাৎ করেই পাহাড়ে চড়ার নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। ২০০৩ সালে প্রথম তিনি বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে কেওক্রাডং অভিযানে অংশ নেন ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে। এটাই ছিল তাঁর বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথম কোনো জায়গায় যাওয়া। তখন তাঁর কাছে বিষয়টা ছিল শুধুই 'বেড়ানো'। এই সফরে তাঁর সহজাত ভঙ্গি দেখে অনেকেই তাঁকে নিয়মিত অ্যাডভেঞ্চারে যোগ দিতে বলেন। এ সময় তিনি ভ্রমণ টিম 'দলছুট'-এর সদস্য হিসেবে কয়েক জায়গায় যান। এরই মধ্যে তিনি জানতে পারেন বিএমটিসির উদ্যোগে বাংলাদেশ থেকে 'এভারেস্ট টিম ওয়ান' গঠিত হয়েছে। এরপর আরো বেশি আগ্রহী হয়ে বিএমটিসি দলে যোগ দেন।
লাইফস্টাইলকে নিশাত বলেন, 'বাংলাদেশে বড় কোনো পাহাড় নেই। তাই বিশ্বের শীর্ষ পর্বতশৃঙ্গগুলোতে উঠতে সমতলের মানুষ হিসেবে আমাদের অনেক বেশি মানসিক শক্তি, একাগ্রতা ও নিবিড় প্রশিক্ষণের দরকার হয়।' দার্জিলিংয়ে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের ট্রেনিংয়ে তিনি এ গ্রেড পান, যা তাঁকে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করে। এরপর তিনি 'সত্যিকারের অভিযানে' বের হন। সেটি ছিল হিমালয়ের মেরা পিক। তিনি জানান, পর্বত আরোহণের মতো সাহসী কাজে পরিবারের কাছ থেকে সব সময়ই সমর্থনই পেয়ে এসেছেন তিনি। এ ধরনের কাজে সামাজিক অনেক বাধা থাকলেও পারিবারিক সমর্থনের জন্য তাঁর কাছে সেটা কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি।
নিশাত বিশ্বের চতুর্থ ঝুঁকিপূর্ণ চূড়া হিমালয়ের মানাসলু অভিযানে সাত হাজার ২০০ মিটার উঁচুতে ওঠার গল্প শোনান সাময়িকীটিকে। ওই অভিযানে তাঁর টিম লিডার ছিলেন এভারেস্টজয়ী মুহিত। তিনি জানান, নানা জটিলতার কারণে তাঁরা একটু দেরিতে চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছান। তখন প্রায় সব টিম নেমে গেছে। আবহাওয়াও ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। গাইডরা ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে তাঁদের নেমে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তাঁরা দুজনের কেউই নেমে যেতে রাজি হলেন না। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়ার কারণে তাঁদের যাত্রা থমকে রইল বেশ কিছুটা সময়। এর ফলে বড় সমস্যা হলো, তাঁদের অক্সিজেন ফুরিয়ে এলো। গাইড জানালেন, যে পরিমাণ অক্সিজেন, তাতে মাত্র একজন যেতে পারবেন। তখন দুজনেই একে অপরকে ওঠার অনুরোধ করেন। নিশাত বলেন, 'আমি তখন দলের কথা ভেবেছি। মুহিত ভাইয়ের এভারেস্টসহ আট হাজার মিটার ওঠার একাধিক অভিজ্ঞতা আছে। তাঁকে অনুরোধ করলাম যেন তিনি যান। কারণ আমি তখন পর্যন্ত যে সাত হাজার ২০০ মিটার উঠেছি, সেটাই আমার সর্বোচ্চ ওঠা। তাই আমি যদি কোনো কারণে সামিট করতে না পারি, তবে সেটা দলের ব্যর্থতা হয়ে যাবে; যদিও আমি শারীরিকভাবে কোনো অসুবিধা অনুভব করিনি।'
এরপর নিশাত নিচে নেমে আসেন। মুহিত ঝুঁকিপূর্ণ পথে রওনা করে সফল হয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান।
এভারেস্ট অভিযানে থাকা বাংলাদেশের আরেক নারী ওয়াসফিয়া নাজরীন তাঁর ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, তিনি ও তাঁর সহযোগী শেরপারা ক্যাম্প থ্রিতে দুর্ঘটনায় পড়েছেন। গত শুক্রবার ভয়াবহ তুষারধসে তাঁদের তাঁবু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। তাঁর সহযোগী দুই শেরপা আহত এবং একজন নিখোঁজ। এ কারণে তাঁর চূড়ার দিকে যাত্র বিলম্বিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের চূড়া জয় করেন মুসা ইব্রাহীম। পরের বছর ২০১১ সালের ২১ মে এম এ মুহিত দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন। তিনিই প্রথমবার তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্টে ওঠেন। নিশাত মজুমদারের সঙ্গে এবার তিনি চূড়া জয় করলেন নেপালের দিক থেকে।
নিশাতের সাহসিকতায় গর্বিত : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিনন্দনবার্তায় বলেছেন, প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে নিশাত বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করায় সমগ্র দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গর্বিত।' তিনি বলেন, 'নারী হিসেবে প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে নিশাত মজুমদার বাঙালির সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর এই সাফল্য আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।'
অনুকরণীয় : খালেদা জিয়া
গতকাল রাতে অভিনন্দন বার্তায় বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, 'একজন নারী হয়ে এভারেস্ট বিজয় করে নিশাত সারা বিশ্বে স্বজাতির মাথা উন্নত করেছে।' তিনি আরো বলেন, 'সারা দেশের মানুষ নিশাত মজুমদারের এই অভূতপূর্ব সাফল্যে উদ্বেলিত। আমিও সে আনন্দে নিজেকে শামিল করছি।' নিশাত মজুমদারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করেছেন খালেদা জিয়া।

No comments

Powered by Blogger.