চরাচর-গণ-অভ্যুত্থান দিবস by তামান্না ইসলাম অলি

সাতচল্লিশের দেশভাগ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ছেষট্টির ছয় দফা। সাতষট্টির শিক্ষা আন্দোলন। এরপর ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। সবই একটি করে সিঁড়ি বা স্বাধীনতা অর্জনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তবে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানকে আমরা বলতে পারি একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষণ। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনগুলো দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে।


সে সময় আন্দোলনে মূল দাবি ছিল স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন। ১৯৬৯ সালের এই দিনে আইয়ুব সরকারের পতন হয়। এরপর থেকে এই দিনটিকে পালন করা হয় গণ-অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে। ১৯৬৯ সালের এ পথ ধরেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করতে ঊনসত্তরের জানুয়ারিতে গঠন করা হয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তারা কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান দেয়, 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা।' 'পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা।' 'জাগো জাগো-বাঙালি জাগো।' ফলে বাংলার অহিংস আন্দোলন সহিংসতার দিকে যেতে থাকে। এ সময় রাজনৈতিক দলগুলোর ৬ দফার দাবি পরিণত হয় গণদাবিতে। বাঙালির এ আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করেন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি তাদের ১১ দফা আন্দোলন শুরু করে। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমাবেশ করে। সমাবেশে তারা সিদ্ধান্ত নেয় ১১ দফা দাবিতে ২০ জানুয়ারি পূর্ণ দিবস হরতাল পালন করা হবে। পূর্ব পাকিস্তানের সব স্কুল-কলেজেও এ ধর্মঘট ডাকা হয়। এদিকে গভর্নর মোনায়েম খান ২০ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করেন। ২০ তারিখে ১১ দফা দাবিতে শহরের প্রায় ১০ হাজার ছাত্রের এক বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। মিছিলটি কিছু দূর এগোলেই পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। এক ঘণ্টার সংঘর্ষে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আসাদসহ কিছু ছাত্র আবার মিছিলটিকে একত্র করে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়। তখন এক পুলিশ সদস্য আসাদকে বেয়োনেট দিয়ে আঘাত করে। পরে তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যার ঘটনা আন্দোলনকে আরো বেগবান করে। বের হয় অসংখ্য শোক মিছিল। গোটা ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে শামসুর রাহমান কবিতা লেখেন 'আসাদের শার্ট'। উত্তাল হয় ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষাঙ্গন।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২২, ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি এই তিন দিন শোককাল হিসেবে ঘোষণা করে। প্রতিদিন পালিত হয় হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি। রাজপথে লাখো মানুষের রোষ তীব্র হতে থাকে। কর্মসূচির শেষ দিন ২৪ জানুয়ারি সফল হরতাল পালিত হয়। গোটা দেশ এক হয়ে যায় আয়ুবশাহির বিরুদ্ধে। সেদিন পুলিশ আবারও মিছিলের ওপর গুলি চালায়। শহীদ হন নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমানসহ পাঁচজন। পুরো পরিস্থিতি চলে যায় গভর্নর মোনায়েম খানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তুমুল গণ-আন্দোলনে পদত্যাগে বাধ্য হন আইয়ুব। এই আন্দোলন শুরুর মাত্র কয়েক দিন আগে আইয়ুব খান তাঁর শাসনের এক দশক পূর্তি উদ্যাপন করেন। তিনি এই শাসনকালকে অভিহিত করেন উন্নয়নের এক দশক হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে শোষণ-বঞ্চনা ও নির্যাতনের বছর। ঊনসত্তরে তাঁর পতনের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে যায় অনেক কিছুই। স্পষ্ট হয়ে যায় ব্যবধান। উজ্জ্বল হয় আজকের বাংলাদেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা।

তামান্না ইসলাম অলি

No comments

Powered by Blogger.