নগর পরিকল্পনা-ঢাকার প্রাণকেন্দ্রের সন্ধানে by আদনান মোর্শেদ
ঢাকার জনজীবনের মান খুব নিচু। বাসযোগ্যতার যেকোনো বৈশ্বিক সমীক্ষায় আমাদের রাজধানী প্রায়ই পাচ্ছে সবচেয়ে কম নম্বর। আমাদের প্রতিযোগিতা জিম্বাবুয়ের হারারে অথবা হাইতির রাজধানী পোর্ট অ প্রিন্সের সঙ্গে। বাসা আর কর্মস্থলের বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আসার মতো নগরবাসীর জন্য নেই পর্যাপ্ত খোলা ময়দান, যেখান থেকে আকাশ দেখা যায় নির্বিঘ্নে আর নিশ্বাস নেওয়া যায় নিশ্চিন্তে।
ঘন আবাসন, যানজট, মানুষের স্রোত, শব্দ ও পরিবেশদূষণ, নিরাপত্তার অভাব এবং সেই সঙ্গে বিক্ষিপ্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ঊর্ধ্বমুখী দালান আর বিলাসী মধ্যবিত্তায়ন—ঢাকা যেন নারকীয় আধুনিকতার এক মূর্ত প্রতীক।
ঢাকার প্রলয়ঙ্করী বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা একটি সীমিত মাত্রার নগর প্রকল্প পরিচালনা করছি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির চতুর্থ বর্ষের ১৭ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে। আমার সহশিক্ষক সিরাজউদ্দিন রাজু, হাসিবুল কবির, আর ফেরদৌস হাবিব খান। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আমাদের প্রকল্প ঢাকার সামগ্রিক নগরায়ণের কোনো সমাধান দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে না; বরং চার সপ্তাহ মেয়াদি এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো নগরের একটি প্রাণকেন্দ্র পরিকল্পনা করা, যেখানে সব শ্রেণীর নগরবাসী তাদের পরিবার পরিজন আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসবে সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সন্ধানে। বিশ্বমানের যেকোনো নগরেই থাকে এক বা একাধিক প্রাণকেন্দ্র। লন্ডনের আছে ট্রাফালগার ও লিস্টার স্কয়ার, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার থেকে ত্রকাদেরও আর ল্যুভ মিউজিয়াম এলাকা। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মল, কুয়ালালামপুরে পেট্রোনাস টাওয়ারের পাদদেশে প্রাণবন্ত নগরকেন্দ্র, কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর ময়দান। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র কোথায়? নগরবাসী কোথায় গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে? বাংলাদেশ যদি ভবিষ্যতে কোনো একদিন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে ওঠে, ১৫ লাখ ঢাকাবাসী কোথায় গিয়ে একসঙ্গে বড় স্ক্রিনে খেলা দেখবে? ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বারাক ওবামার অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় প্রায় ১০ লাখ মানুষ জমায়েত হয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল মলে। দেড় কোটি মানুষের ঢাকায় একটি খোলা জনচত্বর না থাকাটাকে পরবর্তী প্রজন্ম দেখবে একটি ঐতিহাসিক ব্যর্থতা হিসেবে। স্বাধীনতা দিবসে আমরা যথারীতি বাংলা একাডেমী, টিএসসি, আর্ট কলেজ এলাকায় জমায়েত হব। একটা জাতীয় দিবস পালনের জন্য যে ধরনের নগর ব্যাপ্তির প্রয়োজন, সেটা ঢাকা ইউনিভার্সিটির এই এলাকার নেই।
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র হওয়ার জন্য অবারিত সম্ভাবনা নিয়ে ৩৫০ একরের একটি বিশাল উদ্যান নগরের ভৌগোলিক কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে অপর্যাপ্ত ব্যবহারের প্রশ্নবোধক অস্তিত্ব নিয়ে (রমনা আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মিলিত আয়তন ১৫০ একর)। নগরীর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম এখানে এসে আলিঙ্গন করছে একে অপরকে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আমাদের এই ‘ব্রেইন টিচিং’ প্রকল্পের জন্য আমরা তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দরকে নগরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নির্ধারণ করেছি। আমরা আশা করছি যে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন আর বাংলাদেশের বিমান বাহিনী নগরজীবনের বৃহত্তর স্বার্থে এই প্রকল্পের সম্ভাবনা যাচাই করবে।
আমাদের প্রকল্পে থাকবে বিভিন্ন মাপের জনচত্বর, নানা ধরনের জাদুঘর, চিত্রকর্ম প্রদর্শন গ্যালারি, নাটক পাড়া, পায়ে হাঁটার ও বাইসাইকেল চালানোর পথ, খোলা ময়দান, জলাধার আর তার তীর ধরে বসার ঘাট, নৌকা চালানোর ব্যবস্থা, ঐতিহ্যবাহী খাবারের রেস্তোরাঁ, ঐতিহ্য পল্লী, কৃষি বাজার এবং প্রদর্শনীমূলক কৃষিকাজ। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট। যেমন, পর্যটন ইনস্টিটিউট, খাদ্যদ্রব্য ও রান্নাবিষয়ক ইনস্টিটিউট, পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ক, কর্মজীবী নিবাস, সম্মেলন কেন্দ্র ইত্যাদি এখানে অনায়াসে তৈরি করা যেতে পারে।
প্রকল্পের প্রারম্ভিক গবেষণা হিসেবে আমরা তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দরের চারদিকের এলাকার বিবিধ ভূমিবিন্যাস, ব্যবহার আর সড়কব্যবস্থা বিশ্লেষণ করছি। এলাকার মাপ ১০ হাজার বাই এক হাজার ৫০০ ফুট, অর্থাৎ দুই মাইল বাই শূন্য দশমিক ২৮ মাইল। গুগল আর্থ আর মাঠপর্যায়ের গবেষণা কাজে লাগিয়ে দেখেছি, বিমানবন্দরের উত্তরে কাজিপাড়া আর কাফরুলের ঘনবসতি। পশ্চিমে মাঝামাঝি, রোকেয়া সরণি বরাবর আগারগাঁওয়ের কম ঘনত্বের অফিস ভবনগুলো এবং সরকারি কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা। দক্ষিণ-পশ্চিমে সংসদ ভবন, দক্ষিণ সীমানায় পূর্ব-পশ্চিমমুখী বিজয় সরণি, পূর্ব সীমানায় উত্তর-দক্ষিণমুখী বিমানবন্দর সড়কের পাশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং পুরোনো বিমানবন্দরের টার্মিনাল। উত্তর-পূর্বে ঢাকা সেনানিবাস। একমাত্র সেনানিবাসের দিক ছাড়া সব দিক থেকে ভালো সড়ক সংযোগ থাকায় এই এলাকায় অবাধে প্রবেশ করা যাবে।
লুই কানের অনন্য স্থাপত্যকর্মের পাশে হওয়ায় জনচত্বর হিসেবে এই এলাকার নির্বাচন যেন অতি স্বাভাবিক। দক্ষিণ-পশ্চিমে সংসদ ভবন আর পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংযোগ ঘটিয়ে একটি খোলা জনচত্বর পুরোনো বিমানবন্দর এলাকার দক্ষিণ অংশের প্রতীক হতে পারে। একটি ভাষণমঞ্চ তৈরি হবে এখানে, সে মঞ্চে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে জনমতের প্রকাশ ঘটবে। প্রধানমন্ত্রী তা দেখতে পাবেন তাঁর অফিস থেকে, নিজের চোখে। আমরা গণতন্ত্রায়ণের কথা বলি, কিন্তু এর সঙ্গে নগরায়ণের যে নিবিড় সম্পর্ক, সেটা নিয়ে আমরা নীরব।
এখানে থাকতে পারে বিভিন্ন ধরনের মিউজিয়াম। যেমন, এভিয়েশন মিউজিয়াম, নৌকার মিউজিয়াম, বাংলার ইতিহাস মিউজিয়াম, আধুনিক শিল্পকলা মিউজিয়াম, কৃষি মিউজিয়াম, রাজনৈতিক পোস্টারের মিউজিয়াম, ভাষা আন্দোলনের মিউজিয়াম, উপজাতি মিউজিয়াম, প্রাকৃতিক সম্পদ মিউজিয়াম ইত্যাদি। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ থিয়েটার ডিস্ট্রিক্ট এখানে সারা বছর নগরবাসীকে আকৃষ্ট করবে। কল্পনা করুন নবীন শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্মের পসরা বসিয়েছে এখানকার জনচত্বরে। এতে করে শিল্পচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটবে। ছুটির দিনে ফ্রি মার্কেটে অ্যান্টিক ব্যবসায়ীরা তাঁদের সামগ্রী সাজিয়েছেন আর উৎসুক ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। এখানে থাকতে পারে একটা স্থায়ী বই বিক্রির মেলা, অর্থাৎ একুশের বইমেলার একটা বার্ষিক সংস্করণ। কৃষি মার্কেটে কৃষকেরা তাঁদের কৃষিজ উৎপাদন দিয়ে নগরবাসীকে টাটকা সবজি কেনার সুযোগ দিচ্ছেন। নোংরা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ নয়, কৃষকদের জন্য থাকবে রুচিসম্মত স্টল। আর পুরো এলাকার প্রতীক হবে এই দৃশ্য: স্বাস্থ্যসচেতন নগরবাসী এখানে জগিং করছে আর বাইকিং করছে সুনির্দিষ্ট ট্রেইল ধরে। পুরো এলাকায় থাকবে বাইসাইকেল ভাড়া করার স্টেশন। ঐতিহ্যবাহী খাবারের রেস্তোরাঁ থাকবে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। এগুলো খোলা থাকবে ২৪ ঘণ্টা। অগভীর জলাধারগুলোতে শিশুরা জলকেলিতে মগ্ন। জনসমাগম এখানে লেগেই থাকবে। জনগণের জমিকে জনগণের দখলে আনার সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হলো এখানে সার্বক্ষণিক জনসমাগম ঘটানো।
আমাদের দেশে নগরায়ণ আলোচনা ইদানীং প্রায়ই অবকাঠামো উন্নয়ন, সড়কব্যবস্থা, আবাসন, আর ভূমি ব্যবহারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু আজকে সারা পৃথিবীতে টেকসই নগরায়ণের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তাতে মূল লক্ষ্য ধরা হচ্ছে নগরের বাসযোগ্যতার মান বাড়ানো। তার মানে হলো, শুধু ভালো রাস্তাঘাট আর ভালো আবাসনব্যবস্থা থাকলেই একটা শহরকে ভালো বলা যাবে না। একটা বিশ্বমানের নগর তার অধিবাসীদের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে মানসিক পরিচর্যার পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়। মার্কিন নগরবিশেষজ্ঞ রিচার্ড ফ্লোরিডা গবেষণায় দেখিয়েছেন, ভবিষ্যতে সফল নগর বলা যাবে ওগুলোকে, যেগুলো বিভিন্ন পেশার সৃষ্টিশীল মানুষের আকর্ষণ করতে সমর্থ হবে। সৃষ্টিশীল মানুষের আগমন যত ঘটবে, তত অর্থনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। সৃষ্টিশীল মানুষেরা আসবেন যখন শহরের জীবনযাত্রার মান হবে উঁচু। ফ্লোরিডার দ্য রাইস অব দ্য ক্রিয়েটিভ ক্লাস নামে বইটি এখন নগরবিদ আর অর্থনীতিবিদদের অবশ্য-পাঠ্য।
সৃষ্টিশীল, টেকসই নগরায়ণের লক্ষ্যে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শুধু বলিষ্ঠ ভূমিকাই পালন করবে না, এটা নগরবাসীকে তাদের নগরের প্রতি সংবেদনশীল হতেও উদ্বুদ্ধ করবে। একটি বহুমাত্রিক জনচত্বর নগরের জীবনযাত্রাকে করবে সমৃদ্ধ। ‘ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় দারুণ মর্ম ব্যথা’ কিছুটা হলেও লাঘব হবে পুরোনো বিমানবন্দরে আমাদের প্রস্তাবিত জনচত্বরের সবুজ আর জলের মিলন ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক চর্চায় আর মৌলিক নাগরিক অধিকার আদায়ের ছোট ছোট আনন্দে।
আদনান মোর্শেদ: স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সহযোগী অধ্যাপক। ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকা, ওয়াশিংটন ডিসি, বর্তমানে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর।
ঢাকার প্রলয়ঙ্করী বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা একটি সীমিত মাত্রার নগর প্রকল্প পরিচালনা করছি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির চতুর্থ বর্ষের ১৭ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে। আমার সহশিক্ষক সিরাজউদ্দিন রাজু, হাসিবুল কবির, আর ফেরদৌস হাবিব খান। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আমাদের প্রকল্প ঢাকার সামগ্রিক নগরায়ণের কোনো সমাধান দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে না; বরং চার সপ্তাহ মেয়াদি এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো নগরের একটি প্রাণকেন্দ্র পরিকল্পনা করা, যেখানে সব শ্রেণীর নগরবাসী তাদের পরিবার পরিজন আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসবে সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সন্ধানে। বিশ্বমানের যেকোনো নগরেই থাকে এক বা একাধিক প্রাণকেন্দ্র। লন্ডনের আছে ট্রাফালগার ও লিস্টার স্কয়ার, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার থেকে ত্রকাদেরও আর ল্যুভ মিউজিয়াম এলাকা। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মল, কুয়ালালামপুরে পেট্রোনাস টাওয়ারের পাদদেশে প্রাণবন্ত নগরকেন্দ্র, কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর ময়দান। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র কোথায়? নগরবাসী কোথায় গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে? বাংলাদেশ যদি ভবিষ্যতে কোনো একদিন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে ওঠে, ১৫ লাখ ঢাকাবাসী কোথায় গিয়ে একসঙ্গে বড় স্ক্রিনে খেলা দেখবে? ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বারাক ওবামার অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় প্রায় ১০ লাখ মানুষ জমায়েত হয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল মলে। দেড় কোটি মানুষের ঢাকায় একটি খোলা জনচত্বর না থাকাটাকে পরবর্তী প্রজন্ম দেখবে একটি ঐতিহাসিক ব্যর্থতা হিসেবে। স্বাধীনতা দিবসে আমরা যথারীতি বাংলা একাডেমী, টিএসসি, আর্ট কলেজ এলাকায় জমায়েত হব। একটা জাতীয় দিবস পালনের জন্য যে ধরনের নগর ব্যাপ্তির প্রয়োজন, সেটা ঢাকা ইউনিভার্সিটির এই এলাকার নেই।
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র হওয়ার জন্য অবারিত সম্ভাবনা নিয়ে ৩৫০ একরের একটি বিশাল উদ্যান নগরের ভৌগোলিক কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে অপর্যাপ্ত ব্যবহারের প্রশ্নবোধক অস্তিত্ব নিয়ে (রমনা আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মিলিত আয়তন ১৫০ একর)। নগরীর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম এখানে এসে আলিঙ্গন করছে একে অপরকে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আমাদের এই ‘ব্রেইন টিচিং’ প্রকল্পের জন্য আমরা তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দরকে নগরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নির্ধারণ করেছি। আমরা আশা করছি যে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন আর বাংলাদেশের বিমান বাহিনী নগরজীবনের বৃহত্তর স্বার্থে এই প্রকল্পের সম্ভাবনা যাচাই করবে।
আমাদের প্রকল্পে থাকবে বিভিন্ন মাপের জনচত্বর, নানা ধরনের জাদুঘর, চিত্রকর্ম প্রদর্শন গ্যালারি, নাটক পাড়া, পায়ে হাঁটার ও বাইসাইকেল চালানোর পথ, খোলা ময়দান, জলাধার আর তার তীর ধরে বসার ঘাট, নৌকা চালানোর ব্যবস্থা, ঐতিহ্যবাহী খাবারের রেস্তোরাঁ, ঐতিহ্য পল্লী, কৃষি বাজার এবং প্রদর্শনীমূলক কৃষিকাজ। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট। যেমন, পর্যটন ইনস্টিটিউট, খাদ্যদ্রব্য ও রান্নাবিষয়ক ইনস্টিটিউট, পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ক, কর্মজীবী নিবাস, সম্মেলন কেন্দ্র ইত্যাদি এখানে অনায়াসে তৈরি করা যেতে পারে।
প্রকল্পের প্রারম্ভিক গবেষণা হিসেবে আমরা তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দরের চারদিকের এলাকার বিবিধ ভূমিবিন্যাস, ব্যবহার আর সড়কব্যবস্থা বিশ্লেষণ করছি। এলাকার মাপ ১০ হাজার বাই এক হাজার ৫০০ ফুট, অর্থাৎ দুই মাইল বাই শূন্য দশমিক ২৮ মাইল। গুগল আর্থ আর মাঠপর্যায়ের গবেষণা কাজে লাগিয়ে দেখেছি, বিমানবন্দরের উত্তরে কাজিপাড়া আর কাফরুলের ঘনবসতি। পশ্চিমে মাঝামাঝি, রোকেয়া সরণি বরাবর আগারগাঁওয়ের কম ঘনত্বের অফিস ভবনগুলো এবং সরকারি কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা। দক্ষিণ-পশ্চিমে সংসদ ভবন, দক্ষিণ সীমানায় পূর্ব-পশ্চিমমুখী বিজয় সরণি, পূর্ব সীমানায় উত্তর-দক্ষিণমুখী বিমানবন্দর সড়কের পাশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং পুরোনো বিমানবন্দরের টার্মিনাল। উত্তর-পূর্বে ঢাকা সেনানিবাস। একমাত্র সেনানিবাসের দিক ছাড়া সব দিক থেকে ভালো সড়ক সংযোগ থাকায় এই এলাকায় অবাধে প্রবেশ করা যাবে।
লুই কানের অনন্য স্থাপত্যকর্মের পাশে হওয়ায় জনচত্বর হিসেবে এই এলাকার নির্বাচন যেন অতি স্বাভাবিক। দক্ষিণ-পশ্চিমে সংসদ ভবন আর পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংযোগ ঘটিয়ে একটি খোলা জনচত্বর পুরোনো বিমানবন্দর এলাকার দক্ষিণ অংশের প্রতীক হতে পারে। একটি ভাষণমঞ্চ তৈরি হবে এখানে, সে মঞ্চে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে জনমতের প্রকাশ ঘটবে। প্রধানমন্ত্রী তা দেখতে পাবেন তাঁর অফিস থেকে, নিজের চোখে। আমরা গণতন্ত্রায়ণের কথা বলি, কিন্তু এর সঙ্গে নগরায়ণের যে নিবিড় সম্পর্ক, সেটা নিয়ে আমরা নীরব।
এখানে থাকতে পারে বিভিন্ন ধরনের মিউজিয়াম। যেমন, এভিয়েশন মিউজিয়াম, নৌকার মিউজিয়াম, বাংলার ইতিহাস মিউজিয়াম, আধুনিক শিল্পকলা মিউজিয়াম, কৃষি মিউজিয়াম, রাজনৈতিক পোস্টারের মিউজিয়াম, ভাষা আন্দোলনের মিউজিয়াম, উপজাতি মিউজিয়াম, প্রাকৃতিক সম্পদ মিউজিয়াম ইত্যাদি। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ থিয়েটার ডিস্ট্রিক্ট এখানে সারা বছর নগরবাসীকে আকৃষ্ট করবে। কল্পনা করুন নবীন শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্মের পসরা বসিয়েছে এখানকার জনচত্বরে। এতে করে শিল্পচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটবে। ছুটির দিনে ফ্রি মার্কেটে অ্যান্টিক ব্যবসায়ীরা তাঁদের সামগ্রী সাজিয়েছেন আর উৎসুক ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। এখানে থাকতে পারে একটা স্থায়ী বই বিক্রির মেলা, অর্থাৎ একুশের বইমেলার একটা বার্ষিক সংস্করণ। কৃষি মার্কেটে কৃষকেরা তাঁদের কৃষিজ উৎপাদন দিয়ে নগরবাসীকে টাটকা সবজি কেনার সুযোগ দিচ্ছেন। নোংরা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ নয়, কৃষকদের জন্য থাকবে রুচিসম্মত স্টল। আর পুরো এলাকার প্রতীক হবে এই দৃশ্য: স্বাস্থ্যসচেতন নগরবাসী এখানে জগিং করছে আর বাইকিং করছে সুনির্দিষ্ট ট্রেইল ধরে। পুরো এলাকায় থাকবে বাইসাইকেল ভাড়া করার স্টেশন। ঐতিহ্যবাহী খাবারের রেস্তোরাঁ থাকবে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। এগুলো খোলা থাকবে ২৪ ঘণ্টা। অগভীর জলাধারগুলোতে শিশুরা জলকেলিতে মগ্ন। জনসমাগম এখানে লেগেই থাকবে। জনগণের জমিকে জনগণের দখলে আনার সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হলো এখানে সার্বক্ষণিক জনসমাগম ঘটানো।
আমাদের দেশে নগরায়ণ আলোচনা ইদানীং প্রায়ই অবকাঠামো উন্নয়ন, সড়কব্যবস্থা, আবাসন, আর ভূমি ব্যবহারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু আজকে সারা পৃথিবীতে টেকসই নগরায়ণের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তাতে মূল লক্ষ্য ধরা হচ্ছে নগরের বাসযোগ্যতার মান বাড়ানো। তার মানে হলো, শুধু ভালো রাস্তাঘাট আর ভালো আবাসনব্যবস্থা থাকলেই একটা শহরকে ভালো বলা যাবে না। একটা বিশ্বমানের নগর তার অধিবাসীদের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে মানসিক পরিচর্যার পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়। মার্কিন নগরবিশেষজ্ঞ রিচার্ড ফ্লোরিডা গবেষণায় দেখিয়েছেন, ভবিষ্যতে সফল নগর বলা যাবে ওগুলোকে, যেগুলো বিভিন্ন পেশার সৃষ্টিশীল মানুষের আকর্ষণ করতে সমর্থ হবে। সৃষ্টিশীল মানুষের আগমন যত ঘটবে, তত অর্থনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। সৃষ্টিশীল মানুষেরা আসবেন যখন শহরের জীবনযাত্রার মান হবে উঁচু। ফ্লোরিডার দ্য রাইস অব দ্য ক্রিয়েটিভ ক্লাস নামে বইটি এখন নগরবিদ আর অর্থনীতিবিদদের অবশ্য-পাঠ্য।
সৃষ্টিশীল, টেকসই নগরায়ণের লক্ষ্যে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শুধু বলিষ্ঠ ভূমিকাই পালন করবে না, এটা নগরবাসীকে তাদের নগরের প্রতি সংবেদনশীল হতেও উদ্বুদ্ধ করবে। একটি বহুমাত্রিক জনচত্বর নগরের জীবনযাত্রাকে করবে সমৃদ্ধ। ‘ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় দারুণ মর্ম ব্যথা’ কিছুটা হলেও লাঘব হবে পুরোনো বিমানবন্দরে আমাদের প্রস্তাবিত জনচত্বরের সবুজ আর জলের মিলন ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক চর্চায় আর মৌলিক নাগরিক অধিকার আদায়ের ছোট ছোট আনন্দে।
আদনান মোর্শেদ: স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সহযোগী অধ্যাপক। ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আমেরিকা, ওয়াশিংটন ডিসি, বর্তমানে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর।
No comments