বৃত্তের ভেতর বৃত্ত -পদ্মা সেতু : গোড়ায় গলদ by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

শুরুতেই গুরুতর কেলেংকারির অভিযোগ। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ৪০ বছর মেয়াদে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে গত এপ্রিলে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংকের। ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই পদ্মা সেতু বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থার নতুন দিগন্ত সূচনা করবে_এই প্রত্যাশা খুবই সংগত। আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী (বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে) এ জন্য বাংলাদেশকে ২৯০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়।


এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি ৪০ কোটি ডলার এবং ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেতুটির নির্মাণকাজ ২০১৪ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু নির্মাণকাজের শুরুতেই এই সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের সত্যাসত্য নির্ণয় করার দায়িত্ব যাদের, তাদের তরফে ইতিমধ্যে প্রতিশ্রুতি মিলেছে, ঘটনা সত্যি হলে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে এসএনসি লাভালিন গ্রুপ নামের এক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য দুর্নীতির তদন্ত করছে কানাডা। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ_দুর্নীতির প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত অভিযোগ ও চলমান তদন্তের কারণে অর্থছাড় করছে না। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বলা দরকার, যেকোনো কাজের শুরুতেই বাধা এলে সংগত কারণেই সংকট বড় হয়ে দেখা দেয়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সে আলামতই স্পষ্ট।
একটি সেতু শুধু দুপারের মধ্যে সুদৃঢ় বন্ধনই গড়ে দেয় না, সমগ্র অঞ্চল কিংবা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গেও যোগাযোগব্যবস্থা মসৃণ করে দেয়। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে জনজীবন ও অর্থনীতিতে। ভৌগোলিক বাস্তবতার বিচারে যেমন বিষয়টি সত্য, তেমনি মানুষের স্বস্তি-সমৃদ্ধির বিষয়টিও এর সঙ্গে যুক্ত। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পূর্বাপর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরো স্পস্ট হয়ে ওঠে। যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু। এখন রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তর বাংলার বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতে সময় ব্যয় হয় মাত্র চার-পাঁচ ঘণ্টা; আগে যেখানে প্রায় একটি দিন পার হয়ে যেত। পণ্য পরিবহনসহ সব ক্ষেত্রেই এসেছে ব্যাপক গতি। পাল্টে গেছে জীবনচিত্র। পদ্মা নদীর ওপর একদিন সেতু নির্মিত হবে, যাতায়াতের সময় অনেক লাঘব হয়ে যাবে_এই স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে, দক্ষিণ বঙ্গবাসী এই স্বপ্নটা লালন করছে খুব আগ্রহভরে। কিন্তু শুরুতেই যে চিত্র পরিস্ফুটিত হলো, তাতে শুধু স্বপ্নজীবী মানুষরাই নন, দেশের গোটা সচেতন মহল আহত। অতীতে বাংলাদেশে প্রকল্প দুর্নীতি কিংবা অন্যান্য খাতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মানুষ প্রত্যাশা করেছিল, বিপুল জনরায়ে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের দায়িত্ববান কেউই আর সেসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি করবেন না। কিংবা যেকোনো মূল্যে সরকার সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার তা করতে সমর্থ হলেও কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। আশা যেন এ দেশে বরাবরই দূরাশায় রূপ নেয়। বর্তমানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে বলা যায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়েছে। যদি তদন্তে বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুত অর্থের ব্যাপারে দুর্নীতি প্রমাণিত হয় তাহলে অন্য দাতা প্রতিষ্ঠানও হয়তো ভিন্ন চিন্তার আশ্রয় নেবে এবং আখেরে ক্ষতিটা হবে আমাদের, অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থ আঘাতপ্রাপ্ত হবে। একই সঙ্গে পুরো প্রকল্পটি হয়ে পড়বে প্রশ্নবিদ্ধ। আগেই বলেছি, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ যোগাযোগ ক্ষেত্রে এই সেতুর গুরুত্ব অপরিসীম। খুবই দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত যে, সব কিছু পাওয়া সত্ত্বেও সেতুটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থমকে গেল। ব্যক্তি বা মহলবিশেষের অসাধুতা দেশ-জাতির জন্য কতটা ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াতে পারে_এর নজির এই বাংলাদেশে বিস্তর আছে। নির্ধারিত সময়, অর্থাৎ ২০১৪ সালের মধ্যেই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হোক_এ চাওয়া সচেতন মহলের। আমাদের স্মরণে আছে, আগেই বলা হয়েছিল, এত বড় একটি প্রকল্পে দুর্নীতির আশঙ্কা রয়েছে। দেশি-বিদেশি অসাধু চক্র এ ব্যাপারে হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। যদিও চূড়ান্ত কথা, তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না, তবুও বিদ্যমান পরিস্থিতি বলতে বাধ্য করে আশঙ্কা অমূলক ছিল না। যদি ঘটনা সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তবে সর্বাগ্রে অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংককে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সততাও প্রশ্নবিদ্ধ হলো। যদিও তিনি স্বচ্ছ বলে জোর দাবি করেছেন; কিন্তু দেশের মানুষ তাঁর এই দাবি তখনই গ্রহণ করবে, যখন বিষয়টি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে। যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা মহল থেকে বিস্তর অভিযোগ আগেই ছিল। সাম্প্রতিক এই ঘটনায় সেসব অভিযোগ আরো গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও উইকিলিকসের তথ্যে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি কিংবা অসততার যথেষ্ট প্রমাণাদি মেলেনি।
যুগটা মিডিয়ার। কোনো কিছুই গোপন করে রাখা এখন মোটেই সহজ নয়। সমগ্র বিশ্বেই মিডিয়া সমাজ পরিবর্তনের বড় মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশে মিডিয়া এখন অনেক বেশি স্বাধীন ও বিস্তৃত। এই স্বাধীনতা ও বিস্তৃতি শুধু সাধারণ মানুষের জন্যই নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের জন্যও শুভপ্রদ। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে অবশ্যই স্বচ্ছভাবে। সন্দেহ নেই, এই সেতুর সফল নির্মাণের ওপর আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করছে। কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন কিছুতেই যেন ধূলিসাৎ না হয়, তা নিশ্চিত করা চাই। দেশের সচেতন মানুষ আশা করে, স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটবে না। বাংলাদেশে স্বপ্ন বড় দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভেঙে যায় মনুষ্যসৃষ্ট কারণে।

লেখক : সাংবাদিক, deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.