হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ-প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজি by মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন
আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজি একটি অনন্য মাধ্যম। বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি একটি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে, মাতৃভাষা বাংলার সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রথম শ্রেণী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত পড়লেও ইংরেজিতে খুব একটা দক্ষ হয়ে উঠতে পারে না। ছাত্রজীবনের ১২টি বছর ইংরেজি শিক্ষার চেষ্টা করলেও কেন বেশির ভাগ ছাত্র ইংরেজিতে দক্ষ হতে পারছে না_ এর কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, একীভূত প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতি বাংলাদেশে চালু না থাকার কারণে দেশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়। যেমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, এবতেদায়ি মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়, মসজিদ-মন্দিরভিত্তিক বিদ্যালয় ইত্যাদি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা সর্বাধিক। সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সব আয়োজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ঘিরে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর সরকারের সংশিল্গষ্ট সংস্থার নজরদারি কম থাকায় যে যার মতো পাঠ্যসূচি নির্ধারণপূর্বক এনসিটিবির বইসহ অন্যান্য বই পড়াচ্ছে। ফলে শিশুদের ওপর বইয়ের চাপ বাড়ছে। দেশ ও জাতির চাহিদা মোতাবেক নাগরিক তৈরির প্রাথমিক ধাপটি সঠিক পথে এগোতে পারছে না। আবার বিদ্যালয়ের ভিন্নতার কারণে মানে ও মননে দেখা দিচ্ছে বিস্তর ফারাক।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঁচটি শ্রেণীকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে প্রথম দুই শ্রেণীতে শোনা ও বলা এবং শেষ তিন শ্রেণীতে লেখা ও পড়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের মতো ইংরেজি শব্দ বা ব্যাকরণ মুখস্থ করে বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখার পদ্ধতি এখন রহিত করা হয়েছে। লেখাপড়া না শিখেও এ দেশ থেকে যারা ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় প্রবাসী হয়েছেন, তারাও খুব ভালো ইংরেজি শিখেছেন। এটি সম্ভব হয়েছে এ জন্য যে, তারা অনেক বেশি সময় ধরে ইংরেজি শুনেছেন এবং বলার চেষ্টা করেছেন। ফলে ইংরেজি শিখতে পেরেছেন। শিশু তার মাতৃভাষা যেভাবে শেখে, তা এ পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তার মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে শুনে শুনে মাতৃভাষা আয়ত্ত করে। সুতরাং সিএলটি মেথডে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা ইংরেজি সহজে শিখতে পারবে_ এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার মান হতাশাব্যঞ্জক। বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, শুধু পঞ্চম শ্রেণীর এক বা দু'জন ছাত্র কোনো রকমে ইংরেজি টেক্সট বই পড়তে পারছে। অতি কষ্টে ইংরেজি টেক্সট বইয়ের বিষয়ভিত্তিক কিছু প্রশ্নের উত্তর করতে পারে। কিন্তু বইয়ের বাইরে ইংরেজি কথোপকথন পারে না বললেই চলে।
শিক্ষার্থীরা একটি ক্লাসে খুব অল্প সময়, মাত্র পঁয়তালি্লশ মিনিট ইংরেজি শুনতে পারছে। দিনের চবি্বশ ঘণ্টার মধ্যে এই অল্প সময় ইংরেজি শুনেই ইংরেজি শিখতে পারবে_ এমন প্রত্যাশা করা যুক্তিসঙ্গত নয়। শিক্ষার্থীরা অধিক সময় ধরে যদি ইংরেজি শোনা, বলা, পড়া ও লেখার সময়-সুযোগ পেত, তাহলে সিএলটি মেথড উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধনে সক্ষম হতো।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়াশোনা করতে হয়। বিদ্যালয়ে আসে তারা গ্রামের কর্দমাক্ত পথ হেঁটে। বেশিরভাগ শিশু একাই বিদ্যালয়ে আসে। মা সঙ্গে করে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসে না। দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে অবস্থান করলেও আর্থিক দীনতার কারণে তাদের মা উপাদেয় রকমারি টিফিন তাদের দিতে পারে না। প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয় হাজারো সীমাবদ্ধতা আর প্রতিকূলতার সঙ্গে। গায়ে পুরনো মলিন শার্ট আর ঘামের গন্ধ নিয়ে শুধু ইংরেজি নয়, অন্যান্য বিষয় আয়ত্ত করাও যে কত কঠিন হতে পারে, তা প্রত্যক্ষ না করলে কল্পনায় নির্ণয় করা যায় না।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সিএলটি মেথডে ইংরেজি শেখার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ শ্রেণীকক্ষ বা শ্রেণীকক্ষের বাইরেও ইংরেজি বলার অভ্যাস করতে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসব করা সম্ভব হচ্ছে না। ইংরেজি ক্লাসের জন্য বরাদ্দ মাত্র পঁয়তালি্লশ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে আবার শিক্ষকরা ইংরেজি পাঠদান করেন বাংলা মাধ্যমে। তারা টেক্সট বইটা পড়ান তবে কথোপকথন করেন বাংলায়। এ পদ্ধতিতে পৃথকভাবে ব্যাকরণ শেখার প্রয়োজন হয় না। শিক্ষক যখন টেক্সট বই পড়াবেন তখনই প্রয়োজনীয় ব্যাকরণ শেখাবেন বলে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের ধারণা, ব্যাকরণ পড়ানোর প্রয়োজন নেই। আবার বিদ্যালয়ের বাইরে খেলাধুলার সময় কিংবা বাড়িতে বেশির ভাগ বাবা-মা ইংরেজি জানেন না বা বলেন না। কাজেই শিশুদের ইংরেজি শোনার সময় খুবই কম হয়। ইংরেজি শব্দের বাংলা মানে জানা ও ব্যাকরণ শিক্ষার বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা থাকার কারণে এসব শিক্ষার্থী ইংরেজি শব্দভাণ্ডার যেমন সমৃদ্ধ করতে পারছে না, অন্যদিকে ইংরেজি ব্যাকরণ শেখার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে পরীক্ষিত সিএলটি মেথড ইংরেজি শিক্ষায় সুফল বয়ে আনতে পারছে না।
অন্যদিকে শহর এলাকার অপেক্ষাকৃত আর্থিকভাবে সচ্ছল ও সচেতন বাবা-মা তাদের সন্তানদের কিন্ডারগার্টেন বা ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। আবার অতিরিক্ত শেখার জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করছেন। এসব শিক্ষার্থী তুলনামূলক ভালো ইংরেজি শিখতে পারছে। একই ধরনের মেধাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সরকারি বা রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো ইংরেজি শিখতে পারছে না। পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তারা ভালো ফল অর্জনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
মফস্বল শহর এমনকি গ্রামাঞ্চলের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার মান ভালো। উদাহরণ হিসেবে বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল ডুমুরিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। বিয়াম ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে উপজেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় উপজেলা ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাই ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। যে কোনো বিষয়ে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে তারা বুঝতে পারে, উত্তরও করতে পারে। পক্ষান্তরে পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এই ব্যবধানের কারণ মেধার পার্থক্য নিশ্চয়ই নয়। এই ব্যবধানের কারণ, ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে ইংরেজি বইয়ের সংখ্যা বেশি। ফলে অধিক সময় তারা ইংরেজি শোনে, বলে ও পড়ে। ফলে সহজেই তারা ইংরেজি ভাষা শিখতে পারছে। সিএলটি মেথড এখানে কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় বর্তমানে দরিদ্র শ্রেণীর অভিভাবকদের সন্তানদের বিদ্যাশিক্ষা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত। যাদের আয়-রোজগার মোটামুটি ভালো তাদের সন্তানরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে না। তারা পড়ে কিন্ডারগার্টেন কিংবা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজের মায়ের ভাষাটাও শুদ্ধ করে বলতে পারে না, ইংরেজি বলা দূরে থাক। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ইংরেজি শিক্ষার এ ব্যবধান ভবিষ্যতে গ্রাম ও শহরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।
গ্রামাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষের সন্তানদের শিক্ষার মান সম্পর্কে না ভাবলে পিছিয়ে পড়া মানুষ আরও পিছিয়ে যাবে। এদের সমাজের সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার উপযোগী করে তুলতে হলে প্রয়োজন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখাতে হলে তাদের ইংরেজি বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে, যাতে তারা অধিক সময় ইংরেজি শোনা ও বলার সুযোগ পায়। শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ইংরেজি শিক্ষার ক্লাসে বাধ্যতামূলক ইংরেজি বলার জন্য শিক্ষকদের নির্দেশনা দিয়ে তা নিশ্চিত করার জন্য সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের বলা যেতে পারে। এমন করা যেতে পারে যে, স্কুলের অর্ধেক সময় ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য বরাদ্দ থাকবে অথবা প্রাথমিক স্তরে এক বা দুই বছর ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া সিএলটি মেথডের পাশাপাশি আগের মতো শব্দ ও ব্যাকরণ শিখে এ ভাষাটি আয়ত্ত করার কৌশলটিও চালু রাখা যায়।
সব শিশুই এ দেশের সম্পদ। সবাই সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকারী। এ জন্য সমান মানের ইংরেজি শিক্ষা দিতে গেলে সব বিদ্যালয়কে একই সিলেবাসের আওতায় আনা প্রয়োজন। মোদ্দা কথা, ইংরেজি শেখাতে হলে সাধারণ ক্লাস ব্যবস্থার পরিবর্তে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। তাহলেই আমাদের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠতে পারবে।
মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ডুমুরিয়া, খুলনা
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঁচটি শ্রেণীকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে প্রথম দুই শ্রেণীতে শোনা ও বলা এবং শেষ তিন শ্রেণীতে লেখা ও পড়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের মতো ইংরেজি শব্দ বা ব্যাকরণ মুখস্থ করে বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখার পদ্ধতি এখন রহিত করা হয়েছে। লেখাপড়া না শিখেও এ দেশ থেকে যারা ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় প্রবাসী হয়েছেন, তারাও খুব ভালো ইংরেজি শিখেছেন। এটি সম্ভব হয়েছে এ জন্য যে, তারা অনেক বেশি সময় ধরে ইংরেজি শুনেছেন এবং বলার চেষ্টা করেছেন। ফলে ইংরেজি শিখতে পেরেছেন। শিশু তার মাতৃভাষা যেভাবে শেখে, তা এ পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তার মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে শুনে শুনে মাতৃভাষা আয়ত্ত করে। সুতরাং সিএলটি মেথডে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা ইংরেজি সহজে শিখতে পারবে_ এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার মান হতাশাব্যঞ্জক। বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, শুধু পঞ্চম শ্রেণীর এক বা দু'জন ছাত্র কোনো রকমে ইংরেজি টেক্সট বই পড়তে পারছে। অতি কষ্টে ইংরেজি টেক্সট বইয়ের বিষয়ভিত্তিক কিছু প্রশ্নের উত্তর করতে পারে। কিন্তু বইয়ের বাইরে ইংরেজি কথোপকথন পারে না বললেই চলে।
শিক্ষার্থীরা একটি ক্লাসে খুব অল্প সময়, মাত্র পঁয়তালি্লশ মিনিট ইংরেজি শুনতে পারছে। দিনের চবি্বশ ঘণ্টার মধ্যে এই অল্প সময় ইংরেজি শুনেই ইংরেজি শিখতে পারবে_ এমন প্রত্যাশা করা যুক্তিসঙ্গত নয়। শিক্ষার্থীরা অধিক সময় ধরে যদি ইংরেজি শোনা, বলা, পড়া ও লেখার সময়-সুযোগ পেত, তাহলে সিএলটি মেথড উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধনে সক্ষম হতো।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়াশোনা করতে হয়। বিদ্যালয়ে আসে তারা গ্রামের কর্দমাক্ত পথ হেঁটে। বেশিরভাগ শিশু একাই বিদ্যালয়ে আসে। মা সঙ্গে করে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসে না। দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে অবস্থান করলেও আর্থিক দীনতার কারণে তাদের মা উপাদেয় রকমারি টিফিন তাদের দিতে পারে না। প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয় হাজারো সীমাবদ্ধতা আর প্রতিকূলতার সঙ্গে। গায়ে পুরনো মলিন শার্ট আর ঘামের গন্ধ নিয়ে শুধু ইংরেজি নয়, অন্যান্য বিষয় আয়ত্ত করাও যে কত কঠিন হতে পারে, তা প্রত্যক্ষ না করলে কল্পনায় নির্ণয় করা যায় না।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সিএলটি মেথডে ইংরেজি শেখার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ শ্রেণীকক্ষ বা শ্রেণীকক্ষের বাইরেও ইংরেজি বলার অভ্যাস করতে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসব করা সম্ভব হচ্ছে না। ইংরেজি ক্লাসের জন্য বরাদ্দ মাত্র পঁয়তালি্লশ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে আবার শিক্ষকরা ইংরেজি পাঠদান করেন বাংলা মাধ্যমে। তারা টেক্সট বইটা পড়ান তবে কথোপকথন করেন বাংলায়। এ পদ্ধতিতে পৃথকভাবে ব্যাকরণ শেখার প্রয়োজন হয় না। শিক্ষক যখন টেক্সট বই পড়াবেন তখনই প্রয়োজনীয় ব্যাকরণ শেখাবেন বলে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের ধারণা, ব্যাকরণ পড়ানোর প্রয়োজন নেই। আবার বিদ্যালয়ের বাইরে খেলাধুলার সময় কিংবা বাড়িতে বেশির ভাগ বাবা-মা ইংরেজি জানেন না বা বলেন না। কাজেই শিশুদের ইংরেজি শোনার সময় খুবই কম হয়। ইংরেজি শব্দের বাংলা মানে জানা ও ব্যাকরণ শিক্ষার বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা থাকার কারণে এসব শিক্ষার্থী ইংরেজি শব্দভাণ্ডার যেমন সমৃদ্ধ করতে পারছে না, অন্যদিকে ইংরেজি ব্যাকরণ শেখার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে পরীক্ষিত সিএলটি মেথড ইংরেজি শিক্ষায় সুফল বয়ে আনতে পারছে না।
অন্যদিকে শহর এলাকার অপেক্ষাকৃত আর্থিকভাবে সচ্ছল ও সচেতন বাবা-মা তাদের সন্তানদের কিন্ডারগার্টেন বা ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। আবার অতিরিক্ত শেখার জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করছেন। এসব শিক্ষার্থী তুলনামূলক ভালো ইংরেজি শিখতে পারছে। একই ধরনের মেধাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সরকারি বা রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো ইংরেজি শিখতে পারছে না। পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তারা ভালো ফল অর্জনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
মফস্বল শহর এমনকি গ্রামাঞ্চলের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার মান ভালো। উদাহরণ হিসেবে বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুল ডুমুরিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। বিয়াম ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে উপজেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় উপজেলা ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাই ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। যে কোনো বিষয়ে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে তারা বুঝতে পারে, উত্তরও করতে পারে। পক্ষান্তরে পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এই ব্যবধানের কারণ মেধার পার্থক্য নিশ্চয়ই নয়। এই ব্যবধানের কারণ, ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে ইংরেজি বইয়ের সংখ্যা বেশি। ফলে অধিক সময় তারা ইংরেজি শোনে, বলে ও পড়ে। ফলে সহজেই তারা ইংরেজি ভাষা শিখতে পারছে। সিএলটি মেথড এখানে কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় বর্তমানে দরিদ্র শ্রেণীর অভিভাবকদের সন্তানদের বিদ্যাশিক্ষা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত। যাদের আয়-রোজগার মোটামুটি ভালো তাদের সন্তানরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে না। তারা পড়ে কিন্ডারগার্টেন কিংবা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজের মায়ের ভাষাটাও শুদ্ধ করে বলতে পারে না, ইংরেজি বলা দূরে থাক। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ইংরেজি শিক্ষার এ ব্যবধান ভবিষ্যতে গ্রাম ও শহরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।
গ্রামাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষের সন্তানদের শিক্ষার মান সম্পর্কে না ভাবলে পিছিয়ে পড়া মানুষ আরও পিছিয়ে যাবে। এদের সমাজের সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার উপযোগী করে তুলতে হলে প্রয়োজন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখাতে হলে তাদের ইংরেজি বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে, যাতে তারা অধিক সময় ইংরেজি শোনা ও বলার সুযোগ পায়। শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ইংরেজি শিক্ষার ক্লাসে বাধ্যতামূলক ইংরেজি বলার জন্য শিক্ষকদের নির্দেশনা দিয়ে তা নিশ্চিত করার জন্য সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের বলা যেতে পারে। এমন করা যেতে পারে যে, স্কুলের অর্ধেক সময় ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য বরাদ্দ থাকবে অথবা প্রাথমিক স্তরে এক বা দুই বছর ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া সিএলটি মেথডের পাশাপাশি আগের মতো শব্দ ও ব্যাকরণ শিখে এ ভাষাটি আয়ত্ত করার কৌশলটিও চালু রাখা যায়।
সব শিশুই এ দেশের সম্পদ। সবাই সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকারী। এ জন্য সমান মানের ইংরেজি শিক্ষা দিতে গেলে সব বিদ্যালয়কে একই সিলেবাসের আওতায় আনা প্রয়োজন। মোদ্দা কথা, ইংরেজি শেখাতে হলে সাধারণ ক্লাস ব্যবস্থার পরিবর্তে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। তাহলেই আমাদের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠতে পারবে।
মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ডুমুরিয়া, খুলনা
No comments